#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [০১]
#ফারজানা_আক্তার
আজ আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বাসর ঘর সাজাচ্ছি। আমার শ্বাশুড়ির কড়া আদেশ আমার স্বামী আর আমার স’তীনের জন্য বাসর ঘর আমাকে নিজ হাতেই সাজাতে হবে। কি আর করার ঝাপসা চোখে কাঁপা হাতে একা ঘরটাকে সাজিয়ে দিচ্ছি নতুন বউয়ের জন্য। যে খাটে নয় বছর আগে আমি নববধু সেজে বসে ছিলাম, আমার বাসরে যে খাট নয় বছর আগে আমার জন্য সেজেছিলো নানা শুভাশের ফুল দিয়ে সেই খাট আজ আমি নিজ হাতে সাজাচ্ছি আমার স্বামীর জন্য কিন্তু আফসোস আজ তার বধু আমি নয় অন্যকেউ। বুকের ভেতর যেনো কেউ হাতুড়ি দিয়ে ভারি দিচ্ছে এক নাগারে এমন মনে হচ্ছে। কিছু কষ্ট প্রকাশ করা বড্ড বেশি দায়। কিছু কষ্ট থমকে থাকা মেঘের মতো হয় জল জমে থাকলেও সহজে বৃষ্টি নামেনা। ঠিক এই মুহুর্তে আমারও তেমন। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছে করছে না একটুও।
আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার প্রধান কারণ হলো আমি নাকি বন্ধ্যা। আমাকে বন্ধ্যা উপাধি দিয়েই সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চলে গেলো মায়ের কথায়। অথচ এই শ্বাশুড়ি নামক ব্যাক্তিকে এই ঘরে আসার পর থেকে কখনো শ্বাশুড়ির নজরে দেখিনি আমি। সবসময়ই নিজের মায়ের মতোই জেনেছি উনাকে আমি। নয় বছর ধরে বিনা স্বার্থে সেবা করে যাচ্ছি শ্বশুড় শ্বাশুড়ি দুজনের। কিন্তু আজ তারাই আমাকে সহ্য করতে পারছেননা দুই চোখে। কাকে বুঝাবো মনের দুঃখ? স্বামীও তো পর হয়ে গেলো। এতক্ষণে হয়তো বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েই গেছে। সবাই চলে গেছে বউ আনতে। পুরো ঘর ফাঁকা। আমি একাই আছি শুধু। আমার শ্বাশুড়ি যখন আমার স্বামীকে বলেছিলো দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা তখন ও এক লাফেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো যেনো কত বছর ধরে সে এই কথাটারই অপেক্ষা করছিলো। অথচ সে লক্ষই করলোনা তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। সেদিন কাঁদলেও আজ আমার চোখে একটুও জল নেই। একটু আগেও চোখ ঝাপসা ছিলো তবে এখন আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক। একটু পরেই নতুন বউ নিয়ে ফিরবে সবাই। আর আমি কারো সামনেই নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে ইচ্ছুক নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকের পর আমি আর কাঁদবো না। একটা বেইমানের জন্য চোখের জল নষ্ট করার মতো মেয়ে আমি নয়। নয় বছর আগে একটা বিয়ে বাড়িতে দেখেই পছন্দ করে আমাকে আমার স্বামী আয়ান রশীদ। আমার শ্বশুড় হাফিজুর রশীদ আমার আব্বুর দূর সম্পর্কের ভাই হওয়ায় পারিবারিক ভাবেই অল্পদিনের পরিচয়ে বিয়ে হয়ে যায় আমাদের। বিয়ের আগে যেহেতু একসাথে তেমন একটা সময় কাটানো হয়নি আমাদের তাই বিয়ের পর জমিয়ে প্রেম করেছিলাম দুজনে। একদিন হঠাৎ করেই মাঝরাতে আয়ান আমাকে তার উষ্ণ বুকে জড়িয়ে ধরে নরম সুরে বলেছিলো “রিহানা তুমি কথা দাও আমায় কখনো ছেড়ে যাবেনা। কখনো না। যদি আমিও তোমায় কখনো ভুলে যায় তুমি ভুলোনা আমায়। তুমি ছাড়া এতো ভালো কেউ বাসতে পারবেনা আমায়। তুমি ছাড়া এক এক নিঃস্বাস আমার অচল।” আজ সেই মানুষটা সত্যিই ভুলে গেছে আমায়, মুছে ফেলেছে নয় বছরের সব স্মৃতি। আসলেই মানুষ পরিবর্তনসীল। কে কখন কোথায় কিভাবে বদলে যায় সময়ের সমীকরণে তা কেউ বলতে পারেনা। সময় মানুষকে বদলে দেয় মুহুর্তেই। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর এই ঘরের প্রতিটি মানুষ আমি বলতেই পাগল ছিলো আর আজ আমাকে দেখলেই নাক ছিঁটকাই সবাই। আমি আমার ভাগ্যকেই দোষারোপ করেছি সবকিছুর জন্য। আমারই তো সব দোষ। বিয়ের নয় বছরেও এই পরিবারের বংশধর দিতে পারিনি তাদেরকে আমি। আয়ানেরও তো ইচ্ছে জাগে বাবা ডাক শোনার। আমিই অভাগী।
আয়ানের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমার বাবা মা ভাই বোন সবাই-ই অনেক রিকুয়েষ্ট করেছে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে আয়ানকে ডিভোর্স দিয়ে এই বাসা থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হয়নি কিছুতেই। কিভাবেই বা আমি আয়ানকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবো? আমি যে মানুষটাকে কথা দিয়েছি ওকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা কখনো, ও আমাকে ভুলে গেলেও আমি কখনো ভুলবোনা। আমি যে আমার দেওয়া কথা কখনোই ফেলতে পারবোনা। বড্ড বেশি ভালোবাসি মানুষটাকে। আমার শ্বাশুড়ি মা বলেছে আজ থেকে যেনো আমি অন্যরুমে চলে যায়। আর এতোবড় ঘরে আমার জন্য স্টোর রুমটাই একটা আলনা দিয়েছে কাপড়চোপড় রাখার জন্য আর নিচে বিছানা পেতে ঘুমাতে বলেছে। কথাগুলো আয়ানের সামনে বললেও সে একটুও প্রতিবাদ করলোনা। আমি যখন ওর দিকে অশ্রুজমা নয়নে তাকিয়েছিলাম তখন সে আমায় বললো মা যা বলছে তা-ই হবে। আজ বর সেজে সে আমার সামনে এসে মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করলো আমায় তাকে কেমন লাগছে বর সাঁজে। আমিও মৃদু হেঁসে উত্তরে বলেছিলাম একদম সেদিনের মতোই অপূর্ব লাগছে যেদিন আমাদের বিবাহ্ হয়েছিলো। সে চুপ হয়ে গিয়েছিলো, আর কিছু না বলেই হাঁটা ধরেছিলো নিজের গন্তব্যে। আমার বলা শব্দে তার মনে ঝ’ড় তুলেছে বুঝতে পেরেছি। অথচ আমার চোখের নিচের কালি, ফ্যাকাশে চেহারা, এলোমেলো চুল, কুঁচকানো কপাল, শুষ্ক ঠোঁট সে লক্ষই করলোনা। কিভাবে পারলো নয় বছরের ভালোবাসা ভুলতে মানুষটা? আমি যেনো আর কিছু ভাবতে পারছিনা। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি।
বাসর ঘর টা সুন্দর করে সাজিয়ে আমি একনজর পুরো ঘরটায় দৃষ্টি বুলিয়ে বের হয়ে আসলাম। মুহুর্তেই আমার সাজানো গুছানো সংসার টা অন্যের হাতে চলে যাবে এটা যেনো আমার মন মোটেও মানতে পারছেনা। নয় বছরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলাম এই সংসারটাকে আমি। আমার ননদ মাহি যখন তার বয়ফ্রেন্ড এর পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে নিজের সব হারাতে চলেছিলো তখন আমিই ওকে রক্ষা করেছিলাম, মানসিক যাবে সাহস যুগিয়েছিলাম অথচ সেই ননদ আজ তার তিন বছরের সন্তান কোলে নিয়ে আমায় বলে আমি নাকি অপয়া, আমার দিকে তাকাতেও তার বি’ষা’ক্ত লাগে। আমি শুধু তার এই কথার জবাবে একটু ফিকে হেঁসে তাকে এইটুকুই বলেছিলাম উত্তরে “একটু অপেক্ষা করো বোন, আল্লাহ কাউকেই নিরাশ করেননা। তোমার নতুন ভাবি নিশ্চয়ই তোমাকে ফুফি হওয়ার খুশি দিবেন ইনশাআল্লাহ।”
কি অদ্ভুত তাইনা? নিজের স্বামীকে অন্যের সাথে শেয়ার করতে হবে জেনেও ননদকে এমন কথা বলতে হচ্ছে বুকে পাথর চেপে রেখে। আমার শ্বাশুড়ির কড়া আদেশ আজ থেকে আমাকে এই ঘরে কাজের মেয়েদের মতো থাকতে হবে। আমার এই মানুষগুলোকে চিনতে বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে আজ। একটা সময় এই মানুষগুলোই আমাকে রাণী করে তুলেছিলেন এই ঘরে। আমি জানি এসব কিছু তারা এই কারণেই করতেছে আমি যেনো সহ্য করতে না পেরে এই ঘর ছেড়ে নিজে থেকেই চলে যায়। কিন্তু আমার বুকের লুকানো যন্ত্রণা টা কেউই বুঝলোনা। যার সাথে নয়টা বছর সংসার করেছি সেই স্বামীও আমার কথা চিন্তা করলোনা একটিবারের জন্যও। তার সাথে আমিও যে নয় বছর ধরে একটা সন্তানের জন্য কত ব্যাকুল হয়ে ছিলাম তা সে বুঝেও বুঝলোনা। আমিই বোকা। বিয়ের নয় বছরেও সন্তান জন্ম দিতে না পারা একটা মেয়ের জন্য কতটা যন্ত্রণা তা একজন পুরুষ কিভাবে বুঝবে যেখানে শ্বাশুড়ি আর ননদও বুঝলোনা নারী হয়ে।
সব ভাবনা বাদ দিয়ে ছাঁদে চলে গেলাম। রাত হয়ে এসেছে। সেই দুপুরে সবাই রওনা দিয়েছে নতুন বউয়ের জন্য। একটু পর হয়তো এসে পরবে সবাই। ভাগ্যের চাকা কিভাবে ঘুরে হারে হারে তা লক্ষ করছি। চিলেকোঠার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই চিলেকোঠার সাথে যে আয়ানকে নিয়ে কত স্মৃতি তা বলে প্রকাশ করাও বোধহয় সম্ভব নয়। এই চিলেকোঠার চাবি শুধু মাত্র আমার কাছেই আছে, আমার বিয়ের পরেই আয়ান আমার হাতে চাবিটা দিয়ে বলেছিলো “আজ থেকে আমার ছোট্ট চিলেকোঠার রাজ্যে তুমিই রাণী। ভালোবেসে যত্ন করে আগলে রেখো। রাখবে তো?”
সেদিন আয়ানকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলাম কখনো অযত্ন করবোনা এই রত্ন। সেদিন কি হাসির সুর ছিলো দু’জনের এই চিলেকোঠায় আর আজ সময়ের ব্যবধানে শুধু না পাওয়ার সুর তাও আমার একার। অদ্ভুত নাহ সবটা?
আমি জানিনা আগামীকাল এই চিলেকোঠার চাবি আমার হাতে থাকবে কিনা তবে যতক্ষণ পর্যন্ত আছে ততক্ষণ আমার দায়িত্ব আমার কথা আমি রাখবো শত কষ্ট সহ্য করে হলেও।
এসব ভাবনার মাঝখানেই গাড়ির হর্নের শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসে। ছুটে গিয়ে রেলিংয়ের কাছে দাঁড়াতেই দেখলাম নতুন বউ নিয়ে ফিরেছে আমার আয়ান।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ