বকুলতলা ২৪,২৫

0
216

বকুলতলা ২৪,২৫
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২৪.
আশপাশে বাতাস করছে খুব। বকুল গাছের সতেজ পাতাগুলো দুলছে তালে তালে। কিছুসংখ্যক পাতা ঝড়ে পরছে অকালেই! আকাশটাও ভালো নেই। কালো মেঘদের ডেকে এনে কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উঠানে আবার কাপড় রোদে দিয়েছিল তরী। কাপড়ের ক্লিপ দেওয়া হয়নি। এই ঝড়বাদলে কোথাও উড়েটুড়ে গেল কিনা! ওড়না গায়ে জড়িয়ে তরী দ্রুত ছুটে চললো উঠানের দিকটায়। যা ভেবেছিল তাই! কাপড় উড়ে না গেলেও সাদা জামাটা মাটিতে পরে লুটোপুটি খাচ্ছে। ক্ষীণ ময়লায় ধোঁয়া জিনিসটা নষ্টই হয়ে গেল। আবার ধুতে হবে। আকাশের অবস্থাটাও বেগতিক হচ্ছে। গুড়ুম, গুড়ুম বজ্রপাত কাঁপিয়ে তুলছে আশপাশ। তরী হাত চালিয়ে কাপড়গুলো এক এক করে নিতে নিতেই ধুম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যেই সেই বৃষ্টি না! একেবারে কাকভেঁজা করে দেওয়া বৃষ্টি! মুষলধারে বৃষ্টি!
বরকত সাহেব বসার ঘরে থমথমে মুখ নিয়ে বসে ছিলেন। তরীকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে একপলক তাকালেন। গাঢ় সুরে প্রশ্ন করলেন, “তুই আবারও বৃষ্টিতে ভেঁজা শুরু করেছিস তরী? তিতিরের মতো তোরও কি জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছে হয়েছে?”

বৃষ্টিতে তরীর চুল ভিঁজেনি তেমন। মাথায় ওড়না চাপিয়ে দৌঁড়ে এসেছিল। কিন্তু জামাটার শেষ রক্ষা হয়নি। বাতাসের তীর্যক ঝাপটায় বাঁকা ভাবে বয়ে চলা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ওর জামার নিচের অংশটুকু ভিঁজিয়ে দিয়েছে। বাজে ভাবেই। তরী আমতা আমতা করে বললো, “ভিঁজতে যাইনি আব্বা। কাপড় আনতে গিয়েছিলাম। হুট করে বৃষ্টি আসলো।”
—“তোর সাথে আমার একটু কথা আছে। এদিকে আয়। পাশে বয়।”
তরী হাতের কাপড়গুলো দেখিয়ে বললো, “এগুলো রেখে আসি?”
—“পরে রাখিস। আগে শুনে যা।”

বাধ্য তরী কাপড় হাতেই বাবার পাশে গিয়ে বসলো। বরকত সাহেব বললেন, “তুই কত তারিখে ঢাকা যাবি বলে ভেবেছিস?”
—“আসলামই তো মাত্র দুইদিন। এক সপ্তাহ থাকবো ভাবছি।”
তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। পরম স্নেহের দৃষ্টিতে। ভীষণ আদর নিয়ে মেয়ের চুলে হাত বুলালেন বেশক্ষণ। কেমন জড়তার সঙ্গে কোমলস্বরে আওড়ালেন, “তুই কালকে সকালের বাসে শহরে চলে যা মা। এখানে আর থাকতে হবে না।”
কণ্ঠে স্পষ্ট অনুরোধ। অস্পষ্ট চিন্তা। তরী দুটোই টের পেল। অবাক হলো। মনে প্রশ্ন জাগলো। প্রশ্নের বিরাট পাহাড় তৈরি হলো। তবে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা লাগলো না। তার বিমূঢ়তা দেখে বরকত সাহেবই বলতে থাকলেন, “আজকে বাজারে অর্ণবের সাথে দেখা হয়েছিল। ছেলেটা তোর আসার খবর পেয়ে গেছে। তোকে নাকি আবার বিয়ে করবে। আরও কত বিশ্রী বিশ্রী কথা! গ্রামটাও আগের মতো নেই। বিশুদ্ধ মানুষের অভাবে ভরে গেছে। তুই এসেছিস জেনে সাহসও বেড়ে গেছে ওদের। কোন সময় না আবার বাড়ি বয়ে এসে তোকে উত্যক্ত করে যায়। আমি তো বাসায় থাকি না। সারাদিন দোকানেই কাজ করি। কখন কি না কি হয়! তারচেয়ে তুই আগেই এখান থেকে চলে যা।”

বাবার কথায় যে তরী হতাশ হয়েছে, তা ওর কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল,
—“আমি চলে গেলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? তিতিরও তো বাসায় একা থাকে। ওর যদি কিছু হয়?”
—“হবে না। ও এখন অনেকটা সুস্থ। দোকানে যাওয়ার আগে ওকে তোদের ফুপ্পির কাছে রেখে গেলেই হবে।”
বরকত সাহেব কথাটা মন্দ বলেন নি। আমেনা এমনিতে পাশের বাসার আন্টির ভূমিকা পালন করলেও মনে মনে ভাগ্নিদের প্রচন্ড ভালোবাসেন। তাই তিতিরকে নিয়ে আসলেই চিন্তা করার কিছু নেই।
তরী মাথা নিচু করে হতাশ নিশ্বাস ফেললো। পরপর কয়েকবার। আস্তে ধীরে উত্তর দিলো, “ঠিকাছে আব্বা। সকালে চলে যাবো।”

তখন শরৎ ঋতু চলছিল। কাশফুলের ঋতু। স্নিগ্ধ মৌসুমের ঋতু। আকাশে সাদা মেঘের সংখ্যা বাড়ানোর ঋতু। ভালো থাকার এই শরৎ ঋতুতে তরীর দিনগুলোও ভালো চলছিল। ধর্ষ’ণের ঐ বাজে স্মৃতিটাও প্রায় ভুলে গিয়েছিল সবাই। তরীও স্বাভাবিক হচ্ছিল আস্তে আস্তে। তরীর মা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন তখন। সারাক্ষণ মেয়ের পিছনে লেগে থাকতেন। এটা ওটা বুঝাতেন, নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিতেন, চুল আঁচড়ে দিতেন। ছোটবেলার সব আদরগুলো যেন আরও দ্বিগুণ ভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন তরীকে। নতুন করে পড়ালেখার তাগিদটাও তারই প্রথম নেওয়া। আটঘাট বেঁধে পিছনে পরে গিয়েছিলেন মেয়েকে শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠাবান করতে। তরী শুরুতে একটু গাইগুই করলেও পরে মায়ের আবদার ফেলতে পারেনি। কলেজ থেকে বাসা, বাসা থেকে কলেজ। জীবনটা অতটুকুতেই থমকে ছিল। প্রয়োজন ছাড়া প্রানপ্রিয় বন্ধুদের সাথেও কথা বলা হয়ে উঠতো না একদমই। সত্যি বলতে, তরীর এখন বাহিরের মানুষকে ভয় লাগে। বন্ধু বানাতে ভয় লাগে। বন্ধুদের সাথে কথা বলতে ভয় লাগে। বন্ধু নামের জিনিসটাকেই প্রচন্ড ভয় লাগে ওর। একবার বিশ্বাস ভেঙ্গেছে তো! দ্বিতীয়বার সেই বিশ্বাসটা ঠিক আসছে না।

এইচ.এস.সি তখন সন্নিকটে। হাতে বেশি সময় নেই। নাওয়া খাওয়া বাদে দিনরাত শুধু বইয়ের ভেতরই মুখ গুঁজে থাকতো তরী। সেসময় মাতব্বরের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো। ছেলের নাম অর্ণব। তরীকে নাকি কলেজে দেখেছিল অনেকবার। সেই থেকে তার তরীকে অনেক পছন্দ। বিয়ে করতে চায়। সাথে এও জানায়, তরী ধ’র্ষি’তা বলে ওর কোনো আপত্তি নেই।
ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। ভালো পরিবারের। ইঞ্জিয়ারিং পড়ছে। পাস করে বেরুলেই হাতের কাছে চাকরি। মূলকথা, টাকা পয়সার অভাব নেই। তরী ভালো থাকবে।
তরীর মা প্রথমে এক বাক্যে না করে দিয়েছিলেন এই সম্বন্ধে। কিন্তু বরকত সাহেবের বোন-ভাইয়েরা কিছুতেই ছাড় দিলেন না। জোড় গলায় বারবার বললেন, “তরীকে তো একদিন না একদিন বিয়ে দিতেই হবে ইয়াসমিন। এখন দিলে সমস্যা কি? তাছাড়া ওদের বাড়ির সবাই শিক্ষিত। তরীকেও পড়াবে বলেছে। আমাদের বিপদ আপদেও তো কতরকম সাহায্য করতে পারবে মেয়েটা! আমরা বলি কি, বিয়েতে বাঁধা দিস না। মেয়ে ওখানে সুখী থাকবে।”
তরীর মা বেশ বুঝতে পারছিলেন, সবাই সবার স্বার্থ দেখছে। তরীর ফুপি-চাচারা যে অর্থিক সাহায্যের লোভে পরে এত গুণগান গাইছেন, সেটাও বুঝার বাকি নেই। কিন্তু তবুও তরীর মায়ের অন্তর গলে গেল। মেয়েটাকে পড়তে দিবে। মেয়ে সুখী থাকবে। তার আর কি দরকার? তারওপর ছেলেটাকে খারাপ মনে হচ্ছে না। ব্যবহার এত নম্র! ‘আম্মা’ ডাক শুনতেই যেন প্রাণ ভরে উঠে! তরীর ধর্ষ’ণ নিয়েও ওদের সমস্যা নেই। তাহলে বিয়েটা শুধু শুধু আটকে রেখে লাভ কি? ভালো সম্বন্ধ। হাতছাড়া করা যাবে না।

তরীর বিয়েটা হয়ে যায়। মাসের শুরুতেই। তরী কোনোরুপ বাঁধা দেয়নি। তার জীবনটাই তো কেমন এলোমেলো। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কতকিছু হয়ে যায়! অর্ণবের গভীর ভাবে কাছে আসাটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের দিন রাতেই। ধ’র্ষণের সেই বিষাদ স্বাদটা আবারও অনুভব করতে পারছিল তরী। প্রতিটা রাতেই পেতে হচ্ছিল। শুধু ওইদিনের মতো তরী কোনোরুপ প্রতিবাদ করতে পারে নি। কাউকে নালিশ দিতে পারে নি। বলতে পারে নি খোলাখুলি ভাবে।
অর্ণবের পরিবারের মানুষগুলো কেমন যেন! তরীর সাথে হাসিমুখে দু’চারটা লাইন বলে না। শ্বাশুড়ি মা একটা সারাদিন মুখ গোমড়া করে রাখেন। শ্বশুড়কে তো বাসাতেই দেখা যায় না। অর্ণবের সাথে যা একটু কথা হয়, সেটা বিছানায় গিয়ে। অন্তরঙ্গ মুহুর্তে। নয়তো, সেতো তরীর ব্যাপারে বড্ড উদাসীন, বিরক্ত। তবুও ভেতড়টায় একটু হলেও শান্তি ছিল। তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হচ্ছে! পড়াশোনা নিয়ে তরীকে কখনো ওবাড়ির কেউ বাঁধা দেয়নি। অর্ণব প্রতিদিন তাকে কলেজ নেওয়া আসা করতো। কিন্তু রাতে যে একটু টেবিলে বসে পড়াশোনা করবে, তার সুযোগ ছিল না। কলেজের সময়টুকু বাদে ঘরের কাজ করতেই বাকি সময়গুলো ফুড়ুৎ করে কোথায় যে উধাও হয়ে যেত!

এরপর একদিন মাতব্বর হুট করেই মারা গেলেন। তার জায়গাটা অর্ণবকে গ্রামবাসি দিতে চাইলে অর্ণবও দিরুক্তি করে না। ওর আবার লোভ খুব। টাকা পয়সা ভীষণ পছন্দ করে। ক্ষমতার জোড়ে কেমন পালটে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। ভদ্রতার মুখোসটাও আস্তে আস্তে খোলস ডিঙ্গিয়ে বেড়িয়ে আসে। রোজ রোজ ছাইপাঁশ খেয়ে খেয়ে বাসায় আসা যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে হ্যাঁ, তরীর গায়ে কখনো হাত তোলেনি সে। বিশ্রী বিশ্রী গালি দিতো শুধু। দিন নেই, রাত নেই, তরীকে সামনে বসিয়ে মদ্যপানে মেতে উঠতো। এত এত অশালীন কথা বলতো যে, ঘৃণায় শরীর শিরশির করতো তরীর। একসময় জানতে পারলো, অর্ণব আসলে স্বাভাবিক না। সাইকো ধরণের। আগে বুঝতে না পারলেও এখন অনুভব করে, অর্ণবের কাছে আসার পদ্ধতিটা ভয়ংকর অস্বাভাবিক। ও আসলে মানুষকে মানসিক অশান্তি দিতে পছন্দ করে। শারিরীক ক্ষত থেকে মানসিক অশান্তিটা বসে বসে দেখা ওর জন্য বেশি মজার ছিল। তরীকে খেলার পুতুল বানিয়ে ও সেই মজাটাই নিতে চাইতো। উলটাপালটা কাজের নির্দেশ দিতো তরীকে। একবার তো পুরো দুইদিন খাবারই খেতে দেয়নি। এসব করার সময় ওর মুখে লেপ্টে থাকতো ভয়াবহ হাসি। শরীরের লোমকূপ দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মতো বাঁকানো হাসি। তরী সহ্য করতে পারছিল না। মনে মনে মুক্তি চাইছিল। মাকেও বলতে চেয়েছিল অনেকবার। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। দিনকে দিন এই মানসিক অত্যাচারে নেতিয়ে পরছিল সে। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। তারপর একদিন তরী জানতে পারলো, সে অন্তঃসত্ত্বা।

বাস তার গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্রই থেমে গেছে। বরকত সাহেব তরীর জন্য আলাদা করে দেশি মুরগির ডিম, ইয়াসমিন বেগমের বানানো পুরনো আচারের বোয়াম, কিছু খাতা-কলম একটা ব্যাগে করে দিয়েছেন। সেটা তরী বাসে সাথে করে নিলেও কাপড়ের ব্যাগটা বাসের বক্সে রাখা। বাস থেকে নেমে সে প্রথমে কাপড়ের ব্যাগটাই নিলো। দুহাতে দুটো ভারী ব্যাগ এঁটে আশপাশে তাকালো রিকশার খোঁজে। নাহ্! একটাও খালি রিকশা নেই। সব সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সিএনজিতে ভাড়া বেশি। তরী তাই আর ওদিকে গেল না। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো। সামনে যদি কোনো খালি রিকশা পাওয়া যায়!
দু’কদম এগোতে না এগোতেই সশব্দে ফোন বাজতে লাগলো। তরী ভেবেছিল, সে কল ধরবে না। ধরবেই-বা কিভাবে? হাত আটকা তার। কিন্তু অনবরত কল আসায় সে এক প্রকার বিরক্ত হয়েই ব্যাগগুলো রাস্তার একপাশে রাখলো। ফোন বের করে রিসিভ করলো কল। অসহ্য কণ্ঠে বললো, “কি সমস্যা মাহাদ? এতবার ফোন দিচ্ছেন কেন?”
মাহাদ সেকথা কানে নিলো না। নিজের মতো করে কেমন রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
—“ওখানেই দাঁড়াও। আসছি আমি।”

কল কেটে গেল পরপরই। অবাক তরী আশপাশে আবারও নজর বুলালো। সামনেই দেখতে পেল, বেপরোয়া লোকটা তেজি পায়ে রাস্তা পার করে আসছে। মাহাদকে দেখে তরী একটু থমকালোই। লোকটার আগে থেকে পরিবর্তন হয়েছে। ফর্সা রঙটা একটু কালো হয়েছে কি? হ্যাঁ, বড্ড বেশিই মলিন হয়ে গেছে। চুলগুলোয় কি শ্যাম্পু করে না? অতদূর থেকেও কি শুষ্ক দেখাচ্ছে! চেহারায় এক আলাদাই কাঠিন্যতা। বলা হয়নি, মাহাদ চোখে পরার মতোই একজন। সুদর্শন। কিন্তু তার পেছনে যে দশবারো জন মেয়ে লেগে থাকবে, এমন কোনো ঘটনা কখনো হয়নি।

মাহাদ তরীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তরী কিছু বলতে নিলেই কঠিন গলায় শুধালো, “আমাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে, তরী?”
তরী চোখ পিটপিট করে উত্তর দিলো,
—“গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম।”
—“আমাকে কি তোমার মানুষ বলে মনে হয়না?”
—“মনে হবে না কেন?”
মাহাদ কিছুপলক তরীকে দেখে নিলো। আগাগোড়া পুরোটাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিযোগ জানালো, “আমার প্রতি তোমার মিছে মায়াটাও নেই তরী। কেন নেই?”

______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

২৫.
ব্যাগগুলো বেঞ্চের একপাশে সাবধানে রাখা। বেঞ্চটা ছোট। তবুও যথাসম্ভব মাহাদ থেকে দূরত্ব রেখে বসেছে তরী। বারবার কোণা চোখে লোকটাকে দেখছে। মাহাদ খেয়াল করেছে ব্যাপারটা৷ কিন্তু কিছু বলেনি। শুরু থেকেই মুখটা কেমন গম্ভীর করে রেখেছে। কপালে শত শত বলিরেখার ভাঁজ। কথাও বলছে না। তরীর মন খারাপ হলো ভীষণ। নাহ্, মাহাদের অভিমান দেখে নয়। কিংবা তার মাহাদকে না বলে যাওয়ার জন্যও নয়। সে মনে মনে অপ্রাণ চাইছিল, লোকটা যেন এবার একটু শুধরাক। ক্ষণিকের বিচ্ছেদের বেদনা কাটিয়ে মরিচিকার পিছু ছেড়ে দিক। কিন্তু কই? লোকটাকে যেমন দেখেছিল, তেমনই আছে। বরং আরেকটু বেপরোয়া হয়ে গেছে বোধহয়। তরীর প্রতি নীরব অধিকারবোধটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে।
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুদীর্ঘ, চরম যন্ত্রণাময় লম্বা নিশ্বাস! ধীর গলায় শুধালো, “আপনি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন মাহাদ?”
—“তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায়?”

মাহাদ বলতে বলতে তাকালো। গম্ভীর দৃষ্টি, গম্ভীর কণ্ঠ। চাহনিটাও ঠিকঠাক নেই। কোমলতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। আবার বললো, “তুমি নিষ্ঠুর তরী। পাথর। সেই পাথরটা ঠিক কতবার আমাকে আঘাত করেছে জানো?”
—“আপনার উচিত আমাকে ছেড়ে দেওয়া। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। অধৈর্য লাগে না?”
তরীর নির্লিপ্ত প্রশ্ন। মাহাদ সুদূর মাঠের মধ্যিখানে তাকিয়ে রইলো। জবাব দিতে সময় লাগালো খুব। দুটো হাফ প্যান্ট পরা ছেলে একটা ছাগলের ছানা নিয়ে খেলছে। ছেলে দুটোর মধ্যে ছোট ছেলেটা ছাগলটাকে ভয় পাচ্ছে। কাছে আসলেই ছিঁটকে সরে যাচ্ছে বারবার। যা দেখে বড় ছেলেটা মজা পেয়ে ইচ্ছে করে ছাগল ছানাকে ওর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাহাদ পুরো বিষয়টা দেখলো নিঃশব্দে। আবিষ্কার করলো, আমরা যেটা থেকে নিজের পিছু ছাড়াতে চাই, ঠিক সেটাই আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে যায়। ব্যাপারটা হাস্যকর। অল্পখানি হাসলোও মাহাদ। আনমনা হয়ে উত্তর দিলো, “আমি তোমার প্রতি বিরক্ত হতে চাই তরী। অধৈর্য হতে চাই। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার আশাও ছাড়তে পারছি না। এই আশা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। তুমি বরং বলতে পারো, তোমাকে পেয়ে আমি অশান্ত।”

তরী চুপচাপ শুনলো। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার গর্তগুলোতে কি যেন খুঁজলো। পেল না। হতাশ হলো। মায়ের মুখটা একবার মনে করার চেষ্টা করে বললো, “আপনি যদি কখনো জানতে পারেন, আমি ধ’র্ষি’তা। তবে কি আমার সাথে আর কথা বলবেন?”
বলেই মাহাদের দিকে তাকালো তরী। লোকটার অভিব্যক্তি দেখতে। ভেবেছিল সে চমকাবে, ভড়কে যাবে। এরপর ঘৃণ্য দৃষ্টি ফেলে চলে যাবে তরীকে ছেড়ে। অথচ তেমন কিছুই হলো না। মাহাদকে একদম স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। দৃষ্টি আগের মতোই ছেলেগুলোর ওপর। খানিক্ষণ বাদে বললো, “আমি ধারণা করেছিলাম এমন কিছু।”
—“বুঝিনি। কি ধারণা করেছিলেন?”
মাহাদ সেকথার উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তোমার গলার দাগ তাহলে কিসের? অর্ণবের দেওয়া? নাকি ওই জানো’য়ারের?”

তরী এতটা আশা করেনি। একদম করেনি। বিমূঢ়তায় বাকহারা হয়ে গেছে। চোখের বড়োসড়ো দৃষ্টি মাহাদের ওপরই স্থির। কিছু বলতে নেওয়ার আগেই মাহাদই আবার অনুমতি চাইলো, “সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে তরী। আমার কাছে নেই। তুমি এখানে বসো। আমি সামনের দোকান থেকে নিয়ে আসছি।”
তরী একদমই যেতে দিলো না। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এত কিছু জানেন কিভাবে? আমি তো কাউকে বলিনি।”
—“তুমি জানতে চেয়েছিলে না? বকুলফুল কুড়াতে আমি তোমাকে কোথায় দেখেছি? তোমার বাড়িতেই। আমি তোমাদের পাশের গ্রামে থাকি।”

কথাগুলো বড্ড কঠিন লাগছে। যে মাহাদ থেকে সে এতদিন তার অতীত লুকাচ্ছিল, সেই কিনা আগে থেকে সবটা জানে। ব্যাপারগুলো হজম করতে বেগ পেতে হলো তার। রুদ্ধশ্বাসে বললো, “আমাকে কবে থেকে চেনেন আপনি?”
—“বেশি না। তিন বছর হবে।”
—“আপনি জানতেন আমার আগে বিয়ে হয়েছিল? আমাকে ধ’র্ষ’ণ করা হয়েছিল?”
—“হ্যাঁ।”
—“তাহলে না চেনার অভিনয় করেছেন কেন এতদিন?”
—“আমি কোনো অভিনয় করিনি তরী। প্রথম দিন তোমাকে চিনি বলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন শুধু তোমাকে ভালো লাগতো। তোমাকে জানার আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া আমি তোমার ব্যাপারে যা শুনেছি, সব ভাসা ভাসা। সিওর ছিলাম না। তুমি কষ্ট পাবে বলে কখনো জিজ্ঞেসও করিনি।”

নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো তরী। অজানা কারণে খুব কান্না পাচ্ছে। একমুহুর্তের জন্য ছিঁচকাঁদুনে হয়ে চোখের জলে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সব। কিন্তু সে ব্যর্থ। এমনটা করার সাধ্য নেই।
—“এখন তো জেনে গেছেন আমি ধ’র্ষি’তা, ডিভোর্সি। ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন? আমার অসহ্য লাগছে আপনাকে। সবাইকে অসহ্য লাগছে আমার। আমি– আমি মরছি না কেন?”
মাহাদ চুপচাপ তরীর উত্তেজনা দেখলো। ঠান্ডা গলায় আস্তে আস্তে শুধালো, “আমাকে বিয়ে করবে তরী?”
তরীর আগের মতোই জবাব, “না।”
—“চলো, পালিয়ে বিয়ে করি।”
তরী কটমট চোখে তাকালো,
—“বলেছি তো করবো না! বারবার একই কথা বলছেন কেন?”
—“তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও তোমার মনে আমার জন্য একটু হলেও ভালো লাগা আছে। কথাটা কি অস্বীকার করতে পারবে?”
—“আমার আপনাকে কোনো ভালো টালো লাগে না। কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসুন।”
মাহাদ বেহায়ার মতো আরেকদফা হাসলো, “তুমি এত মিথ্যুক তরী!”

অথচ তরীর মুখ শক্ত। হ্যাঁ সে মাহাদকে পছন্দ করে। অর্ণবকেও তো তার ভালো লাগতো। পছন্দ করতো একসময়। সেই পছন্দ কই? নেই। ঘৃণা ছাড়া পছন্দের জায়গা কোথাও নেই। তরী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মাহাদ অর্ণবের মতো হবে না। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাসটা আসে না। আসবেও না হয়তো কখনো।

গায়ের সাদা এপ্রোনটায় কিভাবে যেন কফির দাগ লেগে গেছে। বিশ্রী ভাবে দাগটা জ্বলজ্বল করছে সাদা কাপড়ে। শরীর থেকে এপ্রোনটা খুলে ফেললো প্রণয়। এলোমেলো ভাবে ভাঁজ করে চেয়ারে রেখে দিলো। বিরক্ত লাগছে খুব। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। কপালের বাম পাশটা টনটন করতে করতে অবশ হয়ে গেছে। যা গরম আজকে! তার আবার মাইগ্রেন আছে তো! গরম একেবারেই সহ্য হয় না।
রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ারটা কমালো প্রণয়। বেশি ব্যথা থাকায় একটা ঔষধও খেয়ে নিলো। ডিউটি এখনো শেষ হয়নি তার। সবে দুপুর বাজলো। রাতের আগে তো ছুটিও মিলবে না। শার্টের প্রথম কয়েকটা বোতাম খুলে প্রণয় তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। চোখ বুজলো ধীরে ধীরে। কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না এখন। একটু ঘুম প্রয়োজন। কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু তা কি ওর নসিবে আছে? মিনিট গড়াতে না গড়াতেই ওটির জন্য ডাকতে চলে এলো একজন পুরুষ নার্স।

তখন রাত দশটা বেজে গেছে। হাসপাতাল থেকে মাত্র বেরিয়েছে প্রণয়। আজকে আর গাড়ি করে যাবে না। ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছে না। হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো একটা রিকশা ডাকলো সে। রিকশাচালক প্যান্ডেল ঘুরিয়ে তৎক্ষণাৎ সামনে হাজির হলো। জিজ্ঞেস করলো, “কই যাইবেন?”

উত্তর দিতে গিয়ে ভ্যাবাচেকা খেল প্রণয়। আশ্চর্য ব্যাপার! নিজের বাড়ির ঠিকানা মনে আসছে না ওর। অবশ্য না আসাটাই স্বাভাবিক। অনেক বছর হয়ে গেছে। সেই কলেজ জীবনে রিকশায় ঘুরাঘুরি হতো। এরপর তো বিদেশে পড়তে গেল। ওখানে রিকশা নেই। দেশে এসে বাবা গাড়ি কিনে দিলেন চলাফেরার জন্য। তবে একদম যে মনে নেই, তা কিন্তু নয়। মাথায় ক্ষীণ জোড় প্রয়োগ করতেই ঠোঁটে চলে এলো ঠিকানাটা। দরদার ছাড়াই রিকশায় উঠে বসলো প্রণয়।
রিকশা চলছে। রিকশার গতির তালে তালে বাতাসের ঝাপটা ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রণয়কে। এ যেন এসির থেকেও ঠান্ডা, শীতল পরশ। শান্তি লাগছে খুব। ঘুম চলে আসছে। প্রণয় কিন্তু নির্জনতা খুব একটা পছন্দ করে না। সারাজীবন একা একা থেকেছে বলেই হয়তো। কিন্তু এই নির্জন রাস্তাটা খুব করে টানছে তাকে। যেন বলছে, “এসো হে, এখানে শান্তি বেঁচা হয়। তুমি কি কিনবে একটু করে?”

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটাতে গিয়ে প্রণয় আবারও থমকালো। ভুলেভালে পুরোনো ওয়ালেট-টা নিয়ে এসেছে সে। খুলতেই বামপাশের কিছু অব্যবহৃত কার্ডের মাঝখানে তরীর একটা পুরোনো ছবি দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে প্রথমেই। তরীর ছোটবেলার ছবি। তখন বোধহয় মেয়েটা আট বছরের একটা পিচ্চি। প্রণয়ের বয়সও খুব কম। সবে কিশোরে পা দিয়েছে। আলী নামের একটা ছেলে ছিল ওই গ্রামে। মারাত্বক ছবি তুলতে পারে। সেদিন প্রণয় তরীকে কি জন্য যেন বকেছিল। কাঁদতে কাঁদতে মুখটা পানি পানি করে ফেলেছিল মেয়েটা। আলী তখন চুপিচুপি ছবিটা তুলেছিল। প্রণয় জানতো না। পরবর্তীতে পূর্ণযুবক বয়সে পারিবারিক এলবামে এই ছবিটা খুঁজে পেতেই কেটেকুটে ওয়ালেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল সেই অনেক আগে। এখন আর ওয়ালেট-টা ব্যবহার করা হয়না।
প্রণয় দারোয়ানকে ডেকে বললো, “তোমার কাছে পঞ্চান্ন টাকা হবে চাচা? আমি পরে এসে দিয়ে যাবো।”

________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here