বকুলতলা,০৫,০৬

0
325

বকুলতলা,০৫,০৬
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৫.
প্রণয়ের তীক্ষ্ণ চোখগুলো তরীকে পরখ করছিল। আবারও কিছু বলার আগেই গলায় খাবার আটকে একটুখানি কেশে উঠলো সে। তরীর খেয়ালে এলো, জগের পানি একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভরতে মনে ছিল না। জগটা নিয়ে হন্তদন্ত পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে আবার পানি নিয়ে ফিরে এলো তরী। তারপর প্রণয়কে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। মিনিটের ব্যাপার। এই এতটুকু সময়ে প্রণয় ছিল নির্লিপ্ত, গম্ভীর। দৃষ্টি ছিল খাবারের প্লেটের ওপর স্থির।
গ্লাসের সবটুকু পানি পান করে প্রণয় থমথমে গলায় বললো, “আপনাকে ভুলে তুমি করে বলে ফেলেছিলাম। দুঃখীত।”

এমন কথায় তরী একটু হকচকালো। সত্যি বলতে সে খেয়ালই করেনি, প্রণয় তাকে তুমি করে বলেছিল। ধীরগলায় জবাব দিলো, “সমস্যা নেই।”
প্রণয় প্রচন্ড দ্রুততার সঙ্গে প্লেটের খাবারটুকু শেষ করছে। যেন খাবার ছাড়াও কতশত কাজ বাকি তার! কত তাড়া! তরী নিঃশব্দে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড। তারপর সেখান থেকে চলে যেতে গিয়েও গেল না। টেবিলের সবকিছু একবার দেখে নিলো। মাছের তরকারি ধরেও দেখেনি প্রণয়। ওটা ওভাবেই এককোণায় অবহেলিত হয়ে পরে আছে। সাদা বাটি-টা থেকে একটুকরো মুরগির মাংস নিলেও ভর্তা আর সবজিই বেশি নিয়েছে সে। সবজি তখন প্রায় শেষের দিকে। তরী এগিয়ে গিয়ে বাটি-টা নিলো, রান্নাঘর থেকে আরেকটু সবজি আনার জন্য। ওমনি দারুণ ভাবে দিরুক্তি করে উঠলো প্রণয়, “লাগবে না। এটুকুতে হয়ে যাবে আমার।”

বাটি-টা রেখে দিলো তরী। চুপচাপ সরে দাঁড়াতেই প্রণয় আবার প্রশ্ন করলো, “আপনি এখনো উত্তর দেননি। ছোট ছোট বেণি করে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা কি আপনি ছিলেন?”
তরী মৃদু অস্বস্তি নিয়ে বললো,
—“হতে পারি। আমার বড় বোনও দুই বেণি করতো। আপনি কখনের কথা বলছেন?”
—“সম্ভবত পাঁচ থেকে ছয় বছরের ছিলেন আপনি। বাঁধন তখন ক্লাস টেনে পড়ে।”
—“আপনি আপুর নামও জানেন?”

বোকার মতো প্রশ্ন। না চাইতেও প্রণয় অল্প হেসে ফেললো। এমন হাসি, যা তরীর নজরে আসার আগেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
প্রণয়ের খাওয়া শেষ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বললো, “আমি সম্পর্কে আপনার মামাতো ভাই হই তরী। আপনাদের পরিবারের অনেক কিছুই জানি। জানাটা অস্বাভাবিকও না। সবাই জানে।”

তরীকে বিচলিত দেখালো। বক্ষস্থল ধুকধুক করলো প্রবল শব্দে। নেত্রজোড়া তুলতেই, চোখাচোখি হলো দু’জন। তরী খুব শান্ত, শিষ্ট, ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে। সর্বদা কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে মুখ অনেকটাই ঢেকে রাখে। নম্র, ভদ্র, রিনরিনে কণ্ঠস্বর যে কারো মন ভুলিয়ে দেবে। অথচ প্রণয়ের একটু আগের বলা কথাটা শান্ত স্বভাব পালটে দিলো মুহুর্তেই। ভীতু দেখালো পুরো মুখশ্রী। গলার স্বর নড়বড়ে হয়ে উঠলো, “কি জানেন?”
—“তিন বছর আগের ঘটনা ভুলিনি তরী।”

নিস্তব্ধ হয়ে গেল আশপাশ। তরী কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। প্রণয় তো তখন ছিল না ওখানে। তার সাথে ছোটবেলায় তরীর কোনো সখ্যতা ছিল বলেও মনে পরছে না। অথচ সে সব জানে।
প্রণয় নিজে নিজেই টেবিল গুছিয়ে রাখলো। নিজের প্লেট নিজে ধুঁয়ে রুমে চলে গেল। তরী তখন ধীরে ধীরে বানানো নুডলসগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো। খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছে। ঘুম প্রয়োজন। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।

মাহাদ তার ছেলেপেলে নিয়ে ভার্সিটির সামনে বসে আছে। দু’বছর হলো, ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে ফেলেছে সে। অনেকটা টেনেটুনে কোনোমতে পাস করে বাবার সম্মানটা বাঁচিয়েছে শুধু। এখন বেকার ঘুরে। চাকরি করা ঠিক তার পছন্দ না। মাহাদের মতে, অন্যের হুকুমে চলার মতো বাজে কাজ আর একটিও নেই। বাবার টাকা তো আছেই। বাপ না মরা পর্যন্ত ওগুলোই খেয়েদেয়ে শেষ করবে।

বিকাল তখন চারটে।
তরী মাত্রই ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছে। ক্লান্ত দেহের ললাট জুরে চিকচিক করা লবণাক্ত জলকণার অস্তিত্ব বিদ্যামান। নিশ্বাস ঘনঘন। আচমকা মাহাদকে নিজের পাশে টের পেল সে। লোকটার কপাল সাদা কাপড়ে মোড়ানো। সেই সাদা কাপড়টা আবার গুটি কয়েক চুল ঢেকে ফেলেছে। গালে আর থুতনিতে ছোট্টখাট্টো দু’টো বেন্ডেজ। জ্বর সেরে গেছে মনে হচ্ছে। তবুও তরী জিজ্ঞেস করলো, “এখন কেমন আছেন? জ্বর আছে এখনো?”
—“নেই।”
স্বল্প শব্দটি তরীকে যেন গাঢ় প্রশান্তি এনে দিলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। মাহাদ আবার বললো, “আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি।”
তরী বুঝে নিলো, কথাটির পেছনে মাহাদের সুপ্ত আবদারটি। তবুও কঠোর সেজে জিজ্ঞেস করলো, “তো? আমি কি করবো? কাজের আন্টিকে বলুন খাবার বানিয়ে দিতে।”
—“খালা বাড়িতে চলে গেছে। কয়েকদিন আসবেন না।”
তরী নিশ্চুপ। এবার আর কিছু বললো না।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গেল। আবহাওয়া তখন ভীষণ গুমোট। বৃষ্টি হবে না। কিন্তু মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের ডালপালা, পাতাগুচ্ছ, মানব দেহের মন– সব দুলে উঠছে। তরী আড়চোখে তাকালো পাশের মানুষটির পানে। লোকটা রাস্তা পার করতে গিয়ে তার ডান হাতটা ধরেছিল। এখনো ছাড়েনি। বরং দৃঢ় বাঁধনে ধরেই আছে। তরীও আর ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না।

—“আপনি ক্লান্ত হন না মাহাদ?”
প্রশ্নটা তরীর। অনেকটা অধৈর্য, হতাশার।
মাহাদ কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো, “ক্লান্ত হবো কেন?”
—“এই যে, আমি কখনো আপনার হবো না জেনেও আমার পেছনে সময় নষ্ট করছেন। ক্লান্ত হচ্ছেন না?”
মাহাদের নেত্রজোড়া সুগভীর মেয়েলি নেত্রের পাপড়িগুচ্ছ একটা একটা করে গুনতে চাইলো যেন। মেয়েটির চোখের পাতার পিটপিটানো গুনতে চাইলো। প্রগাঢ় চাহনি নিষ্প্রভ হলো। শিরা-উপশিরায় নিদারুণ উষ্ণতা ছড়িয়ে বললো, “আমি বলেছিলাম, আমি অপেক্ষা করতে জানি। আর এই অপেক্ষায় ক্লান্তি নেই।”

তরী মানলো না একেবারেই। ক্ষীণ আর্তনাদের সুরে বললো, “আপনার সব কথা মিথ্যা। ক্লান্তি আসে, আপনি শিকার করেন না। আপনি আর আমার কাছে আসবেন না। আমি কখনো দূর্বল হবো না আপনার ওপর। শুনতে পেয়েছেন আমার কথা?”
সামনের মানুষটা চুপচাপ শুনলো। নিগূঢ় চোখে চেয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড, মিনিট। তারপর আরেকটু সেকেন্ড। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরীর হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বললো, “ক্ষিধে পেয়েছে তরী? চলো, কিছু কিনবো। আমি খাবো না। তোমাকে খাবার কিনে দিয়ে চলে যাবো।”

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

৬.
তরী তখন নতুন নতুন ঢাকা শহরে এসেছে। কিচ্ছু চিনে না। প্রণয়ের বড় ভাই আবদুল ওকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়েছিল। বিশাল বড় ভার্সিটি! চোখ ধাধানো সুন্দর! তরী বড় বড় চোখে আশপাশটা দেখছিল। মাঠের কাছাকাছি আসতেই দেখলো, একটা লম্বা, চওড়া, সুন্দর মতো ছেলে ক্লান্ত শরীরে ঘাসের ওপর বসে আছে। চোখ বুজে অবিরাম আওড়াচ্ছে, “পানি, পানি, পানি।”

আরেকটু খেয়াল করতেই টের পেল, ছেলেটার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ রক্ত লেগে আছে। ঘর্মাক্ত কপালে গুটি কয়েক ত্যাছড়া আঁচড়। হাত, পা, পরনের শার্ট, জিন্স— সব ধূলোবালিতে মাখোমাখো। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তরী আনমনে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
ঠিক তক্ষুণি ছেলেটার চোখা দৃষ্টি পরলো তার ওপর। ঘাড় কিঞ্চিত বাঁকানো। কি দারুণ সূক্ষ্ণ চাহনি! ডান ভ্রুটা উঁচিয়ে হঠাৎ-ই বলে উঠলো,
—“এই মেয়ে! পানি আছে?”
ভীতু তরী হকচকালো। এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে নিলো একবার। তারপর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা সময় নিলো না। ঢকঢক করে প্রায় বোতলের অর্ধেকটুকু পানি শেষ করে ফেললো। এরপর কপাল কুঁচকে বললো,
—“বসো।”
—“জি?”
—“আমার পাশে বসো।”

কণ্ঠে একরাশ বিরক্তির আভাস। তরী বসলো না। নিমিষেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো, “আমার বোতলটা দিন।”
ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো এবার। হাত ঝেড়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল দশটা বাজছে। ছেলেগুলোর সঙ্গে হাতাহাতি করার সময় ঘড়ির স্ক্রীন ফেটে গিয়েছিল। ফেটে যাওয়া স্ক্রীন দেখে মনে মনে আফসোস করলো সে। আহ! তার সখের পাঁচ হাজার টাকা দামের ঘড়ি!
তরী তখন কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে আছে। তার বিরক্তি লাগছে। ছেলেটার ব্যবহার ভীষণ অদ্ভুদ। দেখে তো বখাটে মনে হচ্ছে না। তবে মুখের ক্ষতগুলো স্পষ্ট খারাপ ছেলে হওয়ার স্বীকারোক্তি জানান দিচ্ছে। তরী বোতলটা আর নিলো না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলেই ছেলেটা আচমকা প্রশ্ন করলো, “নাম কি তোমার?”
তরী রয়ে, সয়ে উত্তর দিলো, “তরী মোশারফ।”
ছেলেটা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো, “তরী অর্থ কি জানো? নৌকা।”

তরী শুধু তখন এক ঝলক তাকিয়েছিল ছেলেটার দিকে। মুখশ্রীতে যেন আগুনের ফুলকি জ্বলজ্বল করছে। সে আর দাঁড়ালো না। অসহ্য ভঙ্গিতে চলে গেল। তবে যেতে যেতে ছেলেটার উঁচানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল, “মেয়ে, তুমি কোন নদীর নৌকা?”

পরে জানা গিয়েছিল, ছেলেটার নাম মাহাদ। বিকাল বেলা প্রতিদিন তাকে ভার্সিটির গেটের সামনে দেখা যায়। মাহাদের বাইকে বসার ভঙ্গিমাটাও দারুণ। সর্বদা রাজকীয় ভাবসাব নিয়ে থাকে। তাকে ঘিরে থাকে দশ-বারো জন অল্প বয়সী ছেলেপেলে।
মাহাদের যন্ত্রণায় তরী ভার্সিটি আসতো লুকিয়ে লুকিয়ে। তবুও যেন চতুর লোকটির হাত থেকে নিস্তার পেত না। দিনেদিনে মাহাদ যেন কেমন হয়ে উঠে। আগে তরীর সাথে কথা বলতো বুঝে শুনে, ঠাট্টার সুরে। তরী বুঝতো, মাহাদ শুধুমাত্র তার সাথে মজা করার জন্যই এসব করতো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেই মজাটা যেন লাগামহীন, বেপরোয়া স্বভাবে পালটে যায়। দিন, ক্ষণ মনে নেই তরীর। মাহাদের পাগলামির শুরুটা তরীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সে তো কখনো কারো ভালোবাসা পায়নি। হঠাৎ আসা এই গাঢ় ভালোবাসাটা তার জন্যে দৃঢ় কালবৈশাখীর ঝড় বইয়ে এনেছিল।

রাস্তাঘাটে আজকে অনেক জ্যাম। আধঘন্টার রাস্তা পেরোতে পুরো একঘণ্টা লেগেছে তরীর। তখন আকাশে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। হলদেটে আভা গায়েব হয়ে ঘন আঁধার এসে হানা দিয়েছে ধরণীতে। তরী ধীর পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। পা থেকে জুতা খুলে জুতার স্ট্যানে গুছিয়ে রাখলো।
আয়েশা খাতুন বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। তরীকে দেখে বাঁকা চোখে তাকালেন।

—“তোমার ভার্সিটি ছুটি দিয়েছে কখন?” আয়েশা খাতুনে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। তরীর সামলে উঠতে সময় লাগলো। চোখ পিটপিট করে বললো,
—“সাড়ে চারটায় মামী।”
—“এখন কয়টা বাজে?”
তরী নজর ঝুঁকালো। মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো,
—“সাতটা।”
আয়েশা খাতুনের নজর টিভির পর্দায় স্থির। এতক্ষণ গম্ভীর গলায় কথা বললেও এবার খানিকটা ঝাঁঝালো শোনালো তার কণ্ঠ, “এটা তোমার নিজের বাসা না যে যখন ইচ্ছা তখন চলে আসবে। টাইম মেইনটেইন করা শিখো। পরেরবার এসব সহ্য করবো না আমি।”

জবাবে তরী ছিল নিরুত্তর। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে মৃদু মৃদু নিশ্বাস ফেলছিল। ওটা কি শুধু ভেতর থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাস ছিল? আটকে আসা দীর্ঘশ্বাস তো একেই বলে।
সালেহা আশেপাশে নেই। হয়তো রান্নাঘরে কাজ করছে। ঘরে শুয়ে বসে থাকতে তরীর ভালো লাগছে না। কোনোমতে চুল হাতখোপা করে নিচে নেমে এলো সে। ডাইনিং টেবিলে প্রণয় বসে আছে। পরনে ডাক্তাদদের এপ্রোন। ফ্রেশ হয়নি বোধহয়। ফোনে কার সাথে যেন খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে। তরী পাত্তা দিলো না অত। মাথা নুইয়ে ফেললো। প্রণয়ও তখন কথা বলা শেষে কান থেকে ফোন নামিয়েছে। শান্ত, স্থবির দৃষ্টি একটুর জন্য আটকে গেছে তরীর নমনীয় মুখপানে। আচমকা শুধালো, “আপনার কি ভীষণ মন খারাপ তরী?”

_____________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here