বধুয়া পর্ব-১+২

0
2900

বধুয়া
পর্ব-১+২
#মুন্নী

‘তোর দিকে কেউ তাকালে আমার সহ্য হয় না, আর অই বেটার কত্ত সাহস তোর হাত ধরে!! এজন্যই তো মেরেছি। ‘
নিজের কাজের সাফাই দিয়ে যাচ্ছেন উনি।
আমার পাশে যে লোকটা বসে আছে উনি আমার -স্বামী ; আরও ভক্তিভরে বললে- পতিদেবতা! মাহির।
এক ঐতিহাসিক বিয়ের মাধ্যমে উনি আমার স্বামীর আসনে নিজের নাম লিখিয়েছেন!এখন আমার পতিদেবতা আমাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় যাচ্ছেন। কারণ বেশ কিছুক্ষণ আগে আমি জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম!
আমি ভেবে পাইনা জীবনের যত প্যারা সব কি আমার জন্য রিজার্ভ করে রাখা?? এই লোকটা আমার জীবনটা তামাতামা করে দিয়েছে।

ঐতিহাসিক বিয়ের পরও আমি পড়াশোনা ছাড়িনি। কয়েকদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। আজ এসাইনমেন্ট জমা দিতে গেলাম। মেম এটা দেখে বললেন –
What’s wrong with you, Kuhu? এই ভুল তোমার কাছ থেকে আশা করিনি।
তারপর মেম যে ভুলগুলো মার্ক করে দিলেন দেখে আমার নিজের উপর রাগ হলো। অগত্যা ডিপার্টমেন্টে বসেই সব ঠিক করে, মেমকে দেখিয়ে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।
ক্যাম্পাস অনেকটা নীরব হয়ে গেছে। খুব কম মানুষের আনাগোনা।
রিকশা পেয়ে গেলাম একটা। রিকশা করেই চলে যাবো মেইন রোডে – এই ভেবে রিকশায় উঠে বসতেই কোথা থেকে এক ছেলে এসে পাশে বসে পড়লো!
– আরে! কে আপনি? নামুন বলছি।
-আপু, একা যেতে তোমার ভয় করবে তাই ভাবলাম আমরা একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।
রিকশার পিছন থেকে আর একটা ছেলে সামনে এসে বললো। ছেলেটা নামছে না দেখে আমি নিজেই তাকে শার্টের কলার ধরে টেনে নামিয়ে একটা থাপ্পড় দিলাম।
– অসভ্য, বেয়াদব!
ছেলেটা খপ করে আমার হাতে ধরে ফেলে।
ঠিক এই সময় একটা ছেলে এসে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে ছেলে দুটোকে। এই ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি!তখন মনে পড়লো আমি যতবার বাসা থেকে বের হয়েছি,যেখানেই গিয়েছি এই ছেলেটাকে সেখানেই দেখেছি আশেপাশে। তবে কি আমাকে ফলো করে??!.
ভাবনায় ডুব দিয়ে ভেসে উঠে দেখি সামনে ঔ ছেলেটার সাথে মাহির দাঁড়িয়ে! আমাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে এলোপাতাড়ি লাথি মেরে যাচ্ছে ছেলে দুটোকে।মাহির কখন আসলো আমি টের পাইনি। তবে ছেলে দুটোর অবস্থা খুবই খারাপ কখন জানি মরে টরে যায়! আঁতকে উঠি আমি – ‘মাহির থামো,
-ছেড়ে দাও এবারের মতো’ মাহিরের হাত ধরে ফেরাতে চাইলাম, কিন্তু
আমার কোনো কথায় কানই দিচ্ছে না, উল্টো রিভালবার বের করে ছেলেটার মাথায় ধরে।

মাহিরের হাতে রিভালবার দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।সত্যি সত্যিই যদি গুলি করে বসে! আমি পড়ে যাচ্ছি এটা বুঝতে পারছিলাম।তারপর আর কিছুই বলতে পারিনা। যখন চোখ খুললাম চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম হসপিটালের বেডে।
একটু পরে ডাক্তারের সাথে মাহির আসে।
– এইতো জ্ঞান ফিরেছে, ভয়ের কিছু নেই। শরীর দুর্বল, খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করতে হবে।
– কোনো মেডিসিন দেবেন না?
– হা, কিছু মেডিসিন লিখে দিয়েছি। উনাকে এডমিট করার দরকার নাই, এখনই নিয়ে যেতে পারবেন।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি।মাহির একটার পর একটা বলেই যাচ্ছে।
-‘ তুই রিভালবার দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবি আমি জানতাম নাকি?’
আমি চুপচাপ বসে আছি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না লোকটার সাথে।

আমি যেখানেই যাই না কেন এই লোক পিছু ছাড়বে না,বরং জীবনটা বিষিয়ে দেবে। একমাত্র মৃত্যু মুক্তি দিতে পারবে এই লোকটার কাছ থেকে। কিন্তু আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার নেই। তাই বাধ্য হয়েই গত একটা মাস এই লোকটার কাছে থাকছি।
আমি জানি কোথাও পালাতে পারবো না।

বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাহির পেছন পেছন দৌড়ে আসে।
– ও কুহু, আমি সরি বললাম তো! কুহু! অই?
মাহির জোর করে আমার মুখটা তার দিকে ফেরায়।
দু’হাতে আমার মুখ ধরে – খুব রাগ হইছে না? এই যে কান ধরলাম আর জীবনেও এমন করবো না।
মাহির দুইহাতে আমার কানে ধরে।মেজাজটা সেই লেভেলের গরম হয়ে গেছে। উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার চোখ দেখে বলেন
– ওহ,এটা তো তোর কান!! ‘ বলেই নিজের কানে ধরে বসে আছে।
থাকুক! আমার কি?!
– উঠ না, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমা।তোর শরীর ভালো নেই।
আল্লাহ! আমারে উঠায়া নেও।।
ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় নিজে একটা দিয়ে মরে যাই! এই জ্বালা সহ্য করতে পারছি না।

– এই কুহু?
বিদ্যুৎগতিতে বেড থেকে নেমে আসলাম। এসে মাহিরের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম
– তুমি কি জানো যে, তুমি দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ বেহায়া??
– না জানার কি আছে? তুই জানতে এতো দেরি করলি!
একথা বলেই ৩২ খানা দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো।এই হাসি দেখে শরীরে আগুন ধরে যায় আমার।
মুখে দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, মাথা ধরে গেছে। হাতের মোবাইলটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলি।তারপর চেঁচিয়ে বললাম
– তোমার জন্য কি আমি মরেও শান্তি পাবো না? কি পেয়েছো তুমি আমাকে? আমার পিছনে লোক লাগিয়ে রাখো! আমি শান্তিতে কোথাও যেতেও পারিনা!!
এইভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। ‘

মাহির আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হা করে শুনছে। আমার কথা শেষ হবার আগেই দুইহাতে কোলে তুলে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে। কোল থেকে নামিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিলো।
আমি কিচ্ছুটি বলার সুযোগ পাইনি।মাহির বের হয়ে যায়। একটু পরেই আমার শাড়ি টাওয়াল নিয়ে হাজির।
পানির ঝাপটায় চুলগুলো চোখেমুখে লেপ্টে আছে, আমি সরাতে চেষ্টা করছি।মাহির আমার দিকে এগিয়ে আসে, আমি পিছনে সরতে গিয়ে দেয়ালে বাঁধা পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

মাহির কাছে এসে চোখের সামনের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলাম, তখন মাহির আমার দুপাশের দেয়ালে হাত রেখে আটকে দেয়, তারমধ্যে বন্দী হয়ে আছি আমি। মাহিরের মুখটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

চলবে…

#বধুয়া
#পর্ব-২

আমি জানি কি হতে চলছে। তার হাত যখন কোমর স্পর্শ করলো তখন ঠোঁটেও একটা ঝড় উঠে গেছে। ঠোঁটের গভীরে ডুব দিলো মাহির।

শাওয়ার নিয়ে বের হলাম,তখন মাহিরের মায়ের গলা শুনতে পেলাম। মাহিরের মা অসাধারণ একজন মহিলা। এই মহিলার এমন একটা সুপুত্র কিভাবে হলো সেটাই আমার মাথায় আসেনা।
– কুহু?
– আন্টি, ভেতরে আসো।
– তোরা খাবি কখন? সেই দুপুর থেকে বসে আছি।
– আমার খিদে নেই।
– খিদে নেই বললেই হলো! সব শুনেছি ডাক্তার কি বলেছে। তুই না খেলে আমিও যে খাবো না সেটা তুই ভালো করে জানিস।’
– ‘পুঁটি মাছের প্রাণ নিয়ে বড় বড় কথা বলে!’ বেলকনি থেকে রুমে ঢুকে মাহির।
– তুই চুপ থাক,কে বলেছিলো তোকে এসব ঝামেলা করতে? বেচারি ঘাবড়ে গেছে।
– মা, রিভালবার দেখে মানুষ আমাকে মাস্তান মনে করছে!!মানুষকে বলে দিও, আমি গুন্ডা-মাস্তান না।আমার লাইসেন্স আছে। আজকেই লাইসেন্স পেয়েছি, এটা সাথে নিয়ে লাইসেন্স আনতে গিয়েছিলাম। তখন ভাবলাম মানুষকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরি।কিন্তু গিয়ে দেখি এই কাহিনী!!
মাহির গাল ফুলিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে দেখায়! মা ছেলে মুখটিপে হাসছে!!
আমি ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে দেখে ফেলি।
আন্টি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন।

এই বাড়িতে আসার পর থেকে আন্টি একবেলাও আমাকে ছাড়া খায়নি।এই বাড়ির নিয়ম সবাই একসাথে সকালের আর রাতের খাবার খাবে।যে যেই কাজে ব্যস্ত থাকুক ঠিক সময় ডাইনিং এ হাজির হতে হবে। তাছাড়া এই বাড়িতে যে অবস্থায় এসেছিলাম তাতে খাবার গলা দিয়ে নামতো না।উনি নিজের হাতে জোর করে খায়িয়েছেন।
উনি আমার শ্বাশুড়ি হলেও উনাকে এখনো আন্টি বলেই ডাকি।সেই ছোট্টবেলা থেকে ডেকে আসছি।
উনি আমার ফুপার বড় বোন। তার উপর আমরা মুখোমুখি ফ্ল্যাটে ছিলাম। আমার জন্মের পর থেকে উনাকে দেখছি। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় উনাদের নিজেদের নতুন বাসা কমপ্লিট হলে সেখানে শিফট করেন।সেটাও আমাদের বাসার কাছেই।
এতদিনের সম্পর্ক উনাদের সাথে। তবে আমি যখন নাইনে ভর্তি হবো তখন আমরাও আমাদের নিজস্ব বাসায় শিফট করি।আমাদের বাসা অনেকটা দূরে ছিলো। তাই আগের মতো যাতায়াত হতো না। আন্টিকে সবাই পছন্দ করে। কারণ এমন একজন মানুষকে অপছন্দ করা যায় না।
অপারগ হয়ে দুপুরের খাবার খেলাম বিকালবেলা।

সেই ছোট্টবেলায় নাকি মাহির বলতেই অজ্ঞান ছিলাম। আমার শৈশব কেটেছে তার সাথে। সারাক্ষণ মাহিরের পেছন পেছন ঘুরতাম। মাহির যে আমাকে খুব পছন্দ করতো তা নয়, বরং চুলের ঝুঁটি ধরে টান দিতো,চিমটি দিয়ে পালাতো।মোট কথা আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়তো তবুও আমি মাহির ভাইয়া,মাহির ভাইয়া করতাম। বয়সে আমার থেকে ৪ বছরের বড়, তবুও এই ছেলে আমার পিছনে পড়ে থাকতো।ওকে ভয় পেতাম ভীষণ। তবে এটাও সত্যি আমাকে যতই জ্বালাতন করুক, অন্যকেউ আমাকে ভেংচি দিলেও সহ্য করতো না।কিছু করতে না পাড়লে কমপক্ষে একটা চিমটি কেটে আসতো।
ছেলেবেলা কেটেছে। কিন্তু সেই মাহিরকে এখন আমি সহ্য করতে পারিনা কেন সেই কারণ কেউ জানে না শুধু মাহির ছাড়া!

যখন আমি কলেজে ভর্তি হলাম, প্রায়ই কলেজে গেটে চলে আসতো। বাইকে উঠতে না চাইলে এমন অবস্থা শুরু করতো যে মানুষ তামাশা দেখতো! মানুষের সামনে ঝামেলা না করে চুপচাপ তার বাইকে উঠতাম।একদিন তো সবার সামনে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় আমার গালে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছি শুধু।
দিনদিন তার এই অত্যাচার যেন বেড়েই চলছিলো। কয়েকটি বছর দাঁতে দাঁত চেপে তার সব অত্যাচার সহ্য করেছি। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর মাহিরের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। মাহির ততদিনে তার বাবার ব্যবসায় ঢুকেছে। অফিসের ব্যস্ততায় আমাকে আর আগের মতো বিরক্ত করার সুযোগ পায় না। সবাই রাজি, কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি।সবাই অনেক বুঝিয়েছে, লাভ হয়নি।শেষ পর্যন্ত মাহির বলেছিলো
– তুই কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করিস আমিও দেখে নিবো!
মানছি মাহিরের বাড়ির সবাই খুব ভালো মানুষ, কিন্তু এই লোকটার সাথে আমি থাকতে পারবো না। এই মানুষটা দিনদিন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তার সব কিছুতেই বিরক্ত হতাম।একটা জেদ চেপে বসে নিজের ভেতরে।
যখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি তখন আব্বু-আম্মু বাধ্য হয়ে অন্য যায়গায় বিয়ে ঠিক করেন। ছেলে ইউকে প্রবাসী। পরীক্ষার পরে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি সহজেই রাজি হয়ে যাই। দেশের বাইরে চলে গেলে মাহিরের হাত থেকে রেহাই পাবো; এই ভেবে খুব খুশি ছিলাম।

সবকিছু ঠিকঠাক, হলুদ – মেহেদী সব অনুষ্ঠান ঝামেলা ছাড়া সুন্দর ভাবেই শেষ হয়।গায়ে হলুদের দিন মাহিরও এসেছিলো। তবে সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থেকেছে। একবার শুধু বলেছিলো
– আমাকে ছেড়ে চলে যাবি, কুহু?
বেচারার মুখ দেখে খুব মজা পাচ্ছিলাম আবার খানিকটা কষ্ট হচ্ছিলো। বললাম,
– আল্লাহ বাঁচিয়েছেন আমাকে। আমি চলে যাবো, তখন জ্বালাতন করার জন্য আমাকে পাবে না।
মাহির মুখকালো করে চলে যায়।

চলবে….
# মুন্নী #

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here