বকুলতলা,২৬,২৭

0
221

বকুলতলা,২৬,২৭
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২৬.
ওইতো, ড্রেসিংটেবিলের উপরে সযত্নে দুটো ওয়ালেট পরে আছে। দুটোর মাঝে একটা প্রণয়ের বাবা কিনেদিয়েছিল। আরেকটা প্রণয় নিজে কিনেছিল। কিন্তু হিসাব মতে প্রণয়ের তিনটে ওয়ালেট। তৃতীয়টা ওর হাতে। প্রথমটা যখন ছিঁড়ে গিয়েছিল, বাবা তখন এই ওয়ালেটটা কিনে দিয়েছিলেন প্রণয়কে। প্রণয়ের খুব প্রিয় ওয়ালেট ছিল এটা। কালো রঙের। ক্রেডিট কার্ড রাখার জন্য অনেকগুলো খাপ। খাপগুলোর মাঝখানে তরীর ছোট্টকালের ছবি গুঁজে রাখা। শোয়ার সময় ওয়ালেটটা সাথে নিয়ে ঘুমাতো প্রণয়। এক মুহুর্তের জন্য হাত ছাড়া করতো না। কাউকে ধরতে দিতো না। কি যে বাচ্চামো করতো! কিন্তু এখন আর সেই বাচ্চামো নেই। অবহেলায়, অনাদিত ভাবে ড্রেসিংটেবিলে পরে থাকে ওয়ালেট-টা। প্রণয়ের খবর থাকে না। ছুঁয়েও দেখেনা কতদিন! তবে মাঝে মাঝে নিকষ আঁধারে চুপচাপ বসে ওয়ালেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, ওয়ালেট খুলে একবার তরীর ছবিটা দেখবে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। দূরত্বটা তরীর বিয়ের দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখতে শিখেছিল সেখান থেকেই। এরপর আর কিছু ঠিক হয়নি। কোনোদিন হবে কি-না প্রণয়ের জানা নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের ওয়ালেটটা ড্রেসিংটেবিলে রাখলো প্রণয়। ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রী ভাবে ঘেমে আছে শরীর। ভীষণ ভাবে গোসল প্রয়োজন।

তরী যে গ্রাম থেকে চলে এসেছে, প্রণয় জানতো না। নিচে এসে সালেহার সঙ্গে তরীকেও টেবিলে খাবার গোছাতে দেখে খানিকটা থমকালো সে। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড। গ্রামের নিজস্ব আবহাওয়ায় মেয়েটা একটু ফর্সা হয়েছে কি? হয়েছে বোধহয়। চেহারাটা জ্বলজ্বল করছে। তরীর পাশ ডিঙ্গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে প্রণয় আস্তে করে শুধালো, “কখন এসেছেন?”

তরী প্রণয়ের দিকে তাকালো না। ভাতের বাটিটা হাতের কাছে এগিয়ে দিলো শুধু। প্রণয় আবার বললো, “কিছু জিজ্ঞেস করেছি তরী। উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
—“দুপুরে এসেছি।”
—“বাসে করে?”
—“হ্যাঁ।”
প্লেটে দু’চামচ ভাত বাড়লো প্রণয়। তরকারির বাটি থেকে অল্প সবজি নিলো। খেতে খেতে আচমকা হেসে বললো, “আপনি অনেক বড় হয়ে গেছেন তরী। আগের আর ছোট্ট তরী নন।”
—“আপনিও বদলে গেছেন ভাইয়া। আগে কথায় কথায় অতীত টেনে আনতেন না।”

কথাটা মোটেও সহজ না। খুব কঠিন, তিক্ত, পীড়াদায়ক। প্রণয় শুনলো চুপচাপ। পেটের ক্ষুধাটা মিইয়ে গেল। বুকের ভেতর কোথাও সূক্ষ্ণ ব্যথারা চিনচিন করছে। নিঃশব্দে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সে বললো, “আমি অর্ণবকে ভুলতে পারি না তরী। কেন যেন আপনাকেও ভুলতে দিতে চাইতাম না।”
তরীর ঘৃণা হলো খুব। সেই সাথে কপাল কুঁচকে গেল দৃঢ় প্রশ্নে। জিজ্ঞেস করলো, “অর্ণবের সাথে আপনার কি? ওকে কেন আপনি ভুলতে পারবেন না?”

প্রণয় চোখ তুলে তাকালো। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া প্রখর ভাবে ঘুরতে লাগলো তরীর মুখের আশেপাশে। মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে আছে। দৃষ্টি কি দারুণ কঠিন! শুধু প্রণয়ের বেলাতেই এই কাঠিন্যতা। ঠোঁট হালকা কাঁপছে। তরী কি রেগে গেছে খুব? প্রণয়কে বকছে? মনে মনে গালিটালি কিছু দিচ্ছে নাকি? দিতেও তো পারে। সে তো প্রণয়কে দেখতেই পারে না। মারাত্বক হতাশ হয়ে প্রণয় কেমন অন্যমনস্ক হলো, “তরী? আমি আপনাকে ভালোবাসি। সেই ছোট থেকে।”

সাথে সাথে একটা ছোট্ট আওয়াজ হলো। সালেহা ‘আপা’ বলে ডাকলো যেন। খুব ক্ষীণ শব্দে। সে যে এতক্ষণ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা গিলছিল, কেউ খেয়াল করেনি। তরী নজর তুলে তাকালো একবার। মেয়েটার ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকা অস্বস্তিতে ফেলছে। প্রণয়ের একটু আগের কথাটাও ভেতরটাকে চমকে দিচ্ছে। এমন মজা করার মানে কি?

—“মাথা ঠিক আছে আপনার? কি আবলতাবল বকছেন?”
প্রণয় আরেকদফা হতাশ হলো। নির্বিকার মন বিরক্ত হলো। মেয়েটা আজও বুঝলো না তাকে। গুরুত্ব দিলো না তার কথাকে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো, “ঠিক আছি আমি। আবলতাবলও বকছি না। শুধু–”
তরী বলতে দিলো না,
—“চুপ করুন ভাইয়া। এতটা– এতটা বাজে কেন আপনি? আপনাদের বাসায় থাকি বলে সস্তা পেয়ে বসেছেন?”
—“সস্তা পেয়ে বসিনি তরী। শুধু আপনাকে বোন হিসেবে দেখছি না।”

তরীকে স্তব্ধ করে প্রণয় চলে যেতেই সালেহা কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু তরী তার আগেই ধমকালো, “একটা কথাও না সালেহা! চুপচাপ কাজ করো।”
বাধ্য হয়ে সালেহাও আর কিছু বললো না। কিন্তু তার ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমেনি।

লাইব্রেরী ঘরের জানালাটা সশব্দে খুলতেই বাতাস সুরসুর করে ঢুকলো যেন। পর্দার বাঁধা মানলো না। তবুও সাদা পর্দাটা একপাশে গুটিয়ে রাখলো প্রণয়। পাঁচ নম্বর তাক থেকে সেই বইটা নিলো। আজ আর ৮১ নম্বর পাতায় কিছু লিখলো না। চলে গেল একদম শেষ পাতাটায়। পাতাটা ফাঁকা পুরো। উপরের দিকে যদিও একদুটো লাইন আছে। লাইনগুলো একবার বিড়বিড় করে পড়ে এর দু’আঙুল নিচ থেকে কলম চালালো প্রণয়,

‘আমি একটু আগে ওকে আমার মনের কথা বলে দিয়েছি একাকীত্ব। কিন্তু ও আমাকে এখনও বুঝেনি। আমাকে ও ভালোবাসে না। পছন্দও করে না। তীব্র কষ্টে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি একাকীত্ব! মনে হয়, মনে হয় যেন শ্বান নিতে পারছি না। আমার এ কি রোগ হলো একাকীত্ব? আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। কেন যে ওকে মনের কথা আগে বললাম না! ওর বিয়ের আগেও বলতে পারিনি। এখনো না।
জানো? ওকে প্রতিদিন একটা ছেলের সাথে দেখি আমি। মাহাদ নাম ছেলেটার। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার ভেতরটা জ্বলে যায়। সহ্য করতে পারি না। স্বার্থপরের মতো বারবার অতীত টেনে এনে বুঝাই, ছেলেরা ভালো না। ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চাই, মাহাদ ছেলেটাও ভালো না। আমি জানি, আমি সত্যিই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। হয়তো হয়েও গেছি। আমি এই বইয়ের মতো পরিণতি চাই না একাকীত্ব। প্রিতমের মতো ভালোবাসা হারাতে চাই না। আমার সত্যি কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট কেন আমিই পাচ্ছি? আমি ভালো থাকতে চাই। একটু ভালোবাসা চাই। অথচ! অথচ আমার আশেপাশে কেউ নেই। সব শূণ্য, ফাঁকা, খালি।

২১ আগষ্ট, ২০২১’

_____________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

২৭.
গ্রাম থেকে আসার পথে তরীর হাতে এক হাজার টাকার পাঁচটা কচকচে নোট ধরিয়ে দিয়েছিলেন বরকত সাহেব। তরী এ টাকাগুলো এখনই খরচ করতে চায়নি। কিন্তু প্রণয়ের মনের কথাগুলো জানার পর সে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছে। এমনিতেও আয়েশা খাতুন তাকে সহ্য করতে পারেন না। এখানে ওর থাকাটাও উনার পছন্দ না। এতদিন তরী হলে সীট পাওয়ার ব্যর্থ অপেক্ষা করলেও এখন ভার্সিটির তিনজন মেয়েকে নিয়ে ছোটখাটো বাসা খুঁজবে বলে ভেবেছে। শুক্রবার বিকালে বেরও হতে চেয়েছিল। বাঁধ সাধলেন প্রণয়ের বাবা রফিক।
তরী তখন মাত্র তৈরি হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। রফিক টেবিলে বসে নিত্যদিনের মতো চা খাচ্ছেন। ওকে এভাবে পরিপাটি বেশে দেখে প্রশ্ন করলেন, “কোথাও যাচ্ছো?”

ব্যাগের টাকাগুলো গুণে দেখছিল তরী। মোটে বারো হাজার পাঁচশত বিশ টাকা আছে ওর কাছে। পাঁচ হাজার থেকে বাকিগুলো তরীর পরিশ্রমের টাকা। ওইযে? মেলায় কাজ করে উপার্জন করেছিল না? ওগুলো। ওরা চারজন মিলে ভেবে রেখেছে, আট হাজারের উপরে কোনো বাসা দেখবে না। আরও তো খরচ আছে! কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল কত কি!
রফিক ডাকতেই পা থামালো তরী। উত্তরে নম্র স্বরে বললো, “জি মামা। নতুন বাসা দেখতে যাচ্ছিলাম।”
তিনি কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ ফেলে বললেন,
—“নতুন বাসা দেখতে যাচ্ছো মানে?”
—“হলের অবস্থা তো আপনি ভালো জানবেন মামা। অনেক অপেক্ষা করেও একটা সীট পাইনি। তাই এখন ভাবছিলাম কয়েকজন মিলে ভাড়া বাসা নিবো। আপনাকে তো আগে বলেছিলামই।”
রফিক একটু গম্ভীর হলেন যেন। থমথমে গলায় বললেন, “আমরা কি তোমার কম আদরযত্ন করছি? খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সাথে?”
সালেহা টেবিল গোছাচ্ছিল। এ কথা শুনে নিজ মনে বিড়বিড়ালো, “আপ্নে খারাফ আছরণ না কইরলে কি হইবো? আপ্নের বউই তো আসল শয়’তান! কু’টনি!”
তরীর মাথা নিচু করে বললো, “না মামা। এমন কিছু না।”
—“তাহলে?”

মাথাটা আরেকটু নুয়ালো তরী। হাঁসফাঁস করলো, “আমি এখানে থাকায় আপনাদের অনেক অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। বাবাও বলছিল নতুন বাসা দেখতে।”
—“তুমি কি ইনিয়েবিনিয়ে আয়েশার কথা বলছো? ওকে আমি বুঝাবো। এ নিয়ে তোমাকে ও আর কিছু বলবে না। যতদিন ঢাকা শহরে থাকার এখানেই থাকবে। অন্যকিছু শুনতে চাচ্ছি না।”
এখানে না থাকার মূল কারণ তো শুধু আয়েশা খাতুন নন। প্রণয়ও। তরী তাই শেষ চেষ্টা চালালো, “কিন্তু আমি তো আমার বান্ধবীদের বলে দিয়েছি আজকে বাসা খুঁজতে যাবো।”
রফিক নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “তাহলে এখন মানা করে দাও। এটা আর তেমন কি? বান্ধবী হয় তোমার। নিশ্চই ঝামেলা করবে না?”

অগত্যা তরী সত্যিই মানা করে দিলো। মনও খারাপ হলো ভীষণ। তার আর মন টানছে না এখানে থাকতে। বাবার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। রফিকের সাথে কথা শেষ করে তরী আর ঘরে গেল না। মন মেজাজ ভালো করতে একা একাই বাহিরে হাঁটতে বেরুলো। আনমনা সে কিসব উলটাপালটা ভাবনায় মসগুল হয়ে প্রথমে এলাকা, তারপর মেন রোডে পৌঁছে গেল। তবুও তরীর হাঁটা শেষ হচ্ছে না। হাঁটতে ভালো লাগছে। বাতাস নেই, তেজস্বী সূর্য চারিদিকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। গরম খুব। তবুও একটুও গ্লানি ভাব আসছে না। বরং ভালো লাগাটা বাড়ছে। আশ্চর্য রকম ভালো লাগায় সিক্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
ভাবনায় ছেদ ঘটাতে ফোনটা তক্ষুণি বেজে উঠলো। মাহাদের কল। তরী প্রথমে কেটে দিলো। আবার কল করতেই রিসিভ করলো। সাথে সাথে ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠ, “কোথায় তুমি?”
—“কেন?”
—“আগে উত্তর দাও।”
—“একটু বাহিরে বের হয়েছি।”
—“তারমানে আমার দৃষ্টিশক্তি এখনো ঠিক আছে।”

তরী বুঝলো না, “মানে?”
মাহাদের কণ্ঠে দারুণ রসিকতা, “মানে, অনেক্ষণ ধরে দেখছিলাম একটা শুকনা কাঠির মতো বিশ্রী মেয়ে হেলেদুলে চোখের সামনে টইটই করছে। আমার মনে হচ্ছিল ওটা তুমি। এখন নিশ্চিত হলাম।”
তরী বাকি কথা শুনলো না। ভ’য়ংকর তেঁতে উঠলো, “আমি বিশ্রী?”
—“নাহ্! গাঁজাটিও মনে হচ্ছিল। যেভাবে হেলেদুলে হাঁটছো!”

আপনাআপনি হাঁটতে হাঁটতে নিজের পায়ের দিকে তাকালো তরী। কই? ঠিকই তো আছে। কিছু বলতে নিবে, তার আগেই কলটা থেকে গেল। পরপরই পেছন থেকে মাহাদের স্পষ্ট গলা শুনতে পেল, “নিজের দোষ কেউ নিজে দেখতে পারে না মেয়ে। তারচে’ আমি ভিডিও করছি, তুমি স্লো-মোশনে হাঁটা দাও। তারপর ভালো ভাবে দেখতে পাবে।”
মাহাদ হাসছে। অল্প শব্দে। আবার কালো রঙের একটা পাঞ্চাবীও পরেছে দেখছি! তরী কেন যেন রাগ করতে পারলো না। নিঃশব্দে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি ভূতের মতো কোত্থেকে হাজির হলেন?”
—“এখানেই ছিলাম। ওইযে টংয়ের দোকান দেখছো? ওখানে চা খাচ্ছিলাম।”

তরী টংয়ের দোকানটার দিকে তাকালো। সেখানে মাহাদের দুজন বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এদিকেই চেয়ে আছে তারা। তরীর অস্বস্তি হলো। কিছু না বলেই আবারও সামনে পা বাড়ালো। পিছু পিছু মাহাদও আসছে।

—“কোথায় যাচ্ছো?”
তরী ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো, “কোথাও না। হাঁটতে বের হয়েছি।”
—“তাহলে চলো, ঘুরবো। দাঁড়াও আমি আমার বাইক নিয়ে আসছি।”
—“আমি বলেছি আমি আপনার সাথে ঘুরবো?”
—“আমি তো ঘুরবো।”
—“যেখান থেকে এসেছেন সেখানে যান মাহাদ। বিরক্ত করছেন আপনি।”

মাহাদ গেল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। একফাঁকে তরীর আঙুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। তরী প্রথমে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পরে হাল ছেড়ে দেয়। মাহাদকে আর ঠিক কি বললে লোকটা ওকে ছেড়ে দেবে? কম তো চেষ্টা করেনি। তাকে ঘৃণা করার জন্য ধ’র্ষি’তার কথাটাও না চাইতে বলে দিয়েছে। অথচ লোকটা আগে থেকেই সব জানতো। তবুও পিছু ফিরেনি। তরী মাঝে মাঝে খুব ভাবে, মাহাদ কি সত্যিই তরীকে এতটুকুই ভালোবাসে? নাকি তার ভালোবাসায় খুঁত আছে? অর্ণবের মতো হবে না তো? তরীর ভয় হয়। সে আর কারো প্রতি দূর্বল হতে চায় না।
তরী মৃদু স্বরে ডাকলো, “মাহাদ?”
মাহাদের ছোট্ট উত্তর, “হু?”
—“আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
—“মানা করেছি নাকি আমি? বলে ফেলো।”

তরী কিছুক্ষণ চুপ রইলো। গলা কাঁপছে। বলে দেওয়া উচিত কি? সে কি এক্ষুণি বলে দিবে? পরে মনে হলো, এখনই বলা দরকার। লোকটার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে। প্রশ্রয় না দিয়ে এটা এখানেই থামাতে হবে।

—“আপনি আমার অতীতের সব জানলেও একটা সত্য আপনার অজানা মাহাদ।”
—“আমি আমার অনুমতি নিয়ে নিচ্ছি তরী। এখন কথা বলা তোমার জন্য নি’ষিদ্ধ।” মাহাদের ঠান্ডা কণ্ঠ।
তরী তবুও বললো, “আমি কখনো মা হতে পারবো না মাহাদ। এটা আমার বাবা ছাড়া কেউ জানে না।”

কথাটা যথেষ্ট ছিল মাহাদকে চমকে দিতে। কিন্তু দমিয়ে দেওয়ার জন্য একদমই না।
—“আমার আপত্তি নেই।”
তরী আর্তনাদ করলো, “আপনার মাথা আসলেই গেছে মাহাদ। বেপরোয়া স্বভাব থেকে বেড়িয়ে আসুন। বাস্তবতা চিনুন।”
—“তো? আমি কল্পনায় আছি নাকি?”
ত্যাড়া কথা! এবার একটু রেগেই গেল তরী, “মাহাদ! বুঝতে পারছেন না কেন? আমি কখনো মা হয়ে পারবো না। আপনি কি চাইবেন এমন একজনকে নিজের জীবনে জড়াতে, যে কখনো আপনাকে সন্তানের সুখ দিতে পারবে না?”
—“চাইবো।”
—“আপনার পরিবার তো মানবে না।”
—“মানবে। আমি বললেই মানবে।”
—“আর সমাজ?”
—“সমাজ কি? সমাজ দিয়ে কি আমি খ্যাতা পুড়বো? ওরা আমাকে খাওয়ায় না পরায়?”
হতাশায় লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিলো তরী। একহাতে কপাল চেপে ধরলো। লোকটা এত অবুজ! এ বয়সে এমন বাচ্চামী মানায়?

তরীর হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলো মাহাদ। আড়চোখে দেখলো, মেয়েটা আওয়াজ ছাড়া কাঁদছে। চোখ বেয়ে তরতর করে জল গড়াচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখটা মারাত্বক গম্ভীর করে নিলো মাহাদ। তেঁতো মেজাজে বেশক্ষণ চুপ রইলো। শান্ত করলো নিজেকে। এতক্ষণ রেগেমেগে তরীর ওপর চেঁচিয়ে কথা বলে ফেলেছে ভুলে। কিন্তু এতে তার একটুও অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে না। বরং মেয়েটার ইদানিং কথায় কথায় কান্না ভেতর থেকে গুমরে দিচ্ছে। একটা প্রশ্ন ভীষণ ভাবে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, মেয়েটা তাকে কেন ভালোবাসে না?

সময় গড়িয়ে গেছে অনেকটা। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার আগমন ঘটছে একটু একটু করে। তরীর কান্না থেমেছে। হাতটা তখনো মাহাদের হাতের দখলে। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেকটা দূরেই চলে এসেছে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মাহাদ বলতে শুরু করলো,
—“তোমাকে আগেও বলেছিলাম তরী। বাবাকে আমি খুব ভালোবাসলেও তার সাথে আমার সম্পর্ক কোনো কালেই ভালো ছিল না। আমার ছোটবেলার মধুর স্মৃতির কোথাও বাবা নেই। তবে হ্যাঁ, কষ্টের স্মৃতিতে তিনি বারবারই আছেন। দাদা মারা যাওয়ার পর বাবার নে’শা করার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অভ্যাসটা আসক্তিতে পরিণত হতেও সময় লাগেনি। আমার মা খুব ধার্মিক ছিলেন। এসব পছন্দ করতেন না। দাদিও মানা করতেন। এই মানা করার জন্য কম গালি খেতে হয়নি আমার মা আর দাদিকে। কারো বাঁধা মানতেন না বাবা। সারাদিন নে’শাপানি নিয়ে পরে থাকতেন। একসময় তো বাসাতেও খাওয়া শুরু করে দিলেন। নূপুর তখন অনেক ছোট। আট বছর হবে হয়তো। বাবার দেখাদেখি ও-ও চুরি করে একবার সিগারেট মুখে দিতে গিয়েছিল। মা সেটা দেখে ওকে অনেক মারলেন। রাতে বাবা আসার পর বাবার সাথেও ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। বাবা তখন পুরো মাতাল। ঠিক করে তাকাতে পারছিলেন না। তবুও গায়ের জোড় ছিল প্রবল। সেবার প্রথম মাকে বাবার হাতে মার খেতে দেখেছিলাম। প্যান্টের বেল্ট দিয়ে আমার সামনেই আমার মাকে মারা হচ্ছিল। মায়ের এক একটা আর্তনাদ আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। দাদি আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেও আমি যাচ্ছিলাম না। কাঁদছিলাম, দেখছিলাম আমার অপরিচিত বাবাকে।
এরপর প্রতিদিনই এমন চলতো। আস্তে আস্তে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। মা বাবাকে শান্ত মাথায় বুঝাতে চাইতো। নে’শা করা ছাড়তে বলতো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। বরং পরিস্থিতি হাতের একদম বাহিরে চলে গেল। দিন যেত, রাত যেত। বাবা দুইতিন দিন বাসায় ফিরতেন না। যা আগে কখনো হয়নি। যতই নে’শা করুক, গভীর রাত হলেও বাবা বাসায় ফিরতেন। তার আচরণও আগের থেকে আরও হিং’স্র হয়ে গিয়েছিল। পরে একদিন জানতে পারলাম, আমাদের দুই গ্রাম পরে একটা ফ্যাক্টরিতে সেলিনা নামের এক মহিলা কাজ করত। তার সাথেই বাবা পর’কীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন। মা এসব আর সহ্য করতে পারছিলেন না। আমাদের অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে, ঘরে খাওয়ার কিছু পেতাম না। স্কুল ফি আটকে ছিল মাসের পর মাস। বাবা ঠিকমতো টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল তখন শুধুই সেলিনা নামক বিশ্রী মহিলাটি। আমার এখনো অবাক লাগে জানো? মা আমার এত ধার্মিক! সে কিভাবে পারলো বিষ খেতে?

আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ক্রিকেট খেলে মাত্রই বাসায় ফিরেছিলাম আমি। সন্ধ্যা বেলা। উঠানে দেখি মা মাটিতে শুয়ে গড়াচ্ছে। মুখ দিয়ে বেরুনো সাদা ফ্যানাগুলো মাটিতে গরিয়ে পরছে। চোখ উলটে খিঁচুনি দিয়ে উঠছে বারবার। পাশেই দাদু বসে কাঁদছেন। আমার ছোট্ট বোনটা মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ছাড়ছে না। আমি অতও ছোট ছিলাম না। পনেরো বছর। কিন্তু কাউকে মারা যেতে, বিষ খেতে কখনো দেখিনি। আমার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। আশেপাশে বাবাকে খুব করে খুঁজছিলাম। দাদু আমাকে দেখেই প্রতিবেশীর কাউকে ডাকতে বললেন। সে বুড়ো মানুষ। হাঁটতে পারে না। দু’কদম এগোলেই হাপিয়ে যায়। গলায় জোড়ও তেমন নেই। তবুও মায়ের মুখে আঙুল দিয়ে বমি করানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি পাগলের মতো ছুটছিলাম সাহায্যের জন্য। পাশের বাসার আঙ্কেলকে সাহায্যের জন্য পেয়েছিলামও।
মাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। কয়েক মিনিট চিকিৎসাও করানো হলো। কিন্তু বাঁচানো গেল না। আমার মাটা আমাকে সেদিন একেবারেই ছেড়ে চলে গেল তরী। ভাত খাইনা বলে রাগ করে কোথাও লুকালো না। একটু পর ফিরেও এলো না।
বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতে নুপুরকে নিয়ে শহরেও এসেছিলাম আমি। ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখি নি। অথচ আমারই দোষে আমার বোনটা তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে ফেললো। রোড এক্সিডেন্টে ওর পা থেতলে গেল। অথচ আমি কিছুই করতে পারিনি। মায়ের বেলায়ও পারিনি। আমি একটা ব্যর্থ সন্তান তরী। ব্যর্থ ভাই। ব্যর্থ প্রেমিক।”

এটুকু বলে মাহাদ একটু থামলো। তরী স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ টলমল করছে কি? করছে। বুক ভারী হয়েছে কি? হ্যাঁ, হয়েছে। মাহাদ শান্ত কণ্ঠটাকে আরেকটু শান্ত করলো। অস্বাভাবিক নির্লিপ্ততা নিয়ে বলতে রইলো, “এই যে, তরী নামের তুমি মেয়েটা। শাড়ি পরা তোমাকে বকুলফুল কুড়াতে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল খুব। অথচ ভালোবাসার আগেই তুমি বিবাহিত হয়ে গেলে। আমিও পিছিয়ে এলাম। পরে আবার জানলাম তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। বিয়ের আগে ধর্ষ’ণও করা হয়েছিল নাকি। মিথ্যা বলবো না, আমার খারাপ লেগেছিল। ওইযে, ভালো লাগাটা ছিল না? ওটাও তোমার বিয়ের পর আর অনুভব করিনি। কিন্তু ভার্সিটিতে তোমাকে আবার দেখে আমার সেই ভালো লাগাটা আবারও ফিরে এসেছিল। তোমাকে শুধু শুধুই জ্বালাতে ইচ্ছে করতো। তোমার বিরক্ত মুখটা দেখতে ভালো লাগতো খুব। জ্বালাতে জ্বালাতেই কখন যে আমি নিজেই তোমার যাতনায় আটকে গেলাম! ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে। তুমি যখন আমাকে তোমার সত্য বলতে চাইতে, এড়িয়ে যেতাম। আমার এসব অতীত ফতীত শুনতে ভালো লাগেনা তরী। এসব তো আমি জানিই। তোমার থেকে আবার শুনতে হবে কেন?
তোমাকে কষ্ট দিতে চাইতাম না। আগলে রাখতে চাইতাম। নিজের কাছে রাখতে চাইতাম। কিন্তু তোমার এমন দূরে সরে যাওয়া আমাকে পোড়ায় তরী। আমি জানি, হয়তো তুমি আমার হবে না। তবুও আকাশের কাছে তোমাকে পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা ছুড়ে দেই। বলি, ‘এই নৌকা আমার তীরেই আটকাবে।’
সত্যি বলতে, আমি হাল ছাড়তে শিখিনি তরী। তোমাকে পাওয়ার আশাটা আমি ছাড়তেই পারবো না। এখন তুমি আমার হও কিংবা না হও। আমি মেনে নেবো যেটাই হোক। তোমার মতো করে না হোক, একটু হলেও কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে। বাস্তবতা কি, সেটাও ভালো করেই জানি।”

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here