বর্ষা দুপুর,পর্ব -১১,১২
হালিমা রহমান
পর্ব -১১
বছর ঘুরে বর্ষা এসেছে আবার।দিন-রাত বিষন্নতার গানে আকাশ কাঁদে। ঝুমঝুম,ঝুমঝুম।বৃষ্টির একটানা গুনগুনে চারপাশ পঁচে যাবে মনে হয়।আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে ইশরাকের।ঘুম থেকে উঠেই জানালায় চোখ যায়।জানালার বাইরে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির অমিয় ধারা।টিনের চাল বেয়ে গড়িয়ে পরা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার জন্য জয়নব বেগম নিচে টিনের বালতি পেতে রেখেছেন।সেই বালতি ভরে গেছে অনেক আগেই।এখন বালতির বাইরে পানি উপচে পরছে।ইশরাকের নজর যায় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীরার দিকে।মাথায় ওড়নার আঁচল টেনে দিয়ে পিটুশের খাচা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পিটুশকে বৃষ্টি দেখাচ্ছে।আশ্চর্য! পিটুশ কি বৃষ্টি চিনে না?নীরার কাজ-কর্মের কোনো আগা-মাথা খুঁজে পায় না ইশরাক।অকারণেই রেগে যায় নীরার উপর।
—” নীরা কি করছিস ওখানে?”
—” বৃষ্টি দেখি।”
—” এইরকম ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি দেখার কী আছে?যদি ঠান্ডা লাগে,তখন কি হবে? ফাজিল মেয়ে,ঘরে ঢুক।
বাড়ি-ঘর ভরে গেল ফাজিল দিয়ে।”
ইশরাকের কথার বিপরীতে খিলখিল করে হেসে উঠে নীরা।নীরা জানে ইশরাকের এতো গরম মেজাজের কারণ।তাই হাসতে হাসতে গানের মতো সুর টেনে বলেঃ”ঘরে বউ নেই,মনে শান্তি নেই,এই জগতে ইশরাক ভাইয়ের কোনো সুখ নেইইইই।”
—” চুপ বেয়াদব।আমি তোর বড় না।”
—” তো আমার সাথে সকাল সকাল রাগ কেন দেখাচ্ছ? আমি কী রিমা ভাবিকে যেতে বলেছি ঢাকা?”
—” ওই ফাজিল মহিলার কথা আমাকে বলবি না।চূড়ান্ত ফাজিল একটা মেয়ে।”
—” এমন করছো কেন ইশরাক ভাই? দুটো দিনের জন্যই তো গেছে ঢাকা।ও কী আর কখনো ঢাকা দেখেছে? এবার ইচ্ছে হয়েছে তাই বোনের সাথে বেড়াতে গেছে।মানুষের শখ-আহ্লাদ বলতেও তো একটা কথা আছে, নাকি? তুমি নিয়ে গেলে তো আর একা একা যেত না।”
—” আজব,ঢাকার মতো একটা দূষিত শহর দেখার কী আছে? আর দুটো দিন বলছিস তুই?ও গেছে আজ সাতদিন।ঘর -সংসার নেই নাকি?একটা যে জামাই আছে ঘরে, সে কথা কি মনে আছে?”
—” থাক আর রাগ করো না।আজকেই চলে আসবে।কথা বলছি আমি রাতে।”
একটু থমকে গেল ইশরাক।রিমা তার অমতে ঢাকা গেছে।শুধু অমতে না, বেশ জোর-জবরদস্তি করেই গেছে।তাই রাগ করে ইশরাক ফোন দেয়নি কোনো।রিমাও দেয়নি।তাই ইশরাক জানতো না আজকেই রিমা আসবে।
—” আজকেই আসবে?”
—” হুম। বলল তো আজকেই আসবে।আবার লক ডাউন দিচ্ছে তো।দূর-পাল্লার গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে আসবে কীভাবে?তাই আজকেই রওনা দিবে।”
হুট করেই মনটা ভালো হয়ে গেল ইশরাকের।বুঝতে পারল মন আকাশের মেঘগুলো কেটে গেছে।সেখানে উঠেছে খরখরা সূর্য। খুশি মনে ঘরের দিকে পা বাড়ালো ইশরাক।মাস দুয়েক আগে বিয়ে হয়েছে তাদের।অর্ধাঙ্গিনী ছাড়া ঘরটা একদম খালি খালি লাগছিল।আজ তার ফাকা ঘর আবার পূর্ণ হবে।ভাবতেই কেমন ভালো লাগছে।নীরা ইশরাকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।ইশরাক একদম পরিপূর্ণ একজন প্রেমিক পুরুষ।ইশরাক – রিমার সংসার দেখলে খুব ভালো লাগে নীরার।মনটা খুশি হয়ে যায়।এদের সংসারটাই এরকম যে দেখলেই কবিগুরুর মতো বলতে ইচ্ছে করে—” এমন তো আর দেখি নাই।”
নীরা আবার বৃষ্টির দিকে তাকায়।বৃষ্টি দেখলেই কেন যেন নীরার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অতীতগুলো মনে পড়ে।কিছু বিষাদমাখা তিক্ত অতীত।
***
সেই সন্ধ্যায়, মেহরাবের সাথে নীরার বিয়ে ভেঙেই গেল।বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙা, একটা মেয়ের জন্য সোজা কথা নয়।আবার তা যদি হয় রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজ তাহলে তো আর কথাই নেই।সেই অলক্ষুণে সন্ধ্যায় যখন ইরা উত্তেজিত কন্ঠে নীরাকে শুনাচ্ছিল বিয়ে ভাঙার কথা, তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল নীরা অজ্ঞান হয়ে যাবে।তলিয়ে যাবে কোনো নাম না জানা অতলে।ইরার কথা শুনে হাঁটু ভেঙে পরে যায় নীরা।বিয়ের আসরে বর পালিয়ে গেছে— ছিঃ! কি বিশ্রি একটা বিষয়।নীরা কি ঘৃণ্য কিছু?অস্পর্শনীয় অলক্ষ্মী কিছু? অথবা ভয়ংকরী? ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠে নীরার।সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠে।মনে হয় সারা শরীরে কেউ নোংরা কিছু ছেড়ে দিয়েছে।সারা শরীরে কিলবিল করছে তা।মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে নীরা।ছোট মানুষ ইরা তা দেখে আঁতকে উঠে।নীরাপু কি পাগল হয়ে গেছে? এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছে কেন? অপরিণত ইরা বুঝে উঠে না কি করবে।নীরার কাছে যেতেও সাহস পায় না।বাইরের আওয়াজ তখন দ্বিগুণ হয়েছে।কানে তালা লাগার জোগাড়।সবাই একসাথে চেচাচ্ছে কেন তা বুঝে উঠতে পারে না ইরা।সেই মুহূর্তে যদি তওসিফ ঘরে না আসতো তবে হয়তো নীরার সাথে ইরাও গলা মিলিয়ে কাঁদতো।উদভ্রান্ত তওসিফকে দেখে কলিজায় পানি আসে ইরার।শরীরে থাকা বাহারি জামা দু-হাতে আগলে দৌড়ে যায় ইরা।দুহাতে লতার মতো পেঁচিয়ে ধরে তওসিফকে।ইরা থরথর করে কাঁপছে।মনে হয় যেন এখনি কেঁদে দেবে।ইরা কাঁপা গলায় বলেঃ” মেজ ভাইয়া, নীরাপু পাগল হয়ে গেছে।দেখ কীভাবে কাঁদে।আমার ভয় করছে ভাইয়া।”
স্বচ্ছ স্বীকারোক্তি। তওসিফ বুঝতে পারে এই বিশ্রি ঘটনা ইরার ছোট মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
—” ভয় পাস না, ইরা।তুই না সাহসী মেয়ে।তোহা কি ভয় পেয়েছে?পায় নি। তাহলে তুই কেন ভয় পাবি?কিছু হয়নি।ঘরে বসে থাক। নীরার কিছু হয়নি।”
ইরাকে বুঝিয়ে খাটের উপর বসায় তওসিফ।কোনো রকম বুঝ দিয়েছে ইরাকে।ভাগ্যিস বুদ্ধি করে এখানে এসেছিল। নাহয়,কি হতো আজ? ভাবতে পারে না তওসিফ।এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায় নীরার দিকে।মেয়েটা কিরকম করে কাঁদছে! তওসিফ অবাক হয়ে যায়।সে কখনো নীরাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি।নীরা বরাবর একটা ধৈর্যশীল মেয়ে।তওসিফের রাগ জমে মেহরাবের উপর।মেহরাবের ভাগ্য ভালো সে এখানে নেই।কারণ, আজ যদি এখানে থাকতো তবে সে কয়েকবার নির্মমভাবে খুন হতো।
তওসিফ হাঁটু ভেঙে নীরার সামনে বসে।দু-হাতের আজলায় তুলে নেয় নীরার মুখখানি।ইশ! কি অবস্থা হয়েছে সুন্দর মুখটার।কাজল লেপ্টে গেছে,ঠোঁটের লাল রঙা লিপস্টিক হাতে লেগে গেছে,টিকলিটা ঝুলে আছে চুলের সাথে।চুলের খোপা খুলে গেছে প্রায়।এলোমেলো চুল ঘামে লেপ্টে আছে কপালের দু’দিকে। তওসিফ যত্ন সহকারে চুল গুছিয়ে দেয়,টিকলি খুলে দেয়,নীরার হাতে লেগে থাকা লিপস্টিক নিজের পাঞ্জাবিতে মুছে নেয়।আলতোভাবে বুকে জড়িয়ে নেয় বোনের মাথা।একটা ভরসার স্থান পেয়ে আরো কাঁদে নীরা।শরীরের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দেয় বড় ভাইয়ের বুকে।
—” কাঁদছিস কেন নীরা? কিছু হয়নি।বিয়ে ভেঙেছে ভালো হয়েছে।একটা কাপুরুষ পিশাচের হাত থেকে বেঁচে গেছিস তুই। আমার দিকে তাকা। দেখি, ওঠ।কিচ্ছু হয়নি।আমরা আছি তো।”
মানুষ সান্ত্বনা বা সহানুভূতিতে সবচেয়ে বেশি কাঁদে।নীরা হেচকি তুলে বলেঃ” আমি ভয়াবহ নই, ভাইয়া।ভয়ংকরী নই।অস্পৃশ্য নই।ফেলে যাওয়ার মতো আমি নোংরা নই।তবে কেন ফেলে গেল? আমাকে ভরা মজলিশে তামাশার পাত্র করে কেন ফেলে গেল? বিয়েতে রাজি না থাকলে আগেই আমাকে জানাতো।আমি কি জোর করতাম? তবে?”
তওসিফ বুঝতে পারে এরকম বিশ্রি প্রত্যাখানটুকু নীরাকে ভয়াবহভাবে আঘাত করেছে।নীরার আত্মসম্মানের ভীতে আঘাত করেছে। নীরার বয়সটাও তো আবেগী বয়স।এতো বড় ধাক্কা সামলাতে পারেনি।তওসিফ সযত্নে নীরার চোখের পানি মুছে দেয়।
—” কাঁদিস না।ওই মেহরাব তোর যোগ্য নয়।তুই কেন কাঁদবি?যে আজ তোকে অকারণে ফেলে পালিয়ে গেছে, সে কালকেও পালাতে পারতো।তুই বরং বেঁচে গেলি নীরা।তুই কোনো তামাশার পাত্রী হসনি।আমরা সবাই জানি তুই কেমন।তবে পাগলের মতো কাঁদছিস কেন।চোখ মুছ, উঠ।শাড়ি, গয়না খুলে ঘরের কোনো জামা পর।ইশ! দেখি ওঠ। ঘামে ভিজে গেছে শরীর।ওঠ, ওঠ।চাইলে গোসল কর।যা।”
কাশেম খান জীবনে এতোটা অপদস্ত কখনো হননি।তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।তার ছেলে এতোটা জঘন্য! একটাবার মেয়েটার কথা ভাবলো না! অবশ্য সব দোষ ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেও পারেন না।দিতে পারলে তিনি বেঁচে যেতেন।ছেলের এই কাপুরষতার পেছনে কী তার কোনো অবদান নেই? ভাবতে পারেন না তিনি। আত্মগ্লানিতে ডুকরে মরে যেচে ইচ্ছে করছে।
কামরুল সাহেব অনেক অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন সেই রাতে।সবাই আশঙ্কা করেছিল, হয়তো হার্ট অ্যাটাক হবে তার।ভয়ে জয়নব বেগমের দম ফুরিয়ে আসে।মুখে ফেনা তুলে ফেলেন আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে।” হে দয়াময়,এই যাত্রায় বাঁচায়া দেও।”এই প্রার্থনা করে ভেঙে পরা মেয়েকে রেখে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে ছুটে গেছেন বড় বাজারের হাসপাতালে।সারাটা রাত হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তার সাথে ছিল তার ছোট দেবর মাসুম।
সেই একটা রাতে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে পরিবারের উপর দিয়ে।সবাই পৃথিবীতেই নরকসম ভয়াবহ যন্ত্রণা দেখেছে।প্রথম কয়েকদিন পুরোপুরি ভেঙে পরেছিল নীরা।সারাদিন নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছে।কারো সাথে কথা বলে নি,হাসেনি।তবে এরকম বেশিদিন চলতে দেয়নি পরিবারের লোক।তারা এই মানসিক যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে পুরোদমে।জয়নব বেগম মেয়ের আশেপাশে ছিলেন সবসময়।শাহানা বেগম চুল বেঁধে দিয়েছেন,রুমা অকারণে এসে গল্প করেছে।ইশরাক,তওসিফ বোনকে সময় দিয়েছে।আর কুসুম তো ছিলই।নীরার সর্বক্ষণের সাথী।তাই বেশিদিন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে নি নীরা।তবে নীরা যখন একা থাকতো, তখন প্রায়ই চিন্তা করত। কেন পালিয়ে গেল মেহরাব? এর উত্তরও পেয়ে গেল কয়েকদিন পর।
বিয়ে ভাঙার প্রায় একমাস পর, এক বিকালে নীরা একা একা এদিক ওদিক ঘুরছিল।এমন সময় সে দেখতে পায় পিয়ন আসছে তাদের বাড়ির দিকে।খুব অবাক হয় নীরা। পিয়নের কি দরকার তাদের বাড়িতে।নীরার সামনে এসে থামে লোকটি।
—” এইটা মাছ ব্যাপারীদের বাড়ি?”
—” জ্বি। কেন?”
—” এই বাড়ির নামে চিঠি আছে।”
—” কার নামে?”
—” নীরা সুলতানা। ”
নিজের নাম শুনে খুব অবাক হয় নীরা।তাকে কে চিঠি পাঠাবে? অবাকের রেশ কাটিয়ে উঠে পিয়নের কথা শুনে।
—” এই যে চিঠি। চিঠিটা নেও আর এইখানে সাইন করো।”
নীরা সাইন করে পিয়নকে বিদায় দেয়।অনেক ভেবে চিন্তে চিঠি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে মেলে ধরে সেই চিঠি।
নীরা
আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলে।তুমি সোজা বাংলায় আমাকে কাপুরুষ বলতে পারো।আমি এটারই যোগ্য।আমি এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ মেলাতে পারি না।লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে।আমি বিয়ের কথা শোনার পরেই বাবাকে বলেছিলাম, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।বাবা আমার কথা মেনে নেয় নি।আমি প্রায়ই তোমাদের বাড়ির আশেপাশে থাকতাম বলে সবাই ধরেই নিয়েছিল আমি তোমাকে পছন্দ করতাম।কিন্তু কথায় আছে না, চোখের দেখায়ও অনেক সময় ভুল থাকে।সেই ঘটনাই ঘটেছে আমাদের সাথে।আমি তোমাদের বাড়িতে উঁকি দিতাম কুসুমকে দেখার জন্য।অবাক হয়েছ? অবাক হওয়ার কিছু নেই,এটাই সত্য।
আমি কুসুমকে প্রথম দেখেছিলাম দু বছর আগে।ভার্সিটি বন্ধ থাকায় গ্রামে এসেছিলাম।এক বিকালে আপার সাথে দেখা করতে ওদের বাড়িতে গিয়েছি,সেখানেই দেখা কুসুমের সাথে।আপার সাথে কথা বলে বসার ঘরে বসেছিলাম।কিছুক্ষণ পর কানে আসে একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর ও প্রানখোলা হাসির শব্দ।আমি একটু অবাক হই।আমাদের নূরজাহান এভাবে শব্দ করে হাসে না।তাই জানালা দিয়ে উঁকি দেই বাইরের দিকে।তখনই চোখ পরে সেই ভয়ংকরীর দিকে।না চাইতেও চোখ আটকে যায়।অনেক সুন্দর করে হাসে মেয়েটা, তাই না? আমি প্রথম দর্শনের প্রেমে বিশ্বাস করি না।প্রথম দর্শনে কী আবার প্রেমে পড়া যায় নাকি?আমার সমস্ত অবিশ্বাস উবে গেল তোমার ছোট বোনকে দেখার পর।আমি সেই ভয়াবহ হাসির প্রেমে পরে গেলাম প্রথম দর্শনেই।সেই আমার কাল হলো।নূরজাহানের মাধ্যমে পরিচিত হলাম তার সাথে।সেই দুষ্টু মেয়ে প্রথমেই আমাকে কী ডাকলো জানো? মামা।ভাবা যায় এগুলো।তার কিছুদিন পর ঢাকায় চলে এলাম।ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিজের জীবনে।আমি কিন্তু তাকে ভুলতে পারি নি।প্রায় দুবছর পর আবার কুসুমের সাথে আমার দেখা হলো।আটমাস আগের কথা।আমি একদিন তোমাদের বাড়ির ওদিকে গিয়েছিলাম বিকাল দেখতে।বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই চোখ আটকে যায় আমার ভয়ংকরীর দিকে।মেয়েটা বড় হয়েছে বেশ।কবরস্থানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একটা শিমুল তুলার গাছের দিকে।আর আমি? আমি চেয়ে ছিলাম শেষ বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ষোরশীর দিকে।সেই থেকে এ যেন আমার অভ্যাস হয়ে গেল।প্রতিদিন তাকে একবার দেখতেই হবে।তাই তোমাদের বাড়ির আশেপাশে আমি প্রায়ই থাকতাম।
তোমার সাথে সবচেয়ে বড় অন্যায় আমি করেছি।ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা নেই,তবুও চাইছি।আমাকে ক্ষমা কর নীরা।কুসুমকে পছন্দ করার বিষয়টি বাবা মেনে নেয় নি।প্রথমত, সে আমার থেকে খুব ছোট।প্রায় নয় বছরের।দ্বিতীয়ত,বাবার চোখে কুসুম শ্যামলা।তোমার মতো সুন্দর নয়।আমি এই কথা শোনার অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাবার দিকে।বাবা কি কখনো কুসুমের হাসি দেখেনি?
আমাকে ক্ষমা কর নীরা। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝবে, আমি তোমাকে নয় কুসুমকে পছন্দ করি।মনে আছে, কয়েকমাস আগের সেই বিকালের কথা? আমি তোমার কাছে পানি চেয়ে খেয়েছিলাম।আমি সেদিন মূলত কুসুমকে দেখতে গিয়েছিলাম।অনেকদিন দেখা হয়নি তাই।আমাকে ক্ষমা কর নীরা।দয়া করে ক্ষমা কর।
ইতি
মেহরাব।
নীরা চিঠিটা পড়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল
এই ছিল তবে আসল ঘটনা! নীরা এই চিঠিটা কুসুমকে দেখায়নি।এটা দেখলে কুসুম নিজেকে অপরাধী মনে করবে।নীরা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢিল মেরে চিঠিটা ছুঁড়ে দেয় পানিতে।এখান থেকেই মেহরাবের ঘটনা শুরু হয়েছিল,এখানেই শেষ হোক।নীরার আর কারো প্রতি অভিযোগ নেই, অভিমান নেই।জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই।তাই বলে জীবন থেমে থাকে না।নীরা বিশ্বাস করে, উত্থান- পতন মানেই জীবনের সমাপ্তি নয়।
চলবে…
# বর্ষা দুপুর (পর্বঃ১২)
# হালিমা রহমান
আকাশে খরখরা সূর্য উঠেছে। সূর্যের তাপ দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে।কচুপাতায় জমে থাকা পানিগুলো সূর্যের আলোতে চকচক করছে।মনে হয় যেন মু্ক্তোদানা।কে বলে শুধু শিশির কণাই মুক্তোর মতো ঝলমল করে?কচুপাতায় জমে থাকা পানির বিন্দুও সূর্যের আলোয় দ্যুতি ছড়ায়।
নীরার আজ খুব মন খারাপ।একদম চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ।নীরা ইদানিং লক্ষ করে, সবাই ওর সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে।একটু-আকটু নয়, অনেকটা ভালো ব্যবহারই করে।জয়নব বেগম আগের মতো খিটখিট করে না।সাহানা বেগম আগের মতো ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা শুনায় না।ইরা মুখে মুখে কথা বলে না।নীরা যা বলে তাই মাথা নিচু করে শুনে।কামরুল সাহেবের কাছে আবদার করলে নিষেধ করে না।অন্যায় আবদার হলেও না।এগুলো প্রথম প্রথম চোখে লাগতো না নীরার।কিন্তু এখন লাগে।এইসব অসামঞ্জস্য আচরণ খুব চোখে পরে।নীরা তলিয়ে দেখলো।তারা এ ধরনের আচরণ করে নীরার বিয়ে ভাঙার পর থেকে।তখন থেকেই নীরার মন খারাপ।তার মানে কী,নীরাকে পরিবারের মানুষেরাও করুণার পাত্র হিসেবে দেখছে?তারা কী এই ঘটনাকে নীরার দূর্বলতা ভাবছে?তাই আগের মতো আচরণ করছে না?হ্যাঁ, ঘটনা এটাই।এসব ভেবেই নীরার মন খারাপ।এগুলো ছাড়াও আরেকটা কান্ড হয়েছে একটু আগে।বৃষ্টি দেখলেই নীরাদের বাড়িতে খিচুড়ি চাপানো হয়।আজো তাই হয়েছে।বেশি করে মুগের ডাল দিয়ে জয়নব বেগম খিচুড়ি বসিয়েছেন।এর সাথে বানাবেন হরেক রকম ভর্তা ও মাছ ভাজা।নীরা দেখলো রুমা বেশ কয়েক পদের ভর্তা বানানোর প্রস্তুতি নিয়েছে কিন্তু টুনির জন্য পারছে না।ভর্তা বানানোর ভার সবসময় রুমার উপরেই পরব।জয়নব বেগম ও সাহানা বেগমের কোমরে সমস্যা।তাই তারা একটানা বসে ভর্তা বানাতে পারে না।তাছাড়া, রুমার হাতের ভর্তা খুব মজা হয়।কিন্তু,আজকে টুনি খুব সমস্যা করছে।টুনিটার বোধহয় শরীর খারাপ।তাই শুধু শুধু মায়ের আঁচল ধরে কখন থেকে খ্যানখ্যান করছে।রুমা বিরক্ত হয়ে পিঠের মধ্যে দিল দুটো কিল।টুনি কাঁদতে কাঁদতে নীরার ওড়নার আঁচলের নিচে লুকালো।
—” আহ,কাকি কী করছো?ওকে মারছো কেন?বেচারির হয়তো শরীর খারাপ।”
—” শরীর খারাপ হইলেই এরকম হাতের নিচে ঘুরতে হইব? ওয় দেখে না ওর মায় কাম করে না?”
—” ও কি বুঝে? দেখি সর, আমি করছি।আমি আজকে ভর্তা বানাই, ওরে তুমি ঘরে নিয়ে যাও।দেখ কী হইছে ওর।”
—” তুমি পারবা না। অনেক পদ,অনেক সময় লাগব।”
—” আরে, পারব।যাও তুমি।”
রুমা কিছুতেই দেবে না।কিন্তু যখন দেখলো নীরা অনেক জোরাজোরি করছে তখন রাজি হলো।টুনিকে নিয়ে পা বাড়ালো ঘরের দিকে।দেখা যাক, মেয়েটার কি হয়েছে।নীরা শিলনোড়া নিয়ে রান্নাঘরের সিড়ির কাছে বসলো।রান্নাঘরের সামনে নারিকেল গাছ কেটে দু-ভাগ করে দেওয়া।এগুলো সিড়ির কাজ করে।কাজে হাত দিল নীরা।কিন্তু আধঘন্টা যাওয়ার পর হাপিয়ে উঠলো সে।আহ! এতো কষ্ট কেন?হাত দুটো একেবারে ব্যাথায় টনটন করছে।নীরা বুঝতে পারেনি এতো কষ্ট হবে।অনভ্যস্ত নীরা অসহায় চোখে বাটির দিকে তাকালো।এখনো প্রায় চার পদের ভর্তা বানানো বাকি।নীরার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।কি দরকার ছিল খাল কেটে কুমির আনার!
—” এই নীরা,কী করছ?”
নিজের নাম শুনে সামনে তাকালো নীরা।তাদের পিচ্ছিল উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাড়ির সুমনা খালা।নীরাদের প্রতিবেশী তিনি।বয়সে বোধহয় সাহানা বেগমের সমান।
—” ভর্তা বানাই, খালা।”
—” কীয়ের কীয়ের ভর্তা?”
—” শুটকির,ডালের,কচুপাতার,কাঠাল বিচির, কালোজিরা আর শুকনা মরিচের।”
সুমনা বেগম সাবধানী পায়ে সিড়ি বেয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় বসলেন।নীরার বানিয়ে রাখা শুটকি ও কালোজিরার ভর্তায় আঙুল চালিয়ে মুখে চেখে নিলেন।নীরার বিশ্রি লাগলো ব্যাপারটা।সুমনা খালার হাতটা কি ধোয়া?
—” ভালোই বানাইছোছ নীরা।তোর মায় কই?”
—” রান্নাঘরে।”
সুমনা বেগম চারপাশে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নীরার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললেনঃ” জানোস,কালকে কমলার লগে দেখা হইছে বাজারে।”
—” কমলা কে?”
—” আরে, কমলারে চিনোছ না? চেয়ারম্যানের বউ।ওই হারামজাদা মেহরাবের মা।”
নীরার মনে পড়লো কমলা বানুর কথা।তার না হওয়া শ্বাশুড়ি। না হওয়া শ্বাশুড়ি!কথাটা খুব ভালো লাগলো নীরার কাছে।মনে মনে হাসলো নীরা।কি রকম একটা কথা!
—” বুঝছোস, কালকে দেখা হওয়ার পরে আমার লগে আগায়া আইসা কথা বলা শুরু করছে।আমি আবার আগ বাড়ায়া কথা কই নাই।আগের থেকা শুকায়া গেসে কমলা। শুনলাম, তার ছেলে নাকি এই কয়েকমাস ধইরা আসে না।অবশ্য,আইবই কোন মুখে? তোর লগে যেই অন্যায় করছে,সেই অন্যায়ের আবার মাফ আছে নাকি? ওরা তো এহনো ওইরকম পোলারে ত্যাজ্য করে নাই।তোর খালু হইলে এতোদিনে কবে ত্যাজ্য কইরা দিত।এরম পোলা পেটে ধরাও পাপ।”
নীরা কিছু বলল না।কিইবা বলা যায় এখানে? তবে বুঝতে পারলো এরপর সুমনা বেগম কী বলবে।
—” কথার মাঝে আবার আমারে জিগায় তোর কথা। তুই কেমন আছোস,কোনো বিয়ার ঘর আসে নাকি– এইসব।আমিও এক্কেরে কতগুলি কথা শুনায়া দিছি।মাইয়ার কপালে কলঙ্ক লাগায়া এহন আবার ভালো-মন্দ জিগাও! কেন? কি দরকার তোগো এত? আমগো সোনার মতো মাইয়ার কপালে এই বয়সেই কেমন একটা দাগ লাগায়া দিসে! তোর কি আর ভালো ঘর থেকা সম্বন্ধ আইব?পোলার বাড়ির মানুষজন যহন শুনবো বিয়ার দিন বিয়ার আসরে রাইখা জামাই পালায়া গেসে, তহনি তো উল্টা দিকে হাঁটা ধরব।হেরা কী আর ভালো-মন্দ খোঁজ-খবর নিব?মনে করব মাইয়ার দোষ, তাই পোলায় পলাইছে।আমার তোর লেগা অনেক খারাপ লাগেরে নীরা।কালকেও তোর খালুর লগে আলোচনা করছি কতোক্ষণ……”
নীরার কানে আর কিছু ঢুকলো না।বিয়ে ভাঙার পর থেকেই এসব ভবিষ্যৎ বানী শুনতে হয়।এই কয়েক মাসে এরকম অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েছে নীরার।তারা নীরার ভবিষ্যৎ ভেবে নিজেরাই বুক চাপড়ায়।নীরা ভেবে পায় না তাদের এতো মাথা ঘামাতে হবে কেন।কই, নীরাতো কষ্ট পায় না! বরং নীরা ভুলে থাকতে চায় সেই প্রত্যাখানের সন্ধ্যা। একটা এলোমেলো সন্ধ্যা। তবে পারে না এসব শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য।এরা খুচিয়ে ঘা করে মনে করিয়ে দেয়।সুমনা বেগম কথা বলেই চললেন।কথায় আনলেন হাজারো উদাহরণ। তার কোন আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে ভেঙেছে, কার আর বিয়েই হলো না,কে বরের প্রত্যাখ্যানের পর গলায় দড়ি দিয়েছে….সব এসব কথা।নীরা মনোযোগ দিতে চাইলো না।কিন্তু, তবুও সবসময় মনোযোগ না দিয়ে পারা যায় না।শত হলেও নীরার কিশোরী আবেগী মন।নীরার কাজ প্রায় শেষের দিকে।এমন সময় জয়নব বেগম এলেন সেখানে।
—” নীরা, শেষ তোর?”
নীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।বাড়ির লোকের সামনে এসব শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে বিয়ে নামক জুজুবুড়ির ভয় দেখায় না।তারা মানসিকভাবে আক্রমণ করে নীরা যখন একা থাকে তখন।
—” হ্যাঁ, আম্মা শেষ।”
—” তাইলে হাত ধুইয়া ঘরে যা।ভালোমতো ধুইছ,নাহয় জ্বলবো। ”
জয়নব বেগম পাত্তাও দিলেন না সুমনা বেগমকে।এই মহিলাকে তিনি দেখতে পারেন না।সবসময় বেশি কথা বলে আর মানুষের সংসারে নাক গলায়।এ ধরনের মানুষকে বেশি পাত্তা দিতে নেই।এরা সুযোগ পেলেই মাথায় চড়ে বসে।জয়নব বেগম যদি জানতেন তিনি এখানে,তবে আরো আগে আসতেন।মেয়েটার মাথায় কী কী ঢুকিয়ে দিয়েছে আল্লাহ মালুম।
নীরা উঠে যাওয়ার পিছন দিয়ে সুমনা বেগমও উঠে গেলেন।নীরার মনটা খারাপ তখন থেকেই।তাকে কি সবসময়ই এমনসব কথা শুনতে হবে? কত ভালো লাগে এসব কথা?যারা এসব কথা বলে তাদেরকে ঘাড় ধরে কবিগুরুর অপরিচিতা গল্পটা পড়াতে ইচ্ছে করে নীরার।পড়ানোর পর গলা টিপে ধরে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেঃ” কল্যানীর বিয়েও তো ভেঙে গেছে।ওর জীবন কি নষ্ট হয়ে গেছে? আমার বিষয়ে এতো কথা বলতে হবে কেন আপনাদের?আমার পরিবারের মানুষ কি মরে গেছে?”এরকম দু-তিনটে কঠিন কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করে নীরার।তবে, পারে না।নীরা তথাকথিত ভদ্র মেয়ে।এরা প্রতিবাদ করতে জানে না।দিনভরে শুধু শুনতেই জানে।গলায় ছুরি ধরলেও এরা কিছু বলে না।ইশ! যদি বেয়াদবের তকমা লাগিয়ে দেয় গায়ে।
***
দুপুরে খাওয়ার পর নীরার ঘরে বসে সবাই লুডু খেলছিল।সবাই বলতে তওসিফ, কুসুম,ইরা, তোহা ও নীরা।ইরা খেলছে না শুধু দেখছে।ভাত খাওয়ার পর ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেলেও ঘুম আসেনি কারো।বাইরে অত্যধিক গরম।টিনের চাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে সূর্যের তাপ ঘরে ঢুকছে।তাই কেউ ঘুমাতে পারেনি।পরে তওসিফের বুদ্ধিতেই লুডুর আসর বসেছে।খেলা প্রায় জমে এসেছে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ইশরাক।ধপ করে বসে পরে তওসিফের পাশে।
—” তওসিফ তোর ফোন দিয়ে রিমার ফোনে একটা কল দে তো।”
—” কেন কী হইছে?”
—” আরে আমি ফোন দিলাম, শুধু বন্ধ বলছে।ওকে না পেয়ে আমার ভায়রার ফোনে কল দিলাম কতদূর আছে তা জানার জন্য।ওই ব্যাটা কি বলে শুনবি? বলে কি না ও নাকি রিমার সাথে বাসে উঠে নাই।”
তওসিফ ফোন কানে ধরেই বললঃ” উঠে নাই মানে? ভাবিরে একা পাঠায় দিসে?”
—” না,একা না। কোন ছেলে নাকি পরিচিত আছে, ওই ছেলের সাথে বাসে পাঠায় দিসে।”
তওসিফ কল দিয়েও রিমার ফোন বন্ধ পেল।সে চিন্তিত স্বরে বললঃ”ভাবির বোন জামাই কি গাধা নাকি? এতো দূরের রাস্তা, কীভাবে অন্য একটা ছেলের সাথে পাঠায়? তার কী হইছে?সে আসবে না কেন?”
—” সেই হারামজাদার নাকি ডায়রিয়া হয়েছে।তাই আসতে পারে নাই।তুই না আসতে পারলে আমারে ফোন দিয়ে বলবি না?।কালকে থেকে আবার লক ডাউন শুরু।উফ! চিন্তায় আমার মাথা নষ্ট।”
ইশরাককে খুব অসহায় দেখালো।তাকে সামাল দেওয়ার জন্যই কুসুম বললঃ” চিন্তা করো না,ভাইয়া।ভাবি চলে আসবে,ইনশাআল্লাহ। ”
—” চিন্তা না করে কি পারা যায়? আজকাল মেয়েরা ঘরেও নিরাপদ না সেখানে রিমা কতদূরে! তাও আবার একা।সাথে একটা অপরিচিত ছেলে। ঢাকা যেয়ে ওর বোনের স্বামীর নাকটা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।শালা ভাত খেয়ে বড় হয়নি, বাতাস খেয়ে বড় হয়েছে।বেয়াক্কেল।”
উঠে গেল ইশরাক।সবারই খুব চিন্তা হচ্ছে।এর মাঝে আবার রিমার ফোনটাও বন্ধ।লুডুর আসর ভেঙে গেল।কেউ মনোযোগ দিতে পারছে না খেলায়।তওসিফ চলে গেল,ইরা-তোহা উঠে গেল,কুসুমও পিছন দিয়ে বেড়িয়ে গেল।সে এখন কবরস্থানে যাবে।সবাই ঘুমিয়ে আছে।এখনই সময়।একা ঘরে নীরা আর কী করবে? দরজা আধ ভিজিয়ে বিছানায় শুতে গেল।কোনো কাজ নেই হাতে।রিমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।নীরা আবার কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়।আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।দুচোখে ঘুম জড়িয়ে এলো দ্রতই।
নীরার ঘুমটা সবে গাঢ় হয়েছে।এমন সময় ধপধপ করে ঘরে ঢুকলো কুসুম।দৌড়ে গেল নীরার দিকে।
—” নীরাপু, নীরাপু উঠো।ভাবি আসছে।এই নীরাপু,নীরাপু।”
ঘুম অনেকটাই কেটে গেল নীরার। উঠে বসে গায়ে ওড়না জরিয়ে বললঃ” কখন আসলো।”
—” বাড়িতে ঢুকে নাই এখনো।বড় রাস্তায়। আমি কবরস্থানে দাঁড়িয়ে দেখলাম।”
নীরা ও কুসুম বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল।ইশরাক আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।রিমা বাড়িতে ঢুকতেই ছুটে গেল নীরা-কুসুম।জড়িয়ে ধরলো রিমাকে।
—” কি খবর তোমার ভাবি?”
কুসুমের প্রশ্নে মুচকি হাসলো রিমা।
—” ভালোই।তোমরা কেমন আছো?”
—” আমাদের কথা পরে হবে।আগে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যা।আরেকবার যদি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার চিন্তা করেছিস,মেরে তোর পা ভেঙে দেব।ইশরাক ভাই একেবারে পাগল হয়ে গেছে এই কয়দিনে।”
রিমা আড়চোখে তাকালো ইশরাকের দিকে।মুখে তার এক আকাশ মেঘ জমে আছে।ইশরাক এতোক্ষণে মুখ খুললো।
—” ব্যাগ কই তোমার? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
রিমা মাথা নেড়ে বললঃ” ব্যাগ রেদোয়ান ভাইয়ের কাছে।উনি নিয়ে আসতেছে।ভারী ব্যাগ আমাকে এক মূহুর্তের জন্য বইতে দেননি।”
রিমার কথা শেষ হতেই রেদোয়ান বাড়ি ঢুকলো।পিঠে তার মস্ত ব্যাগ,হাতে রিমার ব্যাগ।রেদোয়ানকে দেখে নীরা- ইশরাক অবাক হলেও কুসুম খুব খুশি হলো।রেদোয়ান ক্লান্ত শরীরে জড়িয়ে ধরলো ইশরাককে।বিনিময়ে ইশরাকও জড়িয়ে ধরলো।
—” কেমন আছেন ইশরাক ভাই? আপনার বিবিকে পুরো রাস্তা পাহারা দিয়ে নিয়ে আসলাম।পথে বোধহয় তার কোনো সমস্যা হয়নি।”
নীরা আড়চোখে তাকালো রেদোয়ানের দিকে।কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে।নীরা তাকিয়ে দেখলো, রেদোয়ানও তার দিকে চেয়ে আছে।নীরা সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো।সবসময়ের মতো এবারেও নীরা বুঝলো না রেদোয়ানের চোখের গভীরতা।মোটা ফ্রেমের চশমায় ঢেকে রাখা চোখদুটোর আকুলতা।।
চলবে…