বাঁক,১০,১১

0
293

বাঁক,১০,১১
জবরুল ইসলাম
(১০ পর্ব )

মৃদুল খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘আজ রাতটা গল্প করেই কাটিয়ে দেবো ভাবছি।’

– ‘তা করা যায়, তবে শর্ত হচ্ছে আমি তোমার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসবো আর তুমি দুই হাতে আমাকে বেঁধে ধরে গল্প করবে।’

মৃদুল মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে আসো।’

বাতির আলোয় সরাসরি কোলে গিয়ে বসতে মানহার কেমন যেন লজ্জা লাগছে।
চোখের দিকে না তাকিয়ে মুখে যতটা সহজে বলতে পেরেছে কাজটা যেন ঠিক ততটাই কঠিন।

– ‘কী হলো আসো?’

মানহা লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো,

– ‘তোমার চোখ বন্ধ করো আগে।’

– ‘বাবা তোমার লজ্জাও আছে দেখছি।’

– ‘অন্ধকার হলে একটুও লজ্জা করবে না। তুমি সরাসরি তাকিয়ে আছো আমি কীভাবে গিয়ে হুট করে বসবো শুনি?’

– ‘মুখ থেকে হাত সরাও তো, চেহারাটা দেখি, ন্যাকামো করছো না-কি আসলেই লজ্জা পাচ্ছ বুঝা যাচ্ছে না।’

– ‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু, এরকম বললে আরও বেশি লজ্জা লাগে।’

– ‘তুমিই না বললে কোলে বসে গল্প করতে, এখন আবার লজ্জা কেন পাচ্ছ?’

– ‘এতো কথা না বলে চোখ বন্ধ করো।’

– ‘আজব, আচ্ছা করলাম চোখ বন্ধ।’

মানহা চোরা চাহনিতে তাকিয়ে দেখে মৃূদুল সত্যিই চোখ বন্ধ করেছে। ঝট করে ওর কোল থেকে বালিশ সরিয়ে বসে মৃদুলের দু’হাত টেনে এনে নিজের পেটের ওপর আলগোছে রাখে।

ধৈর্যহারা হয়ে মৃদুল বললো,

– ‘চোখ কী খুলবো? শ্যাম্পুর ঘ্রাণে তো মাতাল হয়ে যাচ্ছি।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা এবার খুলো।’

চোখ মেলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো মানহার সদ্য স্নান করে শুকানো উম্মুক্ত কৃষ্ণকেশ। এই চুলের নিচেই ঢেকে আছে ভোরেই সেই ফরসা নগ্ন ঘাড়। মৃদুলের দুই হাত মানহা নিজের উষ্ণ দু’টি হাত দিয়ে পেটে চেপে রেখেছে। তার শরীরে যেন আচমকা এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে গেল। মাথা তুলে দাঁড়াল শরীরের সমস্ত নিম্নমুখী লোম। পরক্ষণেই সে নিজেকে আপন মনে শাসাতে লাগে। নিজের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা হিংস্র দানবকে যেন স্মরণ করিয়ে দেয় তুই বিবাহিত। ফাতিহা ওর মতো রূপবতী না হলেও সে তোর বিয়ে করা স্ত্রী। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য মানহাকে বললো,

– ‘আন্টি মারা গেলেন কয় বছর হলো?’

– ‘প্রায় বারো বছর।’

– ‘বলো কী?’

– ‘হু।’

– ‘তাহলে তো আমাদের দেখা হওয়ার কয়েক বছর পরেই মারা গেলেন।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কীভাবে মারা গেলেন? আর আঙ্কেল কোথায়? তোমরা না মৌলভীবাজার থাকতে? এটা তো তোমার নানাবাড়ি তাই না?’

মানহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘সে অনেক কথা, এগুলো শুনে আজ সুন্দর রাতটা নষ্ট করে লাভ নেই।’

– ‘আরে বলো তো শুনি।’

– ‘মা আত্মহত্যা করেছিলেন।’

– ‘বলো কী! আত্মহত্যা করেছেন মানে?’

– ‘সে অনেক কাহিনি।’

– ‘কী কাহিনি? বলো আমি শুনবো।’

– ‘মা শেষদিকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।’

– ‘কেন?’

– ‘না শুনলে হয় না?’

– ‘তাও ঠিক, আমি তো তোমার ব্যক্তিগত বিষয় জানার মতো কেউ না।’

– ‘সামান্য ব্যাপারটার জন্য মহিলাদের মতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো কেন?’

– ‘কোনো কিছুই করছি না, আমার শুনতে হবে না।’

– ‘তুমি তো দেখছি অভিমানও করছো মহিলাদের মতো।’

– ‘পুরুষ মানুষের কী অভিমান নাই?’

– ‘রেগে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা বলছি সব।
আমার বাবা ঢাকা বায়িং হাউজে কাজ করতেন। আমি আর মা প্রথমে দাদা-দাদিদের সাথেই থাকতাম। আমার আগেই না-কি দু’টা ভাই হয়ে মারা যায়, তারপর আমি শুধু বাঁচলাম। কিন্তু কোনো এক কারণে আমার জন্মের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যায় মা’র আর কোনো সন্তান হচ্ছিল না৷ এমনিতেই প্রথম দু’টা ছেলে সন্তান হয়েই মারা গেছে এটার জন্য দাদি মা’কে দু’চোখে দেখতে পারতেন না৷ বাবা তাদের একমাত্র ছেলে। ওর ঘরে আরেকটা ছেলে না হলে বংশের বাতি কই? এসব নিয়ে প্রথম দুই বছরে প্রচুর স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছিল, তারপর সম্মুখ যুদ্ধ৷ মাও ছিলেন প্রচণ্ড বদ মেজাজি তাই দাদি কিছু বললেই দু’দিন পর পর ঝগড়া লেগে যেতো। বাবা কখনও ফোনে আবার কখনও বাড়িতে এসে ঝগড়া মিটমাট করতে হতো। চার বছরের মাথায় আত্মীয়-স্বজন সবাই বাবাকে আরেকটা বিয়ে করানোর জন্য বলাবলি শুরু করলো। এসব শুনে মা রেগে আগুন হয়ে তুলকালাম বাঁধান। ততদিনে বাবা বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলেন। একদিন দাদির সাথে ঝগড়ার পর মা বাবাকে বললেন ঢাকায় তার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে, সে আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে পারবে না৷
বাবা রাজি হলেন না, তবে মা’র জোরাজোরির কারণে একপর্যায়ে বললেন তাহলে মৌলভীবাজারে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকতে। মা প্রথমে এর কারণ কিছুই বুঝলেন না। তিনি শুধু দাদা-দাদির থেকে আলাদা থাকতে পারবেন ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন। আমরা আলাদা বাসায় গেলাম। সেখানে শুধু মা আর আমি। সুন্দর পুর থেকে আসার কিছুদিন পরই মা লোকমুখে শুনছিলেন বাবা ঢাকায় আরেকটা বিয়ে করেছেন। কিন্তু উড়ো কথা গায়ে মাখলেন না। দিন চলতে থাকে এভাবে। এক সময় বাবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে আনতে শুরু করলেন। টাকাও ঠিকঠাক পাঠান না। মা এক সময় আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি চলে আসেন। এর কিছুদিন পর জানতে পারেন একটা ছেলে সন্তান সহ বাবা বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছেন। মা’র পাগল হওয়ার অবস্থা। মামা তারাও সবাই রেগে গেলেন। করলেন গিয়ে মামলা। কিন্তু মা’র যে কী হলো, বাবার সামান্য দ্বিতীয় বিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র মেনে নিতে পারছিলেন না। খুব দ্রুত পাগল হয়ে গেলেন। এক সময় বেঁধে রাখতে হয়েছে চেইন দিয়ে৷ মাঝে মাঝে খুব চিল্লাচিল্লি করতেন। আমাকে দেখলে ধেয়ে আসতেন মারতে। আমিও ধারে-কাছে যেতাম না৷ কিন্তু মাঝে মাঝে হুট করে পুরোপুরি আবার ভালো হয়ে যেতেন। আমাকে ডেকে নিয়ে হু হু করে কাঁদতেন৷ এভাবে বছর খানেক কাটার পর একদিন ভোরে নানা পুকুরে অযু করতে যাবেন হঠাৎ দেখেন জাম্বুরা গাছে মা ওড়না প্যাঁচিয়ে ঝুলে আছেন। একটা সময় বাপ-দাদারা আমাকে নিতে চাইলেও আমি যাইনি। মামা আর খালারা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাদের ভালোবাসায় আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম, পড়ালেখা শুরু করলাম। মনে মনে পরপুরুষের প্রতি একবুক ঘৃণা আর অবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। তবে তোমার কথা মনে পড়লেই একটু নিভে যেতাম। মনে হতো মানিক অন্য সকলের মতো নয়, সে একটু আলাদা।
এক সময় খালাদের বিয়ে হয়। নানা মারা যান। নানি আগেই মারা গিয়েছিলেন। মামা বিয়ে করলে। ঘরে এলো নতুন মানুষ। সে আমাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারলো না। উটকো ঝামেলা মনে করতো। আমি তখন একটা ঘরেই বন্দি হয়ে গেলাম। ওখানেই পড়ালেখা করি৷ খাওয়া-দাওয়ার সময় শুধু যাই। নিজেকে তখন ভীষণ অসহায় লাগতো। আমার এইসব দুঃখ, কষ্ট আর একাকিত্বের দিনে বন্ধু হিসেবে তোমার কথা ভাবতাম। এইযে এখন যতসব পাগলামি তোমার সঙ্গে করছি সবকিছু আমার তখনকার ভাবনা। যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম হঠাৎ দেখা হবে আমরা এটা-ওটা খেলবো। তারপর যতই বড়ো হচ্ছিলাম ভাবনা পরিবর্তন হচ্ছিল। যখন আমি যুবতী হয়ে উঠলাম। তখন একা একা ভাবতাম আমি তোমার পিঠে হেলান দিয়ে বসে গল্প করবো। রাতে যেদিকে ইচ্ছা হয় ঘুরে বেড়াবো। আমার কোনো ভয় নেই চিন্তা নেই কারণ তুমি আছো। আমি তোমাকে নির্লজ্জের মতো ভালোবাসবো। যেরকম ইচ্ছা মজা করে কথা বলবো। মাঝে মাঝে এমন হতো, বই পড়তে পড়তে হঠাৎ বন্ধ করে কল্পনায় ডুবে যেতাম তোমাকে নিয়ে। আমার যেন ভাবনায় আরেকটা জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যেখানে শুধু তুমি আর মা। তুমি আসবে জানতাম আর মা কখনও আর আসবেন না, এটাই তফাৎ। অবশ্য আমার কখনও টাকার সমস্যা হয়নি। কারণ খালা তিন জনেরই স্বামী প্রচণ্ড ভালো এবং বিত্তবান। আমার পড়ালেখার খরচ আর এইযে চেম্বার সবকিছু তারা মিলেই দিয়েছেন।’

মৃদুল অবাক হয়ে বললো,

– ‘তোমার সঙ্গে এতকিছু হয়ে গেল? কিন্তু বিশ্বাস করো দেখে একটুও বুঝা যায় না।’

– ‘এবার এই প্রসঙ্গ বাদ দেই।’

– ‘হু, দিলাম।’

– ‘আচ্ছা এটা বলো, আমরা কী লুকিয়ে বিয়ে করতে পারি না?’

– ‘বিয়ে করার এতো তাড়া কী?’

– ‘বিয়ে না করলে কী পুরোপুরি একজন আরেকজনকে পাব? আমি এখন চাইলেই কী তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে পারবো?’

মৃদুল কী বলবে ভেবে পেল না। সে গম্ভীর পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য ছল করে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

– ‘তাহলে এখনই বিয়ে করো, কারণ আমার এখনই তোমাকে খুব আদর করতে মন চাচ্ছে।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘বাবা তাই? তাহলে আদর করার অনুমতি দিলাম।’

– ‘জ্বি না ম্যাডাম, আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে ছাড়া আদর করতে চাই না।’

– ‘তাহলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করো।’

– ‘না আমি ধৈর্য ধরবো, আগে মা আর ইশিকে বের করি, তখন ওদের নিয়েই বিয়ে করবো।’

– ‘আচ্ছা আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি হুট করে ভালোবাসো বললে যে, এটা কীভাবে সম্ভব? তুমি কী আসলেই আমাকে ভালোবাসো?’

মৃদুল দমে যায়। তারপর হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলে,

– ‘ম্যাডাম আমার কাছে তো তুমি মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। আমার অবস্থান আমি জানি। তুমি রূপবতী তাও শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়ে। আমার ভালো না বাসার কারণ কী থাকতে পারে?’

– ‘এটাকে ভালোবাসা বলে না-কি?’

– ‘সিনেমা আর গল্পে বলে না, বাস্তব বলে।’

– ‘বাস্তব বলে মানে?’

– ‘এরেঞ্জ ম্যারেজ কীভাবে হয়? মেয়ের পড়ালেখা, রূপ আর ছেলের কেরিয়ার এগুলোই তো দেখা হয়। এগুলো দুপক্ষের মনমতো হয়ে গেলেই শেষ। তখন কী প্রেম-ভালোবাসার জন্য বাসর রাতে কিছু আঁটকে থাকে? এরপর সারাজীবন কী প্রেম-ভালোবাসা ছাড়াই সংসার টিকে? তাছাড়া আমি তো বেশ কিছুদিন থেকেই তোমাকে দেখি।’

– ‘বাবা কী যুক্তি, আচ্ছা যাক, আমাকে ভালোবাসো মানলাম। এখন বাতি বন্ধ করে এসে বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো আর তুমি আদর করবে। দ্বিতীয় কোনো কথার বা দ্বিধাদ্বন্দের স্থান নেই।’

মৃদুল কী বলবে ভেবে পেল না। সে নিজের উপর থেকেও কখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে বুঝতে পারছে না। মানহা বাতি বন্ধ করতে বিছানা থেকে উঠে গেল।

____ চলবে___

বাঁক ( ১১ পর্ব )
_____________

সুইচ টিপে দিতেই ঘরজুড়ে অন্ধকার নেমে এলো। মানহা ফিরে আসছে বিছানার দিকে। মৃদুলের মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। মেয়েটিকে সর্বনাশের পথ থেকে সে কীভাবে ফেরাবে? কোন অযুহাতে ওর থেকে দূরে থাকা যায়? সেইই বা এমন রূপবতী থেকে নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে? এতটা কাছাকাছি থেকেও মোমের মতোন গলে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতোন আদৌও সাধুপুরুষ কি সে? তবুও মানহাকে বিয়ে এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। আচ্ছা সবকিছু যদি খুলে বলে মানহাকে? যদি বলে আমি বিবাহিত? তাহলে কী এখানে কাজ, থাকা-খাওয়া, তার সমস্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা সহ মা আর বোনের সন্ধানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে মানহা? মৃদুলের তা মনে হয় না। মানহা ভেঙে পড়বে। তার প্রতি আগ্রহ হারাবে। আবার বলা যায় না উগ্রও হয়ে যেতে পারে। তাকে ভয় দেখাতে পারে। সত্য ঘটনা প্রকাশ করে দিতে পারে। কিন্তু এক সময় তো মানহা জানবে সে বিবাহিত। জানবে তার সঙ্গে প্রেমের নামে প্রতারণা করা হয়েছে। তখন কী হবে? মানহার পা ধরে মাফ চাইলে কী মাফ করবে? অবশ্য আরেকটা পথ খোলা আছে, পালিয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হওয়া। ইশি আর মা’কে নিয়ে বাটি অঞ্চলের কোনো একটা গ্রামে চলে যাবে। নতুন করে জীবন শুরু করবে। গরু কিনবে, চাষাবাদ করবে, মাছচাষ করবে। সময় করে ফাতিহাকেও রূপগঞ্জ থেকে রাতের আঁধারে তাদের কাছে নিয়ে যাবে।
মানহা বিছানায় এসে বসেছে টের পেল সে। খানিক পর পাশের বালিশ থেকে শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ ভেসে এলো নাকে। বাহুতে এসে আছড়ে পড়লো উষ্ণ শ্বাস।
মানহা কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

– ‘এভাবে শুয়ে আছো যে? বুকে একটু টেনে না নিলে মাথা রাখতে বুঝি আমার লজ্জা করবে না?’

– ‘অন্ধকার তো আছেই।’

– ‘তবুও।’

– ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মানহা। হাঁটুতে আঘাত পেয়েছি, তোমাকে কাঁধে করে নিলাম আনলাম। এখন ক্লান্ত লাগছে খুব।’

– ‘ওমা এতক্ষণ তো ভালোই দেখলাম।’

মৃদুল ঘুম ঘুম গলায় বললো,

– ‘হু, বাতি বন্ধ করায় রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এসেছে, শরীরেও প্রচণ্ড ব্যথা।’

মানহার বড়ো মায়া লাগলো। নারীত্ব মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ভাতের মাড়ের মতো বুদবুদ করে ভালোবাসা-মমতা উপচে পড়তে শুরু করলো।

– ‘তাহলে আজ পুরো রাত আমি তোমার শরীর টিপে দেবো।’

– ‘আরে না তুমিও ঘুমাও।’

‘উহু, এমন একটা রাত আমি ঘুমিয়ে কাটাবো না’ কথাটি বলে মানহা বিছানা থেকে উঠে মৃদুলের কাঁধ থেকে টিপে বাহুতে এলো। তারপর আলগোছে ঠেলে বললো,

– ‘আচ্ছা তুমি একটু উপুড় হয়ে ঘুমাও।’

মৃদুলে ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে যায়। মানহা ঘাড়, পিঠ, পা পর্যন্ত টিপতে থাকে। মিনিট তিরিশেক পর খুব ইচ্ছা হলো বাতিটা জ্বেলে সে দেখে দেখে টিপে দেবে। অন্ধকার ভালো লাগছে না একদম। মানুষটাকে একটুও দেখা যাচ্ছে না। মনহা আলগোছে বিছানা থেকে উঠে যায়, সুইচটা টিপে দেয়। ঘর ভরে যায় আলোয়। বিছানায় দৃশ্যমান হয় মৃদুলের নগ্ন পিঠ। খানিক্ষণ বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকে মানহা। তারপর নিজের কাছেই যেন লজ্জা পায়। দু’হাতে মুখটি ঢেকে নিজেকে বাঁধা দেয়। আবার নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখে ভালোবাসার মানুষটিকে। আচমকা মৃদুল পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকায়। মানহা আঁতকে উঠে লজ্জায় ঘুরে গেল। এটা কী হলো? এমন পাগলামি করতে কেন গেল সে? মৃদুলও আর সময় পেল না চোখ মেলতে? নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় সেও নাক গলাতে হলো? কী লজ্জা, এখন সে ওর দিকে তাকাবে কী করে?

মৃদুলের চোখ আঁটকে আছে মানহার নগ্ন পিঠের দিকে। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে আছে একপাশে। দেখা যাচ্ছে কোমরের উপরিভাগ। আতব চালের মতোন সাদা, মোমের মতোন মসৃণ। মধ্যখানের ছাই রঙের ব্লাউজের ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কালো চুল। নারী দেহের সমস্ত সৌন্দর্য, রহস্য যেন লুকিয়ে আছে মানহাতে৷ ফাতিহা তো এমন নয়? পরক্ষণেই আবার নিজেকে একচোট শাসালো। ফাতিহা যেমন হোক তোর স্ত্রী। মানহা পরনারী। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ‘কী হলো মানহা?’

– ‘তুমি হঠাৎ চোখ মেললে কেন?’

– ‘বাতি জ্বালালে কেন?’

– ‘ইচ্ছা হইছে তাই, আমি একশোবার জ্বালাবো।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে, কিন্তু ওইদিকে তাকিয়ে আছো কেন?’

– ‘তুমি চোখ বন্ধ করো আমি বিছানায় আসবো।’

– ‘কীসব পাগলামি করো তুমি বুঝি না।’

– ‘তোমার এতো বুঝার দরকার নেই চোখ বন্ধ করো।’

– ‘করেছি।’

– ‘আর একবারও খুলবে না এভাবে থাকো।’

– ‘আচ্ছা।’

মানহা বিছানায় এসে বসে পুনরায় বললো,

– ‘চোখ বন্ধ করে জবাব দেবে ঠিকাছে?’

মৃদুল স্মিত হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ম্যাডাম।’

– ‘তোমার ঘুম আসেনি?’

– ‘না।’

– ‘কেন?’

– ‘জানি না।’

– ‘তাহলে আমার কোলে মাথা দাও, আমি চুল টেনে দেবো, কপাল টিপে দেবো, দেখবে ঘুম আসবে।’

– ‘আচ্ছা।’

মানহা বালিশটা সরিয়ে নিজের কোলে ওর মাথা টেনে এনে এক হাতে চুলে আঙুলগুলো ডুবিয়ে আরেক হাত আলগোছে চোখের ওপর রেখে বললো,

– ‘চোখে আলো লাগবে না এবার ঘুমাও জনাব।’

মৃদুলকে বড়ো স্পর্শ করলো মানহার এমন ভালোবাসা, মমতা আর যত্ন। বুকের ভেতর শুরু হলো সংগ্রাম। নিজেকে বড্ড পাষাণ, নির্দয় মনে হচ্ছে৷
এভাবেও ভালোবাসতে পারে বুঝি মানুষ? এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে সবকিছু ভুলে মানহাকে বুকে টেনে নিতে। সেও বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে চেয়েছিল। কিন্তু ফাতিহার সঙ্গে এমন অবিচার সে করবে কীভাবে?
সেই যে সতেরো বছর আগে রূপগঞ্জ পালিয়ে গিয়ে দাদাভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর থেকে তো পরম বন্ধু ফাতিহাই তার। মনে আছে একবার দাদাভাই হাওড়ে ফুল, শসা, মরিচ, টমেটোর চাষ করেছিলেন। সেখানে পাহারা দেয়ার জন্য নাড়া দিয়ে ছোট্ট ঘর বানানো হয়। থাকবে একা মৃদুল। রাত-দিনের বেশিরভাগ সময়ই তার ওখানে থাকতে হতো। প্রথম কিছুদিন ভালোই লেগেছে। এরপরই বিরক্ত লাগা শুরু হয়। দিনে শুধু দাদাভাই আর কাজের লোক বাগানের এটা-সেটা কাজ কর‍তে আসতো। রাতে আবার হারিকেনের আলোয় মশারির ভেতরে সে একা।
দিন রাতের অদল-বদল বড়ো চোখে পড়তো তখন। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি আরও কত রঙ বদল। ফাতিহা স্কুল শেষে ভাত নিয়ে যায়। ওর জন্যই সারাদিন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে সে। ফাতিহা গেলে দু’জন লুডু খেলা, দৌড়াদৌড়ি, মারামারি আর খুনসুটিতে মেতে উঠে কেটে যেত বেলা। ফুল গাছগুলো এক সময় বড়ো হয়। বাগানে নানান ধরনের নানান রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। একেকটা ফুল যেন মানুষকে দেখলেই মিটমিট করে হাসে। চারদিক এক অদ্ভুত দীপ্তময় হয়ে উঠে, স্বর্গীয় দ্যুতি বিরাজ করে। বাতাসে মিশে যায় পুষ্পের অপার্থিব ঘ্রাণ। ফাতিহা তখন স্কুল ফাঁকি দিয়ে ছুটে আসে ফুলের টানে। ফুরফুরে বাতাসে বাগান ভরা ফুল নৃত্য করতে থাকে। সে আর ফাতিহা তখন শুরু করতো লুকোচুরি খেলা। লুকানোর জায়গা বিশাল বিস্তৃত বাগানের কোনো এক সরু আলে শুয়ে পড়া।
ওয়াজের সময় তার সঙ্গে মেলায় গিয়ে দুই হাত ভরে রঙিন চুড়ি কিনে আনা৷ বাড়ির সবার কড়া নিষেধ থাকার পরও লুকিয়ে পূজায় গিয়ে দেরি করে বাড়ি ফিরে বকা খাওয়া। এরকম কত সহস্র স্মৃতি এই ফাতিহার সঙ্গে। তারপর কী হলো? এক দূর্ঘটনার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফাতিহার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পুরো জীবনের জন্য সঙ্গী করে নিল সে। অথচ আদৌও তারা এর আগে একে ওপরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে ভাবেনি। দু’জনই আট-দশটা সমলিঙ্গের বন্ধুর মতোই ছিল। তবুও বিয়ের পর দু’জন দু’জনকে সর্বোচ্চ সুখী করার চেষ্টা করেছে। মৃদুলও ফাতিহার দূর্বলতায় ঘুণাক্ষরেও আঘাত করেনি। শুধু দাদাভাই আশ্রয় দিয়ে বিশ্বাস করে আঘাত পেয়েছিলেন৷ তবুও মৃদুলের দয়া-মায়ার শরীর। ফাতিহার জন্য সকল অপবাদ মেনে নিয়েছিল৷ সকলের তির্যক কথাবার্তা হজম করেছিল। ফাতিহার সঙ্গে বেঁধেছিল ঘর। এখন কী মানহার মতো রূপবতীর, মায়াবতীর আমন্ত্রণে সেই সম্পর্কের বাঁধনে চির ধরতে শুরু করেছে?
কিন্তু মানহার সঙ্গেই বা সে এখন কী করছে? প্রেমের অভিনয়? প্রতারণা? হয়তো অবিবাহিত হলে মানহাকে সে ফিরিয়ে দিত না৷ কিন্তু এখন যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই তার স্বপ্ন দেখানো কী ঠিক হচ্ছে মানহাকে? সে তো এমন মানুষ নয়। অন্যের দোষ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর লোক। কিন্তু এবার সে একটু প্রতারণা করবে। বড়ো ক্লান্ত লাগছে। এবার কেউ তার দ্বারা একটু প্রতারিত হও। একটু নির্দয়, পাষাণ হতে ইচ্ছা করছে।

‘ঘুমিয়ে গেছো না-কি?’ আস্তে আস্তে ডেকে মানহা পরীক্ষা করে মৃদুল ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না। সেও বুঝতে পেরে জবাব না দিয়ে ভান ধরে রইল। মানহা তার চোখের পাতায় বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে পুরো মুখে হাত বুলিয়ে এনে আবার ঠোঁটে বুড়ো আঙুল রাখে।

____চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here