#বর্ষায়_ভেজা_অভ্র,পর্ব_০৬
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
‘কি হইছে তোমার? তুমি এমন মুখটারে টমেটোর মতন গোলমাটল করে বসে আছে কেন?’ বিছানার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে অভ্র তা দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল বর্ষা।
দাঁত কটমট করতে করতে তীক্ষ্ণ চোখে বর্ষার দিকে তাকিয়ে অভ্র বলল,‘ওই বেটা চোর! চুরি করতে আইসা আমার লুঙ্গি চুরি কইরা নিয়া ভাগছে।’
অভ্রর কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল বর্ষা। তা দেখে রাগে ফুঁসছে অভ্র। বর্ষা হাত দিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসতে হাসতে বলল,‘শেষমেস কিনা তোমার লুঙ্গি? আল্লাহ গো! তোমাকে চুরি কইরা নিয়া গেলেও তো মনেরে বুঝ দেওন যাইতো।’
অভ্র বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,‘কি বললি তুই?’
‘বর্ষা তুতলিয়ে বলল, কোকক কোই কিছু না তো।’
‘দাঁড়া আজকে তোর হচ্ছে।’ বলেই অভ্র উঠে বর্ষাকে ধরতে নেয়। বর্ষা অভ্রকে তেড়ে আসতে দেখে অস্ফুটস্বরে, ‘বাবা গো’ বলে উল্টো পায়ে দৌঁড় দিলো৷ পেছন পেছন অভ্র সে নিজেও ছুটছে। দুজনের হড্ড গোল শুনে সিঁড়ির দিকে তাকালো সবাই। বর্ষা দৌঁড়ে তার দাদার পেছনে লুকালো। মনোয়ারা সরু কন্ঠে বলল,‘তোদের আবার কি হয়েছে এমন ভাবে একজন আরেক জনের পেছনে ছুটতাছিস কেন?’
বর্ষা হাসি কন্ট্রোল করার জন্য পেটে হাত রেখে বলল,‘চোর বেটা অন্য কিছু চুরি না কইরা তোমাগো অভ্রর লুঙ্গি চুরি কইরা নিয়া পলাইছে।’
বলে হাসতে হাসতে চেয়ার টেনে বসে পরল। বর্ষার কথার পিঠে বাড়ির প্রতিটা সদস্য ফিক ফিক করে হেসে উঠল। অপর দিকে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েছিল তিন্নি, লুঙ্গি চুরি করে নিয়ে গেছে শুনে বিষম খেলো সে। মাথায় হাত দিয়ে অনবরত কাশছে। অপূর্ব অভ্রর দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,‘ ভাই যখন তোর লুঙ্গি চুরি করছিল তখন তুই কোথায় ছিলি?’
একরাশ বিরক্তি নিয়ে অভ্র বলল,‘ কোথায় ছিলাম মানে কি? মাঝরাতে তোমাদের সবার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। সেজন্য উঠে দরজা খুলে বের হই অন্ধকার বলে তেমন কিছু নজরে পরছিল না। এমন সময় কে জেনো আমার সাথে ধাক্কা লাগলো আমি অস্ফুটস্বরে বললাম কে? সে সাথে সাথে কি দিয়ে জেনো আমার মাথায় আঘাত করল। ঠাসস করে মাটিতে পরে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই। এই দশ বিশ মিনিট আগে হুঁশশ ফিরেছে। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসি প্রচন্ড ব্যথা করছে মাথাটা। রাতের কথা ভাবতেই মনে হল, আমি রুমের বাহিরে ছিলাম ভেতরে কি করে আসলাম। আমার কোমড় পর্যন্ত কাঁথা দিয়ে ডাকা ছিল। রাতে কি হইছিল জানার জন্য তোমাদের কাছে আসবো ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নামতে যাবো তখন দেখি আমার লুঙ্গি নাই। হাওয়া। আবারও মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম লুঙ্গি কই লুঙ্গি কই? ভাবতে ভাবতে একটা শর্টস পরি। কিন্তু কোনো ভাবেই মাথায় আসছিল না লুঙ্গি গেলো কোই? তখন আমার রুমে গিয়া উদয় হলো বর্ষার। ওর মুখে লেংটি চোর শুনে বুঝলাম চোর আর কিছু নিতে না পেরে আমার লুঙ্গি খুলে চুরি করে নিয়ে গেছে।’
বলেই অভ্র ফুসফুস করছে। অন্যদিকে বাড়ির বড়রা বাদে বাকিদের হাসতে হাসতে বেহাল অবস্থা। যা দেখে অভ্র রাগে কটমট করছে। নূর ইসলাম বলল,‘ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে দাদু ভাই। বসো এখন খেয়ে নাও।’
আমির খান (নূর ইসলাম এর ছোট ছেলে) বলল,‘ বুঝলাম না এটা কেমন চোর? বাড়িতে চুরি করতে এসে সোনা গয়না টাকা পয়সা চুরি না করে লুঙ্গি চুরি করে?’
.
.
.
‘তোমার কি মাথা খারাপ হইছিল? আর কিছু পাওনাই শেষে কি না অভ্র ভাইয়ার লুঙ্গি? ইশশ চুরি করার হলে বাড়িতে আরও অনেক কিছু ছিল সেগুলো চুরি করতে অভ্র ভাইয়ার লুঙ্গি কেন চুরি করতে গেলা? তাও আবার তার মাথায় আঘাত করে।’
ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলছে তিন্নি। ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটা ধীর কন্ঠে বলল,‘ আমার আর কিছু করার ছিল না। তোমার সাথে রাত বিরাতে দেখা করতে গিয়ে যে এমন দূর্দশায় পরতে হবে আমি কল্পনাও করিনি। তোমার বাড়ির লোক আমাকে চোর মনে করে কি দৌঁড়ানি দিছে তুমি ভাবতে পারবা না। পানিতে পিছলা খেয়ে পরে গিয়েছিলাম। তখন প্যান্ট ভিজে যায় ভেজা প্যান্ট দিয়ে গাছ বেয়ে নামতে গেলে নির্ঘাত পরে কোমড় ভাঙত। সেখান থেকে উঠে উল্টো দিকে পালানোর সময় হঠাৎ তোমার ভাই সামনে চলে আসে। আমি ভয় পেয়ে যাই, মনে হয় এই বুঝি খাবো ঘন ধুলাই। তারপরই তার মাথায় ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করি। তারপর তাকে রুমে নিয়ে যাই বিছানার উপর শুইয়ে দেই। তার লুঙ্গি খুলে নিজে পরি তারপর তার শরীর কাঁথা দিয়ে ডেকে পালিয়ে যাই। আর হ্যাঁ আল্লাহ’র কসম তখন পুরো রুম অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল কসম করে বলছি আমি কিছুই দেখি নাই।’
‘তুমি চুপ করবে শান? তোমার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? তুমি জানো গতকাল রাতে তোমার জন্য কতবড় একটা গন্ডগোল হইছে। উফফ কে বলেছিল তোমাকে রুম থেকে বের হয়ে একা একা হাঁটতে?’ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল তিন্নি।
‘সরি!’ নিচু স্বরে বলল শান।
শান হচ্ছে তিন্নির বয়ফ্রেন্ড তিন বছরের রিলেশন ওদের। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা দু’জন এই ব্যাপারে ভ্রু নাক্ষেও কাউকে টের পেতে দেয়নি। তিন্নির দুইদিন ধরে জ্বর থাকায় সে ভার্সিটিতে যেতে পারছিল না। শান’র সাথেও ঠিকমতো কথা হয়নি। বেশ চিন্তিত হয়ে পরে শান। তাই সাহস করে দেখতে চলে আসে। তিন্নি হঠাৎ করে বলে তার পানি পিপাসা পেয়েছে। রুমে পানি ছিল না বৈকি শান কিচেন থেকে পানি আনতে যায়। তার ধারণা ছিল বাড়ির সবাই এই মূহুর্তে ঘুমাচ্ছে। ভুল বসত বর্ষা তখন কিচেনে ছিল। শান এই প্রথম নূর মঞ্জিলে এসেছে বলে সে বেখেয়ালি হয়ে টেবিলের সাথে ধাক্কা খায়। আর একটা গ্লাস শব্দ করে মেঝেতে পরে ভেঙে যায়। সে শব্দ কানে আসতেই ভূত বলে চিৎকার করে উঠে বর্ষা।
‘ও হো হো! সকাল সকাল এই সব হচ্ছে?’
পেছন থেকে কারো শানিতকন্ঠ শুনে থুতুমুতু খেয়ে যায় তিন্নি। শুকনো ঢোক গিলে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নেয়। এক আঙুল দিয়ে কল কেটে দিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়। কোমড়ে হাত দিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। তা দেখে জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া হালকা ভিজিয়ে নেয় তিন্নি। আমতা আমতা করে বলল,‘ তুতত তুই এখানে কখন আসছিস?’
বর্ষা হেঁটে তিন্নির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ছাঁদ থেকে নিচে তাকিয়ে বলল,‘যখন তুমি তোমার শানকে শাসাচ্ছিলে!’
‘মানন মানে তুই সব শুনে ফেলেছিস?’ অস্ফুটস্বরে বলল।
‘জি হ্যাঁ! শুনেওছি আর বাড়ির সবাইকে শুনাবো ও।’
তিন্নি বর্ষার হাত ধরে বলল,‘লক্ষী বোনটি আমার। দয়া করে কাউকে বলিস না। তুই বলে দিলে বাড়ির সবাই আমার ক্লাস নিয়ে নিবে। তুই যদি না বলিস তাহলে তুই যা চাইবি আমি তোকে তাই দিবো।’
‘প্রমিজ?’
‘পাক্কা প্রমিজ!’
‘আচ্ছা যাও কাউকে বলবো না। বদলে প্রতি সপ্তাহে আমাকে তোমার রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যেতে হবে। আর শান ভাইয়ার সাথেও দেখা করাতে হবে। আরও শর্ত আছে ওটা আমি পরে চিন্তা ভাবনা করে জানাবো ওকে?মেরি লাভলী বেহনা!’
বলেই দুষ্টু হাসি দিয়ে বর্ষা চলে যায়। তিন্নি বর্ষার যাওয়ার পর রাগী গলায় বলল,‘ বাঁশ দিয়া বলতাছিস লাভলী বেহনা! তোর মতো বোন জেনো কারো না হয়। বজ্জাত!’
_______________
– বউকে কুপিয়ে খুন করতে গিয়েছে। বোন দেখে ভাবীকে বাঁচাতে আসলে তাকেও খুন করেছে। তারপর দুটি বডির পাশেই বসে ছিলো।
পালানোর চেষ্টা অব্ধি করেনি। কোন কথাও বলছে না। কত কথা, কত প্রশ্ন করছি সেই তখন থেকে। আর এ চুপটি মেরে বসে আছে। মা এসে দেখে ফেলায় মেয়ে দুটোকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ওর বোন মারা গেছে। আর বউয়ের অপারেশন চলছে মরেনি এখনো। তবে বাঁচবে না বেশিক্ষন।
চোখের উপর অন্ধকার দেখছি মুহূর্তেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। গলাটা জেনো শুকনো কাঠ হয়ে গেলো। আহিল ভাইয়াকে আমরা ছোট থেকে চিনি। সে এমন কাজ করতেই পারে না। এটা তার ধারা সম্ভব নয়। তিনি তো ভাবিকে প্রচন্ড ভালো বাসে।
সকাল নয়টার মধ্যে এলাকায় পুলিশের গাড়ি ঢুকলো তাও আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িতে। কৌতূহল বসত আমরা সবাই ওই বাড়িতে গেলাম। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই আসছে দেখতে পেলাম। তাদের এড়িয়ে ভেতরে যেতে দেখলাম। বাড়ির মধ্যখান টায় আহিল ভাই বসে আছে। মেঝে ভিজে চিপচিপে হয়ে আছে রক্তে।
দাদাজান এই পরিস্থিতি দেখে পুলিশের কাছে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলেন।
আমি ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আহিল ভাইয়ার কাছে এগিয়ে গেলাম। তা দেখে পেছন থেকে পুলিশ অফিসার বলল,‘ সাবধানে ওনার কাছে যাবেন না।’
আমি শুনেও শুনলাম না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আহিল ভাই এটা করতে পারে। আমি দেখেছি তিনি ভাবীকে কত বেশি ভালোবাসতেন। আমি হাঁটু গেঁড়ে তার সামনে বসলাম। সরু কন্ঠে বললাম,‘আহিল ভাইয়া?’
ভাইয়া আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললাম আমি। চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। একহাত বাড়িয়ে দিলাম আহিল ভাইয়ার হাতের উপর রেখে বললাম,‘ আমি জানি ভাই এটা আপনি করেননি? দোষ না করেও কেন তার শাস্তি পাবেন? বলেন না ভাই কি হয়েছিল ভাবী আর অর্পণা আপুকে কে আঘাত করছে?’
আহিল ভাইয়া হঠাৎ করেই হিংস্র হয়ে উঠল। আমার হাত ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালো। তা দেখে তিন জন পুলিশ এগিয়ে আসল। দু’জন অফিসার আহিল ভাইয়াকে ধরে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গাড়িতে বসালো। অন্য জন আমার দিকে এগিয়ে আসল, আমার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল। আমি কেন তার হাত ধরে উঠতে যাবো আজব? মেঝেতে দুই হাতের ভোর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পুলিশ অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আমি তার পুলিশ ইউনিফর্মে থাকা নেইম-প্লেটে লক্ষ্য করলাম। কিন্তু দেখার আগেই তিনি চলে গেলেন অন্য দিকে।
দাদাজান এগিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলতে শুরু করল। তারপর দু’জনে একসাথে বাড়ি থেকে বের হয়। পেছন পেছন আমিও বের হলাম, পুলিশের গাড়ির দিকে তাকাতে স্পষ্ট আহিল ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। তিনি খুব অদ্ভুত আচরন করছেন। মনেই হচ্ছে না এটা যে আমাদের আহিল ভাইয়া। মনে হচ্ছে এটা অন্য কেউ! আমাদের আহিল ভাইয়া এমন নয়। এটা উনি হতেই পারে না।
মাথার মধ্যে শতশত প্রশ্ন তোলপাড় করে দিচ্ছে। ঠিক তখনই কারও কর্কশকন্ঠের ধ্বনি কানে ভেসে আসল।সে বলল,‘পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে তুই কি করছিস পিচ্ছি মেয়ে?’
চলবে?