বাঁক,২২,২৩

0
191

বাঁক,২২,২৩
জবরুল ইসলাম
( ২২ পর্ব )

মানহা কাঁধ থেকে মাথা তুলে জল ছলছল চোখ মৃদুলের চোখে রেখে বললো,

– ‘কখন যাবে? ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।’

– ‘ট্রেন তো নয়টায়, এখন আটটা মাত্র।’

– ‘কিছু খেয়ে উঠতে হবে না? তাছাড়া যেতে যেতেও তো ত্রিশ মিনিট চলে যাবে।’

– ‘হ্যাঁ, তা ঠিক, চলো যাই৷’

মানহা সবুজ ঘাসের ওপর থেকে নিজের ভ্যানিটিব্যাগটা হাতে নেয়৷ তারপর মৃদুলের হাত ধরে বলে,

– ‘চলো।’

দু’জন টিলা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে।
পাহাড়ের মাঝখানের সরু পথ পেরিয়ে সিএনজি নিয়ে বন্দর আসে। একটা হোটেলে গিয়ে খাবার শেষে রিকশা নিয়ে যায় রেলস্টেশন। মানহা জানালার পাশটায় বসে। মৃদুল ওর পাশে বসতে বসতে বললো,

– ‘যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহলে আমরা ট্রেন থেকে নেমে কোথাও রাত কাটিয়ে দিনে আমজাদ কলোনিতে যেতে হবে না-কি?’

– ‘না, কলোনিতে রাতেই যাওয়া ভালো। কারণ দিনে সবাই কাজে থাকবে। তাছাড়া ইরফান বলেছে আমজাদ লোকটা ভালো না। তবে টাকার লোভ দেখালে না-কি সবকিছুতে সহযোগিতা করবে৷ সুতরাং ওর মাধ্যমে আমরা থাকার ব্যবস্থা করে নিব।’

– ‘হ্যাঁ তা করা যাবে, লোভী মানুষদেরও দেখছি বিপদে-আপদে কাজে লাগে।’

মানহা ফিক করে হেঁসে ওর কাঁধে মাথা রাখে।
বেশিক্ষণ তাদের অপেক্ষা করতে হয় না। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। আশেপাশের সবুজ মাঠ, গাছগাছালি আর দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে মৃদুলের আচমকা ফাতিহার কথা বড়ো মনে পড়ে। ওর ট্রেন চড়ার ভীষণ শখ। নাটক-সিনেমা ছাড়া বাস্তবে ট্রেন দেখেনি কখনও। কি অদ্ভুত ব্যাপার৷ কিছু কিছু মানুষের জীবন একটা সীমানার মধ্যে কেটে যায়। বাংলাদেশে এখনও লঞ্চ চলাচল থাকার পরও কিছু কিছু মানুষ সরাসরি লঞ্চ না দেখে মরে যায়। ট্রেন রোজ বাংলাদেশের বুক দিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে গেলেও কিছু কিছু মানুষ সরাসরি ট্রেন দেখার সুযোগ পায় না। চড়বো চড়বো করেও চড়া হয়ে উঠে না। অথবা কেউ কেউ এসব বিলাসিতার প্রয়োজনবোধ মনে করে না।

– ‘মানহা।’

কাঁধ থেকে মাথা তুলে মানহা বললো,

– ‘কী?’

– ‘তাকিয়ে দেখো কী সুন্দর একটা গ্রাম।’

মানহা তাকায়। সত্যিই ছবির মতোন সুন্দর একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সরু রাস্তা গেছে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে। ‘হাওয়াই মিঠাই, হাওয়াই মিঠাই’ বলা লোকটির পিছু নিয়েছে খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরা একদল বাচ্চারা।
একটা নারিকেল গাছের নিচে বাক্সটা রেখে দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে ফেলে পিচ্চিদের দল। দৃশ্যটি পলকে পেছনে ফেলে যায় ট্রেন। সামনে দৃশ্যমান হয় সবুজ মাঠ। একটা গরুর কাঁধে বসা কালো ফিঙে। খুটিতে বসা কাক। গরু ঘাস থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে।
মানহার ইচ্ছা করছে গ্রামটাতে নেমে যেতে। এতো সুন্দর গ্রাম ফেলে যেতে মন চাচ্ছে না। এই যাত্রাটা যেন মানুষের জীবনের মতোই। সুন্দর কত মুহূর্ত পিছনে ফেলে আসি আমরা। ফেলে আসি সোনালি অতীত। কিন্তু চাইলেই ফিরে যাওয়া যায় না।

সন্ধ্যা ছয়টায় তারা পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম। স্টেশনের বাইরে এসে মৃদুল বললো,

– ‘ইরফানকে মেসেজ দিয়ে বলে দাও আমরা ট্রেন থেকে নেমেছি।’

– ‘হ্যাঁ ভালো কথা মনে করছো।’

মানহা মেসেজ পাঠায়। তারা একটা সিএনজি ডেকে ইরফানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাত আটটায় পৌঁছে যায় আমজাদের কলোনিতে। মানহা ভাড়া চুকিয়ে মৃদুলকে বললো,

– ‘কলোনির ভেতরে যাই।

– ‘হ্যাঁ চলো।’

দু’জন কলোনির একটা গলিতে গিয়ে দেখে একটা রুমের দরজা খোলা। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ পাটিতে বসে ভাত খাচ্ছে। স্ত্রী সামনে বসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে।
মৃদুল এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘ভাই ইশিকে চিনেন? ও কোথায় থাকে বলতে পারবেন?’

পুরুষ লোকটি বললো,

– ‘না চিনি না।’

মহিলাও মাথা নেড়ে না করলো। বিছানায় থাকা আরেকটা ছোট ছেলে শোয়া থেকে উঠে বললো,

– ‘চিনি উনার আম্মার অপারেশন হইছিল এখন তারা চলে গেছে দেশের বাড়ি।’

মৃদুল আগ্রহ নিয়ে তাকায়।

– ‘হ্যাঁ চিনতে পারছো তুমি। আচ্ছা ওরা কোন ঘরে থাকতো জানো?’

– ‘এই গলির পাশের গলির একেবারে মাথায়।’

মানহা একটু এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘আমাদের একটু দেখিয়ে দিতে পারবে?’

ছেলেটি তাদের সঙ্গে এলো। পাশের গলির মাথায় গিয়ে একটা তালা ঝুলানো ঘর দেখালো।

মানহা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘ইশিরা কাদের সঙ্গে বেশি থাকতো তুমি জানো?’

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

– ‘এই ঘরের কোকিলা আপুর লগে।’

মানহা ঘরের দরজায় নক দেয়। দরজা খুলে এক বয়স্ক মহিলা।

– ‘কোকিলা আছে?’

– ‘আমি ওর মা, কি দরকার কন?’

– ‘এই ঘরে ইশি এবং একজন বয়স্ক মহিলা থাকতো না?’

– ‘হ্যাঁ, ওরা এখন নাই এখানে।’

– ‘কোথায় গেছে বলতে পারেন?’

তখন কোকিলা এগিয়ে জবাব দিলো,

– ‘ইশিকে কল দিয়া পাইনা প্রথম দিন থাইকা। কোথায় গেছে জানি না।’

মানহা তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

– ‘কোথায় গেছে কে বলতে পারবে?’

– ‘আমজাদ ভাই পারবে উনি টিকিট কাইটা দিছে। লগেও সিলেট গেছিল।’

মৃদুল অবাক হয়ে বললো,

– ‘উনি লগে সিলেট গিয়েছিল মানে? ইশিদের লগে?’

– ‘হ।’

– ‘আমজাদের বাসা কোথায়?’

– ‘কলোনির সামনের দালান বাড়ি আছে না? ওইটায়।’

মানহা বললো,

– ‘আচ্ছা আপনার নাম্বার দিন আবার দরকার হলে কল দেবো, যাচ্ছি আমরা।’

মেয়েটি দরজা বন্ধ করে দেয়। কলোনি থেকে বের হয়ে দালান ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মানহা বললো,

– ‘ইরফানকে একটা কল দিয়ে আগে জানাই যে আমজাদ সিলেট গিয়েছিল ওদের সঙ্গে, এটা কি সে জানতো।’

– ‘আচ্ছা দাও কল।’

মানহা কল দিতেই ইরফান রিসিভ করলো,

– ‘হ্যালো মানহা, কি অবস্থা? কোথায় এখন?’

– ‘আমরা কলোনিতে ইশির পরিচিত এক মেয়ের সাথে কথা বলে এলাম।’

– ‘কিছু জানতে পারলে?’

– ‘ও বলছে আমজাদ না-কি সিলেট গিয়েছিল ইশিদের সাথে।’

– ‘তাহলে আমজাদ কী এখনও সিলেট?’

– ‘না সে এখানেই আছে।’

– ‘বলো কী? তাহলে তো আমজাদ সবকিছু জানবে। ও কিন্তু মানুষ সুবিধার না। তবুও সুন্দরভাবে লোভ দেখিয়ে হাতে আনতে হবে। তোমরা তাকে বলবে যে ইরফান ইশিদের খুঁজে পাচ্ছে না। যে ওর খোঁজ দিতে পারবে পনেরো হাজার টাকা নগদ পাবে। এরকম তার লাভ দেখাবে বুঝেছো? কোনোভাবে তর্কবিতর্ক বা রাগারাগিতে যাবে না।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘রাখছি এখন।’

মানহা কল কেটে মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে বললো,

– ‘চলো যাই।’

উঠোন পেরিয়ে দালান ঘর। বারান্দায় গ্রিল। মৃদুল ছিটকানি নাড়া দিয়ে ডাকলো,

– ‘আমজাদ সাহেব বাড়িতে আছেন?’

কোনো সাড়া পেল না। আবার সে ডাক দেয়। লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরনে এক জন বের হয়ে এসে বললো,

– ‘কে আপনারা?’

– ‘আপনি কী আমজাদ সাহেব?’

– ‘হ।’

– ‘ভেতরে গিয়ে কী বসা যাবে? একটু দরকার ছিল।’

আমজাদ দরজা খুলে দিয়ে বললো,

– ‘আসেন।’

তাদের বারান্দার বেঞ্চিতে বসতে দিয়ে বললো,

– ‘কন তো কী দরকার।’

মৃদুল বলতে যাবে মানহা তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বললো,

– ‘আসলে আমাদেরকে ইরফান সাহেব পাঠিয়েছেন৷ এখান থেকে ইশি উনার কাছে যাওয়ার কথা ছিল৷ সে যায়নি এবং কলেও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারলে পনেরো হাজার টাকা দেয়া হবে ঘোষণা দিয়েও লাভ হয়নি। এখন আপনাকে খুঁজে বের করলাম আরকি। যেহেতু ইশি এখানে ছিল আপনি জানতে পারেন কোথায় গেছে।’

আমজাদ চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর নিমিষেই তার চেহারা ঝলমল করে উঠে। কারণ সিলেট তার আর দরকার নেই। এমনিতেই আলেয়া বেগমের সাথে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। টাকা ফিরিয়ে দিতে কল দেয় প্রায়ই। সুতরাং এদিকে কিছু টাকা হাতিয়ে নিলে ক্ষতি কী। সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘হ, ওর খোঁজ আমি জানি, মেয়েটির ট্রেনে মোবাইল ছিনতাই হয়েছিল। তারপর ইরফান সাহেবের নাম্বার নাই তাই খোঁজে পায়নি। আমাকে বললো একটা কাজ দিতে তখন পরিচিত এক জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছি৷’

মৃদুল আর মানহা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো,

– ‘ওরা এখন কোথায়?’

– ‘এইটা তো বলা যাবে না, অপরিচিত মানুষকে আরেকজনের ঠিকানা আমি দিতে যাব কেন? তবে ইরফান সাব ইশির পরিচিত জানি। উনার সাথে কলে কথা বলান’ তারপর খানিকটা গলা কেশে নিয়ে বললো, ‘আমার বিকাশ নাম্বারও দিয়ে দিন।’

মানহা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে দিচ্ছি।’

ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ইরফানকে কল দেয় মানহা। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে সে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘হ্যাঁ ইরফান ভাই, আমজাদ সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। উনি না-কি একটা জায়গায় ইশিকে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।’

– ‘কোথায়? ওর ফোন বন্ধ কেন?’

– ‘আমরা অপরিচিত তাই বলতে চাচ্ছেন না, আপনাকে বলবেন।’

– ‘দাও কথা বলি।’

মানহা মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘নিন আমজাদ সাহেব।’

আমজাদ মোবাইল নিয়ে সালাম দিয়ে বললো,

– ‘ইরফান সাব কেমন আছেন?’

– ‘হ্যাঁ ভাই ভালো।’

– ‘ইশিরা কোথায় আছে বলুন তো।’

– ‘এবার ওদের কাছে বলতেছি সমস্যা নাই। আপনি যেহেতু তাদের চিনেন। তা আগে আমার বিকাশ নাম্বারটা নিন।’

– ‘হ্যাঁ বলুন।’

আমজাদ বিকাশ নাম্বার দিয়ে কল রেখে অপেক্ষা করে৷ খানিক পরেই মোবাইলে মেসেজ টিউন বেজে উঠে। সঙ্গে মানহার মোবাইল।

– ‘হ্যাঁ, ইরফান ভাই।’

– ‘জিজ্ঞেস করো টাকা গেছে কি-না।’

– ‘আমজাদ সাহেব টাকা আসছে তো?’

– ‘হ আসছে।’

ইরফানকে লাইনে রেখেই বললো,

– ‘এবার বলুন কোথায় আছে।’

আমজাদ কোনো জড়তা ছাড়াই তাদের স্থানটি বুঝিয়ে বলে দেয়। মানহা আমতা-আমতা করে ইরফানকে বললো,

– ‘তুমি কী চিনেছো?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আলেয়া বেগমের বাড়ি কীভাবে পাব বুঝতে পারছি না।’

আমজাদ সেটা শুনতে পেয়ে বললো,

– ‘খেয়ার ঘাটের মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেই চিনিয়ে দেবে।’

____চলবে___

বাঁক ( ২৩ পর্ব )
_____________

ইরফান ফোনের অপর পাশ থেকে আমজাদের কথা শুনে মানহাকে বললো,

– ‘বুঝতে পারছি, মাঝিকে জিজ্ঞেস করে বের করা যাবে। তোমরা সিলেট আসার পর একসাথে সেখানে যাব।’

– ‘আচ্ছা ইরফান ভাই তাহলে এখন রাখছি।’

মানহা মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে বললো,

– ‘আমজাদ সাহেব, আমরা দু’জন রাতে এখানে কোথায় থাকতে পারব?’

মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে বললো,

– ‘ট্রেন এখন না পাওয়া গেলেও বাস তো মিলবে, তাই না আমজাদ সাহেব?’

– ‘হ্যাঁ তা মিলবে।’

– ‘স্টেশন কতদূর এখান থেকে কীভাবে যেতে হবে?’

আমজাদ খানিক চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

– ‘আসলে এখন রাত অনেক হয়ে গেছে। আপনারা গিয়ে বাসের টিকিট কাটতে ঝামেলা হবে।’

মানহা কুণ্ঠিত গলায় বললো,

– ‘আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করে দিতেন ভালো হতো, রাত নয়টা হয়ে যাচ্ছে।’

আমজাদ ইতিউতি করে বললো,

– ‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আমজাদ চেয়ার থেকে উঠে বারান্দা থেকে ভেতর ঘরে গিয়ে মুহূর্তেই আবার একটা ফতোয়া গায়ে জড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কলে কথা বলতে বলতে বের হলো।

– ‘আসুন আমার সাথে, আপনারা বিদেশি মানুষ আমার বাড়িতে আসছেন। সাহায্য সহযোগিতা না করলে কেমন জানি দেখায়।’

মৃদুল আর মানহা তার পেছনে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে এলো। আমজাদ ফতোয়া একটু টেনে-টুনে ঠিক করতে করতে বললো,

– ‘আপনাদের সিলেট আমার বড়ো ভালো লাগে, আলী আমজাদের ঘড়ি জানেন তো? আহা আমার নামে নাম।’

মানহা পিছু থেকে মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে দিল। মৃদুল চিমটি কেটে দাঁত কটমট করে ইশারায় শাসায়। আমজাদ এসবে খেয়াল না করে কথা বলে যাচ্ছে৷ তারা উঠোন পেরিয়ে পাকা রাস্তায় এলো।

– ‘একটা সিএনজি আসতেছে অপেক্ষা করি এখানে।’

মৃদুল ‘আচ্ছা’ বলে সম্মতি জানায়। মিনিট পাঁচেক পরেই একটি সিএনজি তাদের সামনে এসে থামে। ‘উঠেন’ বলে আমজাদ সামনের সিটে বসে। মানহা আর মৃদুল পিছনে৷

– ‘বাস স্টেশন চল।’

সিএনজি চলতে থাকে। মিনিট তিরিশেক সময় লাগে তাদের বাস স্টেশন আসতে।
আমজাদ তাদেরকে একটা হোটেলে বসিয়ে বললো,

– ‘আপনারা বসে নাশতা করেন, আমি টিকিট নিয়ে আসি।’

‘আচ্ছা’ বলে মৃদুল সম্মতি জানায়।

আমজাদ ইতস্তত করে বললো,

– ‘টিকিট আর সিএনজি ভাড়ার টাকাটা।’

– ‘কত?’

– ‘সিএনজি এক হাজার দিতে হবে আর টিকিট দুই হাজার।’

মৃদুল রূঢ় গলায় বললো,

– ‘কী বলেন এগুলো? এইটুকু জায়গা এক হাজার টাকা কীভাবে? তাছাড়া বাসের টিকিট এতো টাকা না-কি?’

মানহা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,

– ‘উনাকে কি বলছো এগুলো? চুপ থাকো তো তুমি।’

কথাটি বলে মানহা টাকা বের করে দিয়ে বললো,

– ‘এই নিন আমজাদ সাহেব। আমরা অপেক্ষা করছি, আপনি এলে একসঙ্গে নাস্তা করবো।’

‘আচ্ছা’ বলে আমজাদ বের হয়ে গেল। মৃদুল হোটেলের জানালা দিয়ে ‘থুথু’ ফেলে বললো,

– ‘এই শালা তো দেখি মানুষের কাতারেই পড়ে না। সামান্য তথ্য দেয়ার জন্য কত টাকা নিল। এখন আবার সিএনজি ভাড়া আর বাসের টিকিটেও টাকা বাড়িয়ে নিয়েছে।’

– ‘তুমি এতো রাগ করছো কেন বাদ দাও তো।’

– ‘তাকে ছাড়াও আমরা আসতে পারতাম, টিকিটও কাটতে পারতাম।’

– ‘তা ঠিক, তবুও ভেবেছিলাম রাত হয়ে গেছে দেরি হলে বাস মিস হবে।’

– ‘কিন্তু এখন যে টিকিটের টাকা দিয়ে দিলা যদি পালিয়ে যায়?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো তো এসে। মানুষকে তোমার এতো অবিশ্বাস কেন?’

– ‘তোমার এতো বিশ্বাস কেন?’

– ‘বলছি বসো এসে।’

মৃদুল পাশে বসার পর মানহা বললো,

– ‘আমরা আমজাদের বাড়ি চিনি তাই পালিয়ে যাবে না।’

– ‘বাড়ি চিনে কী হবে সে অস্বীকার করতে পারে।’

– ‘হ্যাঁ তোমাকে বলছে, মানুষ চোরা পথে ইউরোপও চলে যায় আগে দালালকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে।’

– ‘কিন্তু আমজাদ চোরাকে দিয়ে দুই টাকার বিশ্বাস নেই আমার।’

মানহা আবার হেঁসে ফেললো।

– ‘নিন টিকিট, দশটায় বাস ছাড়বে। আর বেশি বাকী নেই।’

আমজাদ এসে চেয়ারে বসতে বসতে কথাটি বললো।

মানহা টিকিট হাতে নিয়ে বললো,

– ‘এখানে কী খাওয়া যাবে বলুন তো।’

– ‘ভালো কিছু পাবেন না, সময়ও কম। শিঙারা আর ডিম দিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে নিন।’

মানহা সম্মতি জানায়। আমজাদ অর্ডার দেয়। টেবিলে তিন প্লেট বিরিয়ানি এলো।
কথা বলার মাঝখানে মানহা আমজাদের নাম্বার নিয়ে সেভ করে রাখলো মোবাইলে। খাবার শেষে আমজাদ তাদের বাসে তুলে দিয়ে বিদায় নিল। মানহা বসেছে জানালার পাশে। তাকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যাচ্ছে। নির্ঘুম, বাইরের অখাদ্য খাবার, গোসল না করা কোনো কিছুই তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফেলতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে দিনটা কত সুন্দর। এক সঙ্গে থাকা হয়েছে, ওর পাশটায় বসে অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে ট্রেনে এসেছে। এখন আবার বাসে করে যাবে৷ মানুষটা পাশেই বসা।

– ‘যাক আমজাদ ভালোই ভালোই বলে দিছে ইশিদের কথা। এবার মনে হয় ওদের পেয়ে যাব, কী বলো মানহা?’

মানহা ওর দিকে তাকিয়ে হাতটা পেঁচিয়ে ধরে বললো,

– ‘ইনশাআল্লাহ এবার পেয়ে যাব, প্লিজ দুশ্চিন্তা করো না তো তুমি।’

– ‘তোমাকে ছাড়া এগুলো সম্ভব হতো না মানহা। তুমি কীভাবে যেন সবকিছু সহজ করে দেখো।’

মানহা মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘হুহ, তবুও তো মানুষ আমাকে একটুও আদর করে না।’

কৃত্রিম অভিমান হলেও মৃদুলের বুকটায় চিনচিনে এক ব্যথা অনুভব হয়। আসলেই তো মানহার সঙ্গে সে অবিচার করছে। মেয়েটা তার জন্য কি-না করে যাচ্ছে। তার জন্য নিজের পরিবার থেকেও বঞ্চিত হবার পথে। তবুও একটু ভালোবাসে না সে। বিয়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে নিয়েও তো মানহাকে কাছে টানা যায়। এমন না যে মানহাকে তার ভরণ-পোষণ করতে হবে৷ ওটা সে নিজেই পারবে। কেবল তার নিখাদ ভালোবাসা চায় মানহা। সেও কী চায় না? অবশ্যই চায়, কেবল বিবাহিত বলে বারবার নিজের হাত গুটিয়ে নিতে হচ্ছে তার।

বাস চলতে শুরু করেছে, ভেতরে বাতির আবছা আলো। প্রায় সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। কেউ মোবাইল টিপছে, কেউবা ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখবুজা। মানহাও ফেইসবুক নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করতে যেয়ে একটা বেবির ছবি দেখে মৃদুলকে দেখিয়ে বললো,

– ‘অনেক কিউট তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

মানহা তার কাঁধে মাথা রেখে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ‘আমারও এমন বেবি চাই।’

মৃদুল দাঁত কটমট করে তাকায়। ইশারায় বাসের মানুষ দেখায়৷ মানহা এসব পাত্তা না দিয়ে বললো,

– ‘ইশিদের পেয়ে গেলে কালই ওদের জলেস্বরী নিয়ে যাব।’

– ‘নিয়ে?’

– ‘আলাদা বাসা ভাড়া নিব। আমরা সবাই সেখানেই থাকবো। তাছাড়া শিগগিরই বিয়ে করবো।’

মৃদুল কোনো জবাব দেয় না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেয়।

তারা সিলেট পৌঁছে গেল পরেরদিন ভোরে। মানহা বাস থেকে নেমে হাই তুলে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘তোমার চোখ এতো লাল হলো কেন?’

– ‘লাল হবে না? তোমার মতো পুরো রাস্তা তো আমি ঘুমিয়ে আসিনি।’

– ‘আচ্ছা আমরা কোথাও গিয়ে নাশতা করি। তারপর ইরফান ভাইকে কল দিতে হবে।’

– ‘আগে কল দাও, তারপর আমরা ব্রিজের ওপারে গিয়ে নাশতা করতে করতে সে চলে আসবে।’

– ‘কিন্তু ও তো অসুস্থ, আসতে পারবে কি-না কে জানে।’

– ‘কল দিয়ে দেখো।’

– ‘সবেমাত্র ছয়টা বাজে এতো ভোরে কল দেবো?’

– ‘হ্যাঁ দাও, সে আসতে এমনিতেই দেরি হবে।’

মানহা মোবাইল বের করে কল দেয়। কয়েকবার কল হবার পর ইরফান রিসিভ করে ঘুম ঘুম গলায় বললো,

– ‘হ্যালো।’

– ‘ইরফান ভাই আমরা তো সিলেট এসে গেছি।’

– ‘আচ্ছা তোমরা বন্দর কোথাও বসে নাশতা করো আমি এসে কল দিচ্ছি।

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

মানহা মোবাইল ব্যাগে রেখে বললো,

– ‘আমাদের বন্দর বসতে বলছে।’

‘আচ্ছা’ বলে মৃদুল একটা রিকশা ডাকে। দু’জন রিকশায় উঠে বসে।
মানহা বললো,

– ‘এখন ভাত খেলেই ভালো হতো।’

– ‘এতো ভোরে ভাত পাবে না। এখন নাশতা করতে হবে।’

– ‘তুমি খুব এক্সাইটেড তাই না?’

– ‘কেন?’

– ‘কতদিন পর মা বোনের সাথে দেখা হবে।’

– ‘হ্যাঁ সতেরো বছর পর।’

– ‘আমিও এক্সাইটেড।’

– ‘কেন?’

– ‘আমিও তো ইশি আর আন্টিকে চিনি জনাব।’

– ‘সেটা তো মাত্র কয়েক সপ্তাহের চেনা।’

– ‘থাকলেও শৈশবের কিছু কিছু স্মৃতি মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভোলা যায় না। স্মৃতিগুলো যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয় তাও না।’

– ‘কে বলছে এই কথা?’

– ‘কেউ বলতে হয় না আমি জানি। তবে একটা বইয়ে পড়েছিলাম। ধরো তুমি অসুস্থ অবস্থায় দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় উদাস মনে বসে গাছের উপর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছো। তখন একটা পাখি ডেকে গেল৷ কাকও ধরো ডেকেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এই দৃশ্য কোনো যুক্তি ছাড়াই আজীবন তোমার মনে থাকতে পারে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, ওইদিন আমি জর্দা দিয়ে ঠোঁট লাল করে পান খেয়ে মাথা ঘুরিয়েছিল না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এরপর থেকে কাউকে পান খেতে দেখলে আমার শরীরে লোম দাঁড়িয়ে যায়।’

– ‘বলো কী এটা সামান্য ব্যাপার ছিল।’

– ‘সমান্য হলেও এটা হয়তো আমার কয়েকবছর স্থায়ী থাকবে অথবা সারাজীবন। ওইদিন চেম্বারে এক প্যাসেন্টের মা’কে পান চিবুচ্ছে দেখে আমার অসহ্য লাগছিল৷ কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলাম না৷ বারবার চোখও চলে যায় মহিলার দিকে। তারপর মাথা ব্যথা চলে এলো।’

মৃদুল হেঁসে উঠলো কথা শুনে। মানহা হাতে চিমটি কেটে বললো,

– ‘হাসছো কেন?’

– ‘তুমি বাচ্চাদের মতো কথা বললে হাসবো না?’

– ‘আমি বাচ্চাদের মতো কিছুই বলিনি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে বলোনি।’

বন্দর এসে রিকশা থামলো। ভাড়া চুকিয়ে দু’জন গেল নাশতা করতে। প্রায় মিনিট তিরিশেক পর কল এলো ইরফানের।

– ‘হ্যালো ইরফান ভাই।’

– ‘হ্যাঁ কোথায় তোমরা? আমি বন্দর এসেছি।’

মানহা রেস্টুরেন্টের নাম বলতেই খানিক পর ইরফান এলো৷ হালকা-পাতলা গড়নের লম্বা একটি ছেলে। শ্যামলা গায়ের রঙ। দাঁত অস্বাভাবিক পরিষ্কার। মুখ ক্লিন সেভ করা। হাফহাতা সাদা গেঞ্জি পরনে। এক হাত বেন্ডেজ করা। মানহা দেখেই হাত তুলে বললো,

– ‘এইতো ইরফান ভাই এসে গেছে।’

মৃদুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। ইরফানকে একদম চেনা যাচ্ছে না। কত ভীতু ছিল। এখন বড়ো হয়েছে, চেহারায় আভিজাত্য একটা ভাব। শিক্ষকতা করায়। উত্তেজনায় মৃদুল বসা থেকে উঠে এগিয়ে গেল। ইরফানও মিষ্টি সরল একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘তোমাকে দেখেই চেনা যাচ্ছে মৃদুল ভাই। ইশি তো দেখলেই চিনে ফেলবে।’

– ‘কিন্তু তোকে চিনবে না। একদম বদলে গেছিস।’

– ‘আচ্ছা চলো বসি। কত বছর পরে আবার দেখা হলো।’

___চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here