বাঁক,১৬,১৭

0
171

বাঁক,১৬,১৭
জবরুল ইসলাম
(১৬ পর্ব )

মানহা প্রথমে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে। তারপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

– ‘ইরফানের সহযোগিতা নেব।’

মৃদুল অবাক হয়ে মানহাকে ছেড়ে ওর মুখ আঁজলা করে ধরে বলে,

– ‘ইরফান?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাকে পেতে হলেও তো গ্রামে যেতে হবে।’

– ‘না, ওর নানাবাড়ি তো আমার নানাবাড়ির কাছেই। সুন্দরপুর আমি গিয়েছিলাম কেন? ইরফানের মা আমার আম্মুর বান্ধবী।’

– ‘এসব জানি, কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কীভাবে?

– ‘ওর নানাবাড়ি থেকে আনতে পারবো নাম্বার। কিন্তু তার দরকার হবে না। ফেইসবুকে মেসেজ দেবো ইরফানকে।

– ‘সে বড়ো হয়ে এখন কেমন হয়েছে জানি না। বাপ-চাচাদের মতো হলে তো সমস্যা। অবশ্য সেদিন লুকিয়ে আমার হাতের দড়ি খুলে দিয়েছিল ইরফানই।’

– ‘মোটেও বাপ-চাচাদের মতো হয়নি সে, একদম আলাদা। আমার মা মারা যাবার পর ওরা এসেছিল।’

– ‘আগেও আলাদা ছিল।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘হ্যাঁ ছিল, তবে ওর বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পেতো।’

– ‘ইরফান এখন কী করে?’

– ‘পড়ালেখা করে অন্য রকম হয়েছে। একটা কলেজে শিক্ষকতা করায়, বিয়েও করে নিয়েছে। মা আর বউকে নিয়ে শহরে আলাদা থাকে।’

– ‘বাহ, তাহলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভালো হবে, তুমি আগে বলোনি কেন?’

– ‘আগে কী জানতাম ওরে তোমার দরকার হবে? আমি তো জানি তুমি গ্রামের সবাইকে ছেড়ে পালিয়ে আছো। কাল মেসেজ থেকে বুঝলাম ইশিদের খুঁজতে ইরফান কাজে লাগবে। গ্রামে তোমার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সেইই সহজে যোগাযোগ করতে পারবে।’

– ‘আচ্ছা ওকে তুমি কল দাও।’

– ‘নাম্বার নাই, তবে ফেইসবুকে মেসেজ দেই?’

– ‘হ্যাঁ, তাকে তোমার নাম্বার দিয়ে বলো কল দিতে একবার।’

– ‘আচ্ছা দিচ্ছি, অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’

মানহা সোফায় গিয়ে বসে বললো,

– ‘খাবে কখন? আমি মেসেজ দিচ্ছি তুমি নাশতা বানাতে যাও।’

মৃদুল অস্থিরতায় আঁজলা করে নিজের মুখ ঘষে বললো,

– ‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’

– ‘নুডলস বানিয়ে নাও সবকিছু আছে।’

– ‘আচ্ছা।’

মৃদুল উঠে নাশতা বানাতে চলে গেল। ইরফানের নাম সার্চ দিয়ে মানহা ফেইসবুকে তাকে বের করে মেসেজে নাম্বার দিয়ে বললো,

– ‘ইরফান ভাই এটা আমার নাম্বার, জরুরি দরকার আছে কল দিয়ো।’

ইরফানকে অফলাইন দেখাচ্ছে। মানহা উঠে রান্না ঘরে গেল। মৃদুলকে পেঁয়াজ কাটতে দেখে রসিকতা করে বললো,

– ‘আহারে বেচারা, বিয়ে করে নিলে বউই এসব করে দিতো।’

মৃদুল রসিকতা এড়িয়ে গিয়ে বললো,

– ‘মেসেজ দিয়েছো?’

– ‘হ্যাঁ, সিন করেনি এখনও।’

– ‘ও আচ্ছা।’

মানহা ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগায়। নাশতা বানাতে সময় একটু বেশিই গেল। দু’জন প্লেট নিয়ে টি-টেবিলে গিয়ে খেতে বসেছে তখনই ফোন বেজে উঠে।

– ‘কে কল দিছে দেখো তো।’

– ‘অপরিচিত নাম্বার, ইরফানই হবে।’

– ‘লাউডে দিয়ে রিসিভ করো।’

মানহা কল রিসিভ করে সালাম দিলো। ওপাশে সালামের জবাব দিয়ে ইরফান অস্থির গলায় বললো,

– ‘মানহা বলো কী জরুরি দরকার। যোগাযোগ করেছো ভালোই হয়েছে। আমি খুব ঝামেলায় পড়েছি।’

– ‘কী হয়েছে?’

– ‘আমি তো মানিক ভাইয়ের বোন ইশিদের সন্ধান পেয়েছিলাম।’

মানহা আর মৃদুল অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মৃদুল ওর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বললো,

– ‘ইরফান আমি মানিক বলছি। ওদেরকে পাওয়ার পর কী হলো বলো আমাকে।’

ওপাশে বিস্মিত গলা শোনা গেল,

– ‘আরে কী বলো এসব? মানিক ভাই মানে? তুমি ওখানে কীভাবে? এতোদিন কোথায় ছিলে?’

– ‘আমি ওখানে অন্য নামে আছি। এসব পরে কথা হবে, এখন বলো ওদের সন্ধান পাওয়ার পর কী হয়েছে?’

– ‘পরশু ওরা ট্রেনে উঠার আগে আমাকে কল দিয়েছিল। আমি তাদের স্টেশন থেকে গিয়ে আনার কথা সন্ধ্যায়। কিন্তু তার আগে থেকে কলে পাইনি। স্টেশন সহ পুরো সিলেট আমি পইপই করে খুঁজে যাচ্ছি পরশু রাত থেকে।’

মানহা ওর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বললো,

– ‘ইরফান ভাই তোমার ঠিকানা আমাকে মেসেজে দাও, এখনই আমরা দু’জন আসছি।’

– ‘আচ্ছা দিচ্ছি ঠিকানা, কিন্তু তোমরা আরও দেরিতে বের হও, আমি বিকেল চারটায় দেখা করতে পারবো।’

– ‘আচ্ছা দাও, রাখছি এখন।’

– ‘তুমি কী জানি জরুরি কথা বলবে বলছিলে?’

– ‘মৃদুলকে পেয়েছি এটা বলার জন্য। তাছাড়া বাকি কথা সাক্ষাতে হবে।’

ইরফান কল কেটে দিল। মৃূদুলকে ঘামতে দেখে মানহা ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে এসে বললো,

– ‘এতো অস্থির হচ্ছ কেন? রিলাক্স থাকো, নাশতা করে আমরা বের হব।’

– ‘সে তো বললো চারটায় দেখা করবে।’

– ‘আমরা তার আগে স্টেশনের আশেপাশের হোটেল বা কলোনিগুলো খুঁজে দেখবো।’

– ‘চেম্বার?’

– ‘বন্ধ থাকবে, নাশতা করো।’

দু’জন নাশতা করার পর মানহা একটা কাগজের ব্যাগ মৃদুলের হাতে দিয়ে বললো,

– ‘পরশুদিন তোমার জন্য গেঞ্জি আর প্যান্ট এনে রেখেছিলাম কিন্তু দেয়া হয়নি।’

– ‘এগুলো কিনতে গেলে কেন?’

– ‘কথা না বলে তাড়াতাড়ি পরে নাও জনাব।’

মৃদুল আর কথা না বাড়িয়ে কাপড় পরে নিল।
চেম্বার বন্ধ করে রাস্তায় এলো। গতকাল মামীর সঙ্গে মানহার আবার ঝামেলা হয়েছে। ওর খালা কল দিয়ে ঝামেলা মেটাতে পারেনি। উলটো আরও মামীর পাশাপাশি মামাও রেগে আছেন। সন্ধ্যায় গিয়ে মামীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে খুশি করার জন্য বলেছিল, ‘আমি চলে এসেছি মামী আম্মা।’

তাকে ছাড়িয়ে তিনি গালে জোরে একটা চড় মেরে বসলেন। মানহা বিস্মিত হয়ে গেল। মামা মুখ ভার করে পালঙ্কে শুয়ে পা নাড়াচ্ছেন। মামী বলতে শুরু করলেন,
– ‘কী পেয়েছো তুমি হা? বাপের মতো বজ্জাত হয়েছো না-কি? নানার বংশের ইজ্জত মারতে শুরু করছো দেখছি। তোমার ওইখানে কোথাকার এক ছেলেকে চাকরি দিয়েছো। সে কাজের কী জানে? তোমার মামাকে বলদ মনে হয় তাই না? ওই ছেলেকে তুমি ফষ্টিনষ্টির জন্য নিয়েছো। বিয়ে করছো না বুঝি এইসবের জন্য? খুবরদার এ বাড়িতে থেকে এগুলো হবে না। আমাদের ছেলে-মেয়ে নষ্ট হবে। তোমার জন্য আমাদের বদনাম বরদাস্ত করবো না।’

মানহা ক্রোধে বললো,

– ‘যা মুখে আসে তাই বলবা না মামী, আমি ফুষ্টিনষ্টির জন্য জায়গা দিয়েছি কে বলছে?’

– ‘তুমি রাতে ওই ছেলের লগে বাজারের বাইরে গিয়েছিলে লোকে দেখে তোমার মামাকে বলেছে। শুনি রাইতে হাওরের দিকে আরেক ছেলের লগে কেন যাবে? পুরো বাজার যে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে তুমি জানো?’

এই কথা শুনে মানহার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলের সঙ্গে রাতে থেকেছে এটা কেউ জানে না ভেবে গোপনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। চলে যায় নিজের রুমের দিকে।
তারপরই শুনতে পায় মামা কল দিয়ে খালার সঙ্গে রাগারাগি করছেন। মানহাকে আদর করে বাঁদর বানিয়েছেন বলে দোষারোপ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু এই মুহূর্তে এসব ভাবার সময় নেই মানহার। মৃদুলকে বিয়ে করে নিলেই সমাধান।
তাছাড়া মৃদুলের পুরো ব্যাপারটাতে সে জড়িত। দু’দিন পর মৃদুলকে বিয়েও করবে সে। এখন ওর ব্যক্তিগত সবকিছু এমনিতেই তার।

– ‘মানহা বাসে করে যাবে না-কি?’

ভাবনায় ছেদ হলো। সে খানিক ভেবে বললো,

– ‘না, অপরিচিত কোনো ড্রাইভারের সিএনজি দেখি।’

– ‘আচ্ছা।’

দু’জন বাজারের মাথায় গিয়ে বয়স্ক একজন ড্রাইভার দেখে একটা চলতি সিএনজি থামায়।

– ‘রিজার্ভ সিলেট যাবেন?’

– ‘অয়।’

টাকা নিয়ে দাম-দর করে তারা সিএনজিতে উঠে পড়ে।

– ‘সিলেট কুনানও যাইতায়?’

– ‘রেলস্টেশন।’

– ‘আইচ্ছা।’

মানহা এপ্রোন চেম্বারে রেখে এসেছে। পরনে এখন কেবল শাড়ি। সিএনজি চলতে শুরু করেছে।

– ‘ইরফান মোবাইলে ইশিকে না পেলে তাদেরকে কীভাবে খুঁজে পাবে আর?’

মানহা ওর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারার দিকে তাকায়। মুচকি হেঁসে সায় দিয়ে হাত প্যাঁচিয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলে,

– ‘চিন্তা করো না তো, অনেক পথ আছে, আগে ইরফানের কাছ থেকে শুনি সে ইশির সন্ধান কীভাবে পেয়েছিল।’

– ‘তারপর?’

– ‘তারপর সে আগে যেখানে ছিল সেখানেও আমরা যাব।’

– ‘সে যদি সিলেট চলে আসে সেখানে গিয়ে কীভাবে পাব?’

– ‘এতো চিন্তার কিছু নেই, এখন ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে।’

– ‘আমার চিন্তা হচ্ছে মানহা। ওর ফোন হঠাৎ বন্ধ হবে কেন? কোনো বিপদে পড়েনি তো?’

‘কিচ্ছু হবে না’ বলে মানহা ওর চুলের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসে।

মৃদুল রূঢ় গলায় বললো,

– ‘আমার চিন্তা হচ্ছে আর তুমি হাসছো কেন? পাগল না-কি?’

– ‘তোমরা পুরুষ মানুষরা মুখ ভার করে থাকাটাই একটা বিরাট কাজ মনে করো। এখন তুমি সিএনজিতে বসে চিন্তা করলে ইশির বিপদ কি চলে যাবে? না খুঁজে পাবে?’

– ‘তাহলে কী এখন নাচবো আমি?’

– ‘অযথা রেগে যাচ্ছ কেন?’

মৃদুল কিছু না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে ম্লান মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। মানহা ওর থুতনি ধরে টেনে তার দিকে ফিরিয়ে মোবাইলের স্ক্রিন সামনে ধরে বললো,

– ‘লম্বা চুল এরকম লেপটে থাকলে কী বিশ্রী লাগে দেখো।’

‘ও আচ্ছা গেঞ্জি পরার সময় এমন হয়েছে’ বলে মৃদুল হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে যাচ্ছিল মানহা হাত ধরে টেনে নামিয়ে মোবাইলটা সিটে রেখে নিজেই চুল ঠিক করে দিয়ে বললো,

– ‘এবার ঠিক আছে।’

মৃদুল সোজা হয়ে বসলো সিটে। মানহা মোবাইল হাতে নিল পুনরায়। আপন মনে বাইরে তাকিয়ে ভাবছে ওর ঘন চুল হওয়ায় ভালোই হয়েছে।
ছেলেদের ঘন চুল মানহার ভীষণ ভালো লাগে। বিরলকেশি তার একদম পছন্দ না। কিন্তু ছোট থেকেই তো মৃদুল ছাড়া কোনো ছেলেকে সে ভাবেনি। যদি মৃদুলের এখন টাক হতো তাহলে কী করতো? মানহা আবার মৃদুলের দিকে তাকিয়ে ওর কেশহীন মস্তক কল্পনা করে মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে ফেলে, মৃদুল ভ্রু-কুঁচকে তাকায়। মানহা মুখ ফিরিয়ে সিএনজির বাইরে চোখ রাখে।

– ‘এতো হাসির কী হয়েছে?’

মানহা মুখ না ফিরিয়ে আবার হাসতে হাসতে বললো,

– ‘কিছু না।’

– ‘বুঝলাম না মানহা, তোমার হাসি পাচ্ছে কীভাবে? আমি টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

– ‘টেনশন করে কী হবে? ওদেরকে এখন পাওয়া যাবে। এবং ইরফান তোমাকে সাপোর্ট করলে আরও অনেক কিছু সম্ভব।’

– ‘কীভাবে?’

– ‘তোমার এখনই এতো জানতে হবে না। আমার উপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত থাকো।’

– ‘তবুও আমার চিন্তা হচ্ছে।’

আচ্ছা দাঁড়াও দু’জনে গান শুনি ভালো লাগবে। মানহা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করে ওর কানে গুঁজে দিয়ে নিজের কানেও নিল।

– ‘একটু কাছে আসা যাবে না জনাব?’

মৃদুল কোনো আগ্রহ ছাড়াই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। এই মুহূর্তে গান শোনার কোনো আগ্রহ নেই তার। মানহা ওর হাত টেনে পিঠের দিকে নিয়ে নিজের কোমরে রেখে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে।
মোবাইলে মৃদুস্বরে বাজছে,

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে –
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে….।”
_____চলবে___

বাঁক ( ১৭ পর্ব )
____________

মানহার সঙ্গে মৃদুলও চোখবুজে গান শুনে। মানটা তার নিমিষেই যেন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গেছে। গানের মানে সে খুব একটা বুঝে না৷ তবুও গায়কের মিষ্টি সুর আর গীতিকারের কথা মিলে যতটুকু বুঝতে পেরেছে কবি যেন অভিমানে টইটম্বুর হয়ে এই গানটি লিখেছেন। হঠাৎ একটা কথা মৃদুলের মনে পড়ে গেল,

– ‘মানহা।’

চোখবুজেই জবাব দিলো,

– ‘হু।’

– ‘আমার সঙ্গে যখন বের হচ্ছিলে ফার্মেসি থেকে তোমার মামা কেমন করে যেন তাকালেন, কারণ কী?’

– ‘বলতে চাইছিলাম না। তবুও বলে ফেলি। আসলে গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ওইদিন রাতে আমরা বের হইছিলাম না? কে জানি দেখে মামাকে বলে দিয়েছে।’

মৃদুলের বুকটা কেঁপে উঠলো। একটা মেয়ে এই কথাগুলো এতো সহজভাবে বলছে কীভাবে?

– ‘তাও আজ আবার তুমি আসলে যে আমার সঙ্গে?’

– ‘তোমার প্রয়োজনে আমি আসবো না বলো? সামান্য এই বাঁধা আঁটকে ফেলবে আমাকে তা কী হয়?’

মৃদুল আর কিছু বললো না।
পুনরায় প্রথম থেকে গান শুরু হয়েছে। এবার সে একটা জায়গায় থমকে গেল, আগে বিশেষভাবে খেয়াল করেনি।

“চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে –
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।”

মৃদুল চোখ মেলে মানহার মুখের দিকে তাকায়। ওর চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। চোখের পাতা নড়ছে৷ কী নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। রাস্তার পাশের জমিগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবুডুবু করছে৷ তার চোখও ভরে এলো জলে। বুকে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভব হচ্ছে। এই কয়েকটা লাইন যেন মানহার ব্যক্তিগত। তাকে উদ্দেশ্য করেই মানহার বলা। আসলেই তো মানহার সঙ্গে তার স্বীয় স্বার্থের লেনা-দেনা এক সময় মিটে যাবে। তখন কী আর মানহা নামের মেয়েটির কাছে সে আসবে? কখনও কি তারার পানে চেয়ে চেয়ে মানহার কথা ভাববে? মৃদুলের এবার ফাতিহার প্রতি অকারণ রাগ হলো। রাগ হচ্ছে নিজের ভাগ্যের উপরেও। ভুল সময়ে কেন মানহা নামের এই পবিত্র ফুলের সঙ্গে তার দেখা হলো? ফাতিহার জন্যেই বা কেন সেদিন এতো বড়ো ত্যাগ স্বীকার করতে গেল সে? যদি জানতো মানহার মতো এক রূপবতী মায়াবতী নারী শৈশব থেকে তার জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে কী এই ত্যাগ স্বীকার করে নিতো সে?
ফাতিহা আর সে এক সঙ্গেই খেলাধূলা করে বড়ো হয়েছে। অনেকটা সমলিঙ্গের মতো ছিল তারা। কখনও মৃদুল অন্য নজরে দেখেনি। তবুও একসময় তাদের মাঝে দূরত্ব আসে। ফাতিহা বড়ো হয়, নিজের সহপাঠীদের সাথে মিশে। মৃদুল দাদাভাইয়ের সঙ্গে নানান কাজে ব্যস্ত। ফাতিহা তখন নাইনে পড়ে। অথচ বয়স হয়ে গেছে ওর প্রায় সতেরো৷ গায়ে-গতরেও অনেক বড়ো। এর কারণ সে প্রাইমারির কয়েক শ্রেণিতে ফেইল মেরেছে। একদিন মৃদুলকে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

– ‘মৃদুল ভাই স্কুলের সামনে একটা কাপড়ের দোকান আছে না?’

মৃদুল বললো,

– ‘হ্যাঁ আছে, শরৎ সুন্দরী বস্ত্র বিতান নাম।’

– ‘এই দোকানে একটা ছেলে আছে না তাকে এই কাগজ দিতে পারবে গিয়ে? কেউ যেন আবার না দেখে?’

মৃদুল ওর মাথায় ঘাট্টা মেরে বললো,

– ‘কিরে প্রেম-টেম করছিস না-কি?’

ফাতিহা মুচকি হেঁসে পুরো ঘটনা তাকে বললো। ছেলেটি দু’দিন আগে প্রথম চিঠি দিয়েছে। সেটার জবাব দিয়েই ফাতিহার আজকের চিঠি। এরপর থেকে মৃদুল প্রায়ই তাদের চিঠি আদান-প্রদানের দায়িত্ব পেয়ে গেল। এগুলো নিয়ে সে খুব একটা গভীরভাবে ভাবতে যায়নি। ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক বছর তিনেক এভাবে ছিল। হুট করে একদিন ফাতিহা তার গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানায় দোকানের ছেলেটি তাকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে৷ ওর বাড়ি আরও বাটিতে। দোকানে কর্মচারী হিসাবে কাজ করতো।
মৃদুল হালকাভাবে নেয় বিষয়টি। সান্ত্বনা দেয় খানিক্ষণ। কিছুদিন পরই সে বুঝতে পারে ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ফাতিহা সবকিছু উজাড় করে ভালোবেসেছিল পরদেশী ছেলেটিকে। পেট যখন প্রকাশ পেতে শুরু করে ফাতিহা তখন তাকে জানায়। বাড়িতে বিয়ে প্রস্তাব দিতে বলে। এসবের কারণেই ছেলেটি হুট করে দোকান ছেড়ে পালিয়েছে৷ এদিকে দাদা ভাই ছাড়া ফাতিহার মা আর দাদি বুঝে গেছেন। এলাকার মানুষ জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মান-ইজ্জত সবকিছু শেষ। ভেতরে ভেতরে এগুলো নিয়ে বাড়িতে হট্টগোল চলছিল। একদিন দাদি মৃদুলকে নিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। এখন ইজ্জত সেইই রক্ষা করতে পারে একমাত্র। তাকেও বুঝান সে যেহেতু অনাথ। কেউ নেই তার। সুতরাং ফাতিহাকে বিয়ে করে তাদের পরিবারের একজন হয়ে এখানেই থাকতে পারবে।

– ‘কী ভাবছো এতো?’

মানহার কথায় তার স্মৃতি রোমন্থনে ব্যাঘাত ঘটে।

– ‘পেটে চিমটি মারলে কেন?’

– ‘কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলে তাই চিমটি মেরে আমার কাছে ফিরিয়ে আনলাম।’

মৃদুল মুচকি হাসে। তারপর মানহার দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘কিছু না, কিন্তু তোমার চোখ এতো লাল কেন? ঘুম পাচ্ছে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ ঘুম পাচ্ছে অনেক। কিন্তু সিএনজিতে তো ঘুমানো যাবে না।’

মৃদুল খানিক্ষণ ভেবে ড্রাইভারকে বললো,

– ‘একটু পর্দা ফেলে দিন তো।’

– ‘বৃষ্টি তো নেই।’

– ‘ওর ঘুম পাচ্ছে তো পর্দা থাকলে আলো লাগবে না।’

ড্রাইভার আর কিছু না বলে পর্দা ফেলে দিল টান মেরে।

– ‘তোমার ভ্যানিটিব্যাগ পেছনে রেখে ইয়ারফোন কানে দিয়ে মোবাইল আমার হাতে দাও।’

মানহা বাধ্য মেয়ের মতো মুচকি হেঁসে তাই করলো। তারপর মৃদুল পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘এবার তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাও।’

মানহা কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো, ‘হুট করে এতো আদর করছো কেন?’

মৃদুল চোখ দিয়ে শাসিয়ে ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করে। যার অর্থ হলো ড্রাইভার শুনবে। মানহা ফিক করে হেঁসে পরম শান্তিতে চোখবুজে নেয়।

মৃদুলের ডাকে মানহা চোখ মেলে তাকায়।

– ‘বাবা এতো ঘুম তোমার।’

– ‘চলে এসেছি?’

– ‘হ্যাঁ, নামো।’

দু’জন সিএনজি থেকে নামে। মানহা ভাড়া দিয়ে বললো,

– ‘চলো আগে স্টেশন দেখি।’

দু’জন স্টেশনে গিয়ে খুঁজে দেখে। মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য খোঁজা। এভাবে ঘণ্টা তিনেক তারা কলোনি, আবাসিক হোটেলে ছুটে কাটিয়ে দিল৷ কী বলে লোকদের জিজ্ঞেস করবে? ছবিও নেই তাদের কাছে। মৃদুলও চিনবে কি-না জানে না। তবুও খুঁজতে হয় বলে খোঁজা। ক্লান্ত মানহা বললো,

– ‘চলো ব্রিজের ওপারে যাই।’

– ‘হ্যাঁ, চলো।’

রিকশা ডেকে দু’জন ব্রিজের ওপারে এলো।

– ‘এখন কী করবে? ইরফানের বাসায় চলে যাবে?’

– ‘তিনটা হয়ে গেছে এখন যাওয়া যায়, তার আগে ওই পার্কে গিয়ে খানিক্ষণ বসে জিরিয়ে নিই। পিপাসাও লেগেছে। এই নাও টাকা, তুমি ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসো।’

মৃদুল রাস্তার অপর পাশের দোকান থেকে পানি নিয়ে এলো। দু’জন ঢুকলো জালালাবাদ পার্কে। গাছের ছায়া দেখে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে তারা।

মৃদুল বোতলের ছিপি খুলে বাড়িয়ে দিল মানহার দিকে।

– ‘তুমি আগে খেয়ে নাও।’

– ‘কেন?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আমি বোতলে মুখ না লাগিয়ে পানি খেতে পারি না৷ তাছাড়া মুখও ধুতে হবে আমার।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

মৃদুল পানি খেয়ে তাকে বোতল দেয়। তখনই মানহার ফোন বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ইরফান কল দিয়েছে৷

– ‘তুমি কথা বলো।’

মৃদুল কল রিসিভ করে,

– ‘হ্যালো।

– ‘হ্যাঁ মানিক ভাই কোথায় এখন তোমরা?’

– ‘আমরা জালালাবাদ পার্কে বসে আছি।’

– ‘তাহলে এখানে থাকো, আমি পার্কে আসছি। সমস্যা হলো আমার বাসার কাজের মেয়েটা সুন্দর পুরের। আবার গ্রামের একজন সিলেট ডাক্তার দেখাতে এসে আমার বাসায় উঠেছে। তাই বাসায় তোমাদের নিতে চাচ্ছি না। চিনে ফেললে গ্রামে বলে বেড়াবে।’

– ‘আচ্ছা তাহলে আসো এখানে।’

ফোন রেখে দিল মৃদুল। মানহা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,

– ‘ক্ষুধা পায়নি তোমার? চলো খাই কিছু।’

– ‘না ইরফান আসুক তারপর কোনো রেস্টুরেন্টে বসেই কথা বলে নিব।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘ওইযে বাদাম ওয়ালা আসছে ডাক দেবো?’

– ‘তুমি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিলে ডাকতে পারো।’

মৃদুল মুচকি হেঁসে ডাক দিলো। বাদাম ওয়ালার থেকে এক প্যাকেট বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে মানহাকে দেয়া শুরু করলো।
মানহা খেতে খেতে গল্প করছে। হঠাৎ মৃদুলের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে ব্রেঞ্চে
রেখে বললো ওই গাছ থেকে ফুল এনে দাও।

– ‘আরে না ফুল ছিঁড়া নিষেধ।’

– ‘কেউ নাই আশেপাশে চলো তো।’

– ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

মানহাও পিছু পিছু গেল। তারা গাছের অনেকটা আড়ালে চলে এসেছে। মৃদুল উঁকি দিয়ে গাছের ডাল খানিকটা নামিয়ে ফুল ছিঁড়ে এনে বললো,

– ‘এই নাও।’

– ‘এভাবে কেউ প্রেমিকাকে ফুল দেয়?’

– ‘আমি এসব পারবো না।’

– ‘কেন?’

– ‘ফুল নিলে নাও, না হলে ফেলে দিচ্ছি।’

– ‘আচ্ছা নিচ্ছি ফুল, কিন্তু তাকিয়ে দেখো আশেপাশে কেউ নেই।’

– ‘তো কী হয়েছে?’

‘কিছু না’ বলে মানহা চলে যাচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে। মৃদুল ওর হাত ধরে আঁটকে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মানহার চোখে জল চলে এলো৷ কী সিনেমাটিক একটা দৃশ্য। নায়ক নায়িকার হাত ধরে আটকাচ্ছে৷ মানহার সিনেমাটিক ব্যাপারগুলো ভীষণ ভালো লাগে। মৃদুল তাকে টেনে নিজের কাছে নেয়। মানহা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। মৃদুল পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘এতো অভিমান কেন?’

– ‘এগুলো বুঝবে না তুমি, তুমি হচ্ছ পাথর মানব।’

– ‘রক্ত মাংশের মানব হতে হলে কী করতে হবে?’

– ‘তুমি ফুল নিয়ে প্রপোজ করতে পারতে, তাও করোনি। পার্কে আড়ালে-আবডালে প্রেমিক প্রেমিকারা কী করে? তুমি একবার জড়িয়েও ধরো না, চুমু তো অনেক দূর।’

মৃদুল আচমকা ছেড়ে দিল তাকে। ম্লান মুখে চলে গেল ব্রেঞ্চে। হঠাৎ ওর এই আচরণের কোনো কারণ বুঝতে পারে না মানহা। ওর পাশে গিয়ে বসে বললো,

– ‘হঠাৎ কী হলো? এমন মলিন মুখ হয়ে গেল কেন? আমি ভুল কিছু বলেছি না-কি?’

– ‘না কিছু হয়নি, তবে এসব চুমু জড়াজড়ি আমি পারবো না।’

মানহার লজ্জায় কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুলো যেন। সে কী অতিরিক্ত নির্লজ্জ হয়ে গেছে।

– ‘আচ্ছা তোমার এসব করতে হবে না সরি।’

– ‘সরি বলার কিছু হয়নি, ইরফানকে কল দাও অনেক্ষণ হলো আসে না কেন?’

– ‘হ্যাঁ তাইতো, দাঁড়াও কল দিয়ে দেখি।’

মানহা কল দিয়ে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে ওর মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে কেন?’

– ‘কী বলো একটু আগেই তো কথা হলো, আবার কল দাও।’

মানহা আবার কল দেয়। কিন্তু মোবাইল বন্ধ দেখায়।

– ‘কী হলো বুঝতে পারছি না বন্ধ দেখাচ্ছে তো মোবাইল।’

– ‘আরও কিছু সময় পর দিয়ে দেখো।’

– ‘আচ্ছা তাই করি।’

আরও কিছু সময় পর কল দিয়েও মোবাইল বন্ধ দেখালো।

____চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here