বকুলতলা ২৮,২৯

0
202

বকুলতলা ২৮,২৯
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২৮.
মাহাদের সাথে কাটানো পরের মুহুর্তগুলো বিষাদ হয়ে উড়ে গেল। দুজনের কেউই বাঁধা দিলো না। উড়ছে যখন উড়ুক। উড়ে চলে যাক। কিছু অভিমান রয়ে গেলেও কিছু বিষাদ উড়ে যেতে হয়। কেননা অভিমান গুলো আপনাকে কাছে আসতে শিখাবে। নয়তো এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিবে। কিংবা অভিমানের রেশ ধরে হলেও আপনি তাকে মনে রাখবেন। কিন্তু বিষাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো হয়ে যায়। তাকে মনে করে কষ্ট পাবেন বলে সেই মানুষটাকে আপনি মনেই করতে চাইবেন না। তারপর একদিন এমন ভাবে স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যাবে যে, তখন ধ্যান, জ্ঞান আপনার কাছে থেকেও নেই।
হাঁটতে হাঁটতে তরীকে তার এলাকা অব্দি পৌঁছে দেয় মাহাদ। অতটুকু সময়ে লোকটা চুপচাপই ছিল। কথা বলেনি। তাকায়নি। হাতটা শক্ত করে ধরেছিল শুধু। এলাকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হাত ছেড়ে দিলো। শান্ত গলায় শুধালো, “মন ভালো হয়েছে?”

বাজে প্রশ্ন। ভিত্তিহীন প্রশ্ন। মন ভালো হবে কিভাবে? মাহাদ কি সুযোগ দিয়েছে মন ভালো করার? উলটো আরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তরীর ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি গ্রামে চলে যেতে। এই শহরের বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া খুব কঠিন। শহরটা বড্ড অচেনা তার জন্য। অচেনা এখানকার মানুষগুলো, অলিগলিতে হওয়া অচেনা ভয়ে আঁতকে উঠা ক্ষণগুলো। শুধু চেনাজানা আছে ওই দুটোমাত্র চরিত্রের সাথে। যারা তার জীবনে এসে তার এলোমেলো ভাবনাকে আরও এলোমেলো করে দিয়েছে। চরিত্র দুটো কিন্তু পুরুষ। নাম কিন্তু মাহাদ আর প্রণয়।
তরীর উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো মাহাদ। উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, “হয়নি ভালো?”
—“না।”
—“কেন হয়নি?”

জবাবে এবারও নিশ্চুপ সে। মাহাদ একটু করে এগোলো। এক কদম। তরীর গালের শুকিয়ে যাওয়া পানিকণার দাগে আলতো করে হাত বুলালো। বললো, “তুমি শুধু একবার বলে দাও তরী, আমার উপস্থিতি, কাছে আসা তোমার ভালো লাগে না। কথা দিচ্ছি, আর তোমার মুখোমুখি হবো না। কিন্তু খবরদার! মিথ্যে বলবে না। আমি কিন্তু বুঝে যাবো।”
তরী শুনলো। শুনলোই শুধু। কিছু না বলে হেঁটে চলে এলো বাড়িতে। তার এখন আর কান্না আসছে না। অথচ বুকটা ভীষণ কাঁন্নায় হাঁসফাঁস করছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানির জন্য আর্তনাদ করছে। মাহাদটা এত অবুজ! তরীর নিষ্ঠুর হৃদয়কে গলানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মজে থাকে সারাদিন। কিন্তু তরী তো স্বার্থপর না। তার মতো শত দাগ লাগানো মেয়েটা কিভাবে দাগহীন ছেলেটার সাথে জড়িয়ে যাবে?

তরী সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আর বের হয়নি। দুপুরের পর পানি ছাড়া পেটেও কিছু যায়নি। সালেহা অবশ্য দুতিনবার খেতে ডেকেছিল। তরী একবাক্যে খাবে না জানিয়েছে। মাঝরাতে আবার দরজার ওপাশে প্রণয়ের কণ্ঠও শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। ক্ষীণ স্বরে খাওয়ার জন্য ডাকছিল লোকটা। তরী তখন বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে শুয়ে আছে। সিলিংয়ের দিকে নিশ্চল চোখজোড়া ভ’য়া’বহ ভাবে স্থির। ন’টার দিকে বরকত সাহেব কল করেছিলেন। তরীর বড় বোন বাঁধনকে নাকি ওর শ্বশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কারণ বলতে এটুকুই, বাঁধন চতুর্থবারের মতো মৃ’ত সন্তান জন্ম দিয়েছে। এখন এই অ’লক্ষী মেয়েকে বাঁধনের স্বামী, শ্বাশুড়ি কেউই রাখতে চাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে বরকত সাহেব বিকালবেলা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন।
সব শুনে তরী একটা বড়োসড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পীড়াদায়ক দীর্ঘ নিশ্বাস। কেন যেন মনে হতে লাগলো, সবকিছুর মূল সমস্যা আসলে সে-ই। তার সঙ্গে জড়িত একটা মানুষও ভালো নেই। সবাই কষ্টে আছে। ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছে।

অর্ণব বাচ্চাদের অত পছন্দ করতো না। বলা চলে দেখতেই পারতো না। যখন জানলো তার নিজের স্ত্রীই অন্তঃসত্ত্বা, তখন মেজাজ দারুণ তেঁতে উঠলো তার। তরীর হাতে কয়েকটা ঔষধ ধরিয়ে দিয়ে বললো, “এটা খেয়ে নাও। আমি এখনই বাচ্চা চাইনা। আশা করি আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না তুমি।”

তরী তখন অন্য খেয়ালে বসবাস করছে। তার ছোট্ট পেটে ছোট্ট একটা মানুষ বেড়ে উঠছে। যার ছোট ছোট হাত থাকবে। পা থাকবে। এট্টুক একটা মুখ থাকবে। আধো আধো বুলিতে তরীকে মা বলে ডাকবে সে। কথাগুলো ভাবলেই তরীর শরীরে শিহরণ জাগে। মনে হয়, অর্ণব যা খুশি করুক। তার কিচ্ছু যায় আসে না। এই ছোট্ট আদুরে সোনাটা তার হলেই চলবে। কিন্তু অর্ণব সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। পড়ালেখাটাও ততদিনে বন্ধ করে দিয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো মাধ্যম অবশিষ্ট নেই। তরীর নিজেকে মানসিক রোগী মনে হচ্ছিল। সে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না নিজ সন্তানকে মে’রে ফেলতে। অর্ণব প্রথমে ধৈর্য ধরে বোঝাতে লাগলো। নিজের রূপ পালটে ফেললো একদম। তরীকে ভীষণ কৃত্রিম ভালোবাসা দেখিয়ে রাজী করাতে চাইলো। কিন্তু তরী তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল! ততদিনে অবশ্য সে অর্ণবকে চিনে ফেলেছে। এ যে অর্ণবের কেমন ভালোবাসা, সেটাও অজানা নয়।
সেদিন বুধবার ছিল। তরীর স্পষ্ট মনে আছে। সন্ধ্যার দিকে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে মাত্র ঘরে ঢুকেছে সে। ফুলস্প্রিডে ফ্যান চালিয়ে সোফায় বসেছে। ওমনি কোত্থেকে অর্ণব দৌড়ে এলো। নে’শা করে শরীরের তাল নেই। হেলছে, দুলছে। কিন্তু চোখ মুখ ভীষণ শক্ত। রাগে ভরপুর। টেবিল থেকে গর্ভপাতের ঔষধগুলো হাতে নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “তুই এইগুলা খাবি না?”
অর্ণবের আচরণ দেখে তরী ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল। হাত-পা কাঁপছিল আগাম আত’ঙ্কের কথা ভেবে। তবুও থেকে থেকে উত্তর দিয়েছিল, “নাহ্।”
জেদ যেন তক্ষুণি অর্ণবের মাথা চড়া দিয়ে উঠে। ভ’য়ংকর ক্রোধের সঙ্গে ঔষধের পাতা থেকে তিন, চারটা ঔষধ নিয়ে তরীর মুখে ঢুকিয়ে রুঢ় ভাবে মুখ চেপে ধরলো। তরীর শরীরের ওপর প্রায় উঠে বসেছিল অর্ণব। মুখ এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে, তরীর মনে হচ্ছিল গালে আঙুল ডেবে যাচ্ছে। মুখের ভেতরটায় ক্ষীণ নোনতা স্বাদও পাচ্ছিল। বোধহয় দাঁতের সাথে লেগে গালের ভেতরের চামড়া কেটে গেছে। অর্ণবের কিন্তু সেসবে বিন্দু মাত্র পাত্তা নেই। সে তার মতো চেঁচাচ্ছে ঔষধ গিলে ফেলার জন্য। পানি ছাড়া কি ঔষধ আদৌ গেলা যায়? কিন্তু তরী গিলে ফেলেছিল। নোনতা র’ক্ত, থুথু একাকার হয়ে একটা ঔষধ গলা চেপে একটু একটু করে নামছিল। সেটাও অর্ণবের ভালো লাগছিল না। অনবরত বিশ্রী বিশ্রী গা’লি দিচ্ছিল তরীকে। একসময় ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। তরীকে অসহ্য লাগছিল তার। মেয়েটাকে যতবার দেখছে, ততবারই মা’রার জন্য হাত,পা নিশপিশ করছিল। শেষে পা দিয়ে তরীর পেটে লাগাতার কয়েকবার আ’ঘা’ত করলো সে। তরীর সব যেন অন্ধকার হয়ে আসলো নিমিষেই। চোখ উলটে গেছে। ঝাপসা সব। মুখে থেকে রয়ে যাওয়া ঔষধগুলো বেরিয়ে এসেছে। যন্ত্রণাগুলো সহ্য করতে পারছিল না তরী। ঝড়ে যাচ্ছিল দমকা বাতাসে বকুলফুলের মতো।

তরীর শ্বাশুড়ির নাম ছিল উম্মে নাহার। মহিলার নাম যতটা স্নিগ্ধ, মহিলা ততটাই কর্কশ, বদমেজাজি। তরীর সাথে কখনো কথা না বললেও তিনিও কিন্তু কম অত্যা’চার করেন নি। নিরবে যু’দ্ধ চালাতেন তরীর সঙ্গে। তরী প্রেগন্যান্ট জেনেও কাজের বেলায় একচুলও ছাড় দেননি। কিন্তু সেদিন ছেলের এহেন আগ্রাসী কান্ডে কিভাবে যেন তার মনে একটু হলেও মায়া জাগলো। বরকত সাহেবকে ফোন করে তরীর অবস্থা জানালেন। বরকত সাহেব তৎক্ষণাৎই বেরিয়ে পরেছিলেন মেয়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গেছে। ঘরের সাদা ঝকঝকে টাইলসের মেঝেটা র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে শুকিয়ে গেছে বহু আগে। আশেপাশে কোথাও অর্ণব নেই। সে অনেক আগেই চলে গেছে। বরকত সাহেব একা একাই মেয়েকে কোলে তুলে হাসপাতালে রওনা হলেন। তরী বেঁচে গেলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। তরী হারালো ওর মা হওয়ার ক্ষমতা।

মেয়ের এরূপ অবস্থা তরীর মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। নিজেকে দোষী করছিলেন বারবার। তার জন্যই তো তার মেয়ের এ অবস্থা! তিনিই তো মেয়েকে ওই ন’রপ’শুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে অর্ণব নামক বিষ অজান্তেই তাকেও খেয়ে ফেললো। ওইযে উঠোনের বকুলগাছটা? ওখানেই তরীর মাকে কবর দেওয়া হয়েছে। প্রিয় বকুলতলার ছায়াতলে। ভয়ে এজন্য তরী সেখানে এখন আর যায় না। বকুলগাছের নিচে একটু আরাম করে বসে না। মনে হয়– মনে হয় মা যেন ওকে ডাকছে। চিৎকার করা কান্নায় ভারী করে দিচ্ছে আশপাশ। যেন জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওকে। ক্ষমা চাইছে। তরীর এত ভয় হয়! এত এত ভয় ও কখনো পায়নি। কখনো না।

মায়ের মা’রা যাওয়ার, বাচ্চা হারানোর বেশিদিন হয়নি তখনো। অর্ণব এরমধ্যেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। তরী যদিও খুশি হয়েছিল। কিন্তু একটা বিষয় ও তখনো বুঝতে পারেনি। ছেলেটা তো ওকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। তাহলে তার সাথে এমন করলো কেন? পরে জানা গেল, অর্ণব আসলে তরীকে কখনো পছন্দই করতো না। কলেজে প্রথম দেখা, পছন্দ করা এসবই বানোয়াট। তরীকে অর্ণব বিয়ের আগে কখনোই দেখেনি। বরং নিজের ছেলের বউ হিসেবে মাতব্বরই তরীকে পছন্দ করে এনেছিলেন। মাতব্বরের কথাতেই তরী, তরীর পরিবার, সবার সাথে এতকাল ভালো মানুষী করে গেছে অর্ণব। মাতব্বর মা’রা যেতেই ভেতরকার ঘৃণা উপচে আসলো। তরী তো ধ’র্ষিতা। ধ’র্ষিতা মেয়েদের এমন মানসম্মানী লোকেরা বিয়ে করে না। ভালোবাসে না। ওদের ওই অপবিত্র গর্ভ থেকে অপবিত্ররাই জন্মায়।

________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

২৯.
ক্ষুধার চোটে ঘুমটা পুরোপুরি হলো না তরীর। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। বাড়ির কেউই এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। তরী আলসেমী কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই আয়নার দিকে চোখ পরলো। মুখটা তেলতেলে হয়ে আছে। চোখদুটো ফুলে একাকার। সে তো রাতে কাঁদেনি। বেশি ঘুমায়ও নি। চোখদুটো এভাবে ফুলে আছে কেন? নিজেকে দেখতে কেমন অসুস্থ, অসুস্থও লাগছে। যেন কতকাল হাসপাতালের দারে দারে দৌঁড়েছে সে! শ্যামবর্ণের চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে শ্বেতরোগের মতো লাগছে। তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মুখটা ধুঁয়ে নিলো। ওড়না জড়িয়ে আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পরলো।
চারপাশটা এখন সুনশান নিরবতায় ঘিরে আছে। তরী পা টিপে টিপে রান্নাঘরে এগোলো। ফ্রিজ খুললো। কিন্তু ফ্রিজে খাওয়ার মতো কিছু নেই। একপাশে শুধু ভাতের বড় প্লেট আর মাছের তরকারি। এই সকাল বেলা তরীর এসব খেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের জন্য সে ছটপট নুডলস রেঁধে নিলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই দেখা হয়ে গেল প্রণয়ের সাথে। একেবারে ফর্মাল ড্রেস-আপে ঘর থেকে বেরিয়েছে লোকটা। তরীকে দেখে একটু থমকালো যেন। তারপর মুচকি হেসে বললো, “কেমন আছেন?”

প্রণয়কে তরীর পছন্দ না। আগে থেকেই। ছোটবেলার যেটুকু স্মৃতি মনে আছে, সর্বদা গম্ভীর হয়ে থাকতো প্রণয়। তাদের সাথে মিশতো কম। কিংবা একেবারেই না। এখানে এসে যাও একটু কথা বললো, সব অতীত নিয়ে! কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে প্রণয়ের কৃত্রিম মলিন হাসিটা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিলো কথা বলার জন্য। অকারণেই মায়া জাগলো। আমতা আমতা স্বরে জবাব দিলো, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
—“আছি।”
—“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
—“হ্যাঁ। হস্পিটালে ইমার্জেন্সি কাজ পরে গেছে। এক্ষুণি যেতে হবে।”

তরী হালকা মাথা কাত করে সায় দিলো। সে ভেবেছিলো প্রণয়কে নাস্তার জন্য বলবে। কম সময়ে একটুখানি চা বানিয়ে হলেও দেয়া যাবে। কিন্তু প্রণয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার হাতে একদমই সময় নেই। খাওয়ার সময়টুকুও না। তাই এ বিষয়ে আর কিছু বললো না ও। ঠোঁটে জোড়পূর্বক হাসি টেনে চলে যেতে নিলেই প্রণয় হঠাৎ শুধালো, “আপনার চোখ ফোলা কেন তরী? সারারাত কেঁদেছেন?”
—“না। কাঁদবো কেন? এমনি ফুলে গেছে।”
প্রণয়ের বিশ্বাস হলো না একদমই। সে কেমন গভীর দৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখলো সামনের মেয়েটাকে। পরখ করে নিলো বিশেষ কিছু। এরপর নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?”

তরী একটু করে মাথা তুললো। ক্ষণিকের জন্য। ভ্রু ক্রুটি করে বললো, “আমি কেন রেগে থাকবো?”
—“ওইযে? আপনাকে ভালোবাসি বলেছিলাম?”
—“আপনার ইচ্ছে হয়েছে বলেছেন। আবার ইচ্ছে হলে অতীত টেনে আনবেন। এতে আমি রাগ করবো কেন? রাগ করলে কি আপনার স্বভাব পাল্টাবে?”

স্পষ্ট খোঁচা! ভেতরটা অগ্নিগি’রির দা’বানলে ঝল’সে গেল যেন। ধুকধুক শব্দের আন্দোলন থেমে গিয়ে দুঃখের আহাজারি করে উঠলো। চেঁচালো মন, মস্তিষ্ক। প্রণয় নিজেকে এতটা অসহায় বোধহয় কখনো অনুভব করেনি। সে তার অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ। এই ছোট্ট মুহুর্তে দাঁড়িয়েও ব্যর্থ। করুণ নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রণয় সুপ্ত অভিযোগ জানালো, “আমাদের কথোপকথনটা কেন ঝগড়াতেই থেমে যায় তরী? কখনো গভীর দৃষ্টিতে আমাকে তাকিয়ে দেখেছ? এক সমুদ্র ভালোবাসা না পেলেও তোমার জন্য পাওয়া আমার এক আকাশ কষ্ট ঠিকই দেখতে পেতে।”

অথচ কথাগুলো বলা হয় না। নির্জন রাস্তায় বিক্রি করা প্রশান্তিগুলো সে আজও কিনতে পারেনি। রিকশায়, গাড়িতে তার পাশের ফাঁকা জায়গাটা শূণ্য হয়েই থাকে। প্রণয়ের বুকটা এত বাজে ভাবে ভারী হয়ে আসে! তার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না।

টং-এর দোকানে রেডিও চালু করে রাখা। মৃদু শব্দে একটা পুরোনো গান বাজছে। দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকা কিছু যুবক সমান তালে গলা উঁচিয়ে উঁচিয়ে গাইছে গানটা। দোকানের চাচা পান খাওয়া লাল লাল ফোকলা দাঁতগুলো বের করে হাসছেন। মহানন্দে চা বানাচ্ছেন। মাঝে মাঝে যুবকদের সাথে গলা মিলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে তাল মিলাচ্ছেন। আশপাশে কি সুখ, সুখ মনোভাব! তরীর ভালো লাগলো খুব। মন ফুরফুরে হয়ে গেল। গেট মাড়িয়ে আসতে আসতে যতটুকু শোনা যায়, কান খাড়া করে ওদের আনন্দের সুর শুনলো। এক কদম, দুই কদম, তিন কদম। আচমকা মাহাদের ত্যাড়া কথা শোনা গেল, “তোমাকে এখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই তরী?”

তরী আঁত’কে উঠলো। নেত্রজোড়া বড়োসড়ো করে তাকাতেই ভড়কালো জোরেসোরে। মোটরসাইকেলে বসে নেতা নেতা ভাব নেওয়া এলোমেলো মাহাদকে হঠাৎ পরিপাটি বেশে দেখে হজম হলো না। মাহাদ অমায়িক হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গালের গুন্ডাদের মতো দাঁড়িগুলো একটু ছেটেছে। উষ্কশুষ্ক চুলগুলো সুন্দর করে একপাশে আঁচড়ানো। সাদা শার্টের বুক বরাবর একটা আইডি কার্ড ঝুলছে। তরীর চোখ সরলো না। আশ্চর্য চোখে চেয়েই শুধালো, “আপনার কি হয়েছে?”
—“আমার কি হবে?”
—“আপনাকে ঠিক লাগছে না।”

মাহাদের কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ পরলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, “আমাকে তোমার কখনই-বা ঠিক লাগে?”
তারপর খানিক্ষণ সময় নিয়ে তরীর মুখশ্রী আগাগোড়া দেখে নিলো। হতাশ কণ্ঠে আবার বললো, “খানা দানা কিছু খাও না? মুখের এই অবস্থা কেন? বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে। করো নি। নয়তো এতদিনে একটা সুখবর পেয়ে মোটাসোটা হয়ে যেতে।”

তরী কি রেগে গেল? রেগেমেগে এখন মুখটা কি ভীষণ লাল করে ফেলবে? নাহ্! মুখটা লাল হলো না। কিন্তু ভীষণ রেগে কটমট নয়নে তাকালো মেয়েটা।

—“আপনি কি কখনো শুধরাবেন না বলে শপথ নিয়েছেন?”
—“তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। শুধরে কি করবো?”
—“আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসবো না মাহাদ। কেন বুঝেন না? এত বেহায়াপনা কেন করেন? মিনিমাম সেল্ফরেস্পেক্টটুকুও নেই?”
আরও একদফা হতাশ হয়ে ধীরে ধীরে আটকে রাখা নিশ্বাসটা একটু একটু করে ছাড়লো মাহাদ। কথাটা গায়ে লেগেছে খুব। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বেলায় মাহাদ নিত্যান্তই বেহায়া, আত্মসম্মানহীন। হাত বাড়িয়ে তরীর হাতটা টেনে মোটরসাইকেলের কাছে নিয়ে গেল। খুব শান্ত স্বরে বললো, “চলো, বাসায় পৌঁছে দিবো।”
—“আমি আপনার সাথে যাবো না।”
—“আমি তবুও নিয়ে যাবো।”
—“আপনি এমন অসহ্য কেন?”
—“তুমি অসহ্য চোখে দেখো বলেই হয়তো।”
—“আপনি বলেছিলেন, আমি যদি আপনাকে চলে যেতে বলি তাহলে আপনি চলে যাবেন। আর আমার সামনে আসবেন না।”
—“কিন্তু কথাটা তুমি মন থেকে বলছো না তরী। আগে বলো। তারপর চলে যাবো।”
এপর্যায়ে তরী বিস্ময়ে আর কিছু বলতে পারলো না। বিমূঢ়, ধৈর্যহারা হয়ে চুপ হয়ে গেল। মাহাদ আসলে কিসের তৈরি? কোনোভাবেই ভেঙ্গে ফেলা যায় না কেন একে? বরং তরী নিজেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভেঙ্গে গুড়িয়ে নিঃশেষ হচ্ছে।

—“আকাশের দিকে তাকাও তো তরী।”
মাহাদের আদেশে ভরপুর কণ্ঠ। তরী মুখ তুলে তাকালো। দেখলো, একঝাঁক সাদা মেঘেদের। মন ভালো করা নীল, সাদা রঙদের। প্রশান্তিদের। মাহাদ প্রশ্ন করলো, “কি দেখতে পাচ্ছো?”
—“শান্তি।”
—“আমি কি দেখতে পাচ্ছি জানো?”

তরী অল্প মাথা নাড়ালো। সে জানে না। দৃষ্টি তখনো আকাশপানে কঠিনভাবে স্থির। মাহাদ বলতে রইলো, “আমি আমাদের বিচ্ছেদ দেখতে পাই তরী। তোমাকে হারিয়ে ফেলার পর আমার পরিণতি দেখতে পাই।”

হুট করেই আকাশ থেকে পাওয়া প্রশান্তি আর অনুভব করতে পারলো তরী। বিষাদে ভরে গেল ভেতরটা। কথা ঘুরাবার জন্য বললো, “আপনার গলায় এটা কিসের কার্ড?”
—“অফিস থেকে দিয়েছে।”
তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “অফিস মানে?”
—“খুঁজে খুঁজে একটা চাকরি নিয়েছে। সাংবাদিকতার।”
—“আপনি সাংবাদিক?”

মাহাদ তরীকে মোটরসাইকেলে বসতে ইশারা করে বললো, “আমার খবর তো কিছু রাখো না। তাই না জানাটাও স্বাভাবিক। আমার সাংবাদিকতা ভালো লাগে। ওই সাবজেক্টেই পড়ালেখা শেষ করেছি।”

___________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here