বকুলতলা ৩২,৩৩

0
293

বকুলতলা ৩২,৩৩
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৩২.
হাসপাতালের বিছানায় বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে মাহাদের। এত শক্ত! জানালা মাড়িয়ে কোত্থেকে যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ চারিদিকে ঘুরঘুর করছে। মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যান বোধহয় ইহজনমে বন্ধ করা হয়নি। সর্বোচ্চ গতিতে চললেও এত গরম! এত ভারী ভাব! অধৈর্য, ক্লান্ত চোখজোড়া আশপাশে ঘুরিয়ে সবকিছু পরখ করে নিলো মাহাদ। আপেলে কামড় দিতে দিতে তরীকেও দেখলো। মেয়েটা সলজ্জ ভঙ্গিমায় বসে আছে আগের মতোই। আড়ষ্টতা যেন নিশ্বাসে নিশ্বাসে বহমান, সুস্পষ্ট। নার্স এসেছেন অল্পক্ষণ হলো। আসার পর থেকেই কেমন আশ্চর্য হয়ে বারবার আড়চোখে দেখছেন তরীকে। তরীর উলটো জামা পরে আসার কারণেই হয়তো। যা মেয়েটাকে লজ্জায়, অস্বস্তিতে দারুণ ভাবে জড়োসড়ো করে দিচ্ছে।
মাহাদ ভ্রু, কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ ফেলে নার্সটির দিকে তাকালো। ভীষণ বিরক্ত কণ্ঠে শুধালো, “এত কি দেখছেন ওকে? মেয়ে হয়ে মেয়েকে দেখতে লজ্জা লাগে না?”

নার্স থতমত খেলেন। চোখ বড়োসড়ো করে ক্ষীণ তোতলিয়ে বললেন, “মা–মানে?”
—“কাউকে কখনো উলটা জামা পরতে দেখেননি? আশ্চর্য!”
নার্সের হতভম্ব ভাবটা এবার খানিকটা মিইয়ে গেল। বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। তরীর দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত কেটে পরলো সেখান থেকে। এমন অদ্ভুত রোগী সে তার বিশ বছরের কর্মজীবনে কখনো দেখেনি! অনতত তার মনে পরছে না।
নার্স যেতেই তরী কটমট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ওভাবে কথা বললেন কেন নার্সের সাথে?”
—“কিভাবে? ভালো ভাবেই তো কথা বলেছি। উনার মতো তো আর গাঁধার চোখে তাকিয়ে থাকিনি।”
—“আমি গাঁধার মতো কাজ না করলে উনিও গাঁধার মতো তাকাতো না। উনার সাথে এমন করে কথা বলা আপনার একদমই উচিত হয়নি।”

অথচ ত্যাড়া স্বভাবের লোকটা সেকথা মানতেই চাইলো না। তার মতে, সব দোষ নার্সের! এই হাসপাতালের! সবচেয়ে বেশি দোষ তার অফিসের! ঘু’ষখোর অফিস একটা! কি ভ’য়াবহ বিশ্রী হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে তাকে। ফিনাইলের গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। অসহ্য লাগছে। মহা অধৈর্য হয়ে মাহাদ বললো, “ডাক্তারকে ডেকে আনো তো তরী! আমার আর এখানে ভালো লাগছে না। যা যা ফর্মালিটি আছে সেগুলো শেষ করে বাসায় যাবো।”
তরী যেন আঁতকে উঠলো,
—“চলে যাবেন মানে? আপনি অসুস্থ মাহাদ!”
—“অসুস্থ হলে কি হাসপাতালেই থাকতে হবে নাকি? তুমি থাকবা আমার সাথে? যেহেতু না, সেহেতু আমার এখানে থাকার মানেই হয় না। বউ ছাড়া হাসপাতালের পুরুষ রোগীরা কষ্টে কষ্টেই আধম’রা হয়ে যায়। নিশ্বাস নিতে পারে না। অসহায়ের ক্যা’ন্সার হয়ে যায়।”

মাহাদ আশেপাশে থাকলে তরীর হতাশ হতে হতেই সময় কেটে যায়। এখনো তার ব্যতিক্রম নয়। এই যে, মাহাদের বলা এরূপ কথায় হতাশার নিশ্বাসটা একটু শব্দ করেই ফেললো তরী। প্রশ্ন করলো, “আপনার বাবাকে আপনার এই অবস্থার কথা জানিয়েছেন?”
মাহাদের নির্বিকার উত্তর, “নাহ্।”
—“আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে কখন?”
—“সকালে।”
—“এখন বিকাল ৪টা বাজে। এতক্ষণে একটাবার কল দিতে পারেননি?”
—“দিয়ে?”
তরী গলায় জোড় দিয়ে বললো, “এমন করছেন কেন মাহাদ? আপনার বাবা হন তিনি। উনার জানার অধিকার আছে।”

মাহাদ মাথা তুলে তাকালো। চোখেচোখ রাখলো। অস্বাভাবিক ঠান্ডা চাহনি। গম্ভীর স্বরে বললো, “আমার বাবার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না তরী। সে যদি নিজ থেকে ফোন দেয়, তাহলে জানিয়ে দিবো।”

মাহাদের প্রতি তরীর ভালো লাগা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই তরীর হাতটা মাহাদের হাতের মাঝেই আটকে ছিল। এখনও আছে। মাহাদ হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলো। হলদেটে হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ানোর অদম্য ইচ্ছে থাকলেও সেটা দামালো রয়েসয়ে। ধীর গলায় শুধালো, “তুমি কি আজ থাকবে না হাসপাতালে?”
—“না। বাসায় বলে আসিনি। বকবে পরে।”
—“কখন যাবে?”
—“একটু পরই।”

মাহাদ তাদের হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ সরাচ্ছে না। স্থির দৃষ্টি। আচমকা হাতের একদম মধ্যিখানে আলতো করে অধর ছোঁয়ালো সে। হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে ফেললো। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে বলতে থাকলো, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তরী। আমি সত্যি তোমাকে পেয়ে গেছি? তোমার হাত অধিকার নিয়ে ধরতে পারছি? চুমু খেতে পারছি? আমি এতটা আশা করিনি মেয়ে। নিজেকে এত ভাগ্যবান মনে হচ্ছে! এই এক্সিডেন্টটা আরও আগে হলো না কেন? তরী– আমার নিজেকে খুব এলোমেলো লাগছে। চলো না বিয়ে করে ফেলি। কষ্ট দিবো না সত্যি! একটা ছোট্ট কর বানাবো। তোমার আমার। আকাশকে আর ভয় করবো না। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবো, এই মেয়েটা আমার। আমি তাকে জিতে নিয়েছি।”

অন্যান্য রোগীরা চেয়ে আছে ওদের দিকেই। তাদের অবাক দৃষ্টি, কৌতূহল কিছুই এবার আর তরীকে অস্বস্তি, লজ্জায় ফেলতে পারলো না। সে চুপচাপ, নিঃশব্দে দেখে গেল এক পাগল প্রেমিককে। সুখের কান্নায় চোখ নমনীয় হতে চাইলো। তরী দিলো না। কাঁদলো না এক বিন্দুও। সময়ে সময়ে আসা আফসোসটা আবারও হানা দিলো, এই মানুষটা কয়েক বছর আগে এলো না কেন?

মাহাদের আর বাসায় যাওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে কিছুতেই ডিসচার্জ দিবে না কর্তৃপক্ষ। বেশি প্রয়োজন হলে কালকে যেতে দিলেও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আজকে কোনো ভাবেই সম্ভব না। ডাক্তারের এসব কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে মাহাদ শুধু এটুকুই বলেছিল, “এরা টাকার জন্য এমন করছে। ঠিকাছে, আমি টাকাটা দিয়ে দিবো। তবুও যেতে দিচ্ছে না কেন আমাকে? চারপাশের সব রোগীর বউ, বাচ্চা আছে। আমিই একা বিরহে ভুগছি। আমাকে সিঙ্গেলদের কেবিনে নিয়ে যেতে বলো। আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
অফিস থেকে কিছু কলিগ মাহাদকে দেখতে এসেছিল। তার এহেন কথায় হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে তারা। তরীও হাসে। নিঃশব্দে। মাহাদকে সঙ্গ দিতে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে হাসপাতালেও থাকে। কিন্তু এরচেয়ে বেশি সে থাকতে পারবে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে যেতে হবে।

বাসের পথটুকুতে প্রণয় গুণেগুণে ছয়বার কল দিয়েছে তরীকে। ব্যাগে রিং হতেই তরী ফোন বের করেছে, দেখেছে, এরপর রেখে দিয়েছে। কেন যেন মানুষটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। প্রণয়ের প্রতি এক ভিন্ন, অসহ্যকর ধারণা হয়ে গেছে তার। যা আরও প্রখর হয়েছে বিয়ের কথা শুরু হওয়ার পর থেকেই।
বাড়িতে আসা মাত্রই তরীকে দেখে আয়শা খাতুন তেঁতে উঠলেন যেন। রুক্ষ গলায় এক মুহুর্তও ব্যায় না করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “এমন পাগলের বেশে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বলে যাওয়ার একটুও প্রয়োজন বোধ করো নি?”
উত্তর দিতে একটু সময় নিলো সে। আচমকা এভাবে হামলে পরায় হতভম্ব হলো ক্ষীণ। বিমূঢ় গলায় জানতে চাইলো, “কি হয়েছে মামী?”
—“আবার জিজ্ঞেস করছো! তোমার মামা তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, রুমে গিয়ে দেখি তুমি নেই। শুক্রবারে তো তোমার ক্লাসও নেই৷ কোথায় গিয়েছিলে?”
—“একটু কাজ ছিল।”
আয়েশা খাতুন তরীকে আগাগোড়া আরও একবার দেখলেন। কণ্ঠে তেজ ঢেলে বললেন, “কি কাজ? এভাবে পাগলের মতো কোন কাজে গিয়েছিলে তুমি?”
প্রশ্নটা মুখের অদল পালটে দিলো। আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে এলো মুখটা। এমন বিস্ময়কর জেরাগুলো রাগিয়ে তুললো ভীষণ ভাবে। কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো, “আমার কাজ ছিল বলেছিই মামী। আমার ফ্রেন্ড সুমনা রোড এক্সিডেন্ট করেছে। ওকে দেখতেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োয় ভুলে জামা উল্টো পরে চলে গিয়েছি।”

তরী এই প্রথবার আবিষ্কার করলো, সে গুছিয়ে মিথ্যা বলা শিখে গেছে। তার কোনোকালে সুমনা নামের কোনো বান্ধবী ছিল না, নেই। অথচ অকপটে বলা মিথ্যাটা আয়েশা খাতুন ধরতেই পারলেন না। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে, বিশ্বাস করে নিলেন।
—“তোমার মামা এখন বাসায় নেই। রাতে আসবেন। তখন একবার দেখা করে নিও।”

তরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই কোত্থেকে সাহেলা এসে হাজির হলো তার পাশে। ফিসফিসিয়ে বললো, “কিছু বুঝছো আপা?”
তরী ভ্রু কুঁচকালো। সাহেলার মতো করেই বললো, “কি?”
—“এই শয়’তান ব্যাডি আচমকা তুমার পতি এত দরদ দেহাইতেছে ক্যান বুঝো নাই?”
তরী মাথা দুলালো। সে বুঝেনি।
—“তুমার লগে প্রণয় ভাইজানের বিয়া হইবো না? এহন থেইকাই তুমারে নিজের হাতের মুডায় রাখতে চাইতেছে। ব্যাডির মাথায় মেলা মিচকা শয়তা’নি আছে। সাবদানে থাইকো।”
শুনে তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বিয়েটা হবে না। হতে দেওয়া যাবে না। আস্তে করে বললো, “তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?”
—“তুমারে কথাডা কইবার লাইগাই আইছিলাম। কওয়া শেষ! আমিও এহন যাইগা। চুলায় ভাত বহাইছি।”

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গায়ের জামাটা পালটে একটা সুতীর জামা পরেছে তরী। খুলে রাখা জামাটা কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখেছেও। শুধুমাত্র এই জামাটার জন্য কি বিশ্রীরকম পরিস্থিতে পরতে হয়েছে আজ! তখন যতটা না লজ্জা লেগেছিল, এখন অতীত ভেবে আরও লজ্জা লাগছে। উফ! আশেপাশের মানুষ, মাহাদ, নার্স এরা সবাই কি না কি ভেবেছে তাকে! আয়েশা খাতুনের ভাষ্যমতে নিশ্চই পাগল?
বিছানার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিলো তরী। মাহাদকে একবার কল করে দেখবে কি? কল করার জন্য ফোনের লক খুললেও কলটা আর করা হলো না। ঘরের দরজা ভেড়ানো ছিল। হঠাৎ দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো প্রণয়। লোকটা কি একটু হাঁপাচ্ছে? অনেক অনেক জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলছে, নিচ্ছে। যেন অনেক দূর পর্যন্ত দৌঁড়ে এসেছে সে। গায়ের জামাকাপড়গুলোও এলোমেলো। মুখটা শুকিয়ে আছে। তরী চোখ বড় বড় করে উদগ্রীব কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “আপনি এখানে কি করছেন?”

প্রণয় সেকথার জবাব দিলো না। নিশ্বাস নিতে নিতে বললো, “ফোন ধরোনি কেন তরী? কতগুলো কল দিয়েছি। কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মা বললো তোমাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।”
—“পাওয়া না গেলে কি আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম?”
প্রণয় এতক্ষণ পায়ের হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুঁকে ছিল ক্ষীণ। এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অবুজের মতো ডানে বামে মাথা নাড়ালো একবার। অর্থ্যাৎ, পাওয়া না গেলে সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতো না।
তরী আবার বললো, “যখন তখন আমাকে ফোন দেবেন না। ফোনই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাথে কথা বলতে পছন্দ করিনা।”
কেন যেন এ কথাটার পিঠে প্রণয় কিছু বললো না। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইলো। নির্মল দৃষ্টি।
—“আপনি এক্ষুণি মামাকে গিয়ে বলুন, আপনি বিয়েটা করছেন না।”
—“দুঃখীত তরী। আমি বলতে পারবো না।”
—“আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার সঙ্গ আমার পছন্দ না? জোড় করছেন আমাকে?”
—“একটু একটু করছি। এতকাল জোড় করিনি বলেই তুমি আমার হও নি।”

রাগে শরীর জ্বলে উঠলো তরীর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আমি একজনকে পছন্দ করি। সেও করে। বিয়ে করলে আমি তাকেই করবো।”
প্রণয় কি একটু হাসলো? বোঝা গেল না।
—“কার কথা বলছো? মাহাদ?”
—“হ্যাঁ।”
—“পছন্দ আর ভালোবাসায় তফাত আছে।”
তরীর জোড় গলা, “সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।”

প্রণয়ের ভেতরটা যেন জ্বলে গেল। কান্নারা দলা পাকালো। সে কারো সামনে কাঁদে না। আজ তরীর সামনে কাঁদলে কি মেয়েটা রাগ করবে? আটকে আসা কণ্ঠে ভীষণ আকুতি নিয়ে প্রণয় বললো, “আমার দিকে একটু তাকাও তরী। আমাকে ভালোবাসতে হবে না, পছন্দও করতে হবে। শুধু সাথে থাকো। ওই ছেলেটা অনেক তরী পাবে। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই।”

________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

৩৩.
পরিবেশটা মোটেও স্বাভাবিক না। নিস্তব্ধ, থমথমে, গভীর নীরবতায় নিমজ্জিত। এসির ঠান্ডা বাতাসগুলো পুরো ঘরময় ঘুরঘুর করছে। দুটো লাইটের তেজস্বী আলো চোখে বিঁধছে ভীষণ। তরী এতক্ষণ মাথা নুইয়ে ছিল। প্রচন্ড অস্থিরতায়, দুশ্চিন্তায় একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি। হাঁসফাঁস করে গেছে মাত্র। আড়চোখে রফিক সাহেবকেও দেখে নিয়েছে বেশ কয়েকবার। তিনি তার সামনেই বসে আছে। চোখ-মুখে দারুণ গম্ভীরটা। কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ।
সামান্য গলা ঝেড়ে তিনিই আগে কথা শুরু করলেন, “দুলাভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। কাল বা পরশুর মধ্যে ঢাকায় আসার জন্য রওনা হবেন বলে জানিয়েছেন। তারপরই তোমার আর প্রণয়ের বিয়ের কথা আগানো হবে। এখন তোমার কি মতামত? অসুবিধে আছে কোনো?”

না চাইতেও তাচ্ছিল্যের অস্পষ্ট হাসিটা কয়েক মুহুর্তের জন্য ঠোঁটে এসে হানা দিলো। সবকিছু ঠিক করা শেষ। বরকত সাহেবও ঢাকায় চলে আসছেন। বিয়েটা মোটামোটি পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। এখন আর তার মতামত নিয়ে লাভ কি? বাবাও তাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। তরীর একটু অভিমানই হলো। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পরপরই মিহি কণ্ঠে উত্তর দিলো, “আমার আসলে– মানে.. আমি আসলে এই বিয়েটা করতে চাইনা মামা।”
কথাটা শোনা মাত্রই মুখটা বা’জে ভাবে বিকৃ’ত করে ফেললেন আয়েশা খাতুন। মা’রাত্বক তেঁতে উঠে বললেন,
—“বিয়ে করতে চাও না মানে? নখরা করছো আমাদের সাথে? আমার ছেলে যে তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে এটাই তো অনেক!”

স্ত্রীর আগ বাড়ানো কথায় রফিক একটু বিরক্ত হলেন। তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। যথেষ্ট ঠান্ডা গলায় বললেন, “আহা! আমি কথা বলছি তো? তোমার আগ বাড়িয়ে কথা বলার দরকার কি? শুনো আগে ও কি বলে।”
তারপর তরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কেন চাও না বিয়ে করতে? কারণ কি?”

আয়েশা খাতুন তখনো দমে যাননি। তার চিলের মতো তীক্ষ্ণ চোখজোড়া ভীষণ ক্ষু’ব্ধ হয়ে গিলে খাচ্ছে যেন। তরী ইতস্তত করলো। আমতা আমতা স্বরে বললো, “প্রণয় ভাইয়াকে ছোট থেকেই ভাই হিসেবে দেখেছি মামা। হুট করে বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না।”
রফিক এবার আরেকটু গম্ভীর হলেন,
—“দেখো তরী, আমরাও এই বিয়েটা প্রথমে মেনে নিতে চাইনি। প্রণয়ের পাগলামিতে বাধ্য হয়েছি। তুমি তখন বাসায় ছিলে না। বিকালবেলা হঠাৎ এসে বলতে লাগলো তোমাকে বিয়ে করবে। আমরা রাজী না হওয়ায় ভাঙ্গচুর শুরু করে দিয়েছিল। এমনটা নয় যে আমি ভয় পেয়ে রাজী হয়েছি। একবার আমরা ওকে না জেনেশুনেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম। এবার আর আমরা সেটা করতে পারবো না।”
—“কিন্তু মামা, আমি এখনই এসব বিয়ের সম্পর্কে জড়াতে চাইছি না। আপনারা একটু আমার দিকটাও বিবেচনা করুন। আমার অতীতের সবই তো আপনাদের জানা।”

বলতে বলতে উদগ্রীব হয়ে উঠলো তরী। উৎকণ্ঠা হলো। অথচ রফিক আগের মতোই বললেন, “তোমার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো জানি বলেই ডেকে এনে কথা বলছি। প্রণয় কেমন তুমি তা জানো। একটু মাথা ঠান্ডা করে সময় নিয়ে ভাবো। তোমার বাবার কথাও ভেবে দেখো। তিনিও কিন্তু এটাই চান। সবকিছু ভেবেচিন্তে তারপর মতামত জানাও। বাকিটা আমি দেখছি।”

দারুণ হতাশ হয়ে তরী সেখান থেকে চলে এলো। কিন্তু এসেই নিজের ঘরে গেল না। প্রথমে প্রণয়ের দরজার সামনে এসে আলতো হাতে কয়েকবার টোকা দিলো। সারাশব্দ পাওয়া গেল না। আবার দিলো। এবারও না। সে কি ঘরে নেই? ভাবতে ভাবতে নিজের রুমের কাছাকাছি আসতেই টের পেল, লাইব্রেরী ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। দপদপ! দপদপ! নিশ্চই প্রণয় ভেতরে? সে ছাড়া তো আর কারো সাহস নেই ভেতরে ঢোকার।
তরীর পা থেমে গেল। লাইব্রেরীর দরজা ভেড়ানো। ফাঁকফোকর দিয়ে অল্পসল্প দ্যুতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তরী একটু সময় নিয়ে উঁচু গলায় ডাকলো, “প্রণয় ভাইয়া?”

তৎক্ষণাৎ দপদপ শব্দটা থেমে গেল। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড! দরজাও পুরোপুরি খুলে গেল। সামনে দাঁড়ানো তরীকে দেখে ক্ষীণ অবাক হলো প্রণয়। হাসলো। ক্লান্ত হাসি। তরী বললো, “ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া যাবে?”
—“কিন্তু আমি তো এখানে কাউকে ঢুকতে দেইনা।”
—“আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।”

প্রণয় পলক ফেলে তরীকে একটু দেখে নিলো। সরে দাঁড়িয়ে বললো, “আসো।”

এই লাইব্রেরী ঘরটা নিয়ে তরীর শুরুতেই ভীষণ কৌতূহল ছিল। ভেতরে ঢোকার পরও সেই কৌতূহলটা এক বিন্দুও কমলো না। মুগ্ধতার রেশ টেনেহিঁচড়ে আটকে রাখলো। চারিদিকটা এত সুন্দর! সাজানো! বইয়ে বইয়ে একাকার! মাঝখানের বড় জানালাটা খুলে রাখা। সাদা পর্দা দাপিয়ে সেখান থেকে শীতল অনিলেরা আনাগোনা করছে। তরী খেয়াল করে দেখলো, এঘরে এসি নেই। যা আছে, তা একটা ছোট্ট টেবিল ফ্যান। প্রণয় সেই ফ্যানটাই চালিয়ে দিলো। ইশারায় তরীকে সোফায় বসতে বলে সে বসলো চেয়ারে। তারপর শুধালো, “কি বলতে চাও? বিয়ে ভা’ঙ্গা নিয়ে কিছু বলতে চাইলে কিন্তু লাভ নেই। আমি শুনবো না।”

আশপাশ থেকে নেত্রজোড়া সরিয়ে এনে সরাসরি প্রণয়ের দিকে তাকালো তরী। গাঢ় দৃষ্টি। দৃঢ় কণ্ঠ।
—“না, বিয়ে নিয়ে কিছু বলবো না। অন্য কথা আছে।”

এইযে, মেয়েটা চোখেচোখ রেখে কথা বলছে। প্রণয় কিন্তু মোটেও প্রেমে পরছে না। মাতোয়ারা হচ্ছে না। একরাশ কষ্টে বড়বড় নিশ্বাস ফেলছে শুধু। মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? তার যে য’ন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারছে না? সে তো এমন ছোট ছোট মুহুর্তই চেয়েছিল। এখন সেটা সত্য হলেও প্রণয় ভ’য় পাচ্ছে। ভীষণ ভীষণ ভ’য়। মস্তিষ্ক, মন দুটোই একসাথে চিৎকার করে বলছে, “মেয়েটার কথা শুনিস না প্রণয়। ও তোকে আবারও কাঁদাতে এসেছে।”
অথচ অবাধ্য প্রণয় নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেস করলো, “কি কথা?”
—“কিছু প্রশ্ন করবো। ঠিকঠাক উত্তর দিতে হবে। তারপর কিছু কথা বলবো।”

প্রণয় আর কিছু বললো না। ঘাড় কাত করে সায় দিলো। তরী মনে মনে প্রশ্নগুলো সাজিয়ে নিলো একবার। এরপর শুধালো, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন কখন থেকে?”
—“অনেক আগে থেকে। তুমি তখন পনেরো বছরের ছিলে।”
—“কিভাবে ভালোবেসেছেন? আপনাদের সাথে তো তখন আমাদের যোগাযোগই ছিল না।”
—“বাবার ছিল। বাবার ফোনেই তোমার তখনের কিছু ছবি দেখেছিলাম।”
—“ছবি দেখেই ভালোবেসে ফেলেছেন?”
তরীর ক্ষীণ ঠাট্টার সুর। প্রণয়ের ভালো লাগলো না। গমগমে গলায় বললো, “হুট করে ভালোবাসিনি। ভালো লাগা থেকে ভালোবেসেছি।”
—“এতই যখন ভালোবাসতেন, তাহলে আমার সাথে এতদিন খারাপ ব্যবহার করে এসেছেন কেন?”

প্রণয় নিঃশব্দে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পুরোনো কথাগুলো ভেবে বুকটা ভারী হয়ে আসলো যেন। তার বাম হাতটা টেবলের ওপর রাখা। হাতের আঙুলগুলো স্থির নেই। আলতো করে বারবার টেবিলে আঘা’ত করছে। খুটখুট শব্দ হচ্ছে এতে। একদমই লহু শব্দ। সেদিকে চেয়ে থেকেই প্রণয় বলতে লাগলো, “আমি তোমাকে অনেক আগেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তরী। বাবা মাও বলেছিলেন তোমার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিবেন। তখন আমি পড়ালেখার জন্য বাহিরের দেশে ছিলাম। পড়ালেখা শেষে যখন এখানে আসলাম, ততদিনে তোমার বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে। আমাকে বলা হয়েছিল, তোমার আমার বিয়েতে তুমি আর তোমার পরিবারই রাজী ছিলে না। যদিও এটা মিথ্যে। আমি কয়েকদিন আগেই জেনেছি। কিন্তু যখন জানতাম না, ভেতরে ভেতরে তোমার প্রতি একটা চাপা রাগ কাজ করতো। না চাইতেও তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলতাম।”

হাতের আঙুলগুলো থেমে গেছে। বহুদিনের সঞ্চিত কথাগুলো তরীকে বলতে পেরে একটু হলেও শান্তি পেল প্রণয়। কিন্তু পুরোপুরি না। সে গুলিয়ে ফেলছে সব। গুছিয়ে কথা বলতে পারেনি।
তরীর দিকে একবার তাকিয়ে পরখ করে নিলো প্রণয়। মেয়েটা কি আদৌ তার কথা বিশ্বাস করেছে? বোঝা গেল না। তরী সেসময় শুধালো, “আপনার কথা বলা কি শেষ?”
প্রণয় মাথা দুলালো। শেষ।
—“এবার আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো। চুপচাপ কথাগুলো মন দিয়ে শুনবেন। কথার মাঝে কথা বলবেন না। ঠিকাছে?”
—“আচ্ছা।”

তরী আরেকদফা গুছিয়ে নিলো সে কি বলবে। সত্যি বলতে তরীর মায়া লাগছে। লোকটার আকুলতাময় দৃষ্টি ছুঁয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু সে তো অতি সাধারণ, দমে যাওয়ার মতো মেয়ে না। একদমই না।
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে তরী বলতে লাগলো,
—“আপনি আমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসেন। ঠিকাছে। আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। এটাও মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি ভালোবাসা আগলে রাখতে জানেন না প্রণয়। আপনার ভালোবাসা স্নিগ্ধ হলেও ভালোবাসার ধরণ স্নিগ্ধ না। ভালোবাসায় বিশ্বাস প্রয়োজন। কিন্তু সত্যি বলতে, আপনি কেমন যেন। বিশ্বাস, ধৈর্য, আগলে রাখা কিছুই আপনার মাঝে নেই। আপনি শুধু ভালোবাসতেই জানেন। ভালোবেসে কষ্ট পেতে জানেন। অপর মানুষটাকে একটু বোঝার চেষ্টা করতে চান না। আমি বলছি না, ভালোবাসলে অতিরিক্ত আহ্লাদীপনা করতে হবে। ওটা ভালোবাসার পর্যায়েই পরে না। কিন্তু কোনো একটা কাজ, যেটা বোঝাবে আপনি আমাকে মন থেকে চান, আমার প্রতি আপনি মুগ্ধ! এসব আমি কখনো দেখতে পাইনি। মন থেকে অনুভব করতে পাইনি। যখনই আপনার দিকে তাকিয়েছি, দেখতে পেয়েছি একটা উদাস ছেলে যে কিনা কষ্টে দুমড়েমুচড়ে গেছে। তার কেউ নেই। নিজের মাঝে হারিয়ে সে কি যেন কল্পনা করছে। সেই কল্পনায় হয়তো আমি আছি। কিন্তু আমি আমাকে কখনো উপলব্ধি করতে পারিনি। আপনি নিজেই চাইতেন না সেটা। আবার যখন খারাপ ব্যবহার করতেন, মনে হতো আপনার মতো বাজে আর কেউ নেই। যার আশেপাশে আমি নামক কারো অনুভূতির কিচ্ছু যায় আসে না। সে পারে শুধু আমাকে কষ্ট দিতে।

আপনার মনে কখনো প্রশ্ন জাগে নি, আমি মাহাদকেই কেন বেছে নিয়েছি? উত্তর দিচ্ছি। উনি আপনার একদম বিপরীত। হয়তো প্রকাশ্যে সবকিছু করেন। বেশি কথা বলেন। বকবক করে আমার মাথা খেয়ে ফেলেন। বিরক্ত করেন। প্রচন্ড বখা’টে স্বভাবের। কিন্তু তার ভেতরকার তাকে আমি দেখতে পারি। যেন একটা খোলা, মেলে রাখা বই। যেই বইয়ে আমাকে নিয়েই একেকটা শব্দ, বাক্য। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে সম্মান করে। আমার আবদারের জন্য মুখিয়ে থাকে। সবসময় চেষ্টা করে আমি যেন কখনো কোনো কিছুতে কষ্ট না পাই। দিনের পর দিন সে আমার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে গেছে। আমি কিভাবে এমন একটা মানুষকে তুচ্ছ করে ফেলে দেই? তবে হ্যাঁ, তাকে আমি ভালোবাসি না। ভীষণ পছন্দ করি। তাকে আমার অনেক ভালো লাগে। সে আমার পাশে থাকলে ভরসা পাই। আপনার বেলায় কিন্তু সেটা হয় না। বরং মায়া লাগে। এই মায়া থেকেই আপনার সাথে দু’চার মিনিট বসে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। এটুকুই। এর বেশি কিছুই না।
আপনি হয়তো আমাকে জেদ করে বিয়ে করতে পারবেন। কিন্তু আমরা কখনোই সুখি হতে পারবো না। আপনি বলেছিলেন না? আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন? আমারও মনে হয়। একাকীত্বে ভুগছেন আপনি। কি করবেন, কি করা উচিত সেই বোধ হারিয়ে ফেলেছন। আপনার এমন একজনকে প্রয়োজন, যে আপনাকে আগলে রাখবে। কিন্তু আমার প্রয়োজন যে আমাকে আগলে রাখবে। আমাকে সেইসব ভালোবাসা দিবে যা আমি এতকাল পাওয়ার জন্য ছটপট করেছি। আপনি ভালোবাসতে তো জানেন, কিন্তু আপনার ভালোবাসার ধরণ আমাকে ভালোবাসে না। বাকিটা আপনি চিন্তা করুন। আমি কথাগুলো ভুল বলছি কিনা।”

লম্বা দম ফেলে থামলো তরী। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার। প্রবল আশ’ঙ্কা’য় ভুগছে। ফাঁকা অনুভূতিতে কাঁপছে খুব। তার এই বুঝানো যদি প্রণয় না বুঝে? তাহলে কি হবে? কি করবে সে? মাহাদকে কিভাবে সামলাবে? লোকটা তো এসবের কিছুই জানে না।
তাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে মা’রাত্বক শীতল গলায় প্রণয় আস্তে করে বললো, “এখান থেকে চলে যাও তরী। তোমাকে দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

_________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here