বকুলতলা,পর্ব-০১,০২

0
683

বকুলতলা,পর্ব-০১,০২
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সূচনা পর্ব

–“আপনার শার্ট ভিঁজে যাচ্ছে। বৃষ্টিও বেড়ে গেছে। ভেতর করে দাঁড়ান। নয়তো পরে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
অল্পসল্প কাঁপা কণ্ঠ শুনে তাকালো মাহাদ। খুব শান্ত দৃষ্টি। বললো, “আমি ভেতর করে দাঁড়ালে তোমার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়াবো তরী। তুমি সেটা পছন্দ করবে না।”
হকচকিয়ে উঠলো তরী। লোকটা তার সঙ্গে সর্বদা ত্যাড়ামো করেই কথা বলে। সোজা কথা যেন তার স্বভাবেই নেই। আড়চোখে মাহাদের মুখটা একবার পরখ করে নিলো সে। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। কপালে কতশত ভাঁজ! মাহাদ কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত? ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারলোনা তরী। আঁতকে উঠলো মাহাদের হাতের ক্ষতবিক্ষত আঙুলগুলো দেখে। কণ্ঠে ভীড় জমালো দৃঢ় উৎকণ্ঠা,
—“হাত এমন লাল হয়ে আছে কেন আপনার? আবার মারপিট করেছেন? বারবার একই কাজ কেন করেন?”

মাহাদ একবার বিরক্ত দৃষ্টিতে বাম হাতটার দিকে তাকালো। এরপর নির্বিকার ভঙ্গিতে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “আরও করবো। উঠতে, বসতে মারপিট করে জীবন দিয়ে দিবো। তোমার কথা শুনবো না।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একবার আশপাশটায় নজর বুলিয়ে হালকা গলায় বুঝাতে চাইলো, “আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না। তবুও কেন আমার পেছনে নিজের সময় নষ্ট করছেন?”
—“কারণ আমি অপেক্ষা করতে জানি।”
শান্ত, স্বাভাবিক, স্থির কণ্ঠের একটি বাক্য। যা তরীর বুক ভারী করে দিলো। আগত নিশ্বাস আটকে দিলো তক্ষুণি। এই উগ্র, মেজাজি ছেলেটা কেন বুঝে না? সে ভালোবাসতে পারবে না, পারে না। সেই অধিকার তার নেই। তবুও কেন পিছু পিছু ঘুরে?

বৃষ্টি কমে এসেছে। তীব্র ভাব কাটিয়ে ঝিরিঝিরি করে একেকটা ফোঁটা গগন থেকে নেমে আসছে। মাহাদ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো। চারপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজলো। একটাও খালি রিকশা নেই। সব যাত্রীরা আগেভাগেই দখল করে নিয়েছে। যাও একটা পাওয়া গেল, দাম চাচ্ছে অনেক। মাহাদ রাজী হয়ে গেলেও তরী বেঁকে বসলো। সে কিছুতেই এ রিকশায় উঠবে না। এত দাম দিয়ে রিকশা নিতে হলে তো সে আগেই নিতো। বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতো নাকি?
মাহাদ সূক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গাঢ় ধমক লাগালো, “রিকশায় না উঠলে আমি কিন্তু তোমাকে আমার বাইকে উঠাবো তরী! কোনো বাঁধা মানবো না।”

অগত্যা তরীকে সেই রিকশা করেই বাসায় ফিরতে হয়েছে। ফেরার সময় মাহাদ তরীর সাথে সাথেই ছিল। বাইকে করে রিকশার পিছুপিছু আসছিল। তরী খেয়াল করেছিল, আগাম জ্বরে জর্জরিত মাহাদকে। যার মুখশ্রী রক্তিমলাল, দৃষ্টি নিভু নিভু। লোকটার যে বৃষ্টির পানি একদম সহ্য হয় না।

_____

বিশাল দোতলা বাড়িটি তরীর মামার। একমাস আগে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় এসেছিল সে। হলে সীট খালি না পাওয়ায় এখন এখানেই থাকে।
জুতা খুলে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই সালেহা দৌড়ে এলো তরীর কাছে। উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “এমনে ভিঁজ্জা গেছো কেমনে আপা? সর্দি লাগবো তো! রুমে গিয়া তাত্তাড়ি জামা পাল্টাও। আমি স্যুপ আনতাছি।”

তরী একটু হাসলো। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, “এত ব্যস্ত হতে হবে না সালেহা। আমি ঠিক আছি। বাড়ির সবাই কোথায়? দেখছি না যে।”
তরীর কথা একটুও মান্য করেনি সালেহা। ভীষণ ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে যায়। প্রশ্নটাও হয়তো শুনেনি।

দোতলার একদম কোণার ঘরটা তরীর। তার ঘরের বাম পাশেই বিশাল বড় লাইব্রেরী। মামার ছোট ছেলের আবার বই পড়ার অনেক শখ। তাই আস্ত দু, দুটো রুমের জায়গা নিয়ে লাইব্রেরী ঘরটা বানিয়েছে সে।

—“এমন ভেঁজা শরীরে আমার লাইব্রেরীতে ঢুকছেন কেন? পারমিশন কে দিয়েছে আপনাকে?”

গম্ভীর, থমথমে পুরুষ কণ্ঠটি কানে যেতেই তরী চমকে উঠলো। শরীর একটু কাঁপলো যেন। সে তো লাইব্রেরীর দরজাটা বন্ধ করছিল। আর কিছু না। সামনে তাকিয়ে দেখল, মামার ছোট ছেলে। প্রণয়। হাতে গোনা কয়েকবারই ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছে তার। তবে কখনো কথা বলা হয়ে উঠেনি।
প্রণয় আবার বললো, “কিছু বলছেন না কেন? কেন ঢুকতে চাচ্ছেন ভেতরে?”
তরী মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করলো, “আমি ঢুকছিলাম না ভেতরে। হাত লেগে দরজাটা খুলে গিয়েছিল। তাই দরজা বন্ধ–”

কথা শেষ হলো না। সামনে দাঁড়ানো প্রণয় সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আমার জানামতো এ জায়গাটা তো এত ছোট না। একটা ট্রাক যেতে পারবে। এত জায়গা থাকতে আপনি দরজার কাছে গেলেন কিভাবে?”

মাথা নুয়াতে নুয়াতে গলার সাথে থুতনি লেগে গেল তরীর। সে কি উত্তর দেবে? হোচট খেয়ে পরে যাওয়া থেকে বাঁচতে দরজাটা একটু ধরেছিল। ওমনি দরজা খুলে গেছে। এটা বলবে? কথাটা কি আদৌ কারো বিশ্বাসযোগ্য? আগে যদি জানতো, সামান্য দরজায় হাত রাখার জন্য এতকিছু হবে, তাহলে ওই দরজার দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকাতো না কোনোদিন।

জবাব না পেয়ে প্রণয় আরও গম্ভীর হয়ে উঠলো। বললো,
—“পরেরবার যেন আমার লাইব্রেরী ঘরে আপনাকে না দেখি। ভেঁজা জামাকাপড় পরে আছেন। চেঞ্জ করুন, যান।”
তরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু পরক্ষণেই মিনমিনে স্বরে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো, “মামীরা কোথাও কি গিয়েছে? ওদের কাউকে দেখছি না।”
—“শপিংয়ে গিয়েছে। এসে যাবে একটুপর।”
তারপর একটু থেমে কেমন করে যেন দেখলো তরীকে। তীব্র পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি। বললো, “আনসিজনাল বৃষ্টিতে ভিঁজেছেন। অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আপনার রুমে হয়তো ফাস্টএইড বক্স নেই। আমি কিছু ঔষধ সালেহাকে দিয়ে পাঠাচ্ছি। খেয়ে নেবেন।”
এবার প্রণয়কে খানিকটা অদ্ভুদই মনে হলো তরীর। এইতো, একটু আগেও রুক্ষ আচরণ করছিল তার সাথে। এখন আবার এত যত্ন নিচ্ছে কেন?

তরী অতশত ভাবলো না। ঘরে ঢুকে কোনোমতে জামা পালটে কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। ইস! কি ঠান্ডা! এরমধ্যে সালেহাও তার বানানো গরম গরম স্যুপ নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। হতাশার সুরে তরীকে জিজ্ঞেস করলো, “বেশি খারাপ লাগতাছে আপা?”

তরী স্যুপ খেতে খেতে জবাব দিলো, “আরে ধুর! এসব বৃষ্টি-টৃষ্টিতে আমার কিচ্ছু হবে না। আজকের দিনটা একটু খারাপ লাগবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। গ্রামে এমন কত ভিঁজেছি!”
সালেহার চিন্তা তবুও কমলো না। সে তার মতো করেই বললো, “স্যুপ খাইয়া ঔষধটা চোখ বন্ধ কইরা গিল্লা লও আপা। প্রণয় ভাইজান দিছে। ডাক্তার মানুষ! তাত্তাড়ি ঠিক হইয়া যাইবা। তোমারে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভাল্লাগতাছে না।”

জবাবে এবার শুধুই হাসলো তরী। আরেক চামচ স্যুপ মুখে দিবে, ওমনি ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। মাহাদ কল করেছে। সে আড়চোখে দেখলো। তবে ধরলো না। ফোন উলটো করে রেখে দিলো। কিন্তু এতে যেন ভীষণ বিরক্ত সালেহা। সে চোখ-মুখ কুঁচকে শুধালো, “ফোন ধরতাছো না ক্যান আপা? জানো? আমার ফোন এমন কইরা কেউ না ধরলে আমি যে কি বিরক্ত হই! তোমারে যে ফোন দিসে সেও তো বিরক্ত হইবো, তাই না? কল ধরো।”

তরীরও মনে হলো, মাহাদ এখন কেমন আছে, তা জানা উচিত। স্যুপের বাটিটা একপাশে রেখে ফোন হাতে নিলো সে। রিসিভ করে কানে রাখতেই ওপাশ থেকে জোড়ালো, ঢিমে যাওয়া কণ্ঠ শোনা গেল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না কেন তরী?”

তরীর চুপ করে রইলো। লোকটা জ্বরের ঘোরের এই এক প্রশ্নই করছে।

________________

চলবে

বকুলতলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

২.
জ্বর না এলেও মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় কপালে কতগুলো ভাঁজ পরে গেছে তরীর। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। তার ঘরটা অন্যান্য ঘর থেকে ছোট, ছিমছাম। মেঝেতে সাদা চকচকে টাইলস। মাথার ওপর বৈদ্যুতিক পাখার ভটভট, খটখট শব্দ যেন আরও জ্বালাচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা স্যুপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে প্রায়। ঘরের বড় বড় দুটো জানালা গলিয়ে সন্ধ্যার কমলাটে আকাশ দেখা যাচ্ছে। তরী ফোন কানে রেখে ওদিকেই তাকিয়ে আছে। ওপাশে থাকা মাহাদ অবিরাম এটা সেটা বলে যাচ্ছে। উলটাপালটা কথা। সে একটারও জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ শুনছে শুধু। তরীর এমন উদাসীনতা দেখে সালেহা চিন্তিত সুরে বললো,
—“কি হইছে আপা? তুমি এমনে ফোন কানে দিয়া বইসা আছো ক্যান? জ্বর আসতাছে?”

আকাশ থেকে নজর সরিয়ে সালেহার দিকে একবার তাকালো তরী। উত্তরে শুধু মুচকি হাসলো। ফোনের ওপাশ থেকে তখন মাহাদ ভাঙ্গা অথচ দৃঢ় গলায় বলছিল, “তরীহ্— আমি মারপিট করি বলেই তুমি আমাকে পছন্দ করো না, তাই না? কথা দিচ্ছি, তুমি আমাকে ভালোবাসলে আমি সব গুন্ডামী ছেড়ে দিবো। একদম ভালো ছেলে হয়ে থাকবো। প্রমিজ!”
তরী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
—“এমন কথা আপনি কতবার দিয়েছে মাহাদ? আদৌ কখনো কথা রেখেছেন?”
—“তুমিও তো আমাকে কখনো ভালোবাসোনি তরী।”
ছোট্ট একটি বাক্য। অথচ এই বাক্যের ভেতরকার গভীরতা, অভিমান, হাহাকার, সব যেন তরীকে নিমিষেই মিইয়ে দিলো। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হতে লাগলো।
তরী অনুভব করছিল, মাহাদের দ্রুত শ্বাস নেওয়া। হাসফাস করা। মাঝে মাঝে জ্বরের ঘোরে ক্ষীণ গুঙিয়ে ওঠা। লোকটা কি বেশি অসুস্থ? ঔষধ খেয়েছে তো? সে প্রকাশ্যে জিজ্ঞেসও করলো,
—“ওষুধ খেয়েছেন?”
মাহাদের বাচ্চাসুলভ উত্তর, “খাওয়ানোর তো কেউ নেই।”
—“ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাখছি।”

ওমনি মাহাদ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “ফোন কাটবে না তরী। আরেকটু কথা বলবো।”
তরী শুনলো। কল কাটলো না। মাহাদই বলতে রইলো, “আমার ভীষণ একা একা লাগছে তরী। বাসায় কেউ নেই। কথা বলারও কেউ নেই। একটা বউও নেই। রুমও অন্ধকার করে রেখেছি। এখন যদি জ্বীন এসে আমাকে মেরে ফেলে, তখন কি হবে তরী? আমি কি আর তোমার সাথে দেখা করতে পারবো না?”

সালেহা কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। অবিশ্বাস্য চোখে গিলে খাচ্ছে যেন! তরীর অস্বস্তি লাগছে। সালেহার সামনে কথা বলতে জড়তা কাজ করছে খুব। অস্বস্তি নিয়েই বললো, “ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করুন মাহাদ। জ্বর আপনাকে পুরো কাবু করে ফেলেছে।”
তরীর কথার ধার ধারলো না মাহাদ। করুণ সুরে বললো, “আমার ক্ষুধা লেগেছে তরী। কিছু খাবো।”
—“বাসায় রান্না করা নেই?”
—“আছে তো! এসে নুডলস বানিয়ে ছিলাম। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তিতা তিতা লাগে।”
—“কাজের আন্টি আসেনি আজকে?”
—“বৃষ্টি হয়েছে না? বৃষ্টি হলে তো খালা আসে না।”

এমতাবস্থায় মাহাদের জন্য খুব মায়া হলো তরীর। মাহাদের মা নেই। বাবা যদিও আছে। কিন্তু তিনি গ্রামে থাকেন। একা একা ঢাকা শহরে পড়তে এসে মাহাদও বখে গেছে। সারাদিন মারপিট, এর সাথে- ওর সাথে লেগেই থাকে। বাবার টাকায় ফুটানি করে। বেহিসাব উড়োউড়ি। তরী মাঝে মাঝে ভাবে, সে এ ছেলেটার সাথে জড়ালো কিভাবে?
বুক চিঁড়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসতেই নিজেকে ধাতস্ত করলো তরী। হালকা কণ্ঠে বললো, “তিতা লাগলেও খেয়ে নিন মাহাদ। রাখছি। আর কথা বলতে পারবো না।”

সালেহা এতক্ষণ কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল। তরী কল কাটতেই উৎফুল্লতায় বেদিশা হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপা? তুমি পেরেম করো?”
তৎক্ষণাৎ চোখ বড় বড় করে তাকালো তরী। আলতো ধমক দিতে চাইলো, “কিসব জিজ্ঞেস করছো সালেহা? মাথা ঠিক আছে?”
কিন্তু সালেহা নাছোড়বান্দা। সে জেনেই ছাড়বে! তরীর কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “কও না আপা। তুমি কি পেরেম করো? ভাইজানের নাম কি? আমারে আগে কও নাই ক্যান?”

তরী নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো, “এমন কিছু না সালেহা। বেশি ভাবছো তুমি। আমার ফ্রেন্ড হয়। এমনিতে ফোন করেছে।”
সালেহা একটুও বিশ্বাস করলো না কথাটা। মন খারাপ করে মুখটা একটুখানি করে তাকিয়ে রইলো। যেন সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তরীর কথায়। তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। সালেহার গাল আদুরে ভাবে টেনে বললো, “রাগ করছো কেন সালেহা? তোমার জন্য আমি আসার সময় কিটক্যাট এনেছিলাম। খাবে না?”

কিটক্যাট চকোলেট পনেরো বছরের কিশোরী সালেহার ভীষণ প্রিয়। কিটক্যাটের কথা শুনতেই সে হেসে ফেললো। লাজুক কণ্ঠে বললো, “তুমি অনেক ভালা আপা।”
তরীও হাসলো। ওর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললো, “আমার ব্যাগটা নিয়ে আসো। কিটক্যাট দিচ্ছি।”

_____

তরীর মামী আয়েশা খাতুন এলেন রাত ন’টার সময়। তরী তখন ঘুমিয়েছিল মাত্র। কিন্তু নিচ থেকে আসা প্রবল চেঁচামেঁচিতে আর ঘুমাতে পারলো না। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলো। তারপর মাথায় কাপড় জড়িয়ে বেড়িয়ে পরলো রুম হতে।
আয়েশা খাতুন প্রায় সবার জন্য শপিং করে এনেছেন। সোফায় গোল হয়ে বসে আছে উনার আত্মীয়-সজন। তরীর বসার জায়গা নেই। সে ধীরে স্থির পায়ে সালেহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা খাতুন গম্ভীর চিত্তে তরীর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার, নাও।”

তরীও বাধ্য মেয়ের মতো নিলো। পাশ থেকে সালেহা ফিসফিসালো, “তোমারে কি দিছে আপা? দেহি? আমারে থ্রী-পিস দিসে দুইটা।”
উত্তরে প্যাকেট-টাই সালেহার হাতে ধরিয়ে দিলো তরী। সালেহা প্যাকেট খুলে ভেতরের কামিজ উল্টেপাল্টে দেখলো। এরপর ভীষণ ভাবে মুখ বিকৃত করে নাক ছিঁটকে বললো, “আমি কাজের মাইয়া দেইখা আমারে সুতির জামা দিসে। তুমি তো মেম সাহেবের ভাগনি লাগো, তোমারে এমন জামা দিসে ক্যান? বাকিগো তো ভালাটাই দিসে। এত হিংসা এই মহিলার ভিতরে! আল্লাহ!”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙ্গালো তরী। নিচু গলায় বললো, “তোমার বড় হয় সালেহা! ভাষা ঠিক করো।”
সালেহার এবার তরীর ওপরও রাগ উঠলো। এই মহিলা এত এত কথা শুনায় তরীকে! অথচ তরী প্রতিবাদও করে না। অসহ্য স্বজন প্রীতি! সে অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়ালো, “বড়-র ক্যাথাপুড়ি!”

প্রণয় নিঃশব্দে তরীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তরী খেয়াল করেনি প্রথমে। কানের কাছে প্রণয়ের ফিসফিসিয়ে বলা গাঢ় প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। সে বলছে, “তোমাকে অসুস্থ লাগছে। ঔষধ খাওনি?”
তরী একবার হকচকিয়ে তাকায়। এরপর আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মিনমিনিয়ে বলে, “খেয়েছি।”
—“গুড।”
প্রণয়কে দেখে তার চাচাতো বোন বলে উঠলো, “ভাইয়া, এদিকে এসে বসো। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

বলতে বলতে একটু সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিলো প্রণয়কে। কিন্তু নিজ জায়গা থেকে সরলো না প্রণয়। ঠায় দাঁড়িয়ে একরোখা উত্তর দিলো,
—“এখানে ঠিক আছি আমি। বসবো না।”

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here