বাঁক,২,৩

0
302

বাঁক,২,৩
লেখা: MD Jobrul Islam
২য় পর্ব

এখন মৃদু বাতাসের সঙ্গে শ্লথ গতিতে বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে বাজারে আসতে শুরু করেছে৷ কারও হাতে ছাতা আবার কারও পরনে রেইনকোট।
নিঃশব্দে খানিক্ষণ কেটে গেল তাদের। নীরবতা ভেঙে পুনরায় মেয়েটিই বললো,

– ‘আমার নাম মানহা জান্নাত।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।’

মৃদুল মাথা তুলে তাকায়। মানহাকে ভালোভাবে পরখ করে সে। অচেনা একটা মেয়ে তার সঙ্গে এভাবে আচরণ করার কারণ কী হতে পারে? মোবাইল নাম্বারই বা কেন চাচ্ছে? এগুলো মানহাকেই জিজ্ঞেস করা যায়। কেউ তার কাছে নাম্বার চাইলে প্রয়োজনটা কী তার জানার অধিকার আছে। কিন্তু মৃদুল ভীষণ সতর্ক। অধিক ঘাটাঘাটি করতে যাবে না সে। তাই অবিকৃত চেহারায় বললো,

– ‘আমার মোবাইল নেই ম্যাডাম।’

– ‘ফকির।’

– ‘কি?’

– ‘এক কথা একবার বলি।’

মৃদুল কিছু না বলে কেবল দাঁত কটমট করে তাকায়। খানিক পর বলে,

– ‘প্লিজ আপনি এবার যান। দোকানের মালিক চলে আসবে।’

– ‘মালিককে এতো ভয় পান? আপনি একটা নিবীর্য পুরুষ।’

মৃদুল এবার রূঢ় গলায় বলে,

– ‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।’

মানহা ফিক করে হাসে,

– ‘আচ্ছা আজ যাচ্ছি আবার দেখা হবে।’

এই কথা বলে মানহা চলে যায় সেদিন। এরপর প্রায়ই দোকানে আসে। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে তাকে বিপর্যস্ত করে চলে যায়। আজ সকালেও এসেছিল। তাকিয়ে দেখলো মালিক আসেনি। একা বসে আছে মৃদুল। মানহা রিকশা বিদায় করে নিঃসংকোচে পা টিপে টিপে দোকানে আসে। মৃদুল শঙ্কিত চেহারায় চেয়ে থাকে কেবল৷

– ‘মালিক আসেনি এখনও?’

– ‘না।’

– ‘সকালের নাস্তায় কী খেলেন?’

সে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললো,

– ‘আপনি প্রতিদিন এসে কি শুরু করেন বলুন তো।’

– ‘কী শুরু করি?’

মৃদুল কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। মানহা পুনরায় বললো,

– ‘একদিন নির্জন কোথাও গিয়ে বসি?’

– ‘কেন?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘অবিবাহিত ছেলে-মেয়েরা নিভৃতে কী করে?’

– ‘জানি না, তবে আমার কোথাও যাবার সময় নেই। দোকানে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয়।’

– ‘বেতন কত দেবে?’

– ‘আপনি জেনে কী করবেন?’

– ‘ভাবছি আপনাকে চাকরিই তো দেয়ার কথা না৷ তাই বেতন দেয় কি-না জানতে চাচ্ছি।’

মৃদুল মূক হয়ে তাকিয়ে রইল। মানহা পুনরায় বললো,

– ‘আমাকে ভয় পাবেন না। বরং আমি উল্টো আপনার অনেক সমস্যাই সমাধান করে দিতে পারি।’

– ‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’

– ‘এই দোকান ছেড়ে দিন। পদে পদে ঝামেলা থেকে আমি একটা চাকরি দেবো আর ঝামেলায় পড়বেন না।’

– ‘কে আপনি? আমি কেন ঝামেলায় পড়বো?’

মানহা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘এতো যুক্তিতর্ক, দ্বিধা, শঙ্কা বাদ দিয়ে উপকারীর উপকার নেন। আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’

মৃদুলের গলা শুকিয়ে আসছিল। তবুও সে ব্যগ্র গলায় বললো,

– ‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?’

– ‘শুনুন, আপনি আমার ডেন্টাল কেয়ারে সহকারী হিসেবে যোগ দিন৷ এখন যে ছেলে আছে তার সঙ্গেই আপনি কাজ করবেন। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু শিখে নিবেন আপনি। এক সময় ওই ছেলেটিকে বাদ দিয়ে শুধু আপনাকে রাখবো।’

– ‘আপনার লাভ কী এখানে?’

– ‘বেশি ঘাটের জল খেলে এই এক সমস্যা। মানুষ তখন লাভ ক্ষতিই সবকিছুতে খুঁজে। আমি আপনার মতো বেশি ঘাটের জল খাইনি।’

– ‘আমার উপকার করার তো একটা কারণ থাকবে, তাই না?’

– ‘আপনার সঙ্গে আমি প্রেম করবো। আপনাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে এটাই কারণ।’

– ‘মিথ্যে কথা।’

মানহা উচ্চস্বরে হেঁসে বললো,

– ‘তাহলে নিজেই বলুন কারণটা কী?’

মৃদুল সতর্ক হয়ে গেল৷ তারপর কথা না বাড়িয়ে বললো,

– ‘আমি ভেবে দেখবো।’

– ‘অযথা পালাবেন না। আমার কাছে আপনি সেইফ।’

মূদুল বোকার মতো কেবল ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। মানহা মুচকি হেঁসে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে ক্ষীণস্বরে বলে,

– ‘আপনার মালিককে এভাবে বলতে পারেন। আপনি ডেন্টালের এক বছরের কোর্সে ছয় মাসের মতো পড়ে টাকার সমস্যার কারণে বাদ দিয়েছিলেন। যন্ত্রপাতির নাম অল্প অল্প জানেন। পুরোপুরি কাজ শেখার জন্য মানহা ডেন্টাল কেয়ারে যাবেন তাই দোকান ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন।
মালিক যদি বলে এগুলো শিখে সার্টিফিকেট ছাড়া সহকারীর চাকরি পাবি না। তাহলে আপনি বলবেন থানা টাউনের মতো ছোটখাটো বাজারে কাগজ ছাড়া কাজ জানলেই সহকারী হিসেবে রাখে। আপনি আগেও অন্য জায়গায় করেছেন।’

– ‘মালিককে এতকিছু বলার কী দরকার?’

– ‘কারণ এ অঞ্চলের সবাই দেখবে আপনি আমার ওখানে কাজ করেন। তাই মালিককে একটু ডিটেইলসে বলে যাওয়াই ভালো। অন্যরা আপনার সম্পর্কে মাঝে মাঝে উনাকে জিজ্ঞেস করবে। তখন আপনি মালিককে যে তথ্যগুলো দিয়ে যাবেন। উনিও সেগুলো অন্যদের বলবেন।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘ঠিকাছে আমি এবার যাচ্ছি।’

– ‘দাঁড়ান।

– ‘কী?’

– ‘আপনার নাম্বার বলুন।’

মুচকি হেঁসে মানহা নিজের নাম্বার বলে। মৃদুল কাগজে লিখে রাখার পর সে চলে যায়।
‘গ্যাটর গ্যাটর’ শব্দ করে আবার ফ্যান চলতে শুরু করেছে।
বরকত মিয়া বিড়ি টানার ইস্তফা দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। কোণার দিকের ছেলেটির এখনও ফোনালাপ চলছে।
মৃদুল আবার তেল চিটচিটে বালিশে মাথা পেতে ভাবছে মেয়েটি কে হতে পারে? তার নানাবাড়ির না-কি দাদার বাড়ির কেউ? চেনার পরও যেহেতু বলছে তাকে ভয় পাবার কিছু নেই, তাহলে ওর সঙ্গে কাজ করা উচিত। অন্তত সব জায়গায় নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে লুকোচুরি করে থাকতে হবে না। আচ্ছা মেয়েটি তাকে যেহেতু চিনে ওর কাছে কী তার মা, বোনের খবর জানা যাবে? তারা এখন কোথায় আছে? আদৌও কী বেঁচে আছে? ফোনটা বেজে উঠল তার। মনে পড়ে গেল মানহাকে মিথ্যে বলেছিল মোবাইল নেই।
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না ভেসে এলো।
খানিক্ষণ কান্নার সুযোগ দেয় মৃদুল। তারপর মিষ্টি করে বলে,
– ‘ফাতিহা।’

ওপাশে কান্নার তোড় খানিকটা কমে আসে। তারপর নিজেকে সামলে বলে,

– ‘হু।’

– ‘কান্নাকাটি করতাছো ক্যান?’

– ‘কী আর করমু আমি কও, হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল।’

– ‘বাড়ির সবাই ভালা আছেনি?’

– ‘ভালা।’

– ‘ছবি দেইখা কেউ সন্দেহ করছেনি আমারে?’

– ‘পুলিশরে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু মুরব্বি অনেকেই বলাবলি করছে এইটারে দেখতে পুরাই মৃদুলের মতো লাগে। মৃদুল এই গ্রামে যখন আইছিল এইরকম ছিল।’

– ‘আইচ্ছা আগে কও তো তুমি শিওর বুচ্ছিলা ক্যামনে আমি ওই ছবির ছেলে?’

– ‘আমি তোমারে চিনমু না কও? সেই যে গ্রামে আইছিলা দাদা ভাইয়ের লগে। এরপর থাইকা আমরা এক লগেই বড়ো অইছি। আমি চিনমু না? আর তোমার গ্রামের বাড়ির কথা আর কেউরে না কইলেও আমারে কইছিলা কতবার। মা বইনের কথা বইলা কত কান্নাকাটি করছো সবই তো আমার ধারে বইয়া।’

– ‘বুচ্ছি ফাতিহা। আইচ্ছা ওই ছবির লগে আমার মিল কী?’

– ‘তোমার ডাইন চুউক্ষের নিচে কালা তিল। ছবিতেও আছে। এখন আরও বড়ো অইছে তিলটা। আর গঠনও সেইম।’

– ‘আইচ্ছা ফাতিহা তুমি কী তারপরও বিশ্বাস করো আমারে?’

– ‘হু, কিন্তুক আমি চাই আমারে তুমি সবকিছু খুইলে বলো।’

– ‘হু, কইমু সময় আইলে ফাতিহা৷ আইচ্ছা কেউ যদি বলে তোর জামাই কই৷ কইবা শহরে কামে গেছে। বিয়ার পর তো আর দাদা ভাইয়ের কাম কইরা সংসার চলতো না। তাই শহরে পাঠাইছি।’

– ‘হু।’

– ‘তুমি আমার লক্ষী বউ।’

– ‘কোনে আছো তুমি?’

– ‘এগুলো জানার দরকার নাই ফাতিহা। আমি আছি৷ ভালাই আছি। এখন রাখি ফোন।’

– ‘হু।’

– ‘ভালা থাইকো, রাখলাম।’

কল কেটে মৃদুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটির কথা। যেদিন একটা কিশোরের জীবন নদীর মতোন বাঁক নিয়েছিল।
২০০৪ সাল। বয়স বারো-তেরো হবে। সে কাঁদতে কাঁদতে পালাচ্ছে। কোথায় যাবে সে জানে না। শুধু জানে তাকে পালাতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। যেখানে তাকে কেউ চিনবে না। অন্ধকারে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামের পর গ্রাম পেছনে ফেলে যাচ্ছে। আচমকা লঞ্চের ডাক শুনে। বুঝতে পারে সে সুন্দরপুর লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে। এই লঞ্চ ধরতে পারবে না সে। রাত আটটায় শেষ লঞ্চ ভাটি অঞ্চলের দিকে যাবে। সেটাই তাকে ধরতে হবে। খাল-বিল হাওর পেরিয়ে সুন্দর পুর লঞ্চঘাটে গিয়ে দাঁড়ায়। কাদামাখা হাত-মুখ কী একটু ধুয়ে নিবে? উত্তাল কুশিয়ারার দিকে তাকিয়ে সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না সে। চারধারে অন্ধকার। নদীতে কেবল বাতি জ্বালিয়ে ছোট ছোট নৌকা এদিক-ওদিক যাচ্ছে। ঘাটে যাত্রী কম। চা’র স্টলে হারিকেনের আলো জ্বলছে। চা খেতে খেতে কয়েকজন গল্প-গুজব করছে। সে দূরে দূরেই থাকলো। কাছে গেলেই নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। তখনকার ছোট্ট মৃদুল বুঝে নিয়েছিল জীবন নদী যেদিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে মানুষের কাছাকাছি থাকার নিয়ম নেই। দূরে থাকাই মঙ্গল, ঝুঁকি কম।
খানিক পরেই নদীর পাড়ের শীতল বাতাসের কারণে মৃদুলের কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।
সে ঘাস দেখে বসে পড়ে। মশা বারবার চাদরের মতো ঢেকে দিচ্ছে তাকে। শরীর নাড়া দিলে আবার বিরক্তিকর সুর তুলে সব পালিয়ে যায়। দূরে কোথাও দলবেঁধে শেয়াল ডাকছে। পাশের কোনো গ্রামে ‘এই তৈয়ব’ বলে কেউ হাঁক দিলো। নদীর কিনার ঘেঁষে গান বাজিয়ে একটা নৌকা যাচ্ছে। গাঁজার কটু গন্ধ ভেসে এলো সেই নৌকা থেকে। তাদের চোরা আলোয় একটা মেয়েকেও দেখা ফেললো মৃদুল।
অপেক্ষার প্রহর শেষে রাতের সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ফালাফালা করে লঞ্চের ডাক শোনা গেল তখনই। ক্ষীণ সময় পরেই খানিক আগের নৌকা লঞ্চের ছুড়ে মারা আলোয় দৃশ্যমান হয়ে গেল। মেয়েটি মুখ ডেকে নিল চাদরে। কিন্তু চোখের পলকে ঘটে গেল বিপত্তি। আঁতকে উঠল মৃদুল।

—চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam

#বাঁক ( ৩য় পর্ব )
____________

অন্ধকারে লঞ্চের আলো নদীর জলে পিছলে পড়ে ঢেউয়ের সঙ্গে নৃত্য করছে। ঠিক তখনই মৃদুল দেখতে পায় লঞ্চ যতই কাছাকাছি আসছে ঢেউয়ের তোড়ে ছোট্ট নৌকাটি বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। লঞ্চ আসছে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে।
নৌকাটির মাঝি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। সঙ্গের ছেলে তিনটি সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে।
নৌকায় চাদরে ঢেকে নিজেকে আড়াল করা একমাত্র মেয়েটি আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি শুরু করেছে। ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রামে হেরে গিয়ে আচমকা মৃদুলের চোখের সামনেই নৌকাটি উলটে গেল। প্রথম চিল্লানি মৃদুল অনেকটা নিজের অজান্তেই দিয়ে সেদিকে ছুটে যায়। লঞ্চ থেকে একসঙ্গে অসংখ্য মানুষ ‘হায় হায় ডুবে গেল রে, ডুবে গেল রে’ বলে শোরগোল করছে।
পাশের দোকান থেকেও চাচারা জমে উঠা গল্প ইস্তফা দিয়ে নদীর পাড়ে এসে জড়ো হয়েছেন। কিন্তু আশংকাজনক কিছুই হয়নি। নাও অনেকটা কিনার ঘেঁষেই যাচ্ছিল। পাঁচজনই নদী সাঁতরে উঠে এসেছে।
কিন্তু তারা কাউকে হা-হুতাশ করার সুযোগ না দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটিকে নিয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে। দোকানে বসা অতি উৎসুক চাচারা কেবল একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ইতি টানলেন না।
এদেরকে ডেকে দাঁড় করাতে এগিয়ে গেলেন।
মৃদুল শেষটা দেখতে পারলো না৷ লঞ্চের ডাক শুনে দৌড়ে গিয়ে উঠতে হয়েছে।
তার পরনে হলুদ গেঞ্জির সঙ্গে কাদামাখা পুরাতন জিন্স প্যান্ট৷ সবার দৃষ্টিগোচর না হলেও সে মনে-প্রাণে জানে এই প্যান্টের চেইন নেই। কোমড়ের বাঁধা মন্ত্র পড়া শক্ত তাগার উপরে জোরপূর্বক বেল্টের কাজও চাপিয়ে দিয়েছে। লঞ্চের আলোয় নিজের করুণ অবস্থা নিয়ে বড়ই লজ্জায় পড়ে গেল সে। নোংরা পোশাক দেখে লোকজন দলবেঁধে তাকাচ্ছে। মানুষের দৃষ্টির অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য সে ধীরে ধীরে উপরে উঠে লঞ্চের পিছনের দিকে গিয়ে অন্ধকারে বসে পড়ে। অজগর সাপের মতো লঞ্চ একটা গা ঝাড়া দিয়ে বাচ্চাদের নাকি সুরে কান্নার মতোন আর্তনাদ করতে করতে ছুটতে শুরু করে। লঞ্চ নদীর বুক ছিঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সে তাকিয়ে আছে পেছনের দিকে। কেউ যেন তার কোমড়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায়। রাতের আকাশের ঝলমলে বিন্দু বিন্দু তারা পেছনে ফেলে সে কোথায় ছুটে যাচ্ছে? গন্তব্য কোথায়? অচিন পুর? মানুষের কি আদৌও গন্তব্য নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা আছে? মৃদুল উঠে গিয়ে রেলিঙ ধরে নদীতে তাকায়। ঢেউয়ের ওপর লঞ্চের জানালা দিয়ে বাতির আলো লাফিয়ে পড়েছে।
একজন চা নিয়ে নাকি সুরে ‘এই চা লাগবে চাআয়া’ বলে এদিকে আসছে।
সে কি এই লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে কেকগুলো ছিনিয়ে নিতে পারবে? এটাই তো মানুষের আদি পেশা। কাড়াকাড়ি, মারামারি যে পারবে তারই জমি, ফসল। মানুষ এখন সভ্য হয়েছে। গায়ে পোশাক উঠেছে। সরাসরি কাড়াকাড়ি করে না। সে আবার অন্ধকারে গিয়ে বসে পড়লো। পেটের ক্ষুধা মাথাঝাড়া দিয়ে উঠেছে। শীত শীত লাগছে ভীষণ। অবশ্য পেছনের দিকে বসায় ঠান্ডা বাতাস লাগছে না৷ সে পা দু’টা ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে কুণ্ডলি পাকিয়ে চোখ বুজে।
ঘুম যখন ভাঙলো তখন রাত কয়টা সে জানে না। বাঁ হাতে ‘ঝি ঝি’ করছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেল পায়েও ‘ঝি ঝি’ ধরে অবশ হয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে রেলিঙ ধরে পাড়ের দিকে তাকায়। সৌর বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে চারদিকে। মস্ত বড়ো বাজার মনে হচ্ছে। সে ঘোরের মধ্যে নেমে গেল সেখানে। একটা সাইনবোর্ডে লেখা রূপগঞ্জ লঞ্চঘাট। লঞ্চ থেকে নেমে মানুষ পাশের একটা চা স্টলে ভিড় জমিয়েছে।
সে ধীরে ধীরে দোকানে ঢুকে প্রথমে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে এক চুমুকে সবটুকু খেয়ে নেয়।
তারপর অধিক চিন্তা-ভাবনা না করে দোকানিকে গিয়ে বললো,
– ‘দুইটা কলা আর কেক দিন চাচা।’

দোকানি তাকে কেক আর কলা বাড়িয়ে দেয়। পেছনের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে। প্রথমে একটা কলা আর দু’টা কেক খেয়ে নেয় দ্রুত। তারপর ভাবতে লাগলো কীভাবে বের হবে। দরজার দিকে সতর্ক চোখ রেখে শেষের কলাটি ধীরে ধীরে খায়।
আচমকা লঞ্চের ডাক দিল। বসে বসে আয়েশ করে বিড়ি-সিগারেট টানতে থাকা লোকজন বিল দিতে দোকানিকে ঘিরে নিল। সে শ্লথ গতিতে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার মতো শব্দ হচ্ছে। আলগোছে সে বেরিয়ে পড়ে দোকান থেকে। বাজারটা তার পছন্দ হয়েছে। লঞ্চে না গিয়ে হাঁটতে থাকে। এগলি-ওগলি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কয়েকটা নেড়ি কুকুরের সামনে পড়ে যায়। প্রথমে কুকুরগুলো কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। সে আলগোছে তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে গেল।
তখনই ‘ঘেউ ঘেউ’ করে পেছন থেকে তাড়া করলো কুকুর। সে ত্রাসে দৌড়াতে শুরু করে। খানিক পর একটা ইটের রাস্তা পেল সামনে। ভাঙা ইটের টুকরো হাতে নেয়ার জন্য নুইয়ে বসতেই কুকুরগুলো উলটো দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুলে চারদিকে তাকায় মৃদুল, বুঝতে পারে সে বাজারের বাইরে চলে এসেছে। রাস্তার পাশে একটা স্কুল দেখতে পেল। বড়ো করে লেখা ‘রূপগঞ্জ হাই স্কুল’। তার নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, রূপগঞ্জ বাজার’।
সে ইটের রাস্তা ধরে গন্তব্যহীন পথ চলতে শুরু করে। খানিক পথ যেতেই সামনে পেল একটা মসজিদ। পাকা ইদগার পরে একটা পুকুর। গেইট খুলে ইদগা পেরিয়ে পুকুর ঘাটে যায় সে। মুখ-হাত ধুয়ে জামা-কাপড় পানি দিয়ে মুছে নেয়।
ঘাটের দু’পাশে সোফার মতো পাকা করে বসার জায়গা। একটায় উঠে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে সে। কারও ডাকে ঘুম ভাঙার পর নাকে তখন ভুরভুরে আতরের ঘ্রাণ পায়। চোখ মেলতেই বুঝতে পারে তার গায়ে চাদর। শরীর প্রচণ্ড গরম। কেউ একজন তাকে আবার ধাক্কা দেয়। কিন্তু মাথা বের করতে ইচ্ছা করছে না তার৷ শুনতে পেল একজন বলছে, ‘ইমাম সাব ছেলেটার তো জ্বর আইছে মনে অয়।’

– ‘জ্বি জ্বরই মনে হচ্ছে।’

– ‘কি করবো এখন?’

– ‘টেনে তুলে জিজ্ঞেস করি বাড়ি কোথায়, এখানে কি করছে।’

– ‘পরে জিজ্ঞেস করা যাইব। ওরে আগে বাড়ি নিয়া ওষুধ খাওয়াই।’

– ‘হ্যা তাহলে তাকে টেনে দাঁড় করাই ধরুন।’

মৃদুল তাদের কথোপকথন শুনে ভেবে পাচ্ছে না তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে৷ এখানে কীভাবে এলো, কেন এলো এগুলো জিজ্ঞেস করলেই বা সে কি জবাবা দেবে। তবে আপাতত সিদ্ধান্ত নিল অসুস্থতার বাহানা করে সকল প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে। দু’জন তাকে ধরে দাঁড় করালো।
– ‘আস্তে আস্তে হাঁটো আমাদের লগে। বাড়ি কোনে তোমার?’

সে কোনো জবাব না দিয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। অনেক্ষণ হাঁটার পর চোরা চাহনিতে দেখতে পায় সামনে একটা চওড়া বাঁশের সেতু। তাকে নিয়ে তারা সেতু পেরিয়ে সরু মাটির রাস্তায় গেল। রাস্তার দু’পাশে নানান ধরনের গাছ-গাছালি। আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ডালিম, পেপে, পিয়ারা আর লেবুর গাছে ভরপুর। আরেকটু যেতেই দৃশ্যমান হলো একটা হাফ ওয়াল টিনের ঘর। এর দুপাশে আরও দু’টা ঘর। মাঝখানে বিস্তৃত উঠোনের সামনে সামনে বিশাল একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে সারি সারি নারিকেল আর সুপারি গাছ। তাকে বাড়ির বাঁ পাশের টিনের ঘরের দিকে নিয়ে গেল তারা। দরজার খিল তুলে ধাক্কা দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো। ছোট্ট ঘরের একটা দড়িতে কিছু কাপড় আর টিনের লোহায় ক্যালেন্ডার ঝুলানো। খাটের পাশে কাঠের চেয়ার। তাকে ফুল তোলা বিছানায় শুইয়ে কাঁথা উপরে দিয়ে দেয়া হলো। সে চোখবুজে ভান ধরে পড়ে রইল। তার জ্বর এসেছে, কিন্তু চেতনা পুরোপুরি আছে।
– ‘ইমাম সাব আপনে বইন চেয়ারে। আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতেছি।’

– ‘না আমি যাচ্ছি এখন খাঁন সাব।’

– ‘আরে না বইন আপনে।’

তিনি বাইরে গেলেন। ঘরে নীরবতা নেমে এলো। খানিক পরেই আবার ফিরে এলেন।

– ‘ছেলেটা মসজিদে কই থাইকা আইল বুঝতেছিনা হুজুর।’

– ‘জাগলে জিজ্ঞেস করতে হবে।’

– ‘গরু মাঠে দিয়া ফার্মেসি থাইকা জ্বরের ওষুধ আনতে হইব। ছেলেটা আশেপাশের কোনো গ্রামেরই হইব কি কন? মা-বাপ মনে অয় মারছে আর রাগ কইরা মসজিদের ঘাটে আইসা ঘুমিয়ে পড়েছে।’

– ‘তা হতে পারে।’

খানিক পর আবার দরজায় শব্দ হলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠে সালাম দিলো। হুজুর জবাব দিয়ে বললেন,
– ‘ফাতিহা, ভালো আছো।’

– ‘জ্বি হুজুর।’

– ‘কাল মক্তবে যাওনি কেন?’

– ‘মাথা বেদনা আছিল।’

তারপর বিছানায় কিছু একটা রাখা হয়েছে টের পেল মৃদুল। কাঁথার ফাঁক দিয়ে তাকায় সে। একটা ট্রে-তে দু’টা প্লেট। প্রথমেই দেখতে পেল পিস পিস করা লাল টকটকে পাকা পেঁপে। জিভে জল চলে এলো তার। পেটের ক্ষুধা মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তার পাশে বসেই তারা দুই প্লেট পেঁপে খেল। খানিক পর মেয়েটি আবার এলো চা-বিস্কিট নিয়ে। সে কাঁথার ফাঁক দিয়ে এই প্রথম পিচ্চি ফাতিহাকে দেখলো।

—চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here