বর্ষা দুপুর ( পর্ব-২)

0
1227

বর্ষা দুপুর ( পর্ব-২)
হালিমা রহমান

কুসুম চিঠির কথা শুনে প্রথমেই যা বলল তা হলো,
—” নীরাপু তুমি প্রেম কর? আমারে বললে কী হইতো,আমি কী কারো কাছে বলতাম?খুবই দুঃখ দুঃখ লাগতেসে আমার।”
—” এটাকে তোর প্রেমপত্র মনে হয়?”
নীরার প্রশ্নে কুসুম চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বার দুয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।তিন – চারবারের মতো পড়লো। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে বলল,

—” এখন আর প্রেমপত্র মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে, তোমারে হুমকি দিচ্ছে।লেখাগুলোতে কেমন মারকুটে ভাব, খেয়াল করসো?”
—” হুম।তুই তো সবে আজকে দেখলি।আমি সেই গত দুমাস থেকে দেখছি।”
কুসুম অবাক হয়ে গেল।গত দুমাস!

—” মানে? তুমি গত দুমাস থেকে এমন চিঠি পাও?”
—” হুম।দাড়া, দেখাই তোরে।দরজাটা লাগায় দে।”
কুসুম দরজা লাগিয়ে খাটে যেয়ে বসলো।নীরা তার আলমারি খুলে জামা- কাপরের ভিতর থেকে আরো কতগুলো চিঠি বের করলো।দশ – বারোটা হবে বোধহয়। চিঠিগুলো নিয়ে কুসুমের সামনে বসতেই হাতাহাতি শুরু করলো কুসুম।

—” আহ,আস্তে কুসুম।”
—” কোন চিঠিটা আগে পাইসো?
নীরা কয়েকটা চিঠি খুলে সেখান থেকে একটা কুসুমের হাতে দিলো।চোখ দিয়ে ইশারা করলো পড়ার জন্য।

নীরা

তোমাকে আমি আজ অনেক সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম।ভালো লেগেছে তোমাকে।একটু না, অনেকখানি।তোমার সরলতাটুকু বেশি ভালো লেগেছে।

ইতি
তোমার নাম পুরুষ।

—” ব্যস এতোটুকুই?”
—” হুম।”
কুসুম চিঠিগুলো নড়াচড়া করে আরেকটা হাতে নিলো।বালিশে হেলান দিয়ে নীরাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়া শুরু করলো।

নীরা

তোমার পা অনেক বেড়ে গেছে, তাইনা? এতো বেড়ানোর শখ কেন? করোনার সময় লকডাউন দিয়েছে ঘরে থাকার জন্য।আর তুমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘুরতে চলে গেছ।ফাজিল মেয়ে।আমার মন চাচ্ছে, তোমার পা কেটে আলু দিয়ে রেঁধে খাই।অনেকদিন মানুষের মাংস খাই না।অবশ্য,তুমি তো মানুষ না। তুমি হলে গাধী,একদম জংলী গাধী।নাহয়, এইসময় কেউ খালার বাসায় ঘুরতে যায়?

ইতি
তোমার নাম পুরুষ।

চিঠি পড়ে হা করে রইলো কুসুম।কয়েক সেকেন্ড পর অবাক কন্ঠে বললঃ” নীরাপু,ব্যাটা দেখি ব্যপক ফাজিল।কতোবড় সাহস! তোমারে অপমান করে আবার হুমকিও দেয়।চিন্তা করতে পারো? ”
নীরা চিঠিগুলো তুলে রেখে বললঃ ” লেখাগুলো দেখেছিস কী বাজে।তোর লেখার চাইতেও খারাপ”।
সায় দিলো কুসুম।
—” হুম, অনেক বাজে লেখা।আমি তো ভাবতাম একা আমার লেখাই খারাপ।এখন দেখি না, আমি ভুল ছিলাম।আমার জাতভাই আরো আছে পৃথিবীতে। কিন্তু, তুমি এগুলা মেজমারে দেখাও না কেন? ”
—” তুই পাগল কুসুম? আম্মারে দেখানো মানেই প্রশ্ন কামানের সামনে দাঁড়ানো।হাজারটা প্রশ্ন শুরু করে দিবে আম্মা।তোকে কেন দেয়,কারো সাথে সম্পর্ক আছে নাকি,সম্পর্ক না থাকলে টেবিলের উপর চিঠি আসলো কীভাবে,,ব্লা,ব্লা,ব্লা।”
—” তোমার কথায় যুক্তি আছে নীরাপু।কিন্তু তুমি এগুলো নিজের কাছে কেন রাইখা দিসো?”
—” ওই ব্যাটারে যদি কখনো সামনে পাই, এইগুলা ওর চেহারায় ছুঁড়ে মারব।তাই।”
—” ভালো বুদ্ধি।কিন্তু, ইতি নাম পুরুষ কেন লেখে? ”
—” কী জানি?”

হুট করেই কুসুম হেসে ফেললো। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ছন্দে ছন্দে বলল,
–” আমি,তুমি ছাড়া
ভবে আছে যারা
তাহারাই নাম পুরুষ।
এই পত্র প্রেরককে খঁজতে কী করবে তুমি এখন?”

***
দুপুরের দিকে আবারো শুরু হলো বৃষ্টি। একদম মুষলধারে বৃষ্টি যাকে বলে।নীরা ও কুসুম ঘর থেকে বেড়িয়েছে মাত্র।উদ্দেশ্য খাবারের ঘর।নীরাদের রান্নাঘরের পাশে খাবারের জন্য ছোট একটা ঘর আছে।সেখানেই মাদুর পেতে বাড়ির সবাই একসাথে খায়।অবশ্য,সবাই একসাথে না।বাড়ির পুরুষেরা খেয়ে যাওয়ার পর মেয়েরা একসাথে বসে।ঘরের সামনেই একফালি উঠোন।উঠোনের মাঝে একটা টিউবওয়েল। টিউবওয়েলের চারপাশে পাকা করা।তার থেকে দু- পা এগিয়ে গেলেই রান্নাঘর ও খাবার ঘর।তার পাশেই দুটো টয়লেট,গোসলখানা।উঠোনের উত্তরদিকে আলাদা পাকা করা একটা রুম।এই রুমে থাকে রেদোয়ান।
নীরা ও কুসুম বৃষ্টির জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পেল না।দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে।নীরার পাশ দিয়ে একছুটে বেড়িয়ে গেল ইরা ও তোহা।ইরা; নীরার আপন ছোট বোন ও তোহা তার সেজো কাকার মেয়ে।নীরা চিৎকার করে ডাকলো দুই বোনকে।

—” ইরা,তোহা; বৃষ্টি থামলে বের হওয়া যায় না? জ্বর যদি আসে,তাইলে খবর আছে তোদের।”
যাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা, তারা পাত্তাও দিলো না।একদৌড়ে খাবারের ঘরে পৌঁছে নীরাকে চিৎকার করে বললঃ” আমরা কি তোমাদের মতো ভীতু? জ্বরের ভয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?”
ইরা, তোহা ওদেরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু’বার “ভীতু,ভীতু “জপ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর।

বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে অনেকটাই।নীরা ও কুসুম পা টিপেটিপে ঘর থেকে বের হলো।এমন সময় ওদের সামনে দৌড়ে এলো তওসিফ।তওসিফের সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে আছে।তওসিফ হুট করেই সামনে চলে আসাতে, কুসুম তাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়।পিছন থেকে তাকে আঁকড়ে ধরলো নীরা।কুসুম কপালের সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।রাগে চোখদুটো লাল হয়ে আছে মেয়েটার।

—” এগুলো কেমন ধরনের আচরণ, তওসিফ ভাইয়া?”
অনুশোচনা দেখা গেল না তওসিফের চেহারায়।বরং, দাঁত কেলিয়ে বললঃ” ভয় পাইলি নাকি,কালী? এতো ভীতু কেন তুই?”
এমন এক বিশ্রী সম্বোধনে ফুঁসে উঠলো কুসুম।
—” আমার একটা নাম আছে তওসিফ ভাই।আমার নাম কি আপনার মনে নেই? মস্তিষ্ক কী রাস্তা ঘাটে ফেলে এসেছেন?”
—” আহা,রাগ করস কেন? মেয়েরা মোমের মতো নরম হয়।কালো মেয়েরা আরো বেশি নরম হয়।আশেপাশে খেয়াল কইরা দেখিস।”

কুসুম কিছু বলার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো নীরা।তওসিফকে উদ্দেশ্য করে বললঃ” ওর গায়ের রঙ কালো তা আপনাকে কে বলল? শ্যামলা মেয়েদেরকে কখনো কালো বলে না।আর তাছাড়া কালো যদি হয়েই থাকে, তাতে আপনার সমস্যা কী তওসিফ ভাই? ওর দায়িত্ব তো আর আপনাকে নিতে হচ্ছে না।বড় ভাই, বড় ভাইয়ের মতো থাকেন।নিজের সম্মান নিজে ধরে রাখতে শিখেন।আর কুসুম, তুই কী পাগল? সবার কথায় গুরুত্ব দিয়ে রেগে যেতে হবে কেন? রাগটুকু তুলে রাখ।রাগ জায়গামতো দেখাতে হয়।ভবিষ্যতে কখনো যেন না দেখি সবার কথার গুরুত্ব দিতে।আমাদের চারপাশের সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয় না।কিছু আবর্জনাও হয়।বুঝেছিস?”
কুসুমের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে নিয়ে গেল। পিছনে ফেলে গেল ক্রুদ্ধ তওসিফকে।
তওসিফ তোহার ভাই।নীরার থেকে চার বছরের বড় সে।এই বয়সেই স্বভাব এতোটা জঘন্য হয়েছে, যা বলার বাহিরে।তওসিফের জন্য নীরার সেজোকাকা মানুষের সামনে মাথা তুলে পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে না।তওসিফ কয়েকমাস আগে, ইভটিজিং এর অপরাধে জেলেও গেছে।বহু কষ্টে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে বাড়ির বড়রা।যতই খারাপ হোক, নিজেদেরই তো রক্ত।রক্তের টান খুবই ভয়াবহ।সহজে এড়ানো যায় না একে।তবে,সেই ঘটনার পর থেকে নীরা ও কুসুম এড়িয়ে চলে তওসিফকে।যেই ছেলে বাহিরের মেয়েদেরকে সম্মান করে না, সে কখনো ঘরের মেয়েদেরকেও সম্মান করতে পারে না।এটাই নীরা ও কুসুমের অকাট্য যুক্তি।

***
নীরা খাবার ঘরে যেয়ে দেখলো ইরা ও তোহা এখনো খাওয়া শেষ করেনি।আয়েশ করে ভাত চিবোচ্ছে দু- জনে।সাথে হাজার কথা।কার গরু চুরি হয়েছে,কার পুতুলের বিয়ে দেয়া এখনো বাকি,এইবার মেলা কেন হবে না,ভাইরাসে কীভাবে মানুষ মারা যায়… এসব কথা।নীরা দুটোকে রামধমক দিয়ে এগিয়ে গেল ছোট চাচির দিকে।ছোট চাচিকে নীরার খুব ভালো লাগে।সহজ – সরল একটা মানুষ।অল্পতেই অস্থির হয়ে যায় আবার অল্পতেই খুশি হয়।নীরার ছোট চাচির নাম রুমা।তিনি তার তিন বছরের মেয়েকে ভাত খাওয়াচ্ছেন।নীরা তার চাচির পিছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল টেনে কোমড় ঢেকে দিলো।মুখে বললঃ” শাড়ি সামলাতে না পারলে পর কেন? অন্য কিছুই তো পরা যায়।”
—” তোমার কাকা রাগ করে শাড়ি না পরলে।”
—” হাহ!শরীর তোমার আর পোশাক ঠিক করে দেবে আরেকজন? আশ্চর্য! ”
নীরার কথায় পিছন থেকে ফোড়ন কাটলো তার সেজো কাকি।
—” মাইয়া মানুষের নিজের বলতে কিছু থাকে না, এইটা জানো না নীরা?হেগোরে পানি হওয়া লাগে,যাতে সবকিছুর লগে মিশ্যা যাইতে পারে।এতো বড় বড় বই পড় অথচ এইটি জানো না?
নীরা জবাব দিলো না।চুপ করে রইলো।সেজো চাচি প্রচন্ড মুখরা।সাথে তর্কবাজ।নিজে যা ঠিক মনে করবে তাই করবে।হইচই করতেও ওস্তাদ তিনি।তাই বাড়ির কেউ খুব একটা পাত্তা দেয় না তাকে।এই যে এখনো যে তিনি অনর্গল বাজে বকছেন, তাও নীরা কিছুই বলবে না।
—” বুঝছো রুমা,কী যুগ যে আইলো! আঠারো বছর হওয়ার পরেও মাইয়াগো বিয়া দেয় না।আমাগো সময় পনেরো বছরে বিয়া না দিলেই হইছিলো। গেরামের মাইনশে জুতা মারতো বাপ- মার মুখে।আর কথাও কইতে পারতাম না আমরা।হাহ! এহনকার মাইয়ারা যেই বেদ্দপ।আমরা এতো বেদ্দপ আসিলাম না।আমগো সময়…

—” আপনাদের সময়ে তো মেয়েরা ফিসফিস করে কথা বলতো।অথচ, আপনার কথার আওয়াজে আমি ঘরেই থাকতে পারলাম না।ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না, কাকি?”
নীরা অবাক হয়ে তাকালো দরজার দিকে।এই মুখরা কাকির কথার জবাব দেয়ার কী দরকার ছিল? এখন তো কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবেন তিনি!!

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here