#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,১০,১১
#ফারজানা_আক্তার
১০
আমার সুখের সংসারে এভাবে ঝ’ড় উঠবে কখনোই ভাবিনি আমি খালা। জানেন আয়ানের জন্য মনটা বড্ড বেশি চটপট করে। মানুষটারও তো দোষ নেই, ভাগ্য তো আমারই খারাপ। আমি যদি ওকে একটা সন্তান দিতে পারতাম তবে তো আমার সংসারে তৃতীয় ব্যাক্তির প্রবেশ কখনোই হতোনা। নয় বছরেও যে আমি মানুষটাকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারিনি। তা-না হলে কি আর দ্বিতীয় বিয়ে করতো সে?”
কান্নাজড়িতো কন্ঠে কথাগুলো বলছিলাম শাহানা খালাকে তখনই সেখানে প্রবেশ ঘটে নয়নার। চোখে অশ্রু জমে আছে মেয়েটার। নাকটা লাল হয়ে আছে। আমার কথাগুলো বোধহয় শুনে ফেলেছে। আহারে মেয়েটা মনে হয় আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে। নয়না এসে আলতো করে আমার হাত দুটি ধরে বলে “বিশ্বাস করো আপু আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি। আমার হাতে কিছুই ছিলোনা। জানেন আপু আমি বিয়ের দিন পালিয়েও গিয়েছিলাম, আমার ভাই সেখান থেকেই ধরে এনে আমাকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করে। আমার ভাইয়ের মতে আমার জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র পাওয়া যাবেনা, আমি নাকি সতীনের সংসার-ই ডিজার্ভ করি। কোনো অবিবাহিত ছেলে নাকি আমায় বিয়ে করলে তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে তারা বলেছিলো। আর আমার পরিবারকে জানানো হয়নি যে সন্তানের জন্য এই বিয়ে, যদি জানতাম তবে মরে গেলেও তোমার সংসারে অশান্তি করার জন্য আসতাম না। আমিও তো নারী, বুঝি আমিও সব কষ্ট তোমার। কিন্তু আমি যে নিরুপায় ”
কথাগুলো বলে নয়না নিজের রুমে চলে যায়। খুব কষ্ট করে মেয়েটা এতোটুকু কথা বলেছে। কান্নার জন্য তো শব্দ-ই বের হচ্ছিলো না ওর মুখ থেকে। কথাগুলো বলার সময় ওর ঠোঁট জোড়া খুব কাঁপছিলো। ওর কথাগুলো খুব ইমোশনাল ছিলো কিন্তু। ওইদিনও কি যেনো দূর্বলতার কথা বলেছিলে। কি লুকিয়ে আছে এই মেয়েটার মাঝে জানতে হবে আমাকে। ওর বাড়ি থেকেই বা কেউ কেনো আসেনা ওকে দেখতে। কৌশলে জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে সব। সকালে আমাকে আর আয়ানকে একসাথে দেখে মেয়েটার মুখে হাসি না থাকলেও বিষাদ ছিলোনা। শুধু দেখেছি ওর চোখে অপূর্ণতার হাঁহাঁকার।
*
দুপুরে খাবার খেতে এসে আমার শ্বাশুড়ি শুরু করে দিলেন আরেক ঝামেলা। শাহানা খালাকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে উনার। আমিও বলে দিয়েছি “শাহানা খালা কোথাও যাবেননা। উনি আগে যেমন ছিলেন এখনো তেমনই থাকবেন।”
আমার রগচটা জবাবে আর ত্যাজ দেখে আর কিছুই বলেনি, বলেনি বললে ভুল হবে বরং আমিই বলার সুযোগ দেয়নি। আবারো পুলিশের ভয় দেখিয়ে দমিয়েছি কিছুক্ষণের জন্য। আমারো খারাপ লাগে এদের সাথে এমন আচরণ করতে কিন্তু কিছুই করার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়কারী সুযোগ পেয়ে যায়। অনেক সুযোগ দিয়েছি এবার আর একটা সুযোগও দেওয়া হবেনা।
মাহি সকালেই স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে চলে দিয়েছে, মাহি যাওয়ার সময় কান্না ধরে রাখতে পারিনি আমি। আমার জন্যই মাহি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাহির শ্বশুড় বাড়ি একটু দূরে আর ওর স্বামীর জব এখানে তাই বরের সুবিধার জন্য এই বাসায় থাকে সবসময়ই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই বাহিরে বের হলাম। কিছু কাজ ছিলো। আমার শ্বাশুড়ি কৈফিয়ত চাইলেও দিলাম নাহ। কারণ আমি কোথায় যাচ্ছি তা কাউকেই বলা যাবেনা। হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়েছি। বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ হাটার পরই মেইন রাস্তায় উঠে পরেছি তারপর একটা বাসে উঠে পরলাম। শহরে যেতে হবে, তাই সিএনজি নিলাম নাহ কারণ এতোদূর সিএনজি যেতে চাইনা তেমন।বাসে উঠার তেমন অভ্যাস নেই বিধায় কিছুদূর যেতেই বমি বমি ভাব লাগে। তবুও শ্বাস আঁটকে কষ্ট করে গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম।
দাঁড়িয়ে আছি আদালতের সামনে। কখনো আসা হয়নি এমন জায়গায় তাই একটু অস্বস্তি অনুভব করছি। চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখছিলাম এতক্ষণ। তারপর একটা লোককে বললাম একটা ভালো উকিলের সন্ধান দিতে। আমার কথামতো লোকটা একটা ভালো উকিলের সন্ধানও দিলো। তারপর উকিলের কাছে গিয়ে ভালোভাবে সব কাজ সেরে বেরিয়ে আসলাম সেখান থেকে। সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে, দ্রুত বাসায় যেতে হবে। অনেকটা পথ জার্নি করতে হবে। আমাদের বাসা থেকে শহর বেশকিছু দূরে। উকিলবাবু বলেছেন আর আসতে হবেনা এখন শুধু ফোনে কথা বললেই হয়ে যাবে আর যদি আসা লাগে তবে তিনি বলবেন। এর জন্য অনেক টাকাও খরচ হবে বললেন, আমি বলেছি আগামীকাল বিকাশ করে দিবো এই বলেই বিদায় নিয়ে ছিলাম উনার থেকে। আয়ান বিয়ের সময় যে কাবিনের টাকা দিয়েছিলো সব টাকা ব্যাংকে জমা রাখা আছে। আগামীকাল ব্যাংকে গিয়ে ওখানে থেকে টাকা তুলে দিয়ে দিবো নাহয়।
বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাড়িতে এসে পা রাখতেই আমার শ্বাশুড়ি হাজার জেরা শুরু করে দিলেন। এতো জার্নির পর এসব আর ভালো লাগছেনা তবুও মুচকি হেঁসে উনাকে বললাম “চিন্তা করিয়েননা মা, আমি খারাপ কিছু করতে যায়নি বাহিরে। আমি যা করতে গিয়েছি তাতে আপনাদেরই ভালো হবে।”
এইটুকু কথা বলেই ছাঁদের দিকে পা বাড়ালাম। চিলেকোঠায় গিয়ে কিছুক্ষণ মাইন্ড ফ্রেশ করতে হবে। আয়ানের অভ্যাস চলে গেছে এই চিলেকোঠা থেকে তবে আমার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবছি “এই পরিবার ছেড়ে থাকা কি সম্ভব হবে আমার পক্ষে? নাহ কখনোই না। যতই অবহেলা করুক সবাই আমায় তবুও আমি ছাড়তে পারবোনা, খুব যে ভালোবাসি পরিবারটাকে।”
*
শাহানা খালা রাতের খাবার তৈরি করে দিয়েই চলে গেছেন বাসায়। রিদিমা বাসায় একা থাকে তাই খালা না খেয়েই চলে যান মেয়ের সাথে খাবে বলে। খালা যেহেতু চলে গেছে তাই আমাকেই সবার জন্য খাবার বারতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ালাম।
খাওয়া শেষে শুতে গেলাম। তখনই দরজায় কটকট শব্দ হতে লাগলো। আমি বিরক্তিকর কণ্ঠে একটু গলা উঁচিয়ে বললাম ” কে এসেছে এই অসময়ে আবার। খোলা আছে দরজা।”
আমি মুখ থেকে কথাটি বের করার সাথে সাথেই আয়ান হনহন করে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো আমার রুমে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আয়ানকে বললাম “কি হচ্ছে এসব? সব শান্তি তো কেড়ে নিয়েছো, এখন কি শান্তির ঘুমটাও কেড়ে নিতে এসেছো?”
আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আয়ান রাগান্বিত কণ্ঠে বলে “কোথায় গিয়েছিলে আজ তুমি? নয় বছরে তো একা কোথাও যেতে দেখিনি তোমায় তবে আজ কাউকে কিছু না জানিয়ে গেছো কোথায়? সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরা, পাখা গজিয়েছে খুব নাহ?”
কতক্ষণ চুপ হয়ে আয়ানের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রাগে ফুঁসছে আয়ান। একটু সময় নিয়ে আয়ানকে উত্তর দিলাম “আমি যেখানেই যায়না কেনো মনে রেখো এই পরিবারের ভালোর জন্য ই গিয়েছিলাম। নয় বছর তুমি ছিলে আমার পাশে কিন্তু আজ তুমি কাছে থেকেও বহুদূরে তাই একা পথ চলতে শিখতেছি।’
আয়ান আরো বেশি রেগে গেছে। নাকটা লাল হয়ে গেছে। পর পর দ্রুত গতিতে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। হাতের রগ কপালের রগ টানা টানা হয়ে ফুলে গেছে। রাগান্বিত হয়ে বেশ ধীরেই চাপা কণ্ঠে বলে “এই পরিবারের কি এমন ভালোর জন্য তোমাকে একা বের হতে হয়েছে ঘর থেকে? জানতে চাই আমি, বলো।”
আয়ানের চোখের দিকে তাকাতে পারছিনা। লাল হয়ে আছে চোখ দু’টো ওর। ভয়ে ঘামতে শুরু করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে উত্তর দিলাম “তোমার এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নয় আমি। কোন অধিকারে তুমি শাসন করতে আসছো? একবছর ধরে স্বামীর কোনো দায়িত্ব তুমি পালন করোনি তবে আজ কেনো এতো অধিকার? যাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারোনা তার জন্য কি চিন্তা হচ্ছে খুব? কিন্তু আমার যে কিছু করার নেই আর। যেদিন এই পরিবারে এসেছিলাম তোমার হাত ধরে সেদিনই নিজের সাথে প্রমিজ করেছিলাম কখনোই এই পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হতে দিবোনা কিন্তু একবছর ধরে তো অশান্তির শেষ নেই তাই নতুন কোনো অশান্তি যেনো না হয় সে-ই জন্যই বাহিরে গিয়েছিলাম। চিন্তা করিওনা তোমাদের ভালো ছাড়া খারাপ করবোনা।”
আমার কথাটুকু মনে হয় আয়ানের পছন্দ হলোনা তাই তো দরজায় জোরে একটা লা’থি দিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। আমার উপরে রাগ করে নিজের পা কে ব্যাথা দিলো, বেচারা দরজাও ছাড় পেলোনা। তবে খুশি লাগছে যে এতোকিছুর পরেও আয়ান আমার গায়ে হাত না তুলে নিজেকেই আঘাত করেছে। মানুষটা যে একটা সময় বড্ড বেশি ভালোবাসতো আমায় সেটা ভেবে আমিও মানুষটাকে একটু সুখ দিতে চাই। আমার জন্য ওদের পরিবারে কোনো নতুন অশান্তির সৃষ্টি হোক তা আমি কিছুতেই চাইনা। আর অল্প কয়দিন পরেই হয়তো সুখবর শুনতে পাওয়া যাবে। সেইদিনের অপেক্ষায় আছি। আমার আয়ান বাবা হবে, হোকনা তার সন্তানের মা অন্যকেউ। যে খুশিটা আমি দিতে পারিনি তা ওকে অন্যকেউ দিক। ক্ষতি কি তাতে?
**********
আজ আবারো বাহিরে আসার সময় আমার শ্বাশুড়ির সাথে কিছুটা ত’র্ক বি’ত’র্ক হলো। নয়নাও বারংবার জিজ্ঞেস করছিলো কোথায় যাচ্ছি কিন্তু কারো কোনো কথার উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করলাম নাহ। কারণ আমার বুঝা হয়ে গেছে ওই ঘরে আমার আপন আর কেউ নেই। আমি সোজা ব্যাংকে গিয়ে টাকা উঠিয়ে বিকাশ করে দিলাম উকিল বাবুর নাম্বারে।
উকিল বাবু গতকাল একটা কাহিনী শুনিয়েছিলো তার নিজের জীবনের। উকিলবাবু নাকি একটা মেয়েকে প্রচুর ভালোবাসে কিন্তু মেয়েটার ভাই ভাবি মেয়েটাকে অন্যত্রে বিয়ে দিয়ে দেয়। কারণ মেয়েটার মাঝে ছিলো আমার মতোই কিছু অপূর্ণতা। উকিলবাবু নাকি সব মেনে নিয়েছিলো আর বলেছিলো প্রয়োজনে বাচ্চা এডপ্ট করে পালবে তবুও ভালোবাসার মানুষের হাত কখনো ছাড়বেনা তবুও মেয়েটার ভাই ভাবি রাজি হয়নি।
এই অল্পসময়ে প্রথম পরিচয়ে মানুষটা এতোকিছু শেয়ার করেছে নিজের সম্পর্কে যা আমার খুব ভালো লেগেছে। মানুষটা বড্ড বেশি মিশুক। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হলো এই মানুষটার কথা শুনে। আমার আয়ান কি তবে মন থেকে আমাকে ভালোবাসতে পারেনি? যদি মন থেকে ভালোবাসতো তবে তো উকিলবাবুর মতোই এমন চিন্তা করতে পারতো। পারতো একটা বাচ্চা এডপ্ট করতে এতে একটা এতিম অসহায় বাচ্চা পেতো মা বাব আর আমরাও পেয়ে যেতাম বাচ্চা। কিন্তু এমন কিছু না করেই আয়ান বিয়ে করে নিলো পরিবারের কথায়। আয়ান আমায় ভালোবাসেনি, খুব সুন্দর অভিনয় করে গেছে ভালোবাসার। বলতে হবে মা’রা’ত্ম’ক অভিনেতা সে।
********
সন্ধ্যায় আয়ানকে ছাঁদে যেতে দেখলাম। প্রায়ই তিন ঘন্টা হয়ে এসেছে এখনো ছাঁদ থেকে আসেনি। নয়নার সাথে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ মনে পরলো আয়ানের কথা। নয়নাকে বললাম একটু আসি। তারপর ছাঁদে গিয়ে দেখলাম একমনে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যাস্ত আয়ান। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক সিগারেটের অর্ধ অংশ। প্রায়ই ১৬ থেকে ১৭টা হবে। বুঝতে বাকি রইলোনা তিনঘণ্টা ধরে আয়ান সিগারেটের ধোঁয়ায় মগ্ন হয়ে আছে। কি এমন কষ্ট এই মানুষটার মনে যা সে আমার সাথে শেয়ার করতে পারছেনা। এই নয় বছরে তো আয়ান কখনো কিছু লুকায়নি আমার কাছ থেকে তবে এখন কেনো এমন করছে? এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখা যাবেনা। আয়ানের মনের অস্পষ্ট যন্ত্র’ণা’র কথা আমাকে জানতেই হবে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [১১]
#ফারজানা_আক্তার
একা একা ধোঁয়া উড়ানোতে মজা নেই তো, চলো আজ একসাথে ধোঁয়া উড়াবো। বেশ মজা হবে।”
আমার অদ্ভুত রকমের কথা শুনে হকচকিয়ে তাকায় আয়ান আমার দিকে। আয়ানের মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে উড়ছে। আমাকে দেখে হাতে থাকা সিগারেট টা আবারও দুই ঠোঁটের ভাঁজে রেখে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া সব আমার মুখে ছুঁ’ড়’লো। সাথে সাথেই আমার কাঁশি উঠে যায়। এমনিতেই সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয়না তারউপর এলার্জি। মানুষটা জেনেও এমন করলো! কষ্ট হচ্ছে খুব। কাঁশতে কাঁশতে যেনো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কাঁশতে কাঁশতে রেলিং ধরে নিচে বসে পরলাম। আমার অবস্থা বেশি খারাপ দেখে এবার অস্থির হয়ে গেলো আয়ান। চারপাশে কি যেনো খুঁজলো, তারপর আমার আঁচলের গিট থেকে চিলেকোঠার চাবিটা খুলে নিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো। এক হাত দিয়ে আমার বাহু ধরে অন্যহাত দিয়ে আমার মুখে পানি দিচ্ছে। কিন্তু পানির বোতলের মুখ আমার ওষ্ঠ মাঝেই আঁটকে রয়েছে কারণ এতো কাঁশির মাঝেও আমি অপলকে তাকিয়ে আছি আয়ানের মুখের দিকে। একবছর পর আয়ানের এমন আদরের ছোঁয়া পেয়ে বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। চোখ দিয়ে ক্ষনিকের আনন্দের অশ্রু।
“কি হলো এমন দেবদাশ হয়ে আছো কেনো? পানি খেয়ে নাও।”
আয়ানের ধমকের সুরে কিঞ্চিৎ লাফিয়ে উঠলাম। তারপর আর কিছু না বলে পানি খেয়ে নিলাম।
প্রায়ই বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আয়ান রেলিংয়ের উপর দুই হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দাঁড়াতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো “যে কিনা এই অল্প ধোঁয়া সহ্য করতে পারেনি সে কিনা সিগারেট টানবে। অদ্ভুত কথাবার্তা বলো তুমি মাঝে মাঝে। ”
“তুমিও তো কখনো সিগারেট ছুঁয়ে দেখোনি তাহলে তুমি কিভাবে খাও এখন?”
“আমি পুরুষ। আমার সাথে নিজেকে তুলনা করতে আসবেনা একদম। সিগারেট খাবে! সাহস পাও কই এতো হ্যাঁ? ”
“বাব্বাহ আজ দেখি একেবারে দরদ উতলায় পরছে আমার জন্য।”
একটু হেঁসেই বললাম কথাটা। আয়ান আর কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলো। অম্বরজোড়ে তাঁরাদের আনাগোনা। কি যেনো ভাবছে শুন্যে ভেসে থাকা তাঁরাদের দিকে দৃষ্টি রেখে। আমি মোবাইলে আলো জ্বা’লি’য়ে এক নজর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। সময়মতো খাবার না পেলে পুরো ঘর মাথায় তুলবে শ্বাশুড়ি নামক প্রানীটা। আমি আয়ানকে খেতে আসতে বলে নিচে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই আয়ান বলে উঠে “এতো অ’ত্যা’চা’র এতো অ’প’মা’ন সহ্য করে কেনো এখানে পরে আছো রিহানা? কিসের স্বার্থে তুমি এতোকিছু নিরবে সহ্য করছো?”
আয়ানের কথা শোনে কেমন জানি লাগলো। মোটেও পছন্দ হয়নি আয়ানের কথাটা। রাগ আর কষ্ট এক সাথেই জড়িয়ে ধরেছে আমায়। কি বলবো আয়ানকে ভেবে পাচ্ছিনা তখনই মাথায় একটা কথা এলো আর সরাসরি বলে ফেললাম আয়ানকে “কই আর সহ্য করছি। কথা তো সবাইকেই শুনাচ্ছি যে আমার সাথে অ’ন্যা’য় করতেছে। অ’ন্যা’য়ে’র প্র’তি’বা’দ তো আমি করেই যাচ্ছি। মাহি বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিলো আমার জন্য। শুনলাম এখানে কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছে। আম্মু এখন আর আগের মতো বেশি ক্যাঁচক্যাঁচ করেনা। সবমিলিয়ে ভালোই আছি আমি এখন।”
আয়ান আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে আবারও বলে “ডিভোর্স কেনো দিয়ে দিচ্ছোনা আমায় রিহানা? এখানে তোমার কষ্ট হচ্ছে না? চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্যমেয়ের সাথে দেখতেছো।”
এবার বুকটা কেঁপে উঠলো। ঠোঁট জোড়াও কাঁপতেছে। এই বুঝি বাঁধ ভে’ঙে নোনাজল গড়িয়ে পরবে চক্ষু সমুদ্র থেকে। আয়ান এতো স্বাভাবিক ভাবে বলছে কিভাবে কথাগুলো? এতোটা নিষ্ঠুর তো আমার আয়ান না। এই কোন আয়ানকে দেখছি আমি। আমাকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে আয়ান আবার বলে “ডিভোর্স দিয়ে দাও আমায়। অন্যকারো সাথে বেঁধো ঘর, সুখী হবে খুব।”
এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম “তোমার পরিবার নয় বছরের ভালোবাসা ভুলে গিয়ে যেখানে এতো অত্যাচার করতেছে শুধু আমি বন্ধ্যা বলে সেখানে নতুন পরিবার নতুন মানুষরা কিভাবে মেনে নিবে আমায়? কোথায় যাবো আমি? কার কাছে যাবো? বাড়িতে আছে সৎ মা। ডিভোর্সি মেয়েকে নিজের মা একটাদিন সহ্য করতে পারেনা সেখানে সৎ মা কিভাবে সহ্য করবে? এখন শুধু তোমার পরিবার কথা শোনায় বন্ধ্যা বলে তখন পুরো পৃথিবী শুনাবে। এই সমাজে ডিভোর্সি মেয়ের কোনো সম্মাণ নেই, কোনো গুরুত্ব নেই। সবাই ডিভোর্সি মেয়েদের কে ঘৃণা করে অবহেলা করে অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখে। যেখানে তুমি ভুলে গেছো নয় বছরের ভালোবাসা সেখানে কিভাবে আশা করবো নতুন মানুষের সাথে সংসার করলে সে মেনে নিবে এই বন্ধ্যা প্রাণটাকে? এতোই যখন মুক্তি পেতে চাও তাহলে নিজে কেনো দিচ্ছোনা ডিভোর্স? বিয়ে তো করেই ফেলেছো, আর কয়েকটাদিন পরই হয়তো সুখবর আসবে। বাবা হওয়ার সুখ পাবে। দিয়ে দাও ডিভোর্স চলে যাবো কোনো দূর অজানাই। কাউকে বি’র’ক্ত করার জন্য ফিরে আসবোনা আর।”
একদমে কথাগুলো বলে চোখজোড়া বুঁজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করতে লাগলাম। আয়ান সোজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। ওর চোখে দেখলাম ব্যার্থতার আভাস। ওর নিঃশ্বাসও যেনো থেমে থেমে আসছে এমন মনে হচ্ছে। পারছিনা আমি ওর চোখ দু’টোর দিকে তাকাতে।
আমি আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
রাত তখন প্রায়ই ১০টা। নয়না ডাকছে ভাত খাওয়ার জন্য। দরজা না খুলেই ওকে বলে দিলাম খাবোনা আর আমাকে যেনো কেউ বি’র’ক্ত না করে। নয়না বলল ভাত না খেলে ঔষুধ খাবো কেমনে তখন আমি জোর গলায় বলে দিলাম একদিন না খেলে কেউ ম’রে’না যাও এখান থেকে স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটাও, আমাকে একা থাকতে দাও।
*********
সকাল ১০টা। শাহানা খালা কাজ করছে আমিও উনাকে সাহায্য করছি। আজ নাকি রিদিমার স্কুল বন্ধ তাই সেও এসেছে মায়ের সাথে। নয়না তো রিদিমাকে পেয়ে বেশ খুশি। দু’জনে মিলে আড্ডা দিচ্ছে বসার ঘরে। আমার শ্বাশুড়ি নেই। হয়তো মাহিকে দেখতে গেছে। এখানে পাশেই আছে কোনো এক বাসায় মাহি। আমার শ্বশুড় নিজের রুমে নিজের মতো করে খবরের কাগজ পড়ছে। আমার মন বেশ খারাপ আজ কাল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য। আমার মন খারাপ দেখে,শাহানা খালা চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তখন আমিও একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম কিছু হয়নি। অদ্ভুত আজকে এতো চেষ্টা করেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফোটাতে পারিনি একটুও। শাহানা খালা আমার অবস্থা দেখে বলে “চিন্তা করিওনা মা মানুষের দুর্দিন সারাজীবন থাকেনা, দুঃখের পর সুখ আসে যেমন রাত শেষে সূর্য উঠে। তোমারও সুদিন আসবে। শুধু একটা কথা মনে রাখবে যারা তোমার দুর্দিনে তোমার পাশে ছিলোনা তোমার সুদিনে কিন্তু তাদেরকে তুমিও পাত্তা দিবেনা। কারণ যারা তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসে তারা তোমার সব দিনেই তোমার পাশে থাকবে।”
খালার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এই মানুষটা আমাকে সবসময়ই নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে গেছে।
আমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখি নয়না আর রিদিমা টিভি দেখছে এই সুযোগে আমি আয়ানের রুমে গিয়ে সব চেক করতে লাগলাম। আমি নিজেও জানিনা কিসের আশায় আমি এমনটা করছি কিন্তু মনটা বড্ড খচখচ করছিলো তাই সব চেক করতে লাগলাম। চেক করতে করতে একটা একটা ড্রয়ারে অনেক পুরোনো পেপারের নিচে কিছু রিপোর্ট দেখতে পেলাম যা আমার আর আয়ানের। আয়ান কখনোই আমাকে কোনো রিপোর্ট দেখতে দেয়নি সব নিজের কাছেই রেখেছে। আমি দেখতে চাইলে রেগে যেতো খুব তাই আমি আর জোর করতাম না। কিন্তু রিপোর্ট গুলো আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। লেখাগুলো যেনো মাথায় ডুকছেনা কিছুতেই। তাই ভেবে নিলাম এগুলো নিয়ে আয়ানের ডাক্তার বন্ধুর কাছে যাবো। এই ভেবে রুম থেকে বের হতে যাবো তখনই চোখ আঁটকে গেলো একটা ডায়েরিতে। আয়ানের তো ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই তাহলে এটা নিশ্চয়ই নয়নার ডায়েরি হবে।
ধীরে ধীরে নয়নার ডায়েরির দিকে এগিয়ে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতেই যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। আর তখনই নয়না পেঁছন থেকে বলে উঠে____
#চলবে