বধুয়া
পর্ব ১৫ + শেষ পর্ব
#মুন্নি
আমার কিশোরী মনে দোলা দিয়ে যায় মাহির।আমি প্রথম বুঝতে পারি আমি প্রেমে পড়েছি।এমনিতেই সারাক্ষণ মাহির খুনসুটি করতো, আমি যে বড় হচ্ছি সেটা যেন তার চোখেই পড়ে না। আমার ততদিনে আত্মসম্মান বোধ আরও বেড়ে গেছে আর মাহির সবার সামনে আমায় এমন ভাবে বোকা বানাতো যে মাঝে মাঝে কান্না চলে আসতো। এই প্রথম মাহিরকে দেখে লজ্জা পেতাম,কারণ আমার হাজারো কল্পনাজুড়ে মাহির! সেই মাহির সামনে এলে তার চোখের দিকে আর তাকাতে পারতাম না। তাই যখন মাহির আসতো আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তার হাসি,তার কথা বলা সব কিছু।
আগের মতো তার সামনে আর যাইনা।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি।মাহির তারা আরও দুই বছর আগেই তাদের নতুন বাসায় শিফট করেছে। সেই বাসাও আমাদের কাছেই মাত্র ৩-৪ মিনিটে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।
আম্মু সেদিন তালের পায়েস করেছিলেন আর পাটিসাপ্টা। পাটিসাপ্টা মাহিরের অনেক প্রিয় ছিলো। তাছাড়া ভালো-মন্দ যা রান্না করতো আন্টি যেমন নিয়ে আসতেন আম্মুও পাঠিয়ে দিতেন।দুই পরিবারের সম্পর্কটাই এমন ছিলো।
আম্মু আমার হাতে বক্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন – এটা তোর আন্টিকে দিয়ে আয়।কাকলিকে নিয়ে যা।বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি যা।
কাকলি তখন ছোট, ক্লাস থ্রিতে পড়তো।
আমি কাকলিকে নিয়ে বের হই,কিন্তু একটু যেতেই কাকলি ওর বন্ধুদের পেয়ে ওদের সাথে উল্টো বাসায় ফিরে যায় খেলার জন্য।
তাই আমি একাই গেলাম। দরজা খুলে মাহির আমাকে দেখে বলে – ওরে বাবা! তোর কষ্ট হয়নি আসতে?
– কষ্ট হবে কেন?
– না ইদানীং তো তুই এদিকে আসিসই না তাই ভাবলাম তোর কষ্ট হয় এতো পথ হেঁটে আসতে।
আমি কিছু না বলে আন্টিকে ডাকলাম।
– আম্মু নেই। তোর হাতে কি?
– আম্মু পিঠে পাঠিয়েছে। এটা ধরো,আমি গেলাম।
মাহিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে আসছিলাম। মাহির পেছন থেকে চুল টেনে ধরে।
– কোথায় যাচ্ছিস? এটা খুল।
– নিজে খুলে নাও না।
– তোকে খুলতে বলেছি তুই খুলবি।এক্ষুনি খোল।
মাহিরকে এমনিতেই ভয় পেতাম, ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি খুলে দিলাম।
মাহির তখন কি টেবিলে বসে লেখায় ব্যস্ত!
– খুলেছি, কোথায় রাখবো?
– রাখতে হবে না এখানে নিয়ে আয়।
আমি মাহিরের কাছে গেলাম।
– পাটিসাপ্টা! ইসস! আন্টি কত্ত ভালোরে!
খায়িয়ে দে তো।
– আমি কেন দিবো? তুমি নিয়ে খাও আমি যাচ্ছি।
– আমি কত ব্যস্ত দেখ লিখছি,পরীক্ষা আমার।
হাত অবসর নেই।খায়িয়ে দিলে খেতে পারি,না হলে রেখে যা আম্মু এসে খায়িয়ে দিবে।আমার সময় নেই।
আমি মুখের সামনে এগিয়ে দিলাম, মাহির খাচ্ছে আর লিখছে।
উনি খুব ব্যস্ত তাই আমাকেই খাওয়াতে হলো।
আমি চলে আসবো তখন মাহির বলে – কোথায় যাচ্ছিস?
– বাসায়।
– বাইরে তাকিয়ে দেখ।
তাকিয়ে দেখি ঝুম বৃষ্টি আমি এতোক্ষণ টের পাইনি।
– আর সময় পেলো না বৃষ্টি আসার!
– কেন বাসায় যাবার খুব তাড়া।
– হুমম!
– কেন? কেউ কি আছে নাকি বাসায় যে তোর অপেক্ষা করবে?
– আমার আম্মু অপেক্ষা করবে।
– আন্টি জানে তুই এখানে আর বৃষ্টির জন্য আটকে গেছিস সেটা উনাকে বুঝাতে হবে না।উনি তোর মতো বুদ্ধু না!
আমি জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি।কারো স্পর্শ পেলাম- জানি এটা মাহির, তবুও চমকে উঠি।
মাহির আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়।
– কুহু! তুই ইদানীং আমার সাথে কথা কম বলছিস।
– কম বললাম কোথায়? এইতো এখনো বলছি।
– অনেক দিন থেকেই ভাবছি একটা কথা বলবো তোকে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না।
– কি?
মাহির দু’হাতে আমার মুখ তুলে ধরে আরও কাছে এসে বলে – তোকে ভালবাসি কুহু।কখন থেকে যে ভালবাসতে শুরু করেছি বুঝতেই পারিনি। এখন বুঝতে পারছি তোকে ছাড়া আমার একদম চলবে না।
আমি মাহিরের কথার ঘোরে ডুবে আছি।
ভালবাসার প্রথম চিহ্ন এঁকে দিলো কপালে।অদ্ভুত এক শিহরণে কেঁপে উঠি আমি।
বুকে জড়িয়ে ধরে মাহির।ঘোর কাটতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাই।নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছি মাহিরের বাহুডোর থেকে।
কিন্তু মাহির….
আবারও কপালে চুমু খায়। তারপর ঠোঁটের গভীরে চলে কালবৈশাখী ঝড়! যেন উন্মাদ হয়ে ঝড়ের তান্ডব চলছে!
মাহিরের মুখটা সরিয়ে দিয়ে বললাম – কি করছো মাহির ভাইয়া! ছাড়ো আমাকে!
আমার বুকের ভেতরে তখন মনে হচ্ছে পানিশূন্য হয়ে গেছে আর সেখানে হার্টবিট না যেন কেউ ড্রামে আঘাত করে যাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ যেন আমি শুনতে পাচ্ছি!
মাহির ছাড়েনি আমাকে বরং পাগলের মতো চোখেমুখে তার স্পর্শ এঁকে যাচ্ছে একেরপর এক।
মাহিরের চোখে যে গভীর ভালবাসা দেখেছি সেটা এখন অন্যকিছু বলছে। তার স্পর্শ ধীরে ধীরে অন্য কিছু পাবার নেশায় মত্ত।
একটা মেয়ে সহজেই বুঝতে পারে কোন স্পর্শে ভালবাসা আছে আর কোন স্পর্শে কামনা!
মাহির ভালবেসে স্পর্শ করলেও এখন সেটা কামনায় রূপ নিয়েছে।
নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম।
– কি হচ্ছে এসব? মাহির ভাইয়া!
মাহির আবারও আমাকে জড়িয়ে ধরে
– প্লিজ কুহু… তোকে ছাড়া আমার চলবে না। আমি তোকে ভীষণ ভালবাসি।তুই ভুল বুঝিস না।
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই মাহিরকে। আমার চোখ ফেটে কান্না আসে।
– এটা তোমার কাছ থেকে আশা করিনি মাহির ভাইয়া। তুমি আমার ভালবাসাকে অসম্মান করেছো!
মাহির এতোক্ষণে বুঝতে পারে সে কি করেছে।
– কুহু…
– ছুঁবে না আমাকে।
ধাক্কা দিয়ে মাহিরকে সরিয়ে আমি বেরিয়ে আসি।ঝুম বৃষ্টিতেই আমি ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরি।
সেইদিন বৃষ্টিতে চোখের পানি লুকিয়েছিলাম।
বৃষ্টির পানি থেকে চোখের পানি কেউ আলাদা করতে পারেনি।
মাহিরও গেইট পর্যন্ত ছুটে আসে তার আগেই আমি অনেক দূর চলে আসি।
এরপর থেকে প্রায় মাসখানেক মাহির আসেনি আমাদের বাসায়।
পরে যখন এলো আম্মু জিজ্ঞেস করতেই বললো পরীক্ষা ছিলো।তারপর আগের মতোই আসতো কিন্তু আমি পালিয়ে বেড়াতাম যাতে দেখা না হয়।কয়েকমাস পরে আমরাও এই বাসা ছেড়ে নিজেদের বাসায় শিফট করি।
এরপর মাহির অনেক বার ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমি আর এসব নিয়ে কোনো কথাই বলিনি। তারপর থেকে আরও বেশি পিছনে লেগে আছে আর তাতে আমার জেদ আরও বেড়ে গেছে। তাই তাকে মেনে নিতে পারছিনা আমি।
মাহির একটা মাসের মধ্যে সামনেই আসেনি! ভালবাসা পবিত্র কিন্তু সে যেটা চেয়েছিলো সেটা তো…
এসব ভাবতে ভাবতে মাহির চলে আসে রুমে।
অনেক রাত হয়ে গেছে। সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। মাহির ভাবলো আমিও ঘুমে তাই চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
অনেক সময় পর -মাহির ঘুমিয়ে আছে। আমার ভেতরে ছটফট করছিলো সেই পুরনো স্মৃতি মনে করে।
বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসে ভরা পূর্ণিমা দেখছি। এতো সুন্দর চাঁদের আলো!
মাহির কখন এসে পাশে বসেছে বুঝতে পারিনি।
আমার হাতে হাত রেখে বললো –
তোকে কিছু বলার ছিলো।
– তুমি কেন এসেছো এখানে? তুমি চলে যাও। আমি আর ফিরে যাবো না। কিছু শোনার নেই আমার।
একথা বলে বাংলোর সামনে বাগানে চলে যাই।বাগানে গিয়ে বসি।
মাহিরও আমার পেছনে আসে।
– আজ যে তোকে শুনতেই হবে।
আমি চুপ করে আছি।
মাহির বলে চলছে-
আমি জানি তুই কেন সব মেনে নিতে পারছিস না।
সেইদিনের ঘটনা তুই মনের মধ্যে গেঁথে রেখে জেদ ধরে রেখেছিস।আমি অনেক বার ক্ষমা চেয়েছি তুই ক্ষমা করিসনি।
কুহু, আমি তোকে ভীষণ ভালবাসি। সেদিন তোকে প্রথম বুকে জড়িয়ে আমার কি হয়েছিল জানি না।যখন বুঝতে পারি তখন আমি কিছু বলার আগেই তুই বেরিয়ে গেছিস।
লজ্জায় আর তোর সামনেই দাঁড়াতে পারিনি।
আজও আবারও ক্ষমা চাইছি। তুই আমাকে আর ভুল বুঝিস না। সেই দিন যা হয়েছিল তা আবেগের বসে ভুল!
মানছি কিন্তু সেটাকে আমি পাপ বলতে পারবো না কুহু..কারণ আমি জানতাম…
আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।
– সেদিনের ভুল তো আমি ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু… তোমার সবাই মিলে ঠকিয়েছ!
– আমার কথাটা শেষ করতে দে..কেউ তোকে ঠকায়নি, শুধু বাধ্য হয়েছিল এতটুকু করতে। কারণ টা আজ তোর জানা দরকার। সবাই অনেক বার চেষ্টা করেছে সঠিক সময়ে বলার কিন্তু হঠাৎ করে তুই আমাকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছিস! তোর উপর চাপিয়ে দিলে তুই সহ্য করতে পারতিস না উল্টো জেদ আরও বেড়ে যেত আর তখন কি করতি সেটা কেউই জানে না।
– মানে?
– মানে তুই যে বদমেজাজী সবাই ভয় পায় তোকে। তাই কি করে বলতো যে তুই আমার বিয়ে করা বউ ছিলি।
– বউ ছিলাম মানে?
আমি মাহিরের কথা আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।।
-শোন আব্বু- আম্মু তোকে খুব পছন্দ করতো। আম্মু তোর বয়স যখন দেড় বছর তখনই বলে তোকে ছেলের বউ করবে। সবাই ঠাট্টা মনে করলেও আম্মু কিন্তু সিরিয়াসলি চেয়েছিলেন। যখন সবাই জানতে পারে তখন আম্মুর কথা ফেলতে পারেনি তোর আব্বু- আম্মু।তারাও রাজি হয়ে যায়।বড় হলে আমাদের বিয়ে দিবে।কিন্তু তোর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমার দাদু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর বাঁঁচবেন না, মৃত্যু সজ্জায় উনার ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়ে দেখার বউ দেখার, তখন তিনি অনুরোধ করেন যেহেতু বিয়ে ঠিক করা আছে তাহলে এখন যেন বিয়েটা দিয়ে দেন যাতে উনি দেখে যেতে পারেন।
সবাই মিলে উনার ইচ্ছে পূরণ করে আমাদের বিয়ে দিয়ে দেন।
চলবে…
# বধুয়া#
# পর্ব – ১৬
# শেষ পর্ব#
মাহিরের কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। এতো কিছু! অথচ আমি জানি না?!
– কি বলছো এসব?
– হুমম। এই যুগের মেয়ে হয়ে তুই এটা মানতে পারবি কিনা সেটাই ভাবনা ছিলো। তারউপর তোর যে জেদ।সবাই চেয়েছিলো আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকে, যাতে ভালবাসতে পারি। কিন্তু তুই উল্টো পথে হাঁটছিলি!! তাই সবাই মিলে নাটক করে বিয়ে দেয় আবার।
-তার মানে তুমি সব জানতে আগে থেকেই?
– আমি যখন কলেজে ভর্তি হই তখন আম্মু বলেছে যাতে অন্য কোনো মেয়ের প্রেমে না পড়ি!
– সেদিন কি তুমি জানতে?
– হুমম জানতাম। তাই তো বউকে আদর করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম তোর কাছে এটা অন্য মানে হয়ে যাবে!! তুই ভুল বুঝলি।
তবে ভুলটা আমারই, উচিত ছিল তোকে জানিয়ে দেয়া।আর না জানালেও এ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি!
আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা। এতো কিছু হয়ে গেছে অথচ আমি জানি না!
আমি কেঁদেই যাচ্ছি।
আমি বাগানের বেঞ্চে বসা।মাহির উঠে এসে আমার সামনে বসে হাতে হাত রেখে বলে –
কাঁদছিস কেন?
– ছুঁবে না আমাকে!
– এখনও ক্ষমা করবি না আমাকে ? প্লিজ কুহু
তোকে ছাড়া আমার বুকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে! এই কয়দিন তোকে কোথায় কোথায় না খুঁজেছি! থানা-পুলিশ সব করেছি!
তুই যে আমার কি! সেটা তোকে কিভাবে বুঝাই?
– তুমি খুব খারাপ! খুব!
বলে আমি কাঁদতে কাঁদতে আমি মাহিরের হাতে মাথা ঠেকাই।
মাহির বললো – খুব খারাপ?
– হুমম খুব! এতো দিন বলোনি কেন এসব? তাহলে তো এতো কিছু হতো না।
– তুই মেনে নিতি? উল্টো গাল ফুলিয়ে পালাতি!আসলে সবই ভাগ্য। ভাগ্যে ছিলো তাই হয়েছে।
আমি অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছি।
মাহির বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছিয়ে দেয়।
– হয়েছেতো। আর কাঁদতে হবে না।
– আসলেই তুমি খারাপ!
– আবার কি করলাম?
– নিজের বউকে কেউ ‘তুই’ করে বলে?
– আমি তোকে তুই করেই বলবো! তুমি- টুমি বলতে পারবো না।
– আচ্ছা তাই?
– হুমম।তুই হয়েই থাক ‘ কুহুপাখি’
মাহিরের বুকে মিশে আছি আমি ‘কুহুপাখি’ হয়ে।
এমন সময় কাউকে বারান্দায় আসতে দেখে আমি মাহিরকে ছেড়ে চোখমুখ আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম।
– মান অভিমান পর্ব কি বাহিরেই চলবে?
সুমন ভাই আর তরী হাজির।
– সুমন ভাই না জানালে তো জানতেই পারতাম না কুহু এখানে আসতে পারে।
অনেক বড় উপকার করলেন ভাই।সারাজীবন মনে রাখবো।
– তবে এখন আর উপকার করতে পারলাম না!
সুমন ভাই গম্ভীর ভাবে বললেন।
– মানে?
– মানে হলো বিরহের প্রহর কাটিয়ে সুখের মিলন এতো তাড়াতাড়ি হতে দেয়া যাবে না!
– ভাই মেরে ফেললেন!
মাহির হেসে বলে।।
তরী বললো
– এখন আর ঘুমাতে যেতে দিবো না আপনাদের। রাত প্রায় শেষের দিকে।
– তো এখন তাহলে কি করবো? এখানেই বসে থাকবো? আসলে আমার না অনেক ঘুম পাচ্ছে খুব টায়ার্ড তো!
মাহিরের কথায় আমার হাসি অনেক কষ্টে চেপে রাখি।
তরী চেপে রাখতে না পেরে হেসেই ফেললো – ঘুমানোর জন্য সারাদিন পড়ে আছে মাহির ভাই।
সুমন ভাই বললো- চলুন।
– কোথায়?
– গভীর রাতে বাগানে ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিতে! এখন আমরা চারজন হাঁটবো চাঁদনি রাতে।।
আমরা হাঁটতে বের হলাম। চাঁদের এতো আলোয় হাঁটতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না। মাহির কানের কাছে এসে বললো – ধুত! এই ভাই তো উপকার করে এখন বিরাট ক্ষতি করে দিলো! কই বউয়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো! এখন জঙ্গলে হাঁটতে হচ্ছে!
– চুপ থাক তো! লজ্জা শরম নেই নাকি? উনারা কি ভাববেন?
ধমক খেয়ে মাহির চুপ হয়ে গেছে।
তরী এসে আমার গাঁ ঘেসে হাঁটছে।মাহির আমার কাছে আসতে চেষ্টা করছে সুমন ভাই খুব সুন্দর চালাকি করে বারবার আটকে দিচ্ছেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি এটা তরী আর সুমন ভাইয়ের প্ল্যান! আমার হাসি পাচ্ছিলো মাহিরের আর সুমন ভাইয়ের নাটক দেখে।
তরী বললো – তোর জামাইয়ের অবস্থা দেখেছিস! বেচারা!
আমিও মিটিমিটি হাসছি তরীর কথায়।
পরদিন কেয়া তারা চলে যায়। তাদের বিদায় দিয়ে মাহির পড়ে ঘুমাচ্ছে। বেচারা জার্নি করে রাতে ঘুমাতে পারেনি,তার উপর সারাদিন ঘুরাঘুরি, গত রাতেও একই অবস্থা হাঁটতে হাঁটতে আমরা ভোর পাঁচটায় বাংলোয় ফিরে আসি। তবে অনেক সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা হলো। সারাজীবন মনে রাখবো – এমন সুন্দর রাত পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়।
সারারাত ঘুমহীন মাথা ঘুরছে আমার। আমিও ঘুমালাম কিছু সময়।
বিকেলে তরী সুখবরটা দিলো- তরী কনসিভ করেছে!
আমি কি যে খুশি হলাম। সুমন ভাই তো খুশিতে কি করবেন! একটা অন্যরকম আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হলো।
এদিকে আমাদের বাসায় ফেরা দরকার। রাতে ডিনারের পরে সবাই একসাথে বসে কথা বলছি, তখন মাহির বাসায় ফেরার কথা তুললো।
কিন্তু তরী, সুমন ভাই কিছুতেই ছাড়বে না। আরও কমপক্ষে একটা সপ্তাহ থাকার বায়না ধরে।
মাহির আমি আসার পর থেকে আর অফিসেই যায়নি।এসব সমস্যা দেখিয়ে,অনেক বুঝিয়ে ঠিক হলো আমরা আরও একদিন থেকে তারপরের দিন ফিরবো।
আমার সাথে দেখা হবার পর মাহির বাসায় ফোন করে জানিয়েছে, কিন্তু আমি তখন কারো সাথেই কথা বলিনি।তরী বললো – তুই বাসায় সবার সাথে একটু কথা বল।কত চিন্তায় ছিলেন উনারা।
আসলেই তো কথা বলা প্রয়োজন। আমি আর মাহির বারান্দায় বসে বাসায় ফোন দিয়ে কথা বললাম।
আমার মাথা এখনো ধরে আছে।আরও কিছুক্ষণ তরীদের সাথে কথা বলে ঘুমাতে যাবো, তখন রুমের কাছে এসেই মাথাটা চক্কর দিচ্ছিলো।মাহির বললো – কি হয়েছে?
– মাথা ঘুরছে!
মাহির ধরে রুমে নিয়ে এলো। রুমের দরজা খুলে তো পুরাই তাজ্জব দুজন।
তরী আর সুমন ভাই এতো কান্ড কখন করলো?!
সারাটা ঘর সাজিয়েছে!
এমন সময় দুজনেই আসলো। সুমন ভাই বললেন – মাহির ভাই, কালকে তো জ্বালিয়েছি দুজনকে তাই সুদে আসলে ফেরত দিয়ে দিলামরে ভাই।’
মাহির কিছু না বলে শুধু হাসছে। লজ্জায় আমি আর তাকাতেই পারছি না ওদের দিকে।
তরী বললো – হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না।মাহির ভাই,কালকে তো বউ নিয়ে গিয়েছিলাম আজ ফেরত দিলাম, এই রইলো আপনার বউ।
আমরা কেটে পড়ি!
সুমন ভাই আর তরী চলে যায়। মাহির যাবার সময় চেঁচিয়ে বললো – থেংক্স!
তারপর মাহির দরজা বন্ধ করে দিলো।
– তোর এখনো মাথা ঘুরাচ্ছে?
– হুমম।
– তাহলে তো চিন্তার বিষয়!
– কিসের চিন্তা?
– তোর তরীর মতো কিছু হয়নি তো!
– ধ্যাত! যত্তসব বাজে কথা!
– বাজে না রে ভাই! সিরিয়াসলি ভাবছি।
– ধুর এটা সম্ভব নাকি?
– কেন সম্ভব না?
– ভাল্লাগেনা! তুমি কি বুঝও না আমাদের ওসব কিছু হয়নি।
– কে বলেছে হয়নি?
– মানে?
– সেদিন তবে কি হয়েছিলো?
মাহিরের কথা শুনে আমার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
– কোন দিন?
– অইযে নেশায় চুমু খেয়েছিস।শুধু এইটুকুই না আরও অনেক কিছুই করেছিলি!
– মিথ্যে বলবে না একদম! সত্যি করে বলো..
– মিথ্যে বলবো কেন? প্রমাণ আছে!
এটাও ভিডিও হয়ে গেছে! আমি ইচ্ছে করে ভিডিও করিনি কিন্তু!
দেখবি?
মাহিরের কথা শুনে আমার চোখ ভিজে গেছে, লজ্জায় কি বলবো! জানি না কি কি করেছি!
– দেখ।
মোবাইল এগিয়ে দেয় আমাকে।
আমি ধরি না মোবাইল।
– যাও দেখবো না কিছু।
আমার অবস্থা দেখে মাহির হেসে বললো – আরে পাগলি দুষ্টুমি করলাম, কিচ্ছু হয়নি শুধু চুমু খেয়েছিস।
কপালে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে – তাই বলে কি আজ হবে না? আমি মাহিরের বুকে মুখ লুকাই।।☺
* সমাপ্ত *