বাঁক,১৪,১৫

0
221

বাঁক,১৪,১৫
জবরুল ইসলাম
( ১৪ পর্ব )


মৃদুল ঠিক করেছে আর কোনোদিন রাতে মানহার সঙ্গে থাকবে না। এর অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সেদিন ফজরের আগেই তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো,

– ‘মৃদুল এখন তুমি চলে যাও। ভোরে কেউ এক সঙ্গে দেখলে সন্দেহ করবে।’

সে বিস্মিত হয়ে বললো,

– ‘কিন্তু আমি এখন ইদ্রিস ম্যানসনে গেলে তো ওরা জিজ্ঞেস করবে রাতে কোথায় ছিলাম।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘যুবতী একটা মেয়ের সঙ্গে রাত কাটানোর বুদ্ধি ঠিকই আছে, আর ওইখানে গিয়ে কী বলবে এই সামান্য বুদ্ধিটা নাই?’

– ‘মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আজেবাজে কথা বলা শুরু করছো কেন? আমি তো থাকতে চাইছিলাম না।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও।’

– ‘কিন্তু আমি এখন গেলে ওদের কী বলবো?’

– ‘তুমি এখন ইদ্রিস ম্যানসনে না গিয়ে কোথাও গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাও। তারপর সেখানে ঠিক সতটায় যাবে। কেউ তখন কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে এক বন্ধুর বাসায় চলে গিয়েছিলে। ভোরে ফিরেছো চেম্বারে যাবার জন্য। ওরা এরচেয়ে বেশি কিছু আর জিজ্ঞেস করবে না।’

– ‘কিন্তু এতক্ষণ আমি কী করবো?’

– ‘তাহলে কী বর-কনের মতো ভোরে একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠে গ্লাস খুলে লোক ডেকে দেখাবো?’

মৃদুল কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ উঠে গেঞ্জি পরে নিল।

– ‘আজ চেম্বারে দেরি করে আসতে পারো সমস্যা নেই।’

– ‘আচ্ছা।’

তারপর আলগোছে গ্লাস খুলে তাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল মানহা। কয়েকটা ঘণ্টা তার হাওরে গিয়ে বসে থেকে কাটাতে হয়েছে। কী যে বিরক্তিকর মুহূর্ত ছিল। তখনই ঠিক করেছে মানহা যাইই বলুক আর কখনও রাতে থাকবে না সে।
এখন ভোর সাতটা। চেম্বারে যাবার সময় হয়ে গেছে। ওখানে গিয়েই গোসল আর নাশতা করবে। ব্রাশ, গামছা মানহার ওখানেই থাকে। কয়েকদিন থেকে এরকমই চলছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এখনও তার সবকিছু বলা হয়নি মানহাকে। ওর সঙ্গে মিশতে গেলে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যাচ্ছে। আবার এড়িয়ে চলতে গিয়ে কম কথা বলতে হচ্ছে৷ এরকম করে ক’দিন থেকে কিছুই বলা হয়ে উঠেনি। আজ ওই সহকারী ছেলেটি আসার আগে নাশতায় কথাগুলো তুলবে ভেবে রেখেছে। নিজ থেকে না বললে মানহা গুরুত্ব দেবে না৷ তার এখন সবকিছুতে প্রেম প্রেম ভাব। এসব জটিল কাজে মনযোগ নেই।

মানহা গোসল শেষে বের হয়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে মুচকি হাসে। আজকাল এতটাই আনমনা হয়ে গেছে যে গানটা বন্ধ করে বাথরুমে যায়নি। মোবাইলে এখনও মৃদু সুরে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে,
“এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার”

মানহা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেলকনির দড়িতে মাথার ভেজা টাওয়াল রেখে আসে। ভাবছে আজ কামিজ পরবে না-কি শাড়ি? কামিজের ওপর দিয়ে এপ্রোন পরে কাজ করতে সুবিধা। তবুও শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে। মৃদুলকে যদি জিজ্ঞেস করে আমাকে শাড়িতে না-কি কামিজে তোমার ভালো লাগে? জবাবে কী বলবে? অবশ্য এসব ব্যাপারে সে উদাসীন। মৃদুল কী খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখছে না? এটা কেন করছে? একজন মেয়ে হয়ে সে এতো প্রশ্রয় দিচ্ছে। নিজেকে মেলে ধরছে তার কাছে, তবুও মৃদুল উদাসীন কেন? পুরুষ মানুষ তো এরকম না। অন্তত সমাজে চলতে গিয়ে পুরুষ সম্পর্কে তো তার অল্প-বিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন পুরুষ তাকে এড়িয়ে চলার কোনো যুক্তি নেই। উলটো নিজের অবস্থান থেকে মৃদুলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বপ্ন দেখা অযুক্তিক৷ তবুও মানহা চায়, কারণ জীবন নিয়ে অন্য সকলের মতো তার উচ্চাকাঙ্খা নেই, মনের শান্তি নষ্ট করে প্রতিযোগিতা নেই, লোক দেখানোর জন্য স্মার্ট প্রতিষ্ঠিত বরও কামনা করে না। তার লক্ষ্য হচ্ছে জীবনটা উপভোগ করা। মনের শান্তিকে প্রাধান্য দেয়া। মৃদুলকে বিয়ে করবে। ছোট্ট সংসার হবে, দরকার হয় বাচ্চাও নেবে না। দু’জন চেম্বার চালাবে। হুট করে কিছুদিন পর পর কোথাও বেড়াতে চলে যাবে। পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর জীবন।
ছোটবেলা থেকে ছন্নছাড়া ছেলেদের জীবন মানহার খুব পছন্দ। তারা কেরিয়ার -ফেরিয়ার নিয়ে ভাবে না। যেদিকে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায়। খা খা রোদে হাঁটবে, দিনে-দুপুরে মোড়ের চা’র দোকানে আড্ডা দেবে, বন্ধুর বাড়িতে যাবে, রাতে শুকনো মুখে দেরি করে ফিরবে। যেন দিনকাল মহা ব্যস্ততায় যাচ্ছে। এই জীবনটা মানহাকে বড়ো টানে। এর জন্য মৃদুলকে জীবনসঙ্গী দরকার।
অন্তত ছোটবেলায় মৃদুলের সঙ্গে খেলাধূলা করায় বড়ো হয়ে তাইই মনে হচ্ছে।
তবে আরেকটা জিনিস তার চাই। বরের প্রচণ্ড ভালোবাসা। সকল পাগলামি সহ্য করেও বর তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবে৷ জীবনে এই বস্তুর বড়ো অভাব মানহার, তাই ভালোবাসার বড্ড কাঙাল সে। কিন্তু মৃদুলের কাছ থেকে তা পাচ্ছে না। সে এমন করছে কেন? সেদিন পুরো রাত কাটিয়ে গেল একবারও ভালো করে তাকায়নি, বুকে টেনে নেয়নি, যাবার সময় অন্তত জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে যেতে পারতো না? আচ্ছা সেদিনের পর থেকেও বা কেন কেবল বাহ্যিক সৌজন্যেতা পালন করে চলছে? চেম্বারের কাজ শেষেও সহকারী ছেলেটির সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে যায়। মানহাও অভিমান করে এখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সবকিছু কেবল সংগোপনে পরখ করে যাচ্ছে। কিছুদিন থেকে রাতে মানহা এখানেই থাকে। এর অবশ্য কারণ আছে। সমস্যা হচ্ছে মৃদুল এখানে জয়েন করার আগেরদিন ওর মামীর সঙ্গে ঝাগড়া হয়। রোজ চেম্বার থেকে ফিরে দেখে মামাতো ভাই-বোনরা ওর রুমে ঢুকে সবকিছু এলোমেলো করে চলে যায়। মানহার এমনিতেই শুচিবায়ু। সবকিছু নিয়েই অতিরিক্ত সতর্কতা। এলোমেলো দেখলে মেজাজ ঠিক থাকে না। তাই লতাকে হাতের কাছে পেয়ে গালে চড় বসিয়ে দেয়। এটা নিয়েই মামী শুরু করেছিলেন তুমুল ঝগড়া। তাদের বাড়িতে থাকা নিয়েও খোঁটা দিলেন। মানহা জানিয়েছিল ছোট খালাকে। উনি একটু বেশি রাগী। তবুও ঝামেলার ইতি টানতে চান। রাগে বললেন,

– ‘মানহা তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন? বিয়ে করে এখান থেকে সরলেই হয়। মানুষ নিজের মেয়েকেও বড়ো হলে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে আর তুইতো অন্যের মেয়ে বুঝিস না কেন?’

সে তখন উলটো রাগ করে বললো,
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি সরলেই তো সমাধান? আজ থেকে তোমার বাপের ঘর ছেড়ে চেম্বারেই থাকবো।’

খালা ওপাশে খিলখিল করে হেঁসে বললেন,

– ‘ব্যাটা মানুষের মতো দোকানে থাক।’

মানহা রেগে বললো,

– ‘ওইটা কী দোকান খালা? চেম্বারের সঙ্গে বাসা এটাচ।’

– ‘আচ্ছা ওইটা তোর বাসা, একা ভয় না পেলে থাক আমাদের কী? ওখানে থাকবি খাবি আমরাও তোর বাড়িতে বেড়াতে আসবো।’ বলে আবার হাসতে শুরু করলেন।

– ‘মজা করছো তাই না? আমি আসলেই ওখানে থাকবো।’

– ‘একা ভয় না পেলে থাকবি সমস্যার কী আছে? শুধু ব্যাটা মানুষ আনবি না আরকি।’

– ‘ধুরো তোমার মুখে কিছু আঁটকায় না।’

এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়েছিল সেদিন। আজ মনে হয় আবার কল দিতে হবে। বলবে মামীর সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে দিতে। তার নিজেরও দোষ আছে। বাচ্চারা বুঝে না বলেই সবকিছু এলোমেলো করে। এর জন্য চড় মারা মোটেও ঠিক হয়নি। তাছাড়া দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সে বাড়িতে থাকলে এখানে মৃদুল উঠতে পারবে। ইদ্রিস ম্যানসনে গুদামের মতো ঘরে থাকতে নিশ্চয় মানুষটার কষ্ট হয়। এখানে ভালো থাকবে। শেষপর্যন্ত শাড়ি বাদ দিয়ে ব্যাগ থেকে কামিজ বের করে পরলো মানহা। মৃদুল আসার সময় গেছে, নাশতা বানাতে হবে।
রান্নাঘরে গিয়ে দু’টা আলু প্রথমে সেদ্ধ করতে দেয়। এরিমধ্যে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো কুচি কুচি করে কেটে নিল। আলু সেদ্ধ শেষে গুঁড়ো করে দু’টা ডিম বের করে ফাটিয়ে আলুর সাথে কুচি করা পেঁয়াজ, কাঁচালংকা, নুন, হলুদ দিয়ে ভালো করে মাখায়। এবার চুলোয় ফ্রাইপ্যান বসিয়ে আগুন দিয়ে অল্প তেল দেয়। খানিক পর উপরে কিছু কুচানো পেঁয়াজ, টমেটো ও কাঁচালঙ্কা ছিটিয়ে নিয়ে আচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে মিনিট কয়েক রাখে।

– ‘কী বানাচ্ছ?’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মানহা বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বললো,

– ‘নাশতা বানাচ্ছি।’

– ‘আচ্ছা আমাকে একটু পথ দাও বেলকনি থেকে টাওয়েল নেব।’

মানহা সরে দাঁড়ায়। মৃদুল বেলকনি থেকে ফিরে এসে বাথরুমে গোসলে চলে গেল।
মানহার ভীষণ অভিমান হয়। লোকটা এমন করে কেন? একা বাসায় সে রোজ গোসল করে শাড়ি পরে উম্মুক্ত চুলে গ্লাস খোলা রেখে নাশতা বানায়। মৃদুল কী হুট করে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে পারে না? প্রেমিক একটু আক্রমণাত্মক না হলে হয়?

মানহা এগ পটেটো অমলেট কয়েক টুকরো করে কেটে টি-টেবিলে এনে রেখে মোবাইল টিপছে। মৃদুল গোসল করে প্যান্ট পরে খালি গায়ে বাথরুম থেকে বের হয়। মানহা মাথা তুলে তাকিয়ে চোখ সরাতে গিয়েও পারলো না। লোমশ বুকে আঁটকে গেল চোখ।
গৌর বর্ণের পেটানো শরীরে বিন্দু বিন্দু জল। বুক থেকে ছোট ছোট লোম নেমে এসেছে নাভি পর্যন্ত। পেটের বাঁ পাশে কীসের আঁচড়ে যেন খানিকটা লাল হয়ে আছে। নখ দিয়ে চুলকেছে? মৃদুল বেলকনিতে চলে গেল। মানহার বুকটা শিরশির করছে। কী হয় বিয়েটা করে নিলে? এইযে মানুষটা গোসল থেকে বের হয়েছে সে টাওয়েল নিয়ে চুল মুছে দেয়ার ছলে কাছাকাছি যেতে পারতো।

মৃদুল বেলকনির দড়িতে ভেজা গামছা মেলে দেয়। মানহাকে আজ কামিজ পরা হালকা সাজেও ভীষণ মায়াবী লাগছে। কী সুন্দর বসে মোবাইল টিপছিল। যেন কোনো শিল্পীর রঙ তুলিতে এঁকেছে মোবাইল টিপতে থাকা নারীকে। ওর সঙ্গে এখন কথা বলতেও তার ভয় লাগে। একা বাসায় এই রূপবতীর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকা মুশকিল। বারবার ছুটে গিয়ে আঁজলা করে মুখটা ধরে ললাটে চুমু খেতে ইচ্ছা করে। ওর চোখের ব্যাকুল চাহুনির আমন্ত্রণে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভীষণ আদর করে সাড়া দিতে মন চায়। কিন্তু সে কী করবে? তার যে হাত-পা বাঁধা। সে একজন বিবাহিত পুরুষ। আজ কোনোভাবে নাশতা করতে করতে ইশিদের খুঁজে বের করার প্ল্যান করে নিতে হবে। মানহাও কেন যেন এগুলো নিয়ে কথা বলছে না। সে আবার ফিরে এসে গেঞ্জি পরে নিল। বসলো গিয়ে চেয়ার টেনে মানহার সামনে। মানহা নিঃশব্দে তার দিকে বাড়িয়ে দিল প্লেট। মৃদুল ভেবে পায় না ও এতো নীরব হয়ে যাচ্ছে কেন? থাক নীরব, তার নিজের কাজ এগুতে হবে, এক পিস অমলেট হাতে নিয়ে কামড় দিয়ে কথাগুলো বলতে শুরু করবে তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।

– ‘গ্লাস লাগিয়ে এসেছো না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আচ্ছা আমি গিয়ে খুলে দিচ্ছি তুমি খাও।’

___ চলবে ___

বাঁক ( ১৫ পর্ব )
_____________

মানহা গেল দরজা খুলে দিতে। মৃদুল অমলেটে আরেকটা কামড় দিয়ে আনমনে ভাবছে হুট করে এখন কীভাবে কথাগুলো শুরু করা যায়? মানহা তো ক’দিন থেকে আগের মতো কথাও বলছে না।

– ‘রাতুল এখানে চলে আসো, আমাদের সাথে নাস্তা করবে।’

মৃদুল তাকিয়ে দেখে মানহার পেছনে সহকারী ছেলেটিও এসে প্রবেশ করছে। প্রচণ্ড রাগ হলো তার, সে জয়েন করার পরেরদিন থেকেই কলেজ বন্ধ হওয়ায় রাতুল ভোরে চেম্বারে এসে সন্ধ্যায় যায়। আগে কেবল বিকেলেই আসতো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মৃদুল, আজও বোধহয় কথাগুলো বলা হবে না। অতি স্বাভাবিক কথা, এগুলো বলা কোনো ব্যাপার না। অথচ কী অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কথাগুলো বলা হয়েই উঠছে না৷ কলেও বলা যায়, তবুও একটু একান্তে শান্ত পরিবেশে বলতে চেয়েছিল সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আর অপেক্ষা না করে আজ রাতে কলে মানহার সঙ্গে কথা বলে নেবে। মাস খানেক থেকে কেন জানি মায়ের জন্য তার মনটা ভীষণ ছটফট করছে।
রাতুল তার পাশে সোফায় বসে সৌজন্যের হাসি দিয়ে বললো,

– ‘কেমন আছেন ভাই?’

– ‘ভালো।’

– ‘তোমার কলেজ কবে খুলবে?’

– ‘পরশু।’

– ‘ও আচ্ছা।’

মানহা চা বসিয়ে রাতুলের জন্য প্লেটে করে অমলেট নিয়ে এসে টি-টেবিলে রেখে চেয়ারে বসলো। তিনজন গল্প করতে করতে নাশতা করে। আজ পুরোদিন তাদের এক সঙ্গেই চেম্বারে কেটে গেল। সন্ধ্যায় রাতুলের সঙ্গে মৃদুলও চলে যাবে কি-না তাই ভেবে ইতিউতি করছিল। মানহাই তাকে বললো,

– ‘মৃদুল তুমি একটু পরে যাও দরকার আছে।’

রাতুল একা চলে গেল। মৃদুল আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘হ্যাঁ বলো কী দরকার।’

– ‘তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে।’

মৃদুল চেহারায় প্রচণ্ড বিরক্তি মিশিয়ে বললো,

– ‘না, এটা হবে না। আমি এখানে থাকবো না।’

– ‘আমি বলছি থাকবে, তুমি সবকিছু নিয়ে আসো।’

– ‘মানহা বেশি বাড়াবাড়ি করো না, তোমার যা ইচ্ছা তা বললেই হবে না-কি? দরকার হয় চেম্বার ছেড়ে দেবো আমি, তবুও থাকবো না।’

– ‘কেন? থাকলে কী সমস্যা?’

– ‘একটা অবিবাহিত মেয়ের সঙ্গে থাকাই তো সমস্যা?’

মানহা ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো,

– ‘নির্লজ্জ মেয়েটার সাথে তোমার থাকতে হবে না, একাই থাকবে তুমি। আমি চলে যাব বাড়িতে। তাই বলেছি সবকিছু নিয়ে এখানে উঠে যেতে।’

মৃদুল নিজের কাছে নিজে খানিকটা অপমানিত হলো। সে মুহূর্তে পরিবেশ স্বাভাবিক করে নিয়ে হাসে বলে,

– ‘তাই বলো, তুমিও না কেমন রহস্য করে কথা বলো।’

মানহার মনটাই ভালো হয়ে গেল ওর কথা বলার ভঙ্গিতে। ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘তুমি ভেবেছিলে আমার সাথে থাকতে বলছি?’

– ‘বাদ দাও তো এসব কথা।’

– ‘তাহলে কী কথা বলবো?’

মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে ভাবলো এখন প্ল্যান নিয়ে কথা বলা যায়। সে স্মিত হেঁসে জবাব দেয়,

– ‘আগে বলো আজ শাড়ি পরোনি কেন?’

মানহার মনের জানালা দিয়ে যেন একফালি শীতল হাওয়া এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। সে অত্যন্ত মিষ্টি গলায় বললো,

– ‘কেন শাড়ি ছাড়া খুব খারাপ লাগে বুঝি?’

– ‘আরে না, কামিজেও ভালো লাগছে। আচ্ছা চলো আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলি।’

মানহার মনে পড়ে গেল ছোট খালাকে রাস্তায় যেতে যেতে কল দিতে হবে। লতার জন্য আইসক্রিম নেবে৷ আইসক্রিম ওর ভীষণ পছন্দ৷ মামীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কথা বলে খুশি করতে হবে। কিন্তু তার ভীষণ ইচ্ছে করছে মৃদুলের সঙ্গে খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে যেতে। তবুও নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে বললো,

– ‘না মৃদুল, আমার যেতে হবে৷ কাল ভোরে চলে আসবো, আমি গেলাম।’

মানহা ওর হাতে চাবি দিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ আর ছাতা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যায়। মৃদুল পেছন থেকে বললো,

– ‘কিছু জরুরি কথা আছে কল দেব রাতে।’

মানহা জুতো পায়ে দিতে দিতে বললো,

– ‘না, তুমি মেসেজ দিয়ে রাইখো আমি পড়ে নেব।’

– ‘আচ্ছা, ঠিকাছে।’

মৃদুল একটু পরে দরজা তালা মেরে ইদ্রিস ম্যানসন থেকে সবকিছু নিয়ে এখানে চলে আসে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রুমে গিয়ে ব্যাগ-প্যাক একপাশের মেঝেতে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। এখন থেকে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ফাতিহা পাঁচটা কল দিয়েছে। রোজ চেম্বারে আসার আগেই তার ফোন সাইলেন্ট করে আসে৷ তাই বুঝতে পারেনি কখন কল এলো। ব্যাক করে মৃদুল। ওপাশে রিং হতেই রিসিভ হয়।

– ‘হ্যালো ফাতিহা।’

– ‘হ্যালো, কী হইল কও তো? কয়দিন থাইকা তুমি কল দাও না। আমি আজ দিলাম তাও উঠাইতাছো না কেন?’

– ‘আসলে হইছে কী ফাতিহা, আমি একটা কোম্পানিতে কাজে ঢুকেছি৷ ওইখানে মোবাইল নিয়া ঢোকা নিষেধ। তাই রাইতে শুধু মোবাইল হাতে পাই।’

– ‘ও আইচ্ছা, তা কেমন আছো তুমি?’

– ‘ভালাই আছি, তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছে?’

– ‘ভালা আছে সবাই।’

– ‘ওদিকে পুলিশের খবর কী? ছবি দেইখা কেউ কিছু কইছে?’

– ‘না।’

– ‘আইচ্ছা, তাইলে রাখতাছি।’

– ‘আইচ্ছা।’

মৃদুল মোবাইল হাত থেকে রাখতেই মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখে মানহার মেসেজ,

– ‘তোমার রান্না করতে হবে না, ডাল আর ডিম ভাজি করে রেখে এসেছি। আজ এগুলো খেয়ে নিয়ো।’

মৃদুল হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক আজ আর রান্না করতে হবে না৷ এই কাজটা করতে তার ভীষণ বিরক্ত লাগে। ইদ্রিস ম্যানসনে তারা একেকদিন একেকজন রাঁধতে হতো। এখানে সে একা, সুতরাং বাজার করে নিজেই রেঁধে খেতে হবে। ফিরতি মেসেজ দিলো সে,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে মানহা, ধন্যবাদ।’

ওপাশ থেকে আর কোনো মেসেজ এলো না। সে উঠে গেল ভাত খেতে। ভাত খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে আজ। প্লেট ভরে ভাত নেয়। ডাল নেয় বাটিতে।
দারুণ একটা ঘ্রাণ আসছে নাকে।
ফ্রাইপ্যান থেকে ডিম নিতে গিয়েই দেখে পাশে রাখা একটা পলিথিনের ব্যাগে লেবু আর কাঁচা মরিচ রেখে গেছে। ডিমটা ভাতের ওপর তুলে হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি লেবু কেটে নিল। কয়েকটা কাঁচা মরিচ আর লেবু সহ সবকিছু নিয়ে সে রান্না ঘরেরই চালের বস্তায় বসে খাওয়া শুরু করে। অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে সে খাচ্ছে। ডিম ডাল একসঙ্গে৷ ডাল দিয়ে মাখিয়ে এক লুকমা ভাতের সঙ্গে ডিম মুখে দেয়। তারপর লেবুতে একবার কামড় আরেকবার কাঁচা মরিচে। তার খাওয়ার ভঙ্গি একটু অদ্ভুত। প্রথম যেইই দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘এ কী করছো? খাবার কেউ কেড়ে নেবে না-কি তোমার কাছ থেকে? এভাবে খাও কেন?’

সে কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। তার এভাবে খেতে ভালো লাগে এটাই কেবল জানে। আজ পর্যন্ত কারও রান্না তার কাছে খারাপ লেগেছে বলেও মনে পড়ে না৷ তবে মানহার রান্না একটু বেশিই ভালো। মায়ের রান্না কেমন ছিল?
পুনরায় মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। মৃদুল ভাতের প্লেট মেঝেতে রেখে বাঁ হাতে মোবাইল বের করে।

– ‘মৃদুল ফ্রাইপ্যানের পাশে দেইখো লেবু আর কাঁচা মরিচ আছে। আগে বলতে ভুলে গেছিলাম।’

মুচকি হাসে মৃদুল। কিছু কিছু মানুষ এতো খারাপ আবার কিছু কিছু মানুষ এতো ভালো হয় কীভাবে ভেবে পায় না সে।
ফিরতি মেসেজ দেয়,

– ‘পেয়েছি।’

পুনরায় গোগ্রাসে ভাত গিলতে শুরু করে সে। কেউ দেখলে মনে করবে কত কাজ পড়ে আছে তার। অথচ এটাই তার স্বাভাবিকভাবে খাবার চিত্র। খাওয়া শেষ করে বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা হেলিয়ে দেয়। মানহাকে মেসেজ দিতে হবে। তার পড়ালেখা অতি অল্প। তবুও বাংলা পড়া এবং লেখার পাশাপাশি ইংলিশ উচ্চারণও করতে পারে৷ লম্বা করে একটা মেসেজ দিয়ে দেখে যাচ্ছে না। তারপর আবার টুকরো টুকরো করে বিস্তারিত লিখে মানহাকে পাঠিয়ে অপেক্ষা করে সে। ফিরতি কোনো মেসেজ আসে না। অপেক্ষা করে সে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম ভাঙলো ভোরে কলিং বেলের শব্দ শুনে।
হাই তুলে গিয়ে দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল ঘ্রাণে আর রূপে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে মানহার থেকে। ওর পরনে শাড়ি। ডান হাতে এপ্রোন আর ভ্যানিটিব্যাগ।

– ‘হা করে তাকিয়ে আছো কেন?’

মৃদুল লজ্জা পেয়ে বললো,

– ‘আসো।’

– ‘ঘুম থেকে এখন উঠলে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এই শার্ট প্যান্ট পরেই ঘুম?’

মৃদুল অত্যন্ত লজ্জার একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘পঁচা একটা, তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে শার্ট ধুয়ে নাও।’

– ‘গোসল করবো না?’

– ‘আমি আসার আগেই গোসল করে নাস্তা বানানো উচিত ছিল, তাই এখন গোসল বাদ।’

মৃদুল স্মিত হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা।’

মানহা এপ্রোন একপাশে রেখে সোফায় বসে ইয়ার ফোন কানে গুঁজে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে বসে রইল। খানিক পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে তাকায়৷ মৃদুল খালি গায়ে শার্ট ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে বের হয়েছে। মৃদুল বেলকনির দড়িতে কাপড় মেলে রেখে এসে বললো,

– ‘শেষ ম্যাডাম, এবার কী করতে পারি?’

মানহা চোখবুজা অবস্থা বললো,

– ‘আমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে পারো।’

মৃদুল আজ কোনোভাবেই ঝগড়াঝাটির পরিবেশ তৈরি করতে চায় না। তাই মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘সারাক্ষণ রসিকতা করতে মন চায় তোমার তাই না?’

– ‘উহু, সত্যিই ধরবে একবার জড়িয়ে? আমার আজ খুব মন খারাপ।’

– ‘বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেন? আর তোমার আবার কেন মন খারাপ?’

– ‘থাক এতোকিছু শুনতে হবে না তোমার।’

– ‘কাল কোনো মেসেজ রিপ্লাই দিলে না যে?’

– ‘সিম্পল ব্যাপার মৃদুল। তুমি অযথা চাপ নিচ্ছ।’

– ‘তা ঠিক, তুমি চাইলে সিম্পল।’

– ‘আমি চাইলে না, আরেকজনের সহযোগিতা নিব।’

মৃদুল বিস্ময়ে বসা থেকে উঠে মানহার পাশে এসে বললো,

– ‘কার?’

– ‘বলবো, তার আগে আমাকে একটু আদর করবে?’

– ‘কীসব বাচ্চামি করো মানহা।’

মানহা আলগোছে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,

– ‘তোমার বিশ্বাস হয় না আমার মন খারাপ?’

মৃদুল অবাক হয়ে আঁজলা করে ওর মুখ ধরে বললো,

– ‘আরে তোমার চোখে পানি কেন হঠাৎ? মুখ লাল হয়ে গেছে দেখছি, কী সমস্যা বলো তো।’

মানহা ধরা গলায় বললো,

– ‘কিচ্ছু না, তোমার এগুলো শোনার দরকার নেই, একবার জড়িয়ে ধরো শুধু।’

মৃদুল ওকে টেনে দাঁড় করালো। মানহা ভেজা চোখ নিচের দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুলের কেন যেন আচমকা মানহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই জড়িয়ে ধরার পেছনে তার কোনো স্বার্থ আছে কি-না সে নিজেও জানে না। কী অদ্ভুত এক শান্তিতে ছেয়ে গেল তার দেহ আর মন। মৃদুল তাকে ছেড়ে দিয়ে আঁজলা করে মুখ ধরে। মানহা চোখবুজে আছে।

– ‘তাকাও।’

– ‘না লজ্জা লাগে।’

মৃদুল মুচকি হেঁসে বলে,

– ‘আসলেই লজ্জা লাগছে না-কি ন্যাকামো?’

– ‘জানি না।’

– ‘আচ্ছা আজ কী হয়েছে বলো তো?’

– ‘বলা যাবে না।’

– ‘ও আচ্ছা, তা এভাবে কী চোখবুজেই থাকবে?’

– ‘উহু।’

– ‘তাহলে এবার বলো কার সহযোগিতা নেব আমরা বলছিলে।’

– ‘বলবো তুমি আমাকে প্রথমে কপালে একটা চুমু দাও৷ তারপর জড়িয়ে ধরে কাছে নাও।’

– ‘কিন্তু চোখবুজে আছো কেন?’

– ‘চোখ মেলে এগুলো বলতে লজ্জা লাগবে।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা দিচ্ছি।’

– ‘রোবটের মতো না দিয়ে একটু আদর করে দিয়ো।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘কিন্তু তোমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।’

– ‘তাহলে তোমার চুমু লাগবে না। জড়িয়ে ধরে কাছে নাও বলি কার সহযোগিতা নেব।’

মৃদুল তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে আনে। নরম, উষ্ণ এক কিশোরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেও চোখ না বুজে পারলো না। তখনই কানের কাছে মানহা ফিসফিস করে নাম উচ্চারণ করলো,

– ‘ইরফানের সহযোগিতা নেব।’

____চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here