#বসন্তের_রঙ_লাল 10,11
#ফাতেমা_তুজ
#part_10
(১৯)
এক দুই তিন করে চার সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। অভিনবর সাথে শেষ স্বাক্ষাৎ ঘটেছিলো একুশ ফ্রেবুয়ারি তে। তারপর থেকে আর দেখা হয় নি ওদের। হৃদয়ের গভীরে অভিমান জমলে ও ভালোবাসার আস্তরণ পরেছে আবার। ভালো নেই ঝিল। চোখের নিচে জমেছে কালি।প্রচন্ড শীতের প্রকোপে নেতিয়ে পরা গাছের মতোই নুইয়ে পরেছে সে। অন্তরালে হালকা হালকা বেদনার শোক। তবে বাহির টা খুব সুন্দর করে গোছানো পরিপাটি। এই ধরা তে বিচিত্র অনুভূতি আছে বটে। তবে এর সব টাই কি সুখ দেয়? উহু দেয় না। এই যে প্রকৃতি প্রেমি ঝিল প্রকৃতির মাঝে সুখ পায় না আর। গাছের গাঁয়ে আঁকিবুকি করা যাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। আজ সেটা হয়েছে চরম বিরক্তির কারণ। গাড়ি থেকে সরঞ্জাম নামাচ্ছে ভাই রা। আর ঝিল বসে আছে প্রাণ হীন কোনো জড় বস্তুর মতো। সজলের সাথে বোনের তেমন আহামরি মিল ছিলো না কোনো কালেই। তবে আজকাল একটু আটটু ভাব জমেছে। মনের ভেতর আটকে থাকা ভালোবাসা গুলো স্বতস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে। প্রতি বছর ফ্যামিলি ট্রিপ করে ওরা। এবার ও করেছে। ভারতের শীতল এলাকা দার্জিলিং। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত পাহাড়ের রানী দার্জিলিং। এই স্থান থেকে সূর্যাস্ত দেখার স্বপ্ন ছিলো কতো দিনের। তবে আজ ইচ্ছে পূরন হওয়া সত্তে ও সব কিছুই ধূসর রঙে আবৃত।
সজল একটু চাপে আছে। তাই আড্ডা জমলো না কারোই। ব্যবসায়িক কাজে তাঁকে যন্ত্রের মতো চলতে হয় কীনা। ভাই চলে যাওয়া তে ঝিলের মন আরো গুমোট রূপ ধারণ করলো। তৎক্ষনাৎ ফোনে একটি ম্যাসেজ আসে
” আমার কথা মনে পরে মিস ঝিল? ”
কয়েক সেকেন্ড থমকে গিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো।জানালা দিয়ে যতো দূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। এই শীতল হাওয়া তে ও ঘেমে একাকার হয়ে আছে মেয়ে টি। রিপলে দেওয়ার চেষ্টা চালাতেই ম্যাসেজ নট সেন্ড দেখায়। ব্যস্ত হয়ে যায় সে তবে কাজ করছে না কিছু তেই। কয়েক মিনিট পর অনুভব করতে পারে সিম কার্ড টা খুলে নিয়েছে অপর পাশে থাকা ব্যক্তি টি।
” টাইগার হিল থেকে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ কোনো পর্যটক ই মিস করতে চায় না। আর দার্জিলিং এসে ও পাহাড়ের শীর্ষ থেকে মাউন্ট এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য না দেখা কতো টা বোকামি কোনও আইডিয়া আছে তোর? ”
” ভালো লাগছে না আমার। হ্যাঁ আছে আইডিয়া। সারা জীবন তো বোকামি ই করে এসেছি। তবে বিশ্বাস করো এখন আর চালাকি করার মানসিকতা পাই না। মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় পর্বত গিরি মালা এসব দেখার ইচ্ছে করছে না একটু ও। প্লিজ যাও তোমরা। ”
কথা শেষ করেই গাঁয়ে চাদর টেনে নিলো ঝিল। রোহনের মুখের মাং’সপেশি গুলো উঠা নামা করছে বাংর বার। ভাইয়ের প্রতি চরম রাগে ফুলে ফেঁপে উঠেছে যেন। বোন কে প্রচন্ড ভালোবাসে সে। অন্যায় হোক কিংবা সঠিক ঝিলের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিবেচনাই নেই তাঁর।
(২০)
ঝিলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুভূতি নেই অভিনবর অন্তকর্নে। শুধু মাত্র হালকা একটা রেশ, একটা মলিন বসন্ত স্পর্শ করেছে তাঁর হৃদয়। ফারহান অনুভব করতে পারলো খুব দ্রুত ই এই অনুভূতির পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। তবে সেটা নীরবে রেখেই বিদায় জানায় তাকে। যাওয়ার পূর্বে অভিনব বলল
” খুব সুন্দর সময় কাঁটিয়েছি তোমার সাথে। তোমার অনুভূতি গুলো যেন অস্থিমজ্জা অব্দি শিহরণ জাগায়। ”
” থ্যাংকস ব্রো। ”
” আচ্ছা তাহলে দেখা হচ্ছে পরে কোনো এক সময়, কোনো এক অজানা বসন্তে। ”
” হ্যাঁ একদম। ”
একে অপর কে আলিঙ্গন করলো ওরা। মন টা সামান্য ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। দেহে বল নেই একদম ই। পোষা প্রানীর প্রতি ও মায়া কাজ করে যেখানে সেখানে অভিনব তো জলজ্যান্ত মানুষ। খারাপ লাগা কে প্রশ্রয় না দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে ফারহান। হাত নাড়িয়ে শেষ অব্দি তাকিয়ে রইলো অভিনব। ছেলেটার জন্য ভীষণ মায়া হয় ওর। এমন পাগল প্রেমিক কজন আছে এই ভবে? মনে মনে প্রার্থনা জানালো খুব দ্রুত যেন নিজ অনুভূতি কে সাদরে গ্রহণ করে ফারাবি।
*
দার্জিলিং সফর টা খুব অদ্ভুত ভাবেই কেঁটেছে ঝিলের। এই যে পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলেই মনে হতো কানে কানে ফিস ফিস করে অভিনব বলছে ‘ আমার কথা কি মনে পরে না ঝিল। ‘ প্রতিউত্তরে ঝিল কিছুই বলার সুযোগ পায় নি। কারন সে শব্দ উচ্চারণ হওয়ার পূর্বেই অভিনব নামক স্বপ্ন পুরুষ উধাও হয়ে গেছে। আহা কি সুন্দর ছিলো সে মুহুর্ত। পাশাপাশি বসে থাকা স্বপ্ন পুরুষ যেন এক সাগর ভালোবাসা নিয়ে উপস্থিত হয়ে ছিলো। মনের যতো বাসনা সব পুরণ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো ঝিল। তবে কি হলো ,শেষে কি না ধোঁকা পেতে হলো প্রিয় পুরুষের থেকে। ঝমঝমে কেঁদে উঠলো ঝিল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাঁর। সমস্ত টা অসহ্যকর লাগছে। ভারসিটির প্রথম দিনে উপস্থিত হয় নি সে। মন মস্তিষ্ক ঠিক না থাকলে কিই বা ভালো লাগে। কখন যে পাশে বসেছে মৌনতা তা খেয়াল ই করে নি। কবুতর গুলো ডানা ঝাপটা দিয়ে উড়ে গেল। যেন দুই বান্ধবী কে কথা বলার জন্য নীরব ভাবে সম্মতি প্রদান করলো। মৌনতা পরিবেশের মৌনতা ভেঙে বলল
” একটা বিষয় নিয়ে এতো টা প্রাণহীন হওয়া কি উচিত ঝিল? ”
কানে সে বার্তা পৌছাতেই মলিন চোখে তাকায় ঝিল। মৌনতার চোখে মুখে এক রাশ হতাশা লেপ্টে আছে। ঝিল সে দিক থেকে চোখ নামিয়ে বলল
” আমি তাঁকে এখনো ভালোবাসি মৌন। আর প্রচন্ড ভালোবাসি তাকে। ”
মৌনতা কোনো কথা বললো না। পিন পতন নীরবতায় অনেক টা সময় কেঁটে গেল। চোখের সামনে কিছু স্মৃতি এসে রাঙিয়ে দিলো মেয়েটির গাল। ঠোঁট দুটো হালকা কাঁপতে শুরু করেছে। অভিনবর প্রতি ভালো লাগা নয় বরং ভালোবাসা ছিলো বহু দিন ধরেই। সেই ভালোবাসা কে লুকিয়ে রেখেছিলো ভালো লাগা নামক শব্দের অন্তরে।
ঘটা করে সেজেছে ফারাবি। বহু দিন পর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে সে। কয়েক মাস পূর্বে ও দুটো বিয়ের ইনভিটেশন ছিলো তবে ফারহান নামক অসহ্যকর প্রানী টি যেতে দেয় নি তাঁকে। ক্ষনকাল পূর্বে ও মনের গভীরে একটা ভয় কাজ করছিলো। কোথা থেকে যেন বাসায় ফিরে এসেছে ফারহান। বিগত দিন গুলো তে বাসায় ছিলো না সে। আজ সকাল সকাল তাকে দেখে অন্তর শুকনো পাতার মতো হয়ে গিয়েছিলো। মন টা কেমন কু গাইছিলো। এই বুঝি ফারহান তাকে কড়া নির্দেশ দিবে বিয়ে তে যাওয়া নিয়ে। তবে ধারণা ভুল প্রমান করে ফারহান চলে গেছে নিঃশব্দে। খুশি তে কয়েক মিনিট নাচ ও করেছে সে। স্কুলের সিনিয়র এক আপুর বিয়ে। সেখানে ওর পুরো বন্ধুমহলের ইনভিটেশন। যেহেতু সাথে পরিবার থাকবে না সেই কারনে মন মতো স্বাধীনতা পাবে সে।
রিমি কেবল চোখের পলক ফেলে চলেছে। সে যেতে চায় না বিয়ে তে। তবু ও যেতে হবে তাকে। এর কারন ফারাবি কে খুশি রাখা। যদি ও এর মাঝে আরেক টি কারন অব্যাহত রয়েছে। তবে মন যেতে চাইছে কিছু তেই। চোখ দুটো বার বার ভেঙে চলেছে। যেন যতো রাজ্যের ঘুম এই দু চোখেই।
” হয়েছে তোর? ”
” আর একটু, জাস্ট পাঁচ মিনিট। ”
” সেই কখন থেকে সেজেই চলেছিস। একটা কথা বল তো বিয়ে টা কি তোর? ”
” হলে হতে ও পারে। বলা তো যায় না। ”
” মানে! ”
” দেখ তোর ভাইয়ের জন্য আমি আমার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলি দিয়ে ঘরে বসে থাকতাম। এখন তো সে নেই। আর কাউ কে পছন্দ হলে তাঁর গলায় ঝুঁলে যাবো। ”
কাউচে ধপ করে বসে পরলো ফারাবি। মাথায় হাত দিয়ে বলল
” এই যা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুই তোর ভাইয়ের জন্য বিরহ পালন করে চলেছিস। ”
” হয়েছে এবার? ”
” হু জাস্ট লিপস্টিক টা গাঢ় করে নেই। ”
লিপস্টিক গাঢ় করা শেষে বেরিয়ে পরলো ফারাবি। রিমি ফোন টা মুঠো বন্দী করে চোখ বন্ধ করলো। সব টা মুখ বন্ধ করে হজম করতে হচ্ছে তাকে। তবে ভাইয়ের পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো আঁচ ই করতে পারছে না। মন টা শুষ্ক কিসমিসের মতো হয়ে গেল তাঁর। আচ্ছা কখনো কি ফারাবির মনে জাগবে ফারহান নামের বসন্ত!
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
চলবে
#বসন্তের_রঙ_লাল
#ফাতেমা_তুজ
#part_11
(২১)
ইতো মধ্যেই পর পর তিন বক্স আইসক্রিম রোল খেয়ে নিয়েছে ফারাবি। সমকালীন সময়ে এটা বাংলাদেশে ইউনিক হওয়া তে লম্বা লাইন লেগে গেছে স্টল টা তে। অথচ ফারাবির জন্য কেউ খেতেই পারছে না। কেউ কেউ তো মুখের উপর বলে যাচ্ছে এই মেয়ে আর কত খাবে। সে সব তুচ্ছ করে দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে খেয়েই চলেছে মেয়ে টা। রিমি অবশ্য এখন মুড অফ করে নেই। সে বসে আছে ফোন হাতে প্রিয় পুরুষের সাথে কথা বলা নিয়ে।
” আপু একটু সাইট হবেন? ”
” কেন? ”
” তাহলে আমি আইসক্রিম রোল অর্ডার করতাম এই আর কি। ”
” আমার আইসক্রিম রোল বানানো হচ্ছে এখন। পরে আসুন। ”
” আপনি তো খাচ্ছেন ই। ঐ টা একটু পরে নিন প্লিজ। ”
” না আমার এখনি লাগবে। ”
নাছোড়বান্দা সুরে আইসক্রিম নিতে হুমড়ি দিয়ে রইলো সে। আহনাফ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। কিছু টা লজ্জাবোধ হচ্ছে, রোহন কে খুব করে বলেছিলো সবার আগে গিয়ে ঝিলের জন্য আইসক্রিম রোল নিয়ে আসবে। তবে সেটা তো হলোই না।
এক কোনে দাঁড়িয়ে আকাশে থাকা অর্ধকার বিধু কে অবলোকন করছে ঝিল। শিরশির বাতাসে কয়েক গাছি চুল তাড়না দিয়ে বেড়ায়। অথচ চাঁদের মাঝে হারিয়ে গিয়ে চারপাশের সমস্ত সৌন্দর্য কে ভিত্তিহীন করে দিয়েছে মেয়েটি। সুশ্রী মুখের বা পাশ টা তে মশা বসেছে। নিজের ভেতর র’ক্ত ভোজ করে চলেছে। মশার পেট ভরা লাল রঙা তরলে। যার উৎস ছিলো ঝিলের তকতকে গালে। অথচ এ সম্পর্কে অবগত নয় সে। ফারহান এ পথেই এসেছিলো। বিষয় টা লক্ষ হতেই হাত দিয়ে মশা টি তাড়িয়ে দিলো। শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছিয়ে গেল ঝিল। কিছু টা ভয় পেয়েছে কি না। চোখের ভাষা বড় অদ্ভুত হয়। ফারহান তার ব্যবহার ভালোই জানে। ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো ঘটনা টা। ঝিল লজ্জা পেয়েছে সামান্য। বা গালে হাত বুলিয়ে বলল
” থ্যাংকস। আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”
” হ্যাঁ সেটা তো ধ্যান দেখেই বুঝেছিলাম। চাঁদ কে এতো টাই ভালো লাগে? ”
” উহু। অতো ও না। ”
” তাহলে এভাবে দেখছিলেন কেন? ”
” জানি না। ভালো লাগছিলো দেখতে। ”
” বাহ দারুণ ভাবে প্রশ্ন টি এড়িয়ে গেলেন তো। ”
ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো ঝিল। ফারহানের সাথে টুকটাক গসিব ও হলো।দুই হাতে দুটো আইসক্রিম বক্স নিয়ে যাচ্ছিলো ফারাবি। দুজন কে দেখেই থ মেরে গেল। কিছুক্ষণ পর ই এক ঝাঁক জোনাকি এসে আলোকিত করে দিলো ওর মন। অসাবধানতায় এক টা বক্স পরে গেল।সে সব আপাততো মূল্যহীন। ছুটে গেল সে। যেন কোনো মহামূল্যবান কার্যে ব্যাঘাত ঘটে যাবে। চট করেই রিমির থেকে ফোন নিয়ে এসে ঝিল আর ফারহানের ছবি তুলতে লাগলো। আর দাঁতে দাঁত চেপে বলল
” আমাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছিলো তাই না শয়তানের রাজা। আমার সিনিয়র আপু নাকি তোর জুনিয়র বোন হতে পারে এ বিষয়ে আমার কোনো কমন সেন্স নেই।আর কি যেন বলেছিলেন মিস্টার ফারহান, ইনভিটেশন কার্ড আমি পরে পেয়েছি। সেই কারনে তাকে প্রশ্ন করা সাজে না। এবার বুঝাবো মজা। ঘুঘু দেখেছো তুমি ফাঁদ দেখো নি। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রঙ লীলা চলছে এখানে আর আমাকে সবার নিকট হৃদয়হীন প্রমান করা! ”
মেমোরি ফুল। হাজার টা ছবি তুলেছে ফারাবি। খুব পার্থক্য নেই সে সব ছবি তে। প্রতি টা ছবি তেই ঝিল আর ফারহান কে দেখা যাচ্ছে। চিরুনি অভিযান চালিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিমায় সোফা তে গাঁ এলিয়ে দিলো। শরীর আর চলছে না। ঐ দিকে বিয়ে কতো দূর কে জানে। ডান হাতে কপাল টা মালিশ করছিলো সে। তখনি ওয়াসরুম থেকে বের হয় ফারহান। গাঁয়ে শার্ট ব্লেজার কোনো টাই নেই। পাতলা চিকন ফিতার গেঞ্জি পরা। ফারাবির চোখ দুটো অদ্ভুত ভাবে বড় হয়ে গেছে। ওর মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বলছে। হতবাকের মতো তাকানো শেষ হয়ে যেতেই ওয়াসরুমে ছুট লাগায় সে। হাতে থাকা স্মার্ট ফোন টার ক্যামেরা অন। এদিক সেদিক তাকিয়ে যখন আকাঙ্ক্ষিত মেয়েটি কে খুঁজে পেল না। তখন কপালের মাঝ বরাবর ভাজের সৃষ্টি হয়। ফারহান ঠোঁট কামড়ে সব টা দেখলো। মেয়েটা যে আস্ত এক গাঁধা তা বলার প্রয়োজন বোধ হয় না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো পিট পিট করতে লাগলো। মেয়েটির মাথায় চাঁটি মেরে বলল ফারহান
” এই জায়গায় কি হু? ”
” না মানে আপনি এখানে কি করছেন? ”
” প্রশ্ন টা কে করেছে আগে আমি না তুই? ”
” আপনি। ”
” তাহলে উত্তর কে দিবে আগে? ”
” আমি। ”
” তো উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করিস কেন? ”
থতমত খেয়ে সরে যায় ফারাবি। সোফা থেকে ব্লেজার আর শার্ট নিয়ে সেটা গাঁয়ে জড়িয়ে নেয় ফারহান। গাঁয়ে সরবত পরেছিলো। সব কেমন আঠালো লাগে। মিররে নিজেকে দেখতে দেখতে বলে
” মানুষের মনে অশ্লীল চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খেলে যা হয়। ”
ফারাবি কে পাশ কাঁটিয়ে আলোর গতি তে প্রস্থান করে ফারহান। বিহ্বল তাকিয়ে থেকে আপন মনেই প্রশ্ন আওরায় মেয়েটি অশ্লীল মন টা কার?
ইউ এস এ চলে গেছে অভিনব সেই খবর টা এই মাত্র শুনতে পেল ঝিল। নিউজ চ্যানেল এর হেডলাইন গুলো তেমনি খবর ছড়াচ্ছে। নিশুতি রাতের আড়ালে গাড়ির জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাচ্ছে মেয়েটি। বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছে তাঁর। বুকের মধ্যস্থান টা র’ক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে অবলীলায়। পাশেই আহনাফ বসে আছে। গার্লফ্রেন্ড এর সাথে প্রচন্ড বেগে প্রেম চলছে তাঁর। শব্দ গুলো কানে যাচ্ছে না ওর। কেবলি অন্তকর্নে বেজে চলেছে ব্যথার তাল। গাড়ি এসে থামলো মেইন গেটের কাছে। আহনাফ নেমে গিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেছে অথচ ঝিল বসে আছে গাড়িতে। কল কেঁটে দিয়ে মেয়েটির কাছে এলো সে। জানালা দিয়ে নক করে বলল
” আজকের রাত এখানেই কাঁটিয়ে দিবি নাকি মন পরে আছে বিয়ের অনুষ্ঠানে।”
” হু। ”
” মাথা ঠিক আছে বোন? ”
” হ্যাঁ সব ঠিক ঠাক। ”
মলিন হাসির ঝড় তুলে দিয়ে নেমে গেল মেয়েটি। আহনাফের খারাপ লাগছে খুব। প্রিয় বোনের মন টা স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে দিন কে রাত করে দিচ্ছে দুই ভাই। অথচ ফলাফল শূন্য।
(22)
চৌধুরী বাড়িতে একটি বিশেষ রেওয়াজ অবলম্বন করে সবাই। প্রতি সপ্তাহে একটি দিন পালিত হয় চা কফির আড্ডা তে। আর সেই অনুষ্ঠানের অংশ হয় প্রতিবেশী তথা বন্ধু পরিবার। তেমনি এক বিশাল আয়োজন চলছে আজ। বাগান টা পরিপূর্ণ হয়েছে ছোট ছোট রঙিন লাইট দ্বারা। একটু পর ই আঁধার নেমে আসবে ধরায়। আকাশ টা লালচে রূপে সেজেছে মনে হয় খুব লজ্জা লাগছে তাঁর। হা হয়ে থাকার দরুন মুখের ভেতর মাছি চলে গেল রিফাতের। ছেলে টা খ্যাক খ্যাক করে কাশতে শুরু করেছে। অথচ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করে যাচ্ছে মনিকা। মেয়েটা কে নির্লজ্জ বলা চলে শতকরা নব্বই শতাংশ। বিগত তিন চার দিন ধরে বিনা টিকিটে ভ্রমণের মতো অবস্থান করছে হবু শশুর বাড়িতে। অথচ এই বিষয় টি আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে দৃষ্টিকটু। রিফাতের কাশি দেখে মনিকা ভেঙ্চি মেরে চলে গেল। যেন নিছক ই অভিনয় করছে রিফাত। উপায় না দেখে বাসার ভেতর ছুট লাগালো ছেলেটা। পানির গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে পান করার পরিকল্পনা করেছিলো তবে সেই পরিকল্পনা কে অবাস্তবে রূপান্তর করতে পানির গ্লাস নিয়ে গেল মনিকা। রাগে দুঃখে গজগজ করে ওয়াসরুমের পথে হানা লাগালো সে। মনিকার হাসির কারনে রাফাজের কাজে ব্যাঘাত ঘটলো। মনিটরে চোখ নিমজ্জিত রেখেই শুধালো
” কি হয়েছে মনিকা।এভাবে হাসছো কেন তুমি? ”
হাসির দরুণ কথা বলতে পারছে না মেয়েটি। কিছুক্ষণ পর হাসি থামলো ওর। রাফাজের দিকে অগ্রসর হয়ে ফিস ফিস কন্ঠে বলল
” আরে ভাইয়া, কি বলবো আর। ঐ যে গাঁধা টা আছে না ঐ গাঁধা টা কে আবার জব্দ করেছি। ”
” গাঁধা!”
“হ্যাঁ। তুমি জানো না? ”
দুই দিকে মাথা কাত করলো রাফাজ। অর্থাৎ সে জানে না। আশে পাশে নজর রেখে রিফাতের কথা বলতে যাবে কি তখনি ওর কান মুলে দিলো ফারহান।
” ভাইয়া লাগছে আমার। ”
” লাগার জন্যই তো দিয়েছি। এতো দুষ্টু কেন তুই? ”
” উফ আমি আবার কি করলাম। তুমি রাফাজ ভাইয়া কে জিজ্ঞাসা করো আমি তো সেই কখন থেকে বসে আছি এখানে।”
নিষ্পাপ বাচ্চার মতো হ্যাঁ বোধক উত্তর করলো রাফাজ। মনিকার চোখ দুটো আলোকিত হয়ে আছে। ঢিলে ঢালা শরীর টা নিয়ে এগিয়ে এলো রিফাত। বমি করে যা তা অবস্থা। পরিস্থিতি সংকীর্ণ দেখে আগেই প্রস্থান করেছে রাফাজ। এই বাচ্চা দের মাঝে থাকলে কাজ কর্ম সব লাটে উঠে যাবে।
বিদেশী নাম্বার থেকে মধ্য রাতে কল এসেছে ঝিলের ফোন টা তে। ঠিক তখন থেকেই বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হতে শুরু করেছে। তবে কি অভিনব তাকে মনে রেখেছে? ছেলেটা কি ভালোবেসে ফেলেছে তাকে! এমন শতেক ধারার অযুক্তিক কিছু কল্পনা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে হাত বুলাচ্ছে সে। অধিক উত্তেজিত থাকায় হাতের তালু ঘেমে নেয়ে একাকার। যেন এই মাত্র পানি তে হাত ভিজিয়েছে। কাঁপা হাতে ফোনের স্ক্রিনে টাচ করলে ও কোনো কাজ করলো না। নিজের প্রতি বিরক্ত হয় ঘামে ভেজা হাত টা নিজ পোশাকে চেপে নিলো। এখন ঠিক ঠাক সব। কষ্ট করে নিজ থেকে কল করতে হলো না তাঁকে। সেই বিদেশী নাম্বার থেকে আবার কল এসেছে। ঠোঁটের কোন টা তে এক চিলতে হাসি ফোঁটা সত্তে ও বুকের ভেতর কেমন লাগছে তাঁর। এবার ও কল রিসিভ করতে পারলো না। আবার কল এলো। কল রিসিভ হলো এবার। ওপাশ থেকে প্রিয় পুরুষের কন্ঠ শোনার জন্য ব্যকুল মন কে ভেঙে দিয়ে একটি মেয়ে ইংরেজি ভাষা তে বলল
” আমি কি অহনা মির্জা ঝিলের সাথে কথা বলছি। তিনি ইউ এস এ ভ্রমণ করার জন্য একটি কোম্পানির কাছে এপ্লাই করেছিলেন দুই বছর পূর্বে। তখন তাঁর বয়স ছিলো পনেরো। সে সময়ে আমর বলেছিলাম আমাদের কোম্পানির নিয়ম অনুসারে আঠারো বছর পূর্ণ না হলে এপ্লাই টি গ্রহন যোগ্যতা পাবে না। তবে আপনি জেনে খুশি হবেন যে আমাদের কোম্পানির নতুন নিয়মানুযায়ী ষোলো বছর পূর্ণ হলেই এই আবেদন গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আপনি কি আমাদের ব্রাঞ্চ এর সাথে যোগাযোগ করবেন ম্যাম?”
অভিনবর মতো অভিনব উপায়ে লুকিয়ে ভ্রমণের স্বাদ আর স্বপ্ন পুরুষের সাথে স্বাক্ষাৎ নেওয়ার জন্য দুই বছর পূর্বে উক্ত কোম্পানি টি কে খুব রিকোয়েস্ট করেছিলো ঝিল। তবে বয়স কম হওয়া তে সেটা মিশে যায় মাটির সাথে। কথা ছিল খুব খুশি হওয়ার। তবে এ সংবাদ টি মোটে ও আনন্দ দিলো না। বরং চোখের জলে একাকার হলো চিবুক। ওপাশ থেকে শুদ্ধ ইংরেজি তে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে মেয়েটি। বিরক্ত হলো কি না জানা নেই তবে ফোন সুইচ অফ করে দিলো ঝিল। মনের ভেতরের সব অনুভূতি তিক্ততার রূপ ধারন করেছে।
নিজ পরিকল্পনায় অসফল হয়ে মুখ চুপসে গেছে ফারাবির। পুরো ফোনের কোথাও নেই ফারহান আর সেই মেয়েটির ছবি। অথচ সকলের সম্মুখে খুব বড় করে বলেছিলো হাতে নাতে প্রমাণ দিবে ফারহান নামক বাজে মানুষ টি অন্য নারীর সাথে প্রেম ভালোবাসায় জড়িত। এতো গুলো মানুষের সামনে এমন মিথ্যে প্রলাপ করায় অপমানিত হয়েছে ফারহান। রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছিলো সে। তবে যাওয়ার পূর্বে ফারাবির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। ভয়ে চুপসে গেছে মেয়েটি। ফরহাদ ছেলে কে কড়া চোখে স্বাশালেন যাতে ফারাবির প্রতি রাগ না দেখায়। সেই নির্দেশনা মেনে ফারহান বলল
” সকলের মাঝে এভাবে অপমান না করলে ও পারতি। তোকে স্বাধীনতা দেই না আমি। তোর প্রতি অধিকার ফলাই যা আমার নেই।এসব নানান অজুহাতে কম কথা তো শুনালি না সেদিন। তবে আজ কেন এমন করে অপমান করলি ফারাবি? খুব বুঝতে শিখেছিস তাই না! আসল কথা হচ্ছে আমি তোর চোখের সামনে থাকলেই সমস্যা। যা থাকবো না আর। তবু ও রেহাই দে আমায়। ”
পুরো শরীর কেঁপে উঠলো ফারাবির। ভুল তো দেখে নি সে। তবে কোনো প্রমাণ নেই ফোনে। তাই বলে এভাবে বলতে হবে! চোখের পানি তে নাক মুখ ভিজে গেছে ওর। টেনে টুনে আড্ডা চললো কিছুক্ষন। তবে সেটার ফাঁক ফোঁকরে রয়ে গেল হতাশা ভরা দীর্ঘশ্বাস।
অনেক টা মুহূর্ত জুড়ে কথা হলো ফারহানের সাথে। খুব সিরিয়াস হয়ে কিছু কথা বলেছে ফারহান। আপাততো নিজের বিজনেস তৈরি করতে চায়। তাই বাসা থেকে বহু দূরের পথে থাকবে সে। তবে বিডি ছেড়ে যাবে না কোথাও। ছেলেটার ভাগ্য বড্ড যন্ত্রনাময়। যদি ও সৃষ্টিকর্তার দেওয়া ভাগ্য কে কটাক্ষ করা একদম ই অনুচিত। তবু ও আমরা মানুষ জাতি ভাগ্য কে দোষারোপ করেই যাই।
সিগারেটের নেশা কোনো কালেই ছিলো না অভিনবর। তাই গোলাপি রঙা ঠোঁট টা কে কালচে রূপ দিতে পারছে না সে। এ নিয়ে ও কিছু টা অভিযোগ হলো অন্তকর্নে। তবে সর্বাঙ্গে সাপের বি’ষের মতো নীল ব্যথা খেলা করে যাচ্ছে। মার্কো তাকে সব সময় ই চমকে দেওয়ার মতো সংবাদ প্রদান করে। আজ ও হলো তেমন টা। একটা আশা ভরসা চমকের মাঝে হারিয়ে গেল। অবশ্য সেসব নিয়ে এখন আর ভাবছে না সে। তবে মগজ টা বার বার ঝিলের করা প্রত্যাখান কে স্মরণ করে। যেন এর থেকে বিষাদ আর কিছুই হতে পারে না।
” তুমি কি ব্যস্ত অভিনব? ”
” নো মম। ”
” ইদানিং তোমাকে কেমন শুষ্ক দেখায় বেটা। আমি যেন নিজের ছেলের মন পড়তে পারছি না। ”
” তেমন কিছু নয় মম। শুধু শুধু টেনশন করছো তুমি। ”
” আচ্ছা মেনে নিলাম। তবে তুমি কি ভুলে গেছো আমাকে দেওয়া প্রমিস এর কথা?”
” স্যরি। ভেরি ভেরি স্যরি। আমি তারিখ এর কথা স্মরণে রাখতে পারছি কেন যেন! ”
” এতো চিন্তা করলে তো হবেই এমন। কত বার বললাম তোমার ড্যাড এর বিজনেস এ জয়েন করো কিন্তু তুমি শুনলে না। ”
বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। তবে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো অভিনব। ইহরিমা যত্ন নিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ছেলেটি কেমন যেন হয়ে গেছে। বহু বছর পূর্বে একটি ডিল করেছিলেন মা ছেলে তে। প্রত্যেক মাসের একটি বিশেষ তারিখে মা ছেলে এক সাথে কাঁচের তৈরি রুম টা তে ঘুমাবে। রাতের আকাশে বেড থেকে শুয়ে শুয়ে কার্টুনের মতো আকাশে থাকা বিশেষ পরিচিত নক্ষত্র চাঁদ তারা দেখবে অভিনব। এর সাথে যত্ন নিয়ে চুলে বিলি কেঁটে দিবেন ইহরিমা।
চলবে