বর্ষা দুপুর (পর্ব-১)
হালিমা রহমান
সময়টা তখন মাঝরাত।হুট করেই খুলে গেল নীরার ঘরের জানলা।অবশ্য হুট করেই নয়।জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বহু কসরত করে ,বহু সময় ব্যয়ে জানালার একটা পাল্লা খুলতে পেরেছে।নীরা তখন বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা।পাশে তার গায়ে হাত- পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তার চাচাতো বোন কুসুম।আপাদমস্তক কালো চাদরে ঢাকা মানুষটি একবার হাত বাড়িয়ে, নীরার চুলগুলো ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। একদম শান্ত,কোমল একটা স্পর্শ। তবে দিলো না।অভাবনীয় ইচ্ছেগুলোকে জোরেসোরে ধমক দিয়ে গিলে নিলো।বলিষ্ঠ হাতগুলো চাদরের ভিতর ঢুকিয়ে, সেখান থেকে বের করলো চারভাজ করা ফকফকে সাদা রঙা একটা কাগজ।ঢিল মেরে ছুড়ে দিলো নীরার বিছানার উদ্দেশ্যে।বিছানায় পরলো না কাগজ।জায়গা করে নিলো নীরার পড়ার টেবিলে। ব্যক্তিটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট। জানালার পাল্লাটা আলতোহাতে টেনে দিয়ে আড়াল হয়ে গেল সারি সারি বাঁশগাছের আড়ালে।
***
বর্ষার একটি সুন্দর সকাল।আশেপাশে ভিজে মাটির গন্ধ।টুপটুপ করে ঝরছে পাতাছোয়া জল।শেষরাতে একচোট বৃষ্টি হয়েছে।তার দরুন মাটিভেজা,গাছভেজা এমনকি কাঠের দরজার সামনে বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে রাখা কুসুমের তোতাপাখির খাঁচাটা পর্যন্ত আধভেজা।বৃষ্টির দিনে আলসেমিরা ঘিরে ধরে।বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেই করে না।নীরার এখন সেই দশা।ফজরের সময় একবার নামাজের জন্য ডেকে গেছে তার মা।কুসুম উঠে গেছে তখনি।শুধু নীরাই পরে আছে বিছানায়।ঘুমায়নি, ঘুমের ভান ধরে আছে।
নীরার মা, নামাজ শেষ করে হাতে বাঁশের চকচকে কঞ্চি নিয়ে দ্রুতপায়ে নীরার ঘরে ঢুকলো। নীরার ফর্সা পায়ের পাতায় ঠাসঠাস দু- ঘা লাগিয়ে দিলো।লাফিয়ে উঠলো নীরা।অগোছালো চুলগুলো পিঠের পেছনে ফেলে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে।
—” উঠতেসি তো আম্মা।”
—” এতক্ষণ লাগে ক্যান? তুই মুসলমানের বাচ্চা না? নামাজের সময় কী তোর জন্য বইসা থাকে?”
দ্রুত পায়ে খাট থেকে নিচে নামে নীরা।এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাওয়ার আগেই আবারো পেছন থেকে ডাক দেয় তার মা।
—” ওড়না নেস না যে? মাইয়া মানুষ ঘুমের মাঝেও ওড়না রাখে শরীরে।আর তুই?”
ওড়না মাথায় জড়িয়ে প্রায় দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নীরা।এখানে থাকলে মা আরো ভুল ধরবে।
ফজরের নামাজের পর ঘুমানোর কোনো নিয়ম নেই নীরাদের বাড়িতে।বাবা- কাকারা সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তাই, সকাল সাতটার মাঝেই এবাড়িতে সকালের নাস্তা তৈরি হতেই হবে।সুসময় – দুঃসময় যাই হোক না কেন।অবশ্য,নীরা নিজেই ঘুমায় না।ঘুমাবে কী করে?মা – চাচিরা কাজ করার সময় মুখটাকে একটু বন্ধ করে রাখতে পারে না।চিৎকার- চেঁচামেচি করতেই হবে।একটা বাড়িতে কতগুলো মানুষ থাকে।সবাই একটা করে শব্দ বললেই অনেকগুলো কথা হয়।নীরাদের যৌথ পরিবার। নীরার বাবারা চার ভাই।চার ভাই এখনো একসাথেই আছে।চারজনে একসাথে ব্যবসা করছে।বেশ মিল তাদের মাঝে।তাই ঘরের বৌদের মাঝে হিংসা থাকলেও ভাতের হাঁড়ি আজো আলাদা হয়নি।
নীরা নামাজ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো।আশপাশটা ঘুরে দেখবে একটু।কুসুমকে পেল না হাতের কাছে।প্রতিদিন দুজন একসাথেই বের হয়।আজ কুসুমকে না পেয়ে সাবধানী পায়ে একাই বের হলো।স্যাতস্যাতে মাটি,জায়গায় জায়গায় কাদা।নীরা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বাঁশের সাথে ঝুলানো আধভেজা তোতাপাখির খাঁচা নামিয়ে রাখলো।বেচারা তোতাপাখি!চোখ বন্ধ করে কাপাকাপি করছে।নীরা খাঁচা নামিয়ে রাখতেই চোখ মেলে তাকালো তোতাপাখি।নীরা মৃদু হেসে বলল,
—” শুভ সকাল,পিটুশ।কুসুম তোমাকে নামিয়ে রাখে নি কেন? তুমি একদম ভিজে গেছ।কুসুম পচা,তাইনা? বলো, কুসুম পচা,কুউউসুম পওওচা।”
তোতাপাখি কি বুঝলো কে জানে! হুট করেই রিনরিনে গলায় বলে উঠলো,
—” নীরাপু অটোপাশ।”
চমকে উঠলো নীরা।কে শেখালো একে? নীরা কিছু বলার আগে আবারো পিটুশ বার দুয়েক ” নীরাপু অটোপাশ,নীরাপু অটোপাশ ” বলে জপ করলো।নীরা পিটুশকে একপ্রকার ছুড়ে ফেললো ঘরের ভেতর।
“বেয়াদব তোতাপাখি।পড়ালেখা বুঝিস তুই? আবার অটোপাশ অটোপাশ করছে।বেশি বেশি ফাজিল।”
নীরা ওড়নার আঁচল আঙুলে জড়িয়ে হাটা দিলো পশ্চিমের পুকুর পাড়ের দিকে।এতো সকালে ওইদিকে থাকে না কেউ।নীরা পুকুরের কাছে যেয়ে দেখলো পাড়ে বসে দাঁত মাজছে ইশরাক।সম্পর্কে সে তার চাচাতো ভাই।বংশের সবচেয়ে বড় ছেলে।কুসুম ও ইশরাক দুই ভাই- বোন।ইশরাক নীরাকে দেখে মৃদু হাসলো।মুখ ধুয়ে বললঃ” আজ তোর সাথী কই রে?”
—” কি যানি কই গেছে কুসুম।সকাল থেকে দেখিনি।”
—” এদিকে যাস না।জোক অনেক।”
—” আচ্ছা।”
নীরা ফিরে যাওয়ার আগে আবারো পিছু ডাকলো ইশরাক।
—“রাতে ঘুমানোর আগে ভালোভাবে দরজা, জানালা লাগিয়ে ঘুমাবি নীরা।আর মেজ কাকা’কে বলবি নতুন খাট বানিয়ে দিতে।খাট – জানালা দুটোই নিচু।জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়েই তোদের গলা টিপে ধরা যায়।বুঝলি কী বললাম?”
ইশরাক আর দাঁড়ালো না।নীরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ইশরাকের দিকে।জানালা তো নীরা আঁটকেই ঘুমায়।আর ইশরাক ভাই কী করে জানলো জানালা ও খাটের খবর।নীরার জানালার পিছনে অনেক বাঁশগাছ।সচরাচর সেখানে কেউ যায় না।ইশরাকের তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।সে সকালে দোকানে চলে যায়, আসে রাতে।তাছাড়া, নীরা ও কুসুম বড় হওয়ার পর থেকে ইশরাক অনুমতি ছাড়া কখনোই ওদের ঘরে ঢুকে না। তাহলে??
***
গোসল করে সবে বসেছে নীরা।দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে।চুল থেকে গামছা খুলে দড়ির সাথে মেলে দিলো।কোথা থেকে দৌঁড়ে এলো কুসুম।হাতে খাতা কলম।
—” নীরাপু ফিন্যান্সের একটা অংক মিলতেসে না।একটু মিলিয়ে দেও না।”
—” অন্যকারো কাছে যা। আমিতো অটোপাশ।তুই তো জানিস আমি কিছুই পারি না।”
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো কুসুম।পিটুশকে কথাটা শেখানো উচিত হয়নি।
—” আর হবে না নীরাপু।স্যরি। ”
হুট করেই তেড়ে এলো নীরা।
–” সবাইকে শিখিয়ে এখন আমায় স্যরি বলো তাই না? পারবো না আমি। যা এখান থেকে?”
কুসুম অসহায় চোখে অনুনয়ের সুরে বললঃ দেও না নীরাপু,প্লিজ।অংকটা না করতে পারলে রেদু ভাইয়া আজ আমায় একশবার কান ধরাবে।চিন্তা করতে পারো তুমি? মান- ইজ্জত সবশেষ।”
শেষ কথাটায় গলে গেল নীরা।মনে পরলো,শেষবার নীরা যখন পড়া পারেনি, তখন তাকেও একই শাস্তি দিয়েছিল রেদোয়ান।কুসুম বাঁচিয়েছিল নীরাকে।
—“আর বলবি আমাকে অটোপাশ? সরকার এখনো আমাদের ব্যাচরে অটোপাশ দেয় নাই, গাধা।”
—“আর কখনো বলব না,কসম।”
—” যা টেবিলের থেকে ক্যালকুলেটর নিয়ে আয়।”
কুসুম খুশিমনে ক্যালকুলেটর খুঁজতে গেল।পেয়েও গেল এক সেকেন্ডে।আরো একটা জিনিস পেল সাথে একটা ফকফকে সাদা কাগজ।কুসুম কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখলো কয়েকটা লাইন লেখা তাতে।চার – পাঁচটা হবে বোধহয়।
—” কীরে কুসুম এতোক্ষণ লাগে?”
কুসুম কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললঃ ” এটা পেলাম আমি তোমার টেবিলে।”
—” দেখি কি এটা।”
নীরা কাগজটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলো।
নীরা,
যখন – তখন বাইরে যাও কেন?খুবই খারাপ অভ্যাস এটা।এখন বর্ষার দিন, পথঘাট পিচ্ছিল।আছার খেয়ে পরলে কেমন হবে তখন? আর যেন কখনো না দেখি।আর পশ্চিমের পুকুর পাড়ে যাবে না।অনেক জোক সেখানে।প্রয়োজনে গেলেও সাথে লবন নিয়ে যাবে।মনে থাকে যেন।
ইতি
তোমার নাম পুরুষ।
পুরো চিঠি জুরেই হুমকি- ধমকি।কুসুম হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো নীরার দিকে।নীরার দৃষ্টি জানালার ওপারে বাঁশগাছের দিকে।কেন যেন কেবল ইশরাকের কথা মনে পড়ছে।।
( চলবে)