বকুলতলা ১৮,১৯
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
১৮.
রাস্তার ধারে একটা বিরাট বড় বকুলগাছ ছিল। বাতাসের তালে তালে, ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে নিচে আছড়ে পরছিল কতিপয় ফুলগুলি। কি ভীষণ সুন্দর লাগছিল দৃশ্যটা! তরী দৃষ্টি সরাতে পারেনি। চেয়েছিল মুগ্ধ, বিমূঢ় নয়নে।
মাহাদ হুট করে মোটরসাইকেল থামিয়ে দিলো। বকুলগাছটার কাছে এগিয়ে সবচেয়ে নিচু ডালের ফুলগুলো ছিঁড়ে আনলো মুহুর্তেই। বললো, “ধরো। হাত বাড়াও।”
তরী অবাক হয়। হাত বাড়িয়ে দেয় সত্যি সত্যি। মুঠোয় ভরা বকুল ফুলগুলো তরীর বাঁকানো তালুতে ঢেলে দিয়ে মাহাদ আবার প্রশ্ন করে, “বকুলফুল তোমার পছন্দ না?”
—“হ্যাঁ। আপনি জানলেন কিভাবে?”
বিস্মিত চোখ, মুখ, কণ্ঠস্বর তরীর। মাহাদ ক্ষীণ হেসে উত্তর দিলো, “দেখেছিলাম একদিন।”
—“কোথায় দেখলেন?” তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে পরার মতো করে বললো, “আপনি বলেছিলেন, আপনি আমাকে বকুলগাছের নিচে ফুল কুড়াতে দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন? এখানে তো ফুল কুড়ানোর মতো কিছু করিই নি আমি।”
তরীর বলার ভঙ্গিমা দেখে মাহাদ অল্প হাসলো। অথচ জবাবে কিছুই বললো না। বাড়ি পৌঁছানোর পথটুকুতে তরী বারবার জিজ্ঞেস করলেও ওপাশটায় যেন অঘোষিত নিরবতা। জবাব দেওয়ার ঘোর নিষেধাজ্ঞা।
ঘরে এসে বকুল ফুলগুলো বিছানার একপাশে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো তরী। ব্যাগটা রাখলো মেঝেতে। বিছানার কাঠের সাথে একদম লাগোয়া ভাবে। বকুলগুলো সামান্য শুকিয়ে গেছে। তাজা আছে একটা দুটা। তরী হাত বাড়ালো। আলতো আলতো করে স্পর্শ করলো ফুলের ক্ষীণ হলদেটে পাঁপড়িগুলো। চোখের পাতা কাঁপলো। ঘোলাটে হলো চাহনি। বিন্দু বিন্দু জল জমা হতে হতে হঠাৎ-ই ডুকরে উঠলো তরী। ভেতরকার হাহাকার বেড়িয়ে আসতে চেয়েও বেরুলো না। জ্বলন্ত লাভার মতো দাউদাউ করে জ্বলতেই রইলো। ভীষণ করুন শোনালো তার একেকটা আর্তনাদ, “আমিহ্– আমি ভালো নাই আম্মা। পৃথিবীটাও ভালো নেই। পৃথিবীর মানুষগুলোও আর ভালো নেই। আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা। আমি সেদিন মরে গেলাম না কেন?”
বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বিষ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে একটু একটু করে কাঁপছে শরীর। আশপাশ থেকে যেন একটাই ধ্বনি ভেসে আসছে, “কষ্টরা আমার পিছু ছাড়ে না কেন?”
–
কোলাহল, অস্থিরতা আর একটুখানি ব্যস্ততায় গিজগিজ করছে খাবার ঘর। সালেহাকে ওদিক থেকে এদিক ছুটতে দেখা যাচ্ছে। তরী ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল। নূরী চপিংবোর্ডে শশা কাটছিল। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “ঘুম থেকে উঠেছো তাহলে! আমি এখনই ডাকতে যেতাম। খাবার প্রায় তৈরি।”
তরী কি শুনলো? কি জানি! তার দৃষ্টি নূরীর দাঁড়ানো টেবিলের পাশটায়। পুরো টেবিলের খাবার থেকে ওই ছোট্ট অংশ জুড়েই ভিন্ন ভিন্ন খাবার। সিদ্ধ করা দুটো ডিম, আলাদা করে সালাদ, চিকেন স্যুপ, ঝাল ঝাল করে রাঁধা একটা সবজি তরকারি। তরী ভাঙ্গা স্বরে শুধালো, “এসব কার জন্য ভাবী?”
—“প্রণয়ের জন্য। শাশুড়ী আম্মা বিশেষ আদেশ দিয়ে এগুলো বানাতে বলেছেন।”
তরী পলক ঝাপটায়। কান্না করার ফলে চোখদুটো ফুলে আছে। একটু ভালো করে তাকাতে চাইলেই চোখের সামনে সাদা সাদা পর্দার মতো কি যেন ভেসে উঠে। জ্বালা করে খুব। তাকাতে কষ্ট হয়। নূরীর কথা শুনে সে তবুও ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলো। টেবিলের ওইটুকু জায়গা আবারও পরখ করে নিলো। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, “উনার আবার কি হয়েছে?”
যেন প্রশ্নটা করা কিংবা না জানাটা তরীর বড় ধরণের অপরাধ। নূরী তৎক্ষণাৎ হাতের ধারালো ছুঁড়িটা চপিংবোর্ডে রেখে নেত্রযুগল বড় বড় করে তাকালো,
—“ওমা! তুমি জানো না? সকাল থেকে প্রণয়ের মারাত্বক জ্বর! বেচারা তো বিছানা থেকেই উঠতে পারছিল না।”
তরী শুনলো। বুঝলো। কপালের ভাঁজ তীব্র থেকে তীব্র হতে হতে একদম মিলিয়ে গেল। খানিক্ষণ চুপ থেকে সে ছোট্ট গলায় বললো, “ওহ্।”
কাজের ফাঁকে ফাঁকে নূরী তরীকে দেখছিল। মেয়েটা এত মায়াবী, স্নিগ্ধ! চেহায়ার কান্নার ছাপটাও কেমন ফুঁটে রয়েছে। কেঁদেছে নাকি? কাঁদলেও কি? শুধু শুধু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। বার্তি কথা বলা শুধু!
—“দেখি, আমার ছেলেকে বসতে দাও বউমা। খাবার দাবার আর সাজাতে হবে না। সরো দাঁড়াও।”
নূরী সাথে সাথে সরে দাঁড়ালো। আয়েশা খাতুন চেয়ার টেনে দিলেন৷ প্রণয় বসতেই মাথায় সস্নেহে হাতও বুলিয়ে দিলেন। চুলগুলো এলোমেলো করে আবার গুছালেন। প্রণয় কেমন কুঁচকানো মুখশ্রী নিয়ে বসে আছে। চোয়ালের দিকটা শক্ত করে রাখা। ভ্রু কুঁচকানো। চেহারা লাল লাল হয়ে আছে। মায়ের এসব যে তার ভালো লাগছে না, বোঝা যাচ্ছে। তরীর অত খেয়াল নেই সেদিকে। প্রণয় আসার পর তাকায়ও নি। নিজের মতো খাচ্ছিল। কি মনে করে মাথা তুলতেই দেখলো, শেষের সারির পাঁচ নম্বর চেয়ারে বসা প্রণয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত, স্বাভাবিক, নিগূঢ় চোখে। কয়েক সেকেন্ড তার দৃষ্টি স্থিরই ছিল। তরীর মনে হয়েছিল, লোকটা তাকে কিছু বলতে চাইছে। এইতো, বলবে এক্ষুণি। কিন্তু বাস্তবিক প্রণয় কিছু বলেনি। চুপচাপ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলো মাত্র!
–
সালেহা বায়না ধরেছে, সে আজকে তরীর সাথে ঘুমাবে। তরী বারণ করেনি। মেয়েটা তাই কি উৎফুল্ল হয়ে উঠলো তখন! আগ বাড়িয়ে বিছানা ঝাড়লো, বালিশ ঠিক করলো, কাঁথার ভাঁজ খুললো। তরী মানা করার পরেও শুনেনি। হাসতে হাসতে বলছিল, “এইটা আর কি কাম আপা! রোজই করি। তোমারে আমি ভালা পাই, তোমার কাম কমাইতে পারলেও শান্তি!”
তরী আর কিচ্ছুটি বলেনি। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে কিশোরী মেয়েটার দিকে চেয়ে ছিল। এরমধ্যে হাতে থাকা ফোনে মাহাদের পাঁচছয়বার কল করাও শেষ। তরী ইচ্ছে করেই কল ধরছিল না। জানালার একটু পাশে দাঁড়িয়ে এবার কল রিসিভ করলো। সালেহা যেন শুনতে না পায়, এমন করে বললো, “কি হয়েছে মাহাদ? এতবার ফোন করছেন কেন?”
ওপাশ কথাবিহীন। নিশ্বাসের শব্দ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত শ্বাস ফেলছে লোকটা। ফ্যানের ভনভন আওয়াজ একদমই অল্প। ভূতুড়ে পরিবেশ। তরী আবারও ডাকলো, “মাহাদ? আছেন? কথা বলছেন না কেন?”
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মাহাদ প্রশ্ন ছুঁড়লো হঠাৎ, “তুমি কি কাঁদছিলে তরী?”
প্রায় তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে দেওয়া হলো। তরী কেটে দিলো। ভেতর থেকে আগত নিশ্বাসটা ঘন করে বিড়িবিড়ালো, “আপনার সাথে কথা বলা বারণ মাহাদ। আপনি সব বুঝে ফেলেন।”
__________________
চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বকুলতলা
১৯.
মাঝরাত বোধহয়। সময়টা জানা নেই। ঘড়ি দেখতে হবে। উদরে ক্ষুধার প্রখর আন্দোলনে টিকতে পারছে না তরী। ঘুমও আসছে না। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ ওপাশ করেও লাভ হয়নি। তরীর বড্ড আফসোস হলো। তখন সালেহার কথা শুনে আরেকটু ভাত নিলেই পারতো! তাহলে হয়তো এখন আর এমন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। তরী উঠে বসলো। বালিশের নিচ থেকে ওড়না নিয়ে ভালোভাবে শরীর ঢেকে নিলো। যাওয়ার আগে অবশ্য সালেহার পানে একপলক তাকাতে ভুলেনি। মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কি যে আদুরে লাগছে দেখতে!
রান্নাঘরের বাতি জ্বালানো। তরীর স্পষ্ট মনে আছে, সে বাতি নিভিয়েই ঘুমাতে গিয়েছিল। কারো কুঁকড়ে ওঠার সূক্ষ্ণ শব্দও পাওয়া যাচ্ছে একটু একটু করে। তরী আর দেড়ি করলো না। দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকতেই থমকালো সে! প্রণয় বসে আছে। সাদা ঝকঝকে টাইলসের মেঝেতে। পা দুটো ছড়ানো। পিঠ ফ্রিজের দরজার সঙ্গে লাগিয়ে রাখা। মুখটা কি মারাত্বক কুঁচকানো! তরী অনেকটা উঁচু গলায় বলে ফেললো, “আপনি মেঝেতে কি করছেন প্রণয় ভাইয়া?”
প্রণয়ের চোখ বন্ধ ছিল। মৃদু খোলার চেষ্টা করে অল্প তাকালো সে। তারপর আবারও নেত্রজোড়া বুজে ফেললো। হাতের ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিলো একবার। নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “ঘুমাও নি, তরী?”
দুজনের কেউই কারো প্রশ্নের উত্তর দিলো না।
—“আপনি এতরাতে এখানে কি করছেন?”
—“পানি খেতে এসেছিলাম।”
—“আপনার না জ্বর? ঠান্ডা পানি খাচ্ছেন কেন?”
প্রণয় কি একটু হাসলো? হ্যাঁ। ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট ভাঁজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রশস্ত হয়েছে খানিকটা। ভেতর থেকে আগত নিশ্বাসটা দীর্ঘ করে সে বললো, “আমি কতকাল ধরে তোমার মুখ থেকে আমার জন্য কিছু শুনতে চাইছিলাম তরী। আদুরে কিছু। যত্নের মতো কিছু। আজকে প্রথমবার শুনলাম। ভালো লাগলো খুব।”
—“আপনি আমাকে তুমি করে ডাকবেন না।” আচমকা তরীর ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।
প্রণয় সময় নিলো। চোখ খুলে শান্ত নয়নে তাকালো। সামনে ভাসমান হলো, তরীর কাঠিন্য ভরা মুখশ্রী। একটুও মায়া, মমতা নেই সেই চেহারাতে। তার সাথে এমন আচরণ করে কি শান্তি পায় এই পাষাণ মেয়েটা? অল্পখানি ভালো আচরণ কি করা যায় না?
প্রণয় সম্মতি দিয়ে বললো, “আচ্ছা, ডাকবো না।”
বলে আরেকবার ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিলো সে। তরী এবার আর কিছু বললো না। ইচ্ছে হলো না। চলে যেতে নিলেই বাঁধা দিলো প্রণয়, “এখানে কেন এসেছিলেন তরী?”
—“এমনি।”
তরীর কথা বলার আগ্রহ নেই। জবাব শুনেই বোঝা গেল। কি ভীষণ বিরক্তি গলায়! প্রণয় হাসলো তবুও। চঞ্চল, শব্দপূর্ণ হাসি। অনুরোধ করলো, “আমার পাশে একটু বসবেন তরী? জ্বালাবো না। প্রমিজ।”
অথচ মেয়েটা অনুরোধ রাখলো না। তবে গেলও না সেখান থেকে। শক্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। প্রণয় বললো, “আরে, বসুন মেয়ে। জ্বালাবোনা বলছি তো। কথা আছে। বলবো।”
—“বসবো না। এভাবেই বলুন।”
রান্নাঘরে ভ্যাপসা গরম। ঠান্ডা পানি খাওয়ায় গলা ব্যথা করছে। জ্বর জ্বর ভাবটা তীব্র আকার নিয়ে আসছে বোধহয়। চাইলেও বেশিক্ষণ চোখ মেলে রাখতে পারছে না প্রণয়। বাতির আলো এতটা বিঁধছে!
প্রণয় আস্তে আস্তে, ক্ষীণ বসে যাওয়া গলায় শুধালো, “আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করেননি কেন তরী?”
কখন অপেক্ষা করেনি? তরী বুঝলো না। ভুরু কুঁচকে বললো, “কি বলছেন? বুঝিনি।”
—“তিন বছর আগে, আমি– আমি কষ্ট পেয়েছিলাম খুব।”
অবুজ তরীর এবারও কিছু বোধগম্য হলো না। পলক ফেললো কয়েকবার। হঠাৎ রেগে গিয়ে বললো, “আপনি আবারও তিন বছর আগের কথা নিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছেন? আপনি কি কখনো শুধরাবেন না?”
সরব, প্রণয় হো হো করে হেসে উঠলো। ভীষণ, ভীষণ হাসি। চোখে পানি জমে কেঁদে ফেলার মতো হাসি।
—“তুমি এত বোকা তরী! কিছুই জানো না।”
ধীরে ধীরে হাসি কমলো। বাড়লো চেহারার মলিনতা। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে প্রণয় বললো, “তুমি আমাকে ছেড়ে বিয়ে করে ফেললে কেন তরী? আমি খুব কেঁদেছিলাম। তুমি তবুও আসোনি। দেখো নি আমাকে।”
তরী অবাক হলো, ভড়কে গেল। স্পষ্ট বিমূঢ়তায় বুদ্ধী লোপ পেল যেন। লম্বা শ্বাস নিয়ে আওড়ালো, “আপনি পাগল হয়ে গেছেন। জ্বরে উলটাপালটা বকছেন।”
বোতল রেখে উঠে দাঁড়ালো প্রণয়। ঢুলে উঠা পা জোড়া নিয়ে দেওয়াল, সিঁড়ি দু’হাতে ধরে ধরে নিজ ঘরে চলে গেল কারো সাহায্য ছাড়াই। একবারও তাকালো তরীর দিকে। আড়চোখেও না। মেয়েটা কখনো তাকে বুঝেনি। বুঝবেও না হয়তো।
–
মাহাদ তিনরুমের একটা বাসায় থাকে। টাইলস করা। দুটো টয়লেট, একটা বসার ঘর, দুটো শোয়ার ঘর। শোয়ার রুমের একটা ঘর খালিই পরে থাকে। দরজায় বড় একটা তালা ঝুলানো। কতবছর সেই তালা খোলা হয়না!
ঘরটাতে নূপুর থাকতো। ভালো পড়াশোনার জন্য শহরে আসতে গিয়ে নুপুরকেও নিয়ে এসেছিল মাহাদ। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটার কি আনন্দ! ভাইয়ের সাথে থাকবে। তখন মাহাদের কাজের লোক লাগতো না। নূপুর অনেক সাংসারিক মনমানসিকতার মেয়ের। রান্নাবান্নার সবে পটু। স্কুল থেকে ফিরে এই সেই রান্না করে রাখতো। মাহাদ এলেই দৌঁড়ে এসে বলতো, “তোর জন্য আজকে চিংড়ির দোপেঁয়াজা বানাইছি ভাইয়া। খাবি না?”
কি প্রাণোচ্ছল ছিল তার বোনটা! ছোট ছোট পা নিয়ে দৌঁড়ে বেড়াতো সারা ঘরময়। সেই দিনগুলো কই গেল? বোনটাকে আর হাঁটতে দেখে না মাহাদ। দৌঁড়াতে দেখেনা। একটা রোড এক্সিডেন্ট কতকিছু কেড়ে নিলো! নূপুরকে পঙ্গু বানিয়ে ছেড়ে দিলো আজীবন!
মাহাদের ফোন বাজছে। স্ক্রীনে বড় বড় করে ফুটে আছে ‘ABBA’ লেখাটা। সে কি মনে করে রিভিস করলো কলটা। গম্ভীর স্বরে বললো, “বলো।”
—“কবে আসবি বাপ?”
রশিদের করুণ গলার স্বর। মাহাদের মন গললো না। রুক্ষতা নিয়ে বললো, “জানোই তো আসবো না। বারবার জিজ্ঞেস কেন করো?”
—“কেন আসবি না? আমি, আম্মা, নূপুর সবাই কত আশা নিয়ে বসে আছি জানিস? আমারে তো তুই পছন্দ করোস না। নূপুরের জন্য হলেও অনতত আয়? নাকি নূপুরের জন্যও এখন আর মায়া কাজ করে না?”
কথাগুলো খুব তিক্ত। রশিদের মুখে এই তিক্ত কথাগুলো মানায় আসলে। মাহাদ যারপর নাই খুব রেগে গেল,
—“মায়া, ভালোবাসা এসব কিছু তুমি আমাকে শিখাচ্ছো আব্বা? আম্মার সময় এই মায়া কই ছিল? ওই নোং’রা মহিলার সাথে রাত কাটানোর সময় মনে ছিল না? আম্মা যখন তোমার পা ধরে কাঁদছিল তখন মনে ছিল না? আম্মারে যখন আমাদের সামনে বেল্ট দিয়ে মারতা, তখন মনে ছিল না? একমাত্র তোমার জন্য আম্মা আমাদের কাছে নাই আব্বা। কারো সামনে আম্মার সম্মান বাঁচিয়ে রাখো নাই তুমি। আম্মা আমার লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারতো না। যেদিন বিষ খেয়েছিল, ওইদিন তুমি কই ছিলা? উঠানের সামনে একটু দাঁড়িয়ে দেখেছো কখনো? আম্মার মাটিতে গড়াতে গড়াতে মরে যাওয়ার মুহুর্ত চোখে ভাসে। আমার সামনে আমার আম্মাটা মরে গেল! মুখ দিয়ে সাদা সাদা কি বের হচ্ছিল। ওইটুকু আমার বোঝার ক্ষমতা ছিল না। নূপুর আম্মাকে ঠেলে ডাকছিল। অথচ আমার আম্মা নির্জীব। সারা দিচ্ছিল না। দাদি কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তোমাকে ডাকছিল বারবার। কই ছিলা তুমি আব্বা? আমাদের ডাক শুনো নাই?”
রশিদ কল কেটে দিয়েছেন। মাহাদ যখন বুঝলো, মেঝেতে আছড়ে ফেললো ফোনটা। বিছানা থেকে নেমে জানালার পর্দা টেনে দিলো। অন্ধকার রুমে শুয়ে রইলো চুপচাপ। টুকরো টুকরো ফোনের দিকে চেয়েও তাকালো না। ঘুমহীন চোখে আলো ছাড়া কালো কালো দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই আম্মা। তুমি কেন চলে গেলা?”
________________
চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা