বর্ষা দুপুর ( পর্ব-৬)
হালিমা রহমান
ইশরাকের হাতের মুঠো থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো রিমা।হতভম্ব হয়ে গেলো ইশরাক।অবাক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলোঃ” সমস্যা কী তোমার রিমা?”
—” এইগুলা কেমন আচরণ ভাইয়া? ”
—” ভাইয়া!”
—” আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।এখন আপনি যদি এরকমভাবে হাত ধরেন আর কেউ যদি তা দেখে, তাহলে বুঝতে পারছেন আমার কতবড় বদনাম হবে? আপনি ছেলে আপনার তো কিছুই হবে না।সব সমস্যা আমারই হবে।”
অবাকের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না ইশরাক।রিমার বিয়ে ঠিক! তা কীভাবে সম্ভব?
—” আমাকে জানাও নাই কেন? ছেলে কী করে? বিয়ের তারিখ কি পাকা হইসে?”
—” ছেলে প্রবাসী। দিনক্ষণ এখনো পাকা হয়নি।ছেলের পরিবার নাকি আমাকে দেখসে।পছন্দ হয়েছে তাদের।কালকে ছেলেসহ দেখতে আসবে।আম্মা – আব্বার খুব পছন্দ ছেলে।”
কথাগুলো বলার সময় গলা কেঁপে উঠলো রিমার।কাঁপবে না কেন? প্রথম প্রেমের মায়া ত্যাগের মতো এতোবড় বিসর্জন আর কিছু হয় নাকি?
ইশরাক রেগে যেয়ে পাশে থাকা টেবিলের গায়ে একটা লাথি দিলো।রিমার বাবার ঠিক করা প্রবাসীকে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললঃ” প্লেন না বন্ধ?ওই বেয়াদব দেশে আসলো কীভাবে? ”
—” প্লেন যখন চালু ছিলো তখন আসছে।এখন বিয়ে করবে।”
—” তার মানে এখন বেকার?আর খোঁজখবর নেয়া ছাড়াই তোমার বাবা তোমারে বিয়ে দিয়ে দিবে! আশ্চর্য! ”
রিমা ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ইশরাকের পাশে।মনে মনে ইশরাকের উদ্দেশ্যে বললঃ” না আমার বাবা আমারে বিয়ে কেন দিবে? সে তো আপনার জন্য বসে থাকবে।বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস নেই, আবার বড় বড় কথা।যত্তসব।”
ইশরাক রিমার পাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো।এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে নীরা ও কুসুম হাতে আইসক্রিম নিয়ে এটা – ওটা দেখছে।এই দোকানে তাদের অবাধ রাজত্ব।
ইশরাক কিছুক্ষণ ভেবে বললঃ” আচ্ছা,তুমি যাও বাসায়।আমি দেখি কী করা যায়।”
কিছুক্ষণের মাঝে কুসুম – নীরাও চলে এলো তাদের কাছে।কুসুম রিমাকে প্রশ্ন করলোঃ”যাবে না বাসায়?”
—” হুম চলো। ”
ওরা বেড়িয়ে গেলে পিছন থেকে চিন্তিত চোখে চেয়ে রইলো ইশরাক।বিরাট ঝামেলায় পড়া গেল তো।
ইশরাক ও রিমার সম্পর্কের বয়স এক বছর।রিমা প্রায়ই আসা- যাওয়া করতো নীরাদের বাড়িতে।সবাই পছন্দ করে রিমাকে।তেমনি ইশরাকেরও ভালো লাগতো।শান্ত,সহজ,সরল একটা মেয়ে।তবে ভালোবাসার শুরু এক বছর আগে থেকে।সেদিন ছিল এক বর্ষা দুপুর। বৃষ্টি হচ্ছিল খুব।কোথায় যেন যাচ্ছিল রিমা। পথে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।বৃষ্টির তীব্রতায় হাঁটতে পারছিল না।পথের পাশে থাকা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল।পরনে থাকা বোরকাটাও ভিজে গেছে।ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল ইশরাক। সেদিন ইশরাকই দেখেছিল রিমাকে।হাতে থাকা ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল রিমার দিকে।বলেছিল নীরার কাছে চলে যেতে।নাহয় ভিজা শরীরে ঠান্ডা লেগে যাবে।রিমাও ইশরাকের কথামতো গুঁটি গুঁটি পায়ে ইশরাকের পিছু পিছু চললো নীরাদের বাড়িতে।ভালো লাগার শুরু সেখান থেকেই।আস্তে আস্তে কীভাবে যেন প্রেমটাও হয়ে গেল।ওদের সম্পর্কের সমীকরণ খুব সুন্দর ছিল।সামনা-সামনি দেখা খুব কম হতো।দেখা হলেও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কেবল মুচকি হাসতো।আবার কখনো রিমা তার বাবার ফোন দিয়ে লুকিয়ে কথা বলতো ইশরাকের সাথে।কখনো দশ মিনিট, কখনো পনেরো মিনিট।কোনো অশ্লীলতা ছিলো না দুজনের মাঝে।ইশরাক জানতো কীভাবে রিমাকে সম্মান দিতে হয় আবার রিমাও জানতো তার আচরণের সীমাবদ্ধতা। ইশরাক চাইলেই রিমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারতো।তবে ইচ্ছে করেই পাঠায়নি।এই দোকানটা ইশরাকের একার নয়।দোকানের অংশীদার দুজন।ইশরাক ও তওসিফ।তওসিফ বসে না বলেই ইশরাক একাই বসে এখানে।ইশরাকের ইচ্ছে ও নিজে কিছু একটা করবে তারপর বিয়ে করবে।এখনো তো বউয়ের দেনমোহরের টাকাও জোগাড় করতে পারল না,তবে বিয়ে করবে কীভাবে?ততোদিনে রিমাও একটু বড় হোক।মেয়েটার বয়সতো সবে আঠারো। খুব বেশি বড় তো আর হয়ে যায়নি।এখনি যদি সংসারে জড়িয়ে যায় তবে নিজের জীবনটাকে দেখার তো আর সুযোগই পাবে না।কিন্তু এখনি যে রিমার বাবা এতোটা পাগল হয়ে যাবে,তা কে জানতো!
***
অনেকবার গোসল করার কারণে ঠান্ডা লেগে গেছে নীরার।মাথাটাও ধরেছে তার সাথে।বাড়ি এসে শরীর খারাপ লাগায় ঘুমিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ঘুম থেকে উঠার পরেই বুঝতে পারল ঠান্ডা লেগেছে।জয়নব বেগম এসে দেখে গেছে কয়েকবার।ধমকি- হুমকিও দিয়েছে অবশ্য।মেয়ে মানুষের আবার এতো ঢং কীসের? কয়েক কেজি মাছ কেঁটেই একেবারে চৌদ্দবার গোসল করতে হবে কেন? গন্ধ কী সারাজীবন থেকে যাবে হাতে?
নীরা জবাবে কিছু বলেনি।কেবল মুখ বন্ধ করে মায়ের হাত থেকে ভাত গিলেছে।খেতেও ইচ্ছে করছিল না।গলায় মনে হচ্ছে যেন খরা দেখা দিয়েছে।খালি শুকিয়ে যায়।
জয়নব বেগম পানি খাইয়ে দু চামচ ঠান্ডার সিরাপ খাইয়ে দিলো।নীরার আবার সিরাপ খেতে পারে না।তবুও খেয়ে নিলো।এখন না খেলে মা নিশ্চিত দুটো চর মারবে গালে।
জয়নব বেগম ঘরের বাতি বন্ধ করার আগে নীরাকে আরো একবার হুশিয়ার করে দিলেন।
—” খবরদার তোরে যাতে আর কখনো মাছের কাছে যাইতে না দেখি।তুমি কয়েকটা মাছ কাঁটার পর এতো ঢং করবা, আবার অসুখ বাধাইবা।আর আমি সব ফালায়া তোমার কাছে বইসা তোমার সেবা করুম, তা চলব না।”
নীরা কিছু না বলে কাঁথা মুরি দিয়ে চুপ করে শুয়ে রইলো। তার মা এতো কঠিন কেন? মায়েরা না মমতাময়ী হয়?
***
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন বাজে রাত নয়টা।ল্যাপটপের সামনে বিস্মিত চোখে বসে আছে রেদোয়ান। অবশ্য শুধু বিস্মিত না অনেকটা প্রফুল্লও বটে।হঠাৎ করে আল্লাহ তাকে এতোবড় সৌভাগ্যের সম্মুখীন করবে তা যেন ভাবতেও পারছে না রেদোয়ান। রাতের বেলা অলস সময় কাটাতে ই- মেইলগুলো চেক করছিল রেদোয়ান।চার- পাঁচটা ই- মেইল জমে আছে।প্রথম দুটো ইতালি থেকে এসেছে।তার চাচা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশে করোনার খবর।পরের দুটো ই- মেইল চেক করতেই হতভম্ব হয়ে গেল রেদোয়ান।
কিছুদিন আগে কয়েক জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিল সে।সেখান থেকেই ডাক এসেছে তার।কেবল একটা নয় দুটো কোম্পানি থেকে।সহসা এতোবড় খবর হজম করতে বেগ পেতে হল রেদোয়ানকে।চোখ কচলে আবারো তাকালো কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে।না খবরটা তাহলে সত্যি! রেদোয়ান খুব খুশি হলো।যাক এতোদিনের দুশ্চিন্তা কমলো। কিন্তু, মনের সবটা দিয়েই কী রেদোয়ান খুশি হতে পারলো? কে জানে?
রেদোয়ান সবার আগে কাগজ- কলম নিয়ে বসলো।আজ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে।
রাত সাড়ে এগারোটা।
রেদোয়ান, ইশরাক,তওসিফ দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের বাস স্টেশনে। রেদোয়ানের সাথে বিশাল ব্যাগ।জীর্ণ চাতালের নিচে ঢাকার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে।বারোটায় একটা বাস ছাড়বে। রেদোয়ান চাকরির খবরটা সর্বপ্রথম জয়নব বেগমকে দিয়েছিল।তিনি খুব খুশি হলেও পরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।ছেলেটা চলে যাবে! জয়নব বেগম আরো অস্থির হয়ে গেলেন যখন শুনেছেন এই রাতেই বেড়িয়ে যাবে রেদোয়ান।কারণ, ই- মেইল এসেছে আরো তিনদিন আগে।হাতে সময় আছে আর মাত্র দু- দিন।অন্যদিকে, সারাবছর সিলেটে থাকা রেদোয়ান ঢাকার কিছুই চিনে না।রেদোয়ান তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়ি।আপাতত রেদোয়ান সেখানেই থাকবে।এরকম কথাই হয়েছে।তাই, রেদোয়ান ঠিক করলো রাতেই বেড়িয়ে যাবে।সময় খুব কম।
ইশরাক বাস স্টেশন আরো একবার ঘুরে এলো।
—” রেদু,এতো রাতেই যাবা তুমি? কালকে সকালে গেলে হয় না?”
— ” না, ভাইয়া।এখন গেলে সকালেই পৌঁছে যাব।কিন্তু,কালকে সকালে গেলে পৌঁছাতে বিকাল হবে।বিশ্রাম নিতে পারব না।”
—” ওহ,আচ্ছা।”
পৌনে বারোটায় বাস এলো।রেদোয়ান তার ব্যাগ রেখে এগিয়ে এলো ইশরাক ও তওসিফের দিকে।জড়িয়ে ধরলো ইশরাককে।এই কয়েকমাসে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল ওদের সাথে।
—” আসছি ভাই।দোয়া করবেন যাতে চাকরিটা হয়।আর ভালো থাকবেন।”
—” তুমিও ভালো থেক।যোগাযোগ রেখো।আর ঢাকায় কোনো সমস্যা হলে চলে এসো গ্রামে।সংকোচ করো না কোনো। ”
ইশরাক বাস স্টেশনে থাকা দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।এগুলো প্রায় সারারাত খোলা থাকে।রেদোয়ানকে কিছু শুকনো খাবার কিনে দিলে ছেলেটার খুব উপকার হবে।ইশরাক চলে গেলে, রেদোয়ান তওসিফকেও জড়িয়ে ধরলো।তওসিফ অবাক হয়ে গেল খুব।তার সাথে এরকম আচরণতো কেউ এখন আর করে না! তওসিফ নিজেও বিনিময়ে জড়িয়ে ধরলো রেদোয়ানকে।
—” ভালো থেকো তওসিফ।মানুষ অন্যায় করতে পারে কিন্তু অনুশোচনায় সবাই ভোগে না।”
—” আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন ভাই? আমাকে এখন সবাই ঘৃণা করে,আপনি করেন না?”
—” মানুষ মানুষকে ঘৃণা করে না,করে তার আচরণকে।তোমার আচরণটা খারাপ ছিল।কিন্তু তুমি নও।তুমি যে অনুশোচনায় ভোগ তা তোমার চোখ দেখলেই বুঝা যায়।তুমি নিজেও চাও বাড়ির সবার সাথে আগের মতো হয়ে যেতে,কিন্তু মানুষগুলো তোমাকে আর বিশ্বাস করে না।বিশ্বাস ভেঙেছ তুমি আবার অর্জন তোমাকেই করতে হবে।এছাড়া আর পথ নেই।”
হঠাৎ করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো তওসিফ।
—” নীরা, কুসুম কেউ আমার সাথে কথা বলে না।তাই আমি ইচ্ছে করেই ওদেরকে রাগিয়ে দেই।রাগিয়ে দিলে একটু কথা বলে নাহয় তো ফিরেও তাকায় না।”
—” সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?ওদেরকে না রাগিয়ে ভাই হওয়ার চেষ্টা কর।ওরা তোমার সাথে কথা এমনিতেই বলবে।”
বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।আরো একবার বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলো রেদোয়ান।বাস ছেড়ে দিলে।সিটে গা এলিয়ে দিলো সে।রেদোয়ানের দু- চোখের কোল বেয়ে বর্ষা নামলো।কাঙ্ক্ষিত সুখময় স্মৃতি ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের, তা ও ছাড়া আর কে জানে?
নীরার ঘুম ভাঙলো খুব দেরিতে।ঘুম থেকে উঠে অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকালো।দশটা বাজে! অথচ মা এখনো ডাকতে আসেনি।বিষয়টা ভাবনার।নীরা তাড়াতাড়ি গায়ের কাঁথা ফেলে উঠে দাড়ালো। নিচে পা ফেলতেই পায়ের নিচে কাগজের অস্তিত্ব খুঁজে পেল।দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীরা।আবারো সেই নাম পুরুষ! নীরা কাগজ উঠিয়ে হাতে নিলো।খুলবে না খুলবে না করেও খুলেই ফেললো।খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল নীরা।চোখের সামনে ফুটে উঠলো গুটি গুটি অক্ষরে প্রকাশ পাওয়া কিছু মনের কথা।লেখাগুলো বড্ড পরিচিত নীরার।ধপ করে খাটের কোনে বসে পড়লো নীরা।এ কী আদোও সত্যি!!!
( চলবে)6