বাঁক,১২,১৩

0
206

বাঁক,১২,১৩
জবরুল ইসলাম
( ১২ পর্ব )


ইশি এখন তার মা’কে নিয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে আছে। সঙ্গে এসেছে আমজাদ। ট্রেনের টিকিটও কেটে দিয়েছে। সেদিন হোটেলে নিয়ে ইশির দেহ ভোগ করতে ব্যর্থ হলেও সে পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছে৷ আজ কলোনি থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে বললো,

– ‘ইশি দাঁড়াও আমি আইতাছি, তোমাদের স্টেশনে দিয়া আসি।’

ইশি কিছু বলেনি। কারণ আমজাদের দিকে তাকালেই তার লজ্জায় ঘৃণায় শরীর ‘রিরি’ করে। এই লোকটিই তো তার নগ্ন স্তন দু’টো জোর করে দেখেছে, নাক ডুবিয়েছে। সেলোয়ারও টেনে খুলে ফেলতো যদি কোনো এক দৈব ইশারায় ইরফান ভাইয়ের কল না আসতো।
আমজাদ তখন সেলোয়ারের গিঁট খুলতে ব্যস্ত। ইশি আশা ছেড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলছে।
তখনই বিছানায় রাখা ইশির ভ্যানিটিব্যাগে মোবাইল বেজে উঠে। আমজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো,

– ‘এই সময় আবার কেটা কল দিলো।’

ইশি নিজেকে ছাড়িয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই আমজাদ টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে বললো,

– ‘এইটা কার নাম্বার?’

– ‘জানি না, সেভ নাই দেখছোই তো।’

আমজাদ কল কেটে দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখে মোবাইল। ইশিকে পুনরায় পেছন থেকে টেনে নিয়ে বুকে এক হাত রেখে পিঠে নাক ঘষে। বিছানায় রাখা মোবাইলের স্ক্রিন আবার জ্বলে উঠে মেসেজ টিউনে।
আমজাদ ফোন হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে ওর কাছে দেয়। ইশি মেসেজ ভিউ করে পড়ে ‘আমি সুন্দর পুরের ইরফান, কল রিসিভ করো।’
বিস্মিত হয়ে যায় ইশি। এতোদিন পর ইরফান ভাইয়ের কল দিল কেন? সে নাম্বারই বা পেল কোত্থেকে? ইরফান ভাই কী মৃদুল ভাইকেও এভাবে পেয়ে গেছে? সে তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘ইশি বলছো?’

– ‘হ্যাঁ ভাই, তুমি কোত্থেকে? নাম্বার কীভাবে পেলে?’

– ‘আগে বলো আন্টির কী অবস্থা?’

– ‘এখন ভালো কিছুটা, তবে এখনও হসপিটাল আছে, কিন্তু তুমি এসব জানো কীভাবে।’

আমজাদ বিরক্ত হয়ে ফোন টান মেরে নিয়ে নিল। ইশি শুরু করলো টানাটানি ‘প্লিজ আমজাদ ভাই ফোনটা দেন জরুরি কল এটা।’
আমজাদ ছাড়ছে না। সে কেটে দিল কল। মোবাইল বিছানায় ছুড়ে ফেললো। ইশিকে টেনে নিল নিজের কাছে। শুরু হলো দু’জনের ধস্তাধস্তি। ইরফান আবার কল দেয়। ইশি আমজাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মোবাইল হাতে তুলে রিসিভ করে।

– ‘ইশি কে এমন করছে? তুমি কোথায় এখন? কোনো সমস্যা? বলো আমাকে।’

ইশি কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– ‘আমি বিপদে আছি ভাই। তুমি কী আমাকে বারো হাজার টাকা দিতে পারবে? মায়ের চিকিৎসার জন্য ঋণ করেছিলাম। লোকটি এখন টাকার জন্য আমাকে হোটেলে নিয়ে এসেছে।’

আর কিছু বলতে হলো না ইশির। ইরফান বুঝে গেল সবকিছু।
সে শান্ত স্নিগ্ধ গলায় বললো ওর কাছে মোবাইলটা দাও।
আমজাদ চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে।
ইশি ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘কথা বলো।’

আমজাদ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বললো,

– ‘হ কন কি কইবেন।’

– ‘আপনি ওর কাছে কত টাকা পান?’

– ‘পনেরো হাজার।’

– ‘ও তো বললো বারো হাজার।’

– ‘ও খানকি তো বেইমান্নী মিয়া ভাই।’

– ‘একদম গালাগাল করবেন না। আপনাকে পনেরো হাজার না, বিশ হাজার দেয়া হবে। মেয়েটিকে নিরাপদভাবে বাসায় দিয়ে আসুন। আর যদি কোনো ক্ষতি হয় এর পরিণাম ভালো হবে না।’

– ‘না না ক্ষতি করমু কেন? আমার টাকা পাইলেই হইব। তাইলে কথা রইল বিশ হাজার টাকা দিয়া পাঠাইবেন। আমি বিকাশ নাম্বার দিতাছি মেসেজে।’

– ‘আচ্ছা, আর মোবাইল দিন ওর কাছে।’

ইশি মোবাইল হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। নিজেকে অনেক হালকা লাগছে।
ভাবতেই পারেনি আজ নিজেকে রক্ষা করতে পারবে।

– ‘ইশি কান্নাকাটি না করে এখন বাসায় যাও। আমি পরে আবার কল দিয়ে কথা বলবো, ঠিকাছে? আর আমার নাম্বারও সেভ দিয়ে রাখবে।’

– ‘আচ্ছা ভাই।’

আমজদ ইশিকে টেনে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

– ‘এতো কাঁদতাছো কেন কও তো ইশি? আমারে ভয় পাওনের কিছু আছে? আমি জোর করে জীবনেই কিছু করতাম নাকি বেয়াক্কেল। তোমারে দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছা জাগে এইটুকুই। আইচ্ছা চলো, বাসায় চলো।’

ইশি চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়। সেলোয়ার-কামিজ ঠিকঠাক করে পরে মাথায় ওড়না দেয়। তারপর ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,

– ‘চলো।’

আমজাদ দরজা খুলে দেয়, ইশি লজ্জায় ওড়না দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে হোটেল থেকে বের হয়।

– ‘ইশি ভদ্রলোককে আমার বিকাশ নাম্বার দিয়া দেও, অপেক্ষা করতেছে মনে অয়।’

– ‘কিন্তু আমি তো তোমার থেকে বারো হাজার নিয়েছি, পনেরো বললে কেন?’

– ‘আরে ওইটা রাগের মাথায় বইলা দিছি।’

– ‘তাহলে এখন উনাকে বলি বারো হাজার দিতে।’

– ‘আরে বাদ দাও, উনিও দিবে বইলছে। তাছাড়া আমি যেইটার জন্য টাকা দিলাম তা পাইলাম না। একটু বেশি নিলে ক্ষতি কি কও।’

ইশি কোনো জবাব দিলো না। আমজাদ আবার তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘আমার নাম্বারটা দিয়া দেও ইশি।’

– ‘লাগবে না, আমার নাম্বারে বিকাশ আছে। এটাতে ছাড়তে বলে দেবো। তারপর আমিই ক্যাশআউট করে তোমাকে দেবো।’

কথাটি বলে সেখান থেকে ইশি হসপিটাল চলে যায়। পরেরদিন মা’কে নিয়ে হসপিটাল থেকে কলোনিতে ফিরে। এরপর নিয়মিতই ইরফানের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। নানান বিষয়ে কথা হতো। তার এখানকার বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে একদিন ইরফান বললো, ‘আন্টি আরেকটু সুস্থ হলে তাকে নিয়ে তুমি সিলেটে চলে আসো, এখানে আমি কাজ দেখে দেবো তোমাকে।’

সেই থেকেই চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় ইশি। সমস্যা হচ্ছিল তার মা’কে নিয়ে। পেটে সদ্য সেলাই নিয়ে ট্রেনে এতোদূর যাওয়া ঝুঁকি হয়ে যাবে। তাই আজ প্রায় পনেরো দিন পর ভোরে সে সিলেটের উদ্দ্যশ্যে বের হয়েছে। এখান থেকে ট্রেন ছাড়বে নয়টায়। আর বেশি সময় বাকি নেই। ট্রেন চলে এসেছে প্লাটফর্মে। মানুষ ধীরে ধীরে সিটে গিয়ে বসে পড়ছে। ইশি মা’কে ধরে ধরে ট্রেনে নিয়ে উঠে। সৌজন্যতাবোধ থেকে আমজাদকে মুচকি হেঁসে বিদায় জানিয়ে বলে,

– ‘যাচ্ছি ভাই দোয়া কইরো।’

আমজাদও মুচকি হেঁসে চলে যায়। ইশি মা’কে নিয়ে নিজের সিট খুঁজে বের করে বসে। সিট জানালার পাশেই। খানিক পর ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ধীরে ধীরে ছুটতে শুরু করে। আমজাদ আবার কোত্থেকে এসে ইশির সামনে একটা প্যাকেট ধরলো।

– ‘কী এটা?’

– ‘গরম গরম শিঙারা নিয়া আইলাম।’

– ‘এখন এগুলো নিয়ে আসছো কেন? ট্রেনও ছেড়ে দিছে তো।’

– ‘হ ছাইড়া দিছে আমিও দেখছি।’

– ‘মানে? তুমি নামবে কীভাবে?’

আমজাদ ‘খ্যাক-খ্যাক’ করে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘আরে আমারও সিলেটে কিছু কাজ আছে। যাইব যাইব করে যাওন হয় না৷ ভাবলাম তুমিও চাচিরে একা নিয়া যাইবা। তাই এক লগেই যাই টিকিটও তিনটা কাটছিলাম।’

ইশি কোনো জবাব না দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমজাদের মতলব কী সে বুঝতে পারছে না। তাকে বারো হাজারের জায়গায় পনেরো হাজার সে নিজে তুলে দিয়েছে। যদিও বারবার বিশ হাজার দাবি করছিল। ইরফান না-কি বলেছে কোনো ক্ষতি না করলে তাকে বিশ হাজার টাকা দেবে। কিন্তু ইশি দিতে দেয়নি৷ কারণ এমনিতেই তিন হাজার বেশি দেয়া হয়েছে। আমজাদও মেনে নিয়েছে হাসিমুখে। এখন কী মতলব এঁটেছে বুঝতে পারছে না ইশি।
‘শিঙারা খাই না’ বলে প্যাকেট ঠেলে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে সে।
যাত্রাটা বোধহয় খুব একটা সুখকর হবে না। তপ্ত রোদ উঠেছে। ট্রেনের গতি বাড়ছে। বাড়ি-ঘর, গাছগাছালি, বন্ধ দোকান, গরু-ছাগল, পথচারি সবকিছু কেমন উলটো দিকে দ্রুত ছুটে চলে যাচ্ছে।

– ‘ইশি খাইবে না তাইলে চাচি আপনে নেন একটা শিঙারা। গরম গরম আছে ভালা লাগবো।’

ইশি বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আমজাদের হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মা’কে বললো,

– ‘এই লোক কিছু দিলে খাবেন না।’

আমজাদ অবাক হয়ে বললো,

– ‘এ কি কও ইশি? আমি দিলে খাইব না কেন? আমি অপরিচিতনি তোমাদের? আমরা এক লগেই তো যাচ্ছি।’

– ‘তুমি বাড়াবাড়ি করবে না। নিজের কাজে যাচ্ছ যাও, আমাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক প্ল্যাটফর্মেই শেষ।’

– ‘কি কও না কও ইশি। আইচ্ছা যাও, তোমার মনে অয় মন মেজাজ ভালা না। এখন কথা কইতেছি না।’

ইশি কোনো জবাব দিলো না। আবার বুকে হাত বেঁধে বাইরে তাকালো। এভাবে ঘণ্টা কয়েক চলে গেছে। ইশির মা বললেন বাথরুমে যাবেন। ট্রেনও একটু শ্লথ গতিতে যাচ্ছে। হয়তো সামনে কোনো স্টেশন আছে। ইশি এক হাতে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে অন্যহাতে মা’কে ধরে ধরে টয়লেটে দিয়ে দরজা আঁটকে বাইরে দাঁড়ায়। তখনই তিনটা ছেলে তার দিকে এসে ফিসফিস করে বললো,

– ‘চিল্লাচিল্লি না করে ব্যাগ দে না হয় চাকু পেটে ঢুকিয়ে দেবো।’

ইশি তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি একজন চাকু পেটের সামনে ধরে রেখেছে। সে চিৎকার দিতে যাবে তখনই একজন মুখটা চেপে ধরলো। আরেকজন ভ্যানিটিব্যাগ ধরে টান দেয়। কিন্তু ইশি শক্ত করে ধরে রাখে ব্যাগ। পলকেই তৃতীয়জন হাতে চাকু চালিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। ঠোঁটের মতো ‘হা’ হয়ে যায় চামড়া। ইশি হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করে বসে পড়ে। ট্রেনের গতি কম থাকায় ছেলেগুলো ব্যাগ নিয়ে নিমিষেই যেন উধাও হয়ে গেল। ভেতর থেকে মা কিছু একটা টের পেয়ে দরজা খুলে দেখলেন ইশির হাত থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।

___চলবে___

বাঁক ( ১৩ পর্ব )
____________

রক্ত দেখে নেহারা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

– ‘কী করে হলো রে? কী হইছিল বাইরে?’

– ‘মা অস্থির না হয়ে আমার ওড়না নিয়ে হাতটা বাঁধো।’

ততক্ষণে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে আমজাদও এদিকে ছুটে এলো।

– ‘আরে এইগুলা কীভাবে হইল। চাচি আপনে সরেন ওড়না দিয়া হইব না।’

তারপর তার লুজ প্যান্টের পকেট থেকে লাল রুমালটি বের করে শক্ত করে হাত বেঁধে দিয়ে লোকদের বললো,

– ‘দেখি পথ ছাড়ইন আপনেরা, পথ ছাড়ইন। ইশি তুমি হাঁটো, আমি চাচিরে ধইরা নিয়া আইতেছি।’

ইশি বসা থেকে উঠতে গিয়ে চোখ যেন ‘ঝিরঝির’ করে আবার ঠিক হয়ে গেল। সে আহত হাতটি ওপর হাত দিয়ে চেপে ধরে সামনের দিকে হাঁটে। রক্ত এখনও বন্ধ হয়নি। রুমাল ভিজে গেছে। ট্রেন ধীরে ধীরে পুনরায় চলতে শুরু করেছে৷ ছোট্ট স্টেশন ক্রমেই উলটো দিকে ছুটে চলে যাচ্ছে। এদিকে ইশির হাতের ব্যথা ছাপিয়ে মাথায় এখন একটা চিন্তাই ঘুরছে। ভ্যানিটিব্যাগে মোবাইলটাও ছিল। এখন সে ট্রেন থেকে নেমে ইরফান ভাইকে পাবে কীভাবে? নাম্বার তো মুখস্থ করা হয়নি। মোবাইলে কেবল সেভ করে রেখেছিল। স্টেশনের ভিড়ে পরিচিত মানুষকেও তো খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইরফান ভাইকে দেখে সে কীভাবে চিনবে? তারা দু’জনই তো সতেরো বছর আগে কত ছোট্ট ছিল। আচ্ছা ইরফান ভাই কী এতো মানুষের ভিড়ে মা’কে দেখতে পাবে? দেখলে নিশ্চয় চিনতে পারতো।

– ‘আমজাদ ভাই তোমার কাছে কী ইরফান ভাইয়ের নাম্বার আছে?’

– ‘সে আবার কেটা?’

– ‘যে ওইদিন টাকা দিল।’

– ‘না, উনাকে তো আমার নাম্বার দেওনি। তুমি নিজেই টাকা তুইলা দিলা আমারে।’

ইশি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিটে বসে হাতটা আস্তে করে কোলে রেখে৷ টিকিট কাটার পর ব্যাগে একশো তেরো টাকা ছিল৷ মোবাইল টাকা সবকিছুই গেল। এখন সারাদিন কী না খেয়ে থাকবে?

– ‘আমজাদ ভাই ট্রেন সিলেট যেতে কতক্ষণ লাগবে?’

আমজাদ আঙুলের কর গুনতে গুনতে বললো,

– ‘বারো-তেরো ঘণ্টা লাগবো, যাইতে যাইতে মনে করো সন্ধ্যা সাতটা হইব।’

ইশির গলা শুকিয়ে গেল। এতটা সময় মা না খেয়ে থাকবেন কীভাবে? ওষুধ খেতে হলেও তো কিছু খাওয়া দরকার। শেষপর্যন্ত কী আমজাদের উপর ভরসা করতে হবে? কিন্তু এই লোকের সাহায্য নেয়া মানেই বিপদে পড়া। দেশের একশোজন ঠাণ্ডা মাথার ছ্যাঁচড়া মানুষের তালিকা করলে সে থাকবে। না থাকলে ওই তালিকা সঠিক না। কিছু মানুষের পেশাই হয় দরিদ্রদের ঠকিয়ে খাওয়া। যেমন গ্রামের মেম্বার।
আমজাদ অবশ্য মেম্বার না। তবুও দরিদ্রদের সঙ্গে তার নানানভাবে ওঠা-বসা। দুনিয়ার সব দালালির কাজ সেইই পায়। জমির দালালি, বিয়ের ঘটকালি, নানান কোম্পানির ছোটখাটো চাকুরি, পতিতালয়ের খদ্দরের দালালি সবকিছুতেই তার হাত আছে। বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই যা সে চিনে না। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তার পরিচিত কেউ নেই। ট্রেন স্টেশন অনেক দূরে এবং টিকিট কাটাও ঝামেলার তাই কলোনির সবার ট্রেনের টিকিটও আগ্রহ নিয়ে সে কেটে দেয়।

গতকাল ইশিকে এসে বললো,

– ‘তা চলে যাইবা তো বুঝলাম, ট্রেনের টিকিট কী কাটছো?’

ইশি বললো,

– ‘গিয়ে কাটবো।’

সে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে ‘খ্যাক-খ্যাক’ করে হেঁসে বললো,

– ‘পাগল হইছনি? গিয়া কাটবা মানে? টিকিট কাটা বহুত ঝামেলার। আমি থাকতে অসুস্থ মায়েরে নিয়া কেন করবা কও? এর চাইতে আমি একটা কল দিয়াই কাজ খালাস কইরা দিমু। আমার পরিচিত মানুষ আছে স্টেশনে। নাম্বার দিমু গিয়া শুধু কল দিবা সে হাতে টিকিট আইনা দিব।’

ইশি এর আগে বাসে এসেছিল। ট্রেনের সবকিছু জানে না। তাই ভাবলো নিজ থেকে যখন বলছে তার ক্ষতি কী? তাই সেও বললো,

– ‘আচ্ছা ভাই তাহলে কেটে দেন।’

– ‘কোনটায় যাইবা। তিন শ্রেনীর সিট আছে তো।’

– ‘কম টাকায় যেটা সেটাই কাটেন।

আজ স্টেশনে আসার পর বললো,

– ‘এক হাজার টাকা দাও টিকিট এনে দিচ্ছি।’

ইশি টাকা বের করে দিলো। খানিক্ষণ পর দু’টা টিকিটের সঙ্গে একশো টাকা এনে ফেরত দেয়। তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের দামও না-কি ৪২০ টাকা করে। অথচ ইশি আড়ালে একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে ৩৭৫ টাকা। এই হলো আমজাদ। ইশি জানে তার কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে হজম করা এতো সহজ না৷ সবকিছুর পেছনে তার কিছু একটা মতলব থাকবেই। কিন্তু এখন আর কী করার? না খেয়ে থাকবে না-কি আমজাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করবে?
ইশি আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আমজাদ ভাই, দুইশো টাকা ধার দিতে পারবে?’

আমজাদ অবাক হয়ে বললো,

– ‘এইটা কি কইলা ইশি? আমরা এক লগে যাচ্ছি। তোমার ব্যাগ ছিনতাই হইছে এখন তোমার সকল দায়িত্ব আমার। ধার করবা কেন? তোমার কি লাগবো আমারে শুধু কইবা।’

ইশি বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘এতো কথা না বলে ধার দিতে পারবে কি-না বলো। আমার কাছে ভালো মানুষ সাজতে আসবে না।’

আমজাদ আহত গলায় বললো ‘ইশি তুমি কইলাম আমারে ভুল বুঝতেছো’ তারপর চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘ওই দিনের ঘটনার জন্য খারাপ ভাবতেছো তাই না? এইগুলা কোন পুরুষ মানুষ একটু আধটু করে না কও দেখি? তাও আমি তোমারে বিপদের কালে টাকা দিয়েছিলাম। জোর করে তো কিছু করতে চাইনি।’

ইশি বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘তুমি আমার কাছ থেকে সরে বসো। আর এসব ফালতু কথা আমার সামনে কখনও তুলবে না। তাছাড়া তুমি শুধু বদমাইশ না, বাটপারও।’

– ‘ছি ছি, তওবা তওবা, আল্লা তালার আরশ কাঁইপা উঠবো ইশি। আমি বাটপারি কি করলাম কও দেখি।’

আমজাদের কাণ্ড দেখে ইশি রাগে টিকিটের টাকার কথা বলে ফেলতে যাচ্ছিল। তারপর আবার মনে হলো আমজাদকে যে টিকিট কেটে দিয়েছে সেও তো কাজটা করতে পারে। তাই আর জবাব না দিয়ে সে চুপচাপ বসে রইল।

– ‘ইশি রাগারাগি কইরা কি হইব কও? আর শিঙারা নিজেও খাচ্ছ না চাচিরেও খেতে দিতাছো না। এতদূর কি না খাইয়া যাইবা নাকি বেয়াক্কল।’

তারপর আবার প্যাকেট থেকে শিঙারা একটা বের করে ইশির দিকে দিয়ে বললো,
– ‘নেও, আরে নাও না নেও।’

ইশি খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল। আমজাদ নেহারা বেগমকেও একটা দিয়ে বসে আবার উঠে বললো,

– ‘ইশি কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ নেও। এক টুকরা পেঁয়াজ মুখে নিয়া শিঙারায় কামড় দিবা। তারপর কাঁচা মরিচে আরেকটা কামড়। দেখবা অত্যন্ত সুস্বাদু লাগবে।’

ট্রেন সিলেট পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই। চারদিকে বাতি জ্বলছে। মানুষে গিজগিজ করছে। আমজাদ নেহারা বেগমকে ধরে বললো,

– ‘উঠো চাচি, আর ইশি তুমি হাঁটো আস্তে আস্তে। দেইখো হাত কোথাও লাগলে রক্ত বাইর অইব।’

– ‘না, তুমি কোথায় যাবে যাও, আমরা এখন যেতে পারবো।’

– ‘চুপ থাকো তো ইশি, বাচ্চামি করতাছো শুধু, আমি কি কইরা এখন তোমাদের রাইখা যাই? টাকা পয়সা মোবাইল কিচ্ছু নাই। ওই লোকের কাছে দিয়া তারপর আমি যাইমু।’

ইশি আর কিছু বললো না৷ তারা ট্রেন থেকে নেমে গেল। চারদিকে মানুষ ছোটাছুটি হৈচৈ করছে। এতো মানুষের মধ্যে ইরফান ভাই কে হতে পারে? আমজাদ নেহারা বেগমকে একটা জায়গায় বসিয়ে এসে ইশিকে বললো,

– ‘ভদ্রলোককে পাইছো?’

‘না’ বলে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মা বসে আছেন। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে নেহারা বেগমকে ধরে দাঁড় করিয়ে বললো,

– ‘এদিকে আসো।’

তারপর মাঝখানে গিয়ে মা’কে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

– ‘এ কি করতাছো ইশি? চাচিকে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়াইতাছো কেন? কারও লগে ধাক্কা লাগলে তো পাইড়া যাইব।’

ইশি কোনো জবাব দিল না। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভেতর গুলিয়ে কান্না আসছে। যদি ইরফান ভাইকে না পায় সে এখন অসুস্থ মা’কে নিয়ে কোথায় যাবে? কোথায় থাকবে, কীভাবে খাবে? মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে বলে মানুষ বকাবকি করে যাচ্ছে। ইশি কারও কথায় কান দিচ্ছে না। ‘উফ’ বলে পেছন ফিরে তাকায়। একজন মধ্যবয়সী গোঁফওয়ালা লোক অন্যদিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। অথচ স্পষ্ট সে টের পেয়েছে ভিড়ের মধ্যে কেউ তার নিতম্ব টিপে ধরেছিল। ধীরে ধীরে স্টেশন খালি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। কোথাও ইরফান ভাই নেই। কিংবা আছে সে চিনতে পারছে না৷ শরীর কেমন যেন করছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মা’কে নিয়ে গিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে কান্নায়।

– ‘কাঁদতাছিস কেন রে মা?’

– ‘ইরফান ভাইকে তো পেলাম না মা? এখন কী করবো?’

– ‘আমজাদ বাবাজী তো আছে।’

– ‘হ চাচি, আমি তো আছি। তুমি কান্নাকাটি বন্ধ করো তো ইশি। আরেকটু সময় দেইখা লও লোকটারে পাও কিনা। তারপর স্টেশন থাইকা বাইর হয়ে তোমার হাত ব্যান্ডেজ করান লাগবো।’

ইশি কিছুই ভাবতে পারছে না। আমজাদের উপর তার কোনো ভরসা নেই। কিন্তু এখন সে কী করবে অসুস্থ মা’কে নিয়ে? একটা টাকাও নেই যে সাথে? খানিক্ষণ এখানে বসে থাকার পর আমজাদ বললো,

– ‘ইশি চলো তো আর কতক্ষণ এইখানে অপেক্ষা করবা? রাইতও অনেক হইয়া গেছে। তাছাড়া তোমার হাতেও সমস্যা হইব এইরকম থাকলে।’

ইশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। তাই আমজাদের কথায় উঠে দাঁড়াল। বের হয়ে এলো স্টেশনের বাইরে। আমজাদ একটা সিএনজি ডেকে বললো,

– ‘ব্রিজের অইপারে যাইবা?’

– ‘অয় যাইমু।’

নেহারা বেগমকে ধরে গাড়িতে তুলে ইশিকে বললো,

– ‘দাঁড়াইয়া আছো কেন? উঠো তো।’

ইশি উঠে বসলো মায়ের পাশে। ড্রাইভার গাড়ি টান দিলো। খানিক পরেই উঠে এলো সুরমা নদীর কিন ব্রিজে। আমজাদ উৎসাহ ভরা গলায় বললো,

– ‘ডাইভার সাব এইটাই তো সুরমা নদী?’

– ‘অয়।’

– ‘এই নদী দিয়াই তো শাহজালাল সাব জায়নামাজ দিয়া পারি দিছিলা? আল্লার ওলীর কী কেরামত দেখছুইন্নি ড্রাইভার সাব।’

– ‘অয় অয় ভাই।’

আরেকটু এগুতেই আমজাদ দিগুণ আগ্রহ নিয়ে বললো,

– ‘এইতো দেখা যাইতেছে আলী আমজাদের ঘড়ি। আহা আমার নামে নাম বুঝলেন ড্রাইভার সাব।’
তারপর দু’জনের গল্প জমে উঠলো।

খানিক্ষণ পর সিএনজি থেকে নেমে তারা একটা ফার্মেসির সামনে দাঁড়ায়। ইশিকে নিয়ে ফার্মেসি থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে বের হতেই এশার আজান শোনা গেল। ইশি এখন ভেবে পাচ্ছে না কোথায় যাবে। আমজাদ ততক্ষণে ইতিউতি করে বললো,

– ‘ইশি আমার এইখানে এক আপার বাড়ি আছে৷ যাইবা আমার লগে?’

ইশির নিশ্চিত মনে হচ্ছে আমজাদ কোনো একটা মতলব এঁটেছে। সুতরাং ওর সঙ্গে সে যাবে না। সার্কিট হাউজের পেছনের জালালাবাদ পার্ক দেখা যাচ্ছে। এখানে আরও একবার দিনে সে মা’কে নিয়ে বসে ছিল। আজ রাত এখানে বসে কাটিয়ে দেবে। অথবা এখানে জিরিয়ে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শাহজালাল মাজারে গিয়ে রাত থাকবে। দিনে যা হয় হবে।

– ‘আমজাদ ভাই তুমি অনেক হেল্প করছো এবার চলে যাও। আমার বাড়ি হবিগঞ্জ, সিলেটে আমি আগেও এসেছি। তোমার আর কষ্ট করা লাগবে না।’

আমজাদ নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,

– ‘পাগলামি কইরো না তো ইশি। হবিগঞ্জ আরেক জেলা। সিলেট টাউনে কেউ আছেনি তোমার? কই যাইবা রাইতে তুমি? খাইবা কী?’

ইশি কোনো জবাব না দিয়ে রাস্তা পার হয়ে মা’কে নিয়ে পার্কে ঢুকে গেল। আমজাদ মুখ ভার করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ইশি পার্কে ঢুকে দেখলো চারদিকে আবছা আলো। সরু পাকা পথের চারধারে ঝোপঝাড়। খানিক পর পর পাকা করে বসার জায়গা। ইশি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে খালি জায়গা দেখে বসে গেল। তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো চারদিকে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে-বুড়োরা চুপচাপ বসে আছে। কোথাও দু’জন গাছের আড়ালে থেকে চারদিকে তাকাচ্ছে। কোথাও বসার জায়গা অন্ধকারে থাকায় দু’জন জড়াজড়ি করে বসা। ইশি কিছুই বুঝতে পারছে না এখানে কী হচ্ছে। খানিক পর আমজাদ আবার কোত্থেকে এসে ইশির পাশে বসলো। তারপর চারদিকে তাকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– ‘বলছিলা না এই শহরে আগেও আইছিলা? তাইলে এই পার্ক যে সন্ধ্যা থাইকা সমকামিদের হইয়া যায় তা কী জানতা?’
তারপর আবার ফিক করে হেঁসে বললো, ‘ফেইসবুকে সমকামীদেরও আজকাল প্রেম হয় আর এইসব জায়গায় দেখা করে।’

ইশি কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ উঠে গেল। মা’কে নিয়ে মাথা নীচু করে বের হলো পার্ক থেকে। আমজাদ পিছু পিছু এসে নেহারা বেগমকে বললো,

– ‘চাচি ওরে বুঝান তো, এই রাইতে এমুন ঘাড়ত্যাড়ামি কইরা কই যাইব? তুমি অসুস্থ, সে যুবতী মাইয়া, কখন কী বিপদ বলা যায়?’

নেহারা বেগমও বিরক্ত হয়ে বললেন,

– ‘হ রে মা, চলনা আমজাদ কই যাইতে কয় যাই।’

ইশি খানিকক্ষণ ইতিউতি করে বললো,

– ‘তোমার বোনের বাড়ি কোথায়?’

– ‘ওসমানী মেডিক্যালের ওইদিকে গিয়া আরেকটা ভার্সিটি আছে নাম কি যেন মনে নাই, ওইদিকে আরেকটু গেলে আবার সুরমা নদী পাওন যায়। সেখানে খেয়াঘাট আছে। খেয়া কইরা ওইপারে গেলে কান্দিপুর, কান্দিপুর আমার এক বইনের বাড়ি আছে। গেলে বড়ো আদর-যত্ন করে।’

ইশি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আমজাদ কোনো জবাব না পেয়ে বললো,

– ‘তাইলে আমি গিয়া একটা সিএনজি আনতাছি। তোমরা এইখানে দাঁড়াও।’

আমজাদ তাড়াতাড়ি সামনে গিয়েই একটা সিএনজি নিয়ে এসে বললো,

– ‘উইটা পড়ো।’

ইশি মা’কে নিয়ে উঠে বসে। সিএনজি চলতে শুরু করে। সিএনজি নানান সরু অলিগলি পেরিয়ে যাচ্ছে। ইশি কিছুই চিনতে পারছে না। তবে মনে হচ্ছে সিলেট শহরের পশ্চিম আর উত্তর দিকে যাচ্ছে। অনেক্ষণ পর সিএনজি থামে।

– ‘এইতো খেয়া ঘাটে আইসা পড়ছি, চাচিরে নিয়া নামো ইশি।’

ইশি নেহারা বেগমকে নিয়ে ধীরে ধীরে ঢালু পথে নেমে এসে খেয়াতে উঠে। আমজাদ সিএনজি ভাড়া চুকিয়ে আসে,
খেয়া ছেড়ে দেয়। ইশি চারদিকে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার। পেছন দিকে তাকায়, এক টুকরো আলো ঝলমলে সিলেট শহর ফেলে যেন গভীর কোনো অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। মাঝি মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘কিতা খবর ভাই, বাক্কাদিন ফর সিলেট আইলায় না কিতা?’

– ‘অয়।’

– ‘লগে নয়ানি?’

– ‘অয়।’

ইশি তাদের আলাপের কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছে আমজাদের আসা-যাওয়া আছে এদিকে। খেয়া থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে আমজাদ নেহারা বেগমকে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তায় এলো।

– ‘ইশি কিছু জায়গা হাইটা যাওন লাগবো। এইদিকে গাড়ি পাওন যাইব না।’

– ‘মা হাঁটবেন কীভাবে?’

– ‘আরে পারবো, ধীরে হাঁটবো, আমি ধরতাছি নিতাছি, তুমি হাঁটো।’

অন্ধকার রাস্তা, চারদিকে গাছ-গাছালি। গলির পেট থেকে আরেকটা সরু গলি বেরিয়ে গেছে। ইশি বারবার বিরক্ত হয়ে বলছে,

– ‘আর কতদূর আমজাদ ভাই? মায়ের সেলাই তো জানোই তুমি।’

সে প্রতিবারই আস্বস্ত করে বলে

– ‘এইতো সামনে। চইলা আসছি। আমরা ধীরে ধীরে যাইতেছি তো তাই দূরে লাগতেছে।’

এভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটিয়ে একটা বাড়ির সামনে এলো। চারদিকে উঁচু দেয়াল। গেইটে দারোয়ান। আমজাদকে দেখে দারোয়ান গেইট খুলে দিল। আমজাদ তাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে বেশ মোটাসোটা একজন মহিলাকে নিয়ে এলো। তাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো, ‘আসো আমার সাথে।’
আমজাদ তাদেরকে নিয়ে গেল পিছু পিছু।
তাদের নিয়ে বসানো হলো দুতলায় আলাদা একটা কামরাতে। সৌজন্যের আলাপচারিতার পর আমজাদের কথায় এই ঘরেই তাদেরকে ভাত দেয়া হলো। খাবার শেষে একটা মেয়ে এসে আমজাদকে বললো,

– ‘আপারে নিয়া আইতে কইছে আলেয়া আপা।’

আমজাদ নেহারা বেগমকে বললো,

– ‘চাচি আপনে বইন, আমরা আইতাছি, আসো ইশি।’

ইশি আমজাদের পিছু পিছু গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো পালঙ্কে বসে কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে গল্প করছেন আলেয়া বেগম।
তারা গিয়ে সোফায় বসতেই মহিলা বললো,

– ‘আমজাদ মাইয়া কী পারমানেন্ট এইখানে থাকবো?’

– ‘হ, আপা।’

– ‘তোমার মাইয়াগুলা তো আবার এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

– ‘ওরা তো পেশাদারি, এই মাইয়া আলাদা। ওরে কইলাম অনলাইনে ছাড়া কাজ করাইতে পারবেন না।’

– ‘না, ওরে অনলাইনেই লাগামু। কারণ এমনে কাজে দিলে বুক ঝুইলা যাইব। এমুন সৌন্দর্য থাকবো না।’

ইশির শরীর ঘেমে যাচ্ছে। তাদের আলাপের কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
আলেয়া বেগমকে একজন পান সাজিয়ে হাতে দিল। তিনি মুখে পুরে বললেন,

– ‘মাইয়া তোমার নাম কী?’

– ‘ইশি।’

– ‘তা শোনো, আমরা তোমারে দিয়া নতুন একটা কাজ শুরু করতে চাইতেছি। আমাদের এইখানে নতুন নতুন মাইয়া আনা হয় সারা দেশ থাইকা। কিছুদিন কাজ করাইয়া বিদায় করি। খদ্দেররা নয়া মাল চায়৷ কিছুদিন থাইকা আমরা প্ল্যান করছি অনলাইনেও ব্যবসা শুরু করমু। ব্যাপক চাহিদা না-কি আছে এরকম। মানুষ রাতে ঘরে ঘুমাইয়া ভিডিয়ো কলে দেখতে চায়। আমরা অনলাইনে তোমার ছবি দিয়া নাম্বার দিয়া কইমু একশো টাকায় এক ঘণ্টা ভিডিয়ো কলে কথা কইতে পারবো। এই মাইয়াদের দিয়াই শুরু করতে পারতাম। কিন্তু এদের তো সবকিছু ঝুইলা গেছে। কাস্টমাররা দেখে মজা পাইব না। তুমি হচ্ছ কচি, তোমারে আমরা এইভাবেই রাখমু। ধীরে ধীরে আরও মাইয়া আননের প্ল্যান আছে। শুরু তোমারে দিয়া করতাছি আরকি। তোমারা মা মেয়ের থাকা খাওয়ার সব আমরা দেখমু। মাস শেষে ম্যালা টাকাও পাইবা…।

ইশি আর শুনতে পারছে না। ইচ্ছা করছে কানে আঙুল দিয়ে রাখতে। সে রাগে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– ‘থামুন।’

____ চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here