বকুলতলা ৩০,৩১

0
338

বকুলতলা ৩০,৩১
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৩০.
টুপটাপ বৃষ্টির দিন। রাস্তার কোণ ঘেঁষে যে গাছটা আছে? ওখানে জোড়া শালিক বসে আছে। আদুরে ভাবে একে অপরের সাথে লেগে আছে ওরা। উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। জানালা গলিয়ে সে দৃশ্য নিষ্পলক দেখছিল তরী। মুগ্ধ হচ্ছিল বারংবার। পাশ থেকে কন্ডাক্টর তার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, “আফা, ভাড়াটা দেন।”

তরী জানালা থেকে চোখ সরালো। যাত্রী নেওয়া শেষে বাসটা চলতে শুরু করেছে মাত্র। তার পাশের মহিলা যাত্রীটি ঘুমে বিভোর। এত কোলাহলেও ঘুম ভাঙ্গছে না। তরী ব্যাগ থেকে খুচরা টাকা মিলিয়ে কন্ডাক্টরকে দিয়ে দিলো। কন্ডাক্টর এবার পাশের মহিলাটিকে ডাকতে লাগলো। অনেকটা বিরক্ত ভঙ্গিতে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। আশ্চর্য! লোকাল বাসে এমন ম’রার মতো ঘুমাচ্ছে কেন? এত ডাকার পরও উঠছে না!
খানিক্ষণ পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আকাশ ঘন কালো হয়ে আছে। বিকাল নাকি সন্ধ্যা– বোঝা যাচ্ছে না। তরী সময় দেখতে ফোন হাতে নিয়েছিল। পাওয়ার বাটনে চাপ পরতেই দেখলো, স্ক্রীনে মাহাদের তিন চারটা মিসড্ কল ভেসে আছে। দুই মিনিট আগের। এখন আবারও কল এসেছে।

—“কোথায় তুমি? চলে গেছো?”
তরী আস্তে করে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, বাসে এখন।”
—“আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলে?”
প্রশ্নের তোড়ে তরী হকচকালো। সে কি আদৌ সত্য কথাটা বলবে? কখনোই না। অকপটে মিথ্যাটাই বললো, “অপেক্ষা করবো কেন? আপনি অপেক্ষা করার মতো কে?”

তৎক্ষণাৎ সুস্পষ্ট হাসিটা ঝনঝন করে কানে বাজলো। মাহাদ জানে, তরী নামক নিষ্ঠুর নারীটি মিথ্যা বলছে। বলাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মিথ্যা বলার ধরণটা মাহাদের খুব ভালো লাগলো। হাসির দমকে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলো না সে। সময় নিয়ে শুধালো, “এখন কোথায় আছো? বাসায় পৌঁছাতে আর কতক্ষণ?”
—“বেশি নেই। আর পনেরো মিনিটের মতো। আপনি এখন কোথায়?”
—“তোমাকে নিতে ভার্সিটি গিয়েছিলাম। তুমি তো আগেই বাসে চলে গেলে। বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় এখন বাসস্টেন্ডে বসে আছি।”

তরী একবার বাহিরের দিকে তাকালো। প্রচন্ড বৃষ্টিতে আশপাশের কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি যে ঘণ্টাখানেকের আগে বন্ধ হবে না, তা নিশ্চিৎ! মনটা কেমন হাঁসফাঁস করলো তরীর। দীর্ঘশ্বাস ফেললো খুব সন্তপর্ণে, খুব গোপনে। লোকটা তার জীবনে আরও আগে এলো না কেন? একটু বেশিই দেড়ি করে ফেলেছে না?
নিরবতার সুতো কেটে গেল একটু পরই। ওপাশ থেকে মাহাদের উদাস কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “তরী! আমার আর এই চাকরি, বাকরি ভাল্লাগছে না। সাংবাদিকতা তো আরও বোরিং! এর চেয়ে তিন চারটা সিগারেট বসে বসে শেষ করলেও দুনিয়ার তৃপ্তি! তাও যা চাকরিটা করতে মন চাইতো! সারাদিনের কাজ শেষে, বাসায় ফিরে বউয়েরই দেখা পাই না। এই মেয়ে! আমাকে বিয়ে করছো না কেন তুমি? আমি তো এখন আর বেকার নই।”
তরী সামান্য চুপ থেকে শুধালো, “আমি কখন বলেছি আপনি চাকরি করলে বিয়ে করবো?”
মাহাদ একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে বললো তখন, “বলো নি কেন? তুমি আমার কাছে কোনো আবদারই করতে চাও না তরী।”

বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। ঠান্ডায় কাঁপাকাঁপি বেড়েছে। তরী চুপচাপ মাহাদের অভিযোগ শুনলো। মুখে কিছু বললো না। ফোনের ওপাশ থেকে লোকটার নিশ্বাসের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাতাসে শো শো আওয়াজও স্পষ্ট। সেই আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে বললো, “গান শুনবে তরী?”

তরী তখনো জবাবহীন। নিশ্চুপ। তার নিশ্চুপতাকেই সম্মতি ধরে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠলো মাহাদ। সময়টা যেন তক্ষুণি থমকালো। থামতে বাধ্য হলো। হুশ, জ্ঞান হারালো দূর কোথাও।

প্রণয়ের পাগলামি যে এভাবে বেড়ে যাবে, তরী কস্মিনকালেও ভাবেনি। এই শান্ত, চুপচাপ ছেলেটার উড়নচণ্ডী জেদ সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে মায়ের সাথে একচোট ঝগড়াও করে ফেলেছে সে। ঘটনাটা তরীর আসার আগের। তরী জানতো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই আসার পর থেকে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে, কাজ করছে, রান্নাঘরে যাচ্ছে। এরমাঝে রফিক সাহেব একবার তাকে ডেকে পাঠালেন। বরকত সাহেবকে দুএকদিনের ভেতর ঢাকায় আসার জন্য জোর তাগাদা দিলেন। সব কিছু ভীষণ অস্বাভাবিক। আয়েশা খাতুনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটুকুও এড়ানো যাচ্ছে না। মহিলা কেমন ক্ষুব্ধ হয়ে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। মুখশ্রীতে প্রবল অসন্তোষ ভাব ঘুরঘুর করছে।

সালেহা সেই প্রথম থেকে মুখটা চুপসে রেখেছে। যেন ভীষণ মন খারাপ তার। তা দেখে তরী কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? এভাবে মন খারাপ করে আছো কেন?”
—“আমার আপনার জন্যে খারাফ লাগতিছে আফা।”
ভ্রু কুঁচকে তরী বললো, “আমার জন্য খারাপ লাগছে? কেন?”
—“ওইযে? আপনে আপনার প্রেমিকরে আর বিয়া কইরতে পারবেন নাহ্।”
—“তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না সালেহা। কি বলছো এগুলো?”
—“আপনে তো কিচ্ছু জানেন না। প্রণয় ভাইজান আইজকা অনেক কাহানি ঘটাইয়া লাইছে। বুড়ির লগে ঝগড়াও করছে। আপনেরে নাকি ভাইজান যে কুনু মূল্যে বিয়া কইরবো। বুড়ি তো পতমে মানবারই চায় নাই! ফরে আংকেল কইছে বিয়া দিবো। জেদ না কইরতে।”

কথাগুলো তরীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। প্রণয়ের প্রতি রাগ, ঘৃণা যেটাও থাকুক, সেটা একটু হলেও বেড়ে গেল বোধহয়। কিছু বলার জন্য ঠোঁট কাঁপলো। স্তব্ধ হওয়া মস্তিষ্ক সচল হতে সময় নিলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “প্রণয় ভাইয়া এখন কোথায়?”
আরেকটু মন খারাপ করে সালেহা উত্তর দিলো, “ছাদে যাইতে দেখছিলাম।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “প্রণয় ভাইজান তো অনেক ভালা আপা। আপনের প্রেমিক কি ভাইজানের থেইকাও ভালা?”
তরী জবাব দেয় না। চুলাটা বন্ধ করে ছুঁটে চলে ছাদের দিকে।

ছাদের এক কোণায় প্রণয়কে পাওয়া গেল। চওড়া রেলিংয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। এলোমেলো ভাবে। পরনের সাদা শার্টের পিঠের অংশে কিসের যেন দাগ। মুখটা একপাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। প্রচন্ড বিষণ্ণ চোখজোড়া বিস্তর গগনপানে একদম স্থির। তরী ছাদের দরজা ধরে বেশক্ষণ দাঁড়িয়ে জিড়িয়ে নিলো। হাঁপাল, শ্বাস নিলো জোড়ে জোড়ে। এরপর প্রণয়ের কাছাকাছি এগোতেই আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো লোকটা। ঠান্ডা চাহনি।
তরী ভণিতা ছাড়াই কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করলো, “আপনি কোন সাহসে এসব করছেন? লজ্জা করেনি একটুও?”

প্রণয় কথা বললো না। অদ্ভুদ ভাবে চেয়ে রইলো। মারাত্বক মলিন চেহারা। তরী আগের চেয়েও কঠোর ভাবে বললো, “উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমাকে বিয়ে করতে চান আপনি? কেন করতে চান? দয়া দেখিয়ে? আমি বলেছি দয়া দেখাতে?”
—“দয়া তুমি আমাকে দেখাও তরী। কম করে হলেও ভালোবাসো।”

অধৈর্য হয়ে গেল তরী। এত এত কান্না পাচ্ছে! এত অসহায় লাগছে! এটা কেমন জীবন? তাকে ধর্ষণ করার সময় এরা কেউ ছিল না। বিয়ের আগেও ছিল না। পরেও ছিল। এখন কোত্থেকে এসে হাজির হচ্ছে? ঠোঁট হালকা ফাঁক করে ক্ষিপ্ত নিশ্বাসগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে দিলো তরী। রয়েসয়ে বললো,
—“আপনি এক্ষুণি মামাকে বলবেন আপনি বিয়ে করবেন না।”
—“আমি বলতে পারবো না।”
—“কেন বলতে পারবেন না?”
তরী উত্তেজিত হয়ে পরলো। অথচ প্রণয়ের একই কথা,
—“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
—“আমি আপনাকে কখনোই বিয়ে করবো না। শুধু শুধু জেদ করছেন আপনি।”

রেলিং ছেড়ে মেঝেতে দাঁড়ালো প্রণয়। একটু করে তরীর কাছে এলো। আস্তে আস্তে আওড়ালো, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তরী। অনেক আগে থেকে। সেই ছোটবেলা থেকে।”
—“আচ্ছা! আমাকে যখন ধ’র্ষণ করা হয়েছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন? যখন বিয়ে হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলেন?”
—“আমি এসব জানতাম না তরী।”
—“মিথ্যা বলছেন কেন? আসার পর থেকে তাহলে না জেনেই অতীত নিয়ে খোঁচা দিতেন?”
—“বিশ্বাস করো, আমি সত্যি জানতাম না। বিদেশ থেকে আসার পর মায়ের থেকে জেনেছিলাম সব। ততদিনে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

তরী অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। ভেতরকার রাগ দমে গেছে বহু আগে। এখন শুধু বিরক্তি ভাবটা সামলাতে পারছে না। এই মানুষটাকে অসহ্য লাগছে। সে কি খেলনার পুতুল? পুতুলই তো। যার যা ইচ্ছা তার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে!
তরী চলে যেতে চাইলো। তাড়াহুড়ো করে তরীর হাত ধরে আটকালো প্রণয়। ম্লান কণ্ঠে বললো, “আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি তরী।”
—“হাত ছাড়ুন। আমি ভালোবাসি না আপনাকে।”
—“তাহলে কাকে ভালোবাসো? ওই মাহাদকে?”
না চাইতেও কণ্ঠস্বরটা পালটে গেল প্রণয়ের। চাপা ক্ষোভে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তরী তখন অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে। শুধালো, “আপনি মাহাদের কথা জানেন কিভাবে?”
—“খোঁজ নিয়েছি। তুমি উত্তর দাও।”

কথাটা যেন তরীর একদমই ভালো লাগলো না। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো ভ’য়ংকর ভাবে। উত্তর তো দিলোই না, হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেসময় প্রণয় এক অভাবনীয় কান্ড ঘটালো। হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধড়লো তরীকে। খুব শক্ত করে। কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে দমবন্ধ করে রইলো অনেক্ষণ। তরীকে নড়তে দিলো না। পরপরই ঢিমে যাওয়া গলায় বারবার বলতে লাগলো, “তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না তরী। একটু তাকাও আমার দিকে। একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি দিনদিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তরী। তুমি আমাকে এমন বানিয়ে দিলে কেন?”

______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

৩১.
বকুলফুলের নিজস্ব ঘ্রাণটা মিষ্টি হলেও বড্ড কড়া ধাঁচের। আশপাশে তরতর করে ছড়িয়ে পরে। গাছের ঝাঁকে ঝাঁকে ফোঁটা ফুলগুলো মোহগ্রস্ত করে তুলে মন, প্রাণ। আনন্দের জোয়ার যেন এদিক ওদিক ছোটাছোটি করে সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। এই যানজটে বদ্ধ গাড়ির জানালা খুলতেই অতদূর থেকেও বকুলের সুস্পষ্ট ঘ্রাণ পেল প্রণয়। মন মাতানো ঘ্রাণ। সেবার এমনই বকুলের মৌসুম ছিল। ছোট্ট ভাইটা তার এমন দিনেই মা’রা গিয়েছিল। ছেলের মৃ’ত্যুতে দিশেহারা হয়ে আয়েশা খাতুন দোষারোপ করলেন তরীকে। তরীও তখন ছোট। ছাদে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল অপ্রত্যাশিত ভাবে। কেউই দোষী ছিল না। কিন্তু আয়েশা খাতুন সেটা বুঝতেই চাইলেন না। বরং তরীদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।

প্রণয় ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড বুঝদার। বয়সের তুলনায় বেশি বুঝে। হাসে কম, মানুষের সাথে মিশে কম। নিজের মাঝে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এমন না যে কারো অবহেলায় সে এমন হয়ে গেছে। সবাই তাকে প্রচন্ড স্নেহ করে। আসলে প্রণয়টাই এমন। তার স্বভাবটাই অন্যরকম।
প্রণয়ের যতটুকু মনে পরে, গ্রামে গেলে সে ওই ছোট্ট আলো বাতাসে ঘেরা ঘরটাতেই পরে থাকতো। তরীর সাথে দেখা হয়েছে পাঁচ কি ছয়বার। আর দেখা হলেও প্রত্যেকবার মেয়েটাকে অজ্ঞাত কারণে খুব করে বকেছে প্রণয়। তরীর হয়তো সেটাও মনে সেই। আবদুলের সাথে হয়তো প্রণয়কে ঘুলিয়ে ফেলেছিল বোকা মেয়েটা। আবদুল তো তরীদের ওখানে কখনো যেত না। ও থাকতো নানূ বাড়িতে।

তরীর প্রতি প্রণয় ছোটবেলা থেকেই দূর্বল ছিল। জানালা দিয়ে যখন ছোট্ট মেয়েটাকে বকুলগাছের ডালে বসে পা দুলাতে দেখতো, প্রণয়ের ভালো লাগতো খুব। মেয়েটা প্রতিদিন কোত্থেকে কোত্থেকে যেন পেয়ারা, আম, জাম নিয়ে উঠে বসতো গাছের ডালে। মনের সুখে তার বেসুরো গলায় এমন এমন গান গাইত! ওটা আসলে গানেরই জাতই না। তবে সত্যি বলতে, তরীর প্রতি ওই ভালো লাগাটা ঠুনকো ভালো লাগাই ছিল। তার বয়সই বা তখন কত? ভালোবাসার সে কি বুঝে?

রফিক সাহেব আয়েশা খাতুনের অগোচরেই বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শত হোক একমাত্র বোন তার। বললেই কি সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়? তার ফোনেই প্রথম কিশোরী তরীর ছবি দেখেছিল প্রণয়। গ্রাম্য নারীদের মতো ঢালা শাড়ি পরে কোন বিয়েতে যেন গিয়েছে মেয়েটা। মুক্তর মতো চোখ ধাঁধানো হাসি, সাজ। আবেগে বয়সটায় প্রণয় বিশ্রী ভ্রমে পরে গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার বাবার ফোনটা চুরি করে গ্যালারি থেকে তরীর সব ছবি নিয়ে নিয়েছিল নিজের ফোনে। রাতের বেলা একমনে তরীর ছবিগুলো বারবার জুম করে দেখতো। আস্তে আস্তে ভয়া’বহ প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল না চাইতেও। ভালোবেসে ফেলেছিল ছোটবেলার ওই ছিঁচকাদুনে মেয়েটাকে। যাকে শুধু হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় এককালে মাঠে দৌঁড়াতে দেখেছিল সে!

আয়েশা খাতুন কিভাবে যেন ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। ওয়ালেটে তরীর ছবি দেখেই হয়তো। তবে একদম না জানার ভান করে রইলেন। ভেতরে ভেতরে রফিককে দিয়ে প্রণয়কে স্কলারশিপের জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। স্কলারশিপও হয়ে গেল এর মাঝে। প্রণয় পড়াশোনায় ভালো। না হয়ে যাবে কোথায়?
বিদেশে গিয়ে প্রণয়ের ভালোই দিন কাটতে লাগলো। নতুন শহর, নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন কিছু শিখার উদ্যোগ আর রাতের বেলা তরীর ছবি দেখা। দিনগুলো মন্দ কাটছিল না। প্রণয় মনে মনে আশায় ছিল, দেশে ফিরে বাবা মাকে তরীর কথা জানিয়ে দেবে। মাস ঘুরতেই তরীকে চটজলদি বিয়ে করে ফেলবে। তার আর এই অপেক্ষা কিছুতেই সইছে না।

তারপর একদিন রফিক থেকে জানতে পারলো, তরীর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। শুনে প্রয়ণ এক মুহুর্তও দেড়ি করেনি। বলে দিয়েছিল তরীকে তার ভালোবাসার কথা। সে তরীকে বিয়ে করতে চায়। রফিকও আশ্বস্ত করলেন, তিনি বিষয়টা দেখবেন। বিদেশে থাকার পুরো সময়টাতে মিথ্যে বলে গেলেন মা, বাবা দুজনেই। দেশে আসার পর তরীর সাথে নাকি তারই বিয়ে দিবেন। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে প্রণয়ও পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরলো। তরীকে নিজের করে পাবে বলে হাজারটা স্বপ্ন বুনে যত্ন করে আগলে রাখলো। সেই যত্ন করে আগলে রাখা স্বপ্নগুলো তারা কেউই বাস্তব হতে দিলেন না। ভেঙ্গে চূড়মাড় করে দিলেন। জানালেন, তরীর আরও একবছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নাকি চেষ্টা করেছিলেন। তরী, তরীর মা-বাবাই রাজী হননি।

প্রণয়ের বুকের ব্যথাটা এখনো সেই আগের মতোই তাজা হয়ে উঠে। যখন ভাবে, তার জন্মদাত্রী মা-ই দিনের পর দিন তাকে মিথ্যে বলে গেছে। ধ’র্ষিতা বলে তিনিই কোনো ধরণের চেষ্টা করেননি বিয়ের বিষয়ে। কে চায় একটা ধ’র্ষিতাকে বাড়ির বউ করতে?

জ্যাম ছেড়েছে বহু আগে। বকুলগাছটা পেরিয়ে বহুদূরে ছুঁটে গেছে তাদের গাড়িটা। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রণয় গাড়ির কাঁচটা আবার উঠিয়ে দিলো। সীটে নিজের মাথা এলিয়ে আস্তে আস্তে বিড়বিড় করলো, “ও আমাকে হয়তো কোনোদিনই বুঝবে না।”

হাসপাতালের পরিবেশ একটু খারাপ। ঘু’ষখোর কোম্পানি তাকে ভালো কোনো হাসপাতালে ভর্তি করায় নি। এ নিয়ে একটু বিরক্তই মাহাদ। একটু বেশিই। আপেলে কামড় দিতে দিতে তরীর দিকে আড়চোখে একটু তাকালোও সে। মেয়েটা চোখ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। তার হাঁটুর কাছে। আজকে সকালে রিপোর্ট করতে একটা বস্তিতে যেতে হয়েছিল তাকে। সেখানেই কিভাবে যেন নড়বড়ে একটা ঘর হুট করেই গায়ের ওপর পরে গিয়েছিল। ব্যথা অবশ্য তেমন একটা পেত না সে, যদিনা ঘরের টিনে গাঁথা কাচ, পেরাক, আর টিনের সূক্ষ্ণ কোণা অংশগুলো পায়ে বিঁধে যেত! তার চেয়ে বেশি গুরুতর অবস্থা হয়েছে ক্যামেরা ম্যানের। বেচারার পেটে আস্ত একটা কাচ ঢুকে গেছে। আপাতত ওটিতে আছে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পর অফিসের স্যারকে জানানোর পাশাপাশি পরিবারের এক দুজন সদস্যকেও জানানো হয়েছিল। মাহাদের মুখে তো সবসময় তরীই লেগে থাকে। নম্বরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তরীর নম্বরটাই সর্বপ্রথম বলে দিয়েছিল সে। তাছাড়া এখানে তো ওর আপন কেউ থাকে না। বজ্জাদ হাসপাতালের কর্মচারীরা বাড়ির লোক না আনা অব্দি নিস্তারও দিচ্ছিল না।
তরী যে কল পাওয়ার পর তক্ষুণি ছুটে এসেছে হাসপাতালে, মাহাদ তা জানে। তরীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে উলটো জামা পরে এসেছে মেয়েটা। চুল আঁচড়ায় নি। এলোমেলো ভাবে উড়ছে ওগুলো। ফোন পাওয়ার পর কেঁদেছিল হয়তো। চেহারা ভীষণ মলিন হয়ে লাল হয়ে আছে। একটু পর পর নাক টানছে। মাহাদ নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটা তাকে এত গভীর ভাবে ভালোবাসে, অথচ স্বীকার করতে চায় না।

মাহাদ আবারও হাসলো। তা দেখে তরী ভ্রু কুঁচকে শুধালো, “কি হয়েছে? হাসছেন কেন?”
—“তুমি উলটো জামা পরে এসেছো তরী।”

তরী লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ালো। এখানে আসার পরপরই বোকার মতো কাজটা খেয়াল করেছিল সে। মাহাদ ঠোঁটের হাসিটা স্থির রেখেই মোলায়েম স্বরে বললো, “তরী, আমি তো তোমার কাছে আসতে পারবো না। কোমড়ে ব্যথা। তুমিও আমার কাছে আসবে না। একটু কষ্ট করে মুখটা ওড়না দিয়ে মুছো তো। কান্নার দাগ বসে গেছে.. এত কাঁদতে হয়? আমি কি ম’রে গেছি?”
তরীর আবার কান্না পেয়ে গেল। তবে সে কাঁদলো না। একদমই না। ঠিক ঠিক মাহাদের কথা মতোই ওড়না দিয়ে গালটা ঘঁষে মুছলো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে হয়েছে এসব?”
মাহাদ মিথ্যে বললো, “মা’রামারি করতে গিয়ে হয়েছে।”
—“মিথ্যে বলছেন কেন? মা’রামারি করতে গিয়ে কি ক্যামেরা ম্যানকেও নিয়ে গিয়েছিলেন সাথে?”
—“হ্যাঁ। ক্যামেরাম্যানটাকে নিজের এসিসট্যান্ট হিসেবে রেখেছিলাম। আমার সাথে একটু হাতে হাতে মা’রামা’রি করবে। কিন্তু ব্যাটা কাজের না। নিজে তো ম’রলোই, সাথে আমাকেও মা’রলো।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ে আছে। চুপচাপ, নিঃশব্দে দেখছে মাহাদকে। লোকটা মিথ্যা বলতে কি পটু! কিভাবে অকপটে একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছে। ভেবে আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে সময় দেখে নিলো। দুপুর তিনটা। সে এসেছিল দুটোর দিকে।

—“পায়ে কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন? ডাক্তার কি বললো?”
—“ডাক্তারের কথা দিয়ে তুমি কি করবে? আমার কথা শুনো। আমার কোমড় থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। আই নিড প্রপার রেস্ট! আর রেস্টের জন্য সবচেয়ে বড় উপাদান একটা বউ। তাই আমার এখন একটা বউ লাগবে।”
তরী হতাশ কণ্ঠে বললো, “তো বিয়ে করে ফেলুন।”
—“তুমি তো রাজী হচ্ছো না। ভুজুংভাজুং করে যাচ্ছ। শোনো মেয়ে, আমি কিন্তু বুঝে গেছি তুমি আমায় ভালোবাসো। এখন আর নাকচ করে লাভ নেই।”

তরী জবাব দিলো না এবার। বাসা থেকে বলে আসেনি। তার ভয় লাগছে। আয়েশা খাতুন আবার কি না কি শুনিয়ে দেন। আবার অস্বস্তিও হচ্ছে। উলটো জামা পরে হাসপাতালের এই লম্বা কেবিনটায় এভাবে বসে থাকা যায় নাকি? অনেকেই কোণা চোখে তাকে দেখে হাসছে।
মাহাদ আচমকা হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো, “আমার হাতটা একটু ধরো তো তরী।”
তরী ধরলো। উচ্চবাক্য করলো না। মাহাদ ঠান্ডা সুরে বললো, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
তরী শুধু চোখ তুলে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টে। মাহাদই প্রশ্ন করলো, “তুমি কি সত্যিই আমাকে একটুও পছন্দ করো না তরী?”

তরীর কেন যেন আজ আর মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করলো না। প্রশ্রয় দিলো নিজেকে। মাহাদের আকুলতায় সিক্ত হলো। পুরুষালী হাতের ভাঁজে নিজের হাতটার দিকে বেশক্ষণ তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো, “করি।”

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here