বাঁক,২৪,২৫

0
153

বাঁক,২৪,২৫
জবরুল ইসলাম
(২৪ পর্ব )

ইরফান বসলো মানহার সামনের চেয়ারে।
আহত হাতটা টেবিলে আলগোছে রেখে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘ডাক্তারনি ম্যাডামের কী অবস্থা? কেমন আছো?’

মানহাও রসিকতা করে বললো,

– ‘ভালো আছি স্যার।’

– ‘স্যার?’

– ‘শিক্ষক মানুষ।’

তিনজন হেঁসে উঠলো।

– ‘তোমদের কী নাশতা করা শেষ?’

– ‘হ্যাঁ, তুমি তো করে আসোনি মনে হচ্ছে।’

– ‘না, এখানে চা খেয়ে নিব।’

ওয়েটারকে চা দিতে বললো ইরফান। মৃদুল ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘এখন কী অবস্থা হাতের?’

– ‘ভালোই।’

মানহা বললো,

– ‘শুধু কী হাতে লেগেছে?’

– ‘না পায়েও আছে। আচ্ছা এগুলো থাক। তোমাদের কীভাবে দেখা হলো সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। আমি কত খোঁজাখুজি করেও পাইনি।’

মানহা ফিক করে হাসে। মৃদুল তাকে পুরো ঘটনা খুলে বললো। রূপগঞ্জ শুনে ইরফান অবাক হয়। কারণ কিছুদিন আগের খুনের ঘটনা রূপগঞ্জ হয়েছে সে জানে। তবুও এসব আলোচনায় না গিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদুলকে বললো,

– ‘তুমি এখন থেকে আর পালাবে না। পুলিশ ধরে নিলে নিক সমস্যা নেই।’

মৃদুল অবাক হয়ে বললো,

– ‘পুলিশে ধরা নিলে সমস্যা নেই মানে?’

– ‘পুলিশ ধরে নিলে আসল ঘটনা সামনে আসবে। তুমি যা গোপন করতে চাচ্ছ সেটা করার দরকার নেই। আমি পরিচিত এক আইনজীবীর সাথে কথা বলেছিলাম।’

মানহা পাশ থেকে বললো,

– ‘হ্যাঁ, পালানোর আর দরকার দেখছি না। এখন আইনি লড়াই করতে হবে। কারণ ইরফান ভাই আর আন্টি আছে৷ আমিও ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাছাড়া কম বয়সে পরিস্থিতির শিকার হয়ে খুন করলে শুনেছি শাস্তি হয় না।’

ইরফান চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘রাইট, তবে পরিস্থিতির শিকার ছিল সেটা প্রমাণ করতে হবে। তার জন্য আমি আর তুমিই তো আছি।’

– ‘আমরা তো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম।’

– ‘সমস্যা নেই মা আছেন।’

মৃদুল খানিক ভেবে বললো,

– ‘চাচি কেমন আছেন?’

– ‘ভালো, আমার সাথেই থাকেন।’

– ‘চাচি আমাদের পক্ষে সাক্ষী দেবেন?’

– ‘হ্যাঁ, আমিও দেবো, মা দেবেন নিজের ক্রোধ থেকে। বাবা আরও কয়েকটা বিয়ে করেছেন। মা’র সঙ্গে পৃথিবীর যতপ্রকার অবিচার অত্যাচার আছে সবই করেছেন। কিন্তু আমি ক্রোধ থেকে সাক্ষী দেবো না, আমি সাক্ষী দেবো বিবেক থেকে। চোখের সামনে একটা পরিবারের এমন দুর্দশা মেনে নেয়া যায় না।’

– ‘চাচিকে দেখতে যাব, পুলিশ যেহেতু ধরলে সমস্যা নেই তাহলে ভয় কিসের।’

– ‘এখনও ওরা সক্রিয়। তাদের বিজনেস আপডেট হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। রূপগঞ্জ যে খুন হয়েছে বুঝতে পারছো তো? এখন তোমার সঙ্গে মায়ের দেখা সাক্ষাৎ হলে ওরা জানতে পারলে পাগলা কুকুর হয়ে যাবে।’

– ‘ও বুঝেছি, কিন্তু এখন ইশিদের বের করার পর আমি কী নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেবো?’

মানহা প্রতিবাদ করে বললো,

– ‘না, তুমি ধরা দেবে কেন? যে সত্যিকার অপরাধী সে ধরা দিবে।’

– ‘কী বলো এসব?’

ইরফান মানহাকে সমর্থন করে বললো,

– ‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। তবে এই আলোচনা পরে করা যাবে। আগে ইশিদের বের করি।’

মৃদুল নীরব হয়ে গেল। মানহাকে এখন তার সন্দেহ হচ্ছে। মানহা কী নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ইশিদের খুঁজছে? খুঁজে পাওয়ার পর কী পুলিশকে ওরা আসল ঘটনা বলে দিবে? এতোদিন এই ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি। মানহা যদি তাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে তো তাকে নিরাপদ রাখতে চাইবে। মৃদুল আর ভাবতে পারছে না। ইশিকে সে কোনোভাবেই এসবে জড়াতে দেবে না। প্রয়োজনে ওদের নিয়ে আবার দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। যেখানে মানহা আর ইরফান কেউ থাকবে না। নতুন করে জীবন শুরু হবে।
ইরফান চা শেষ করে ঘড়ি দেখে বললো,

– ‘সাতটা হয়ে গেছে৷ এবার যাওয়া যাক।’

মানহা সম্মতি জানিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ যেতে যেতে দেরি হবে হয়তো।’

– ‘হ্যাঁ, উঠি।’

মানহা বিল দিতে চাইলে ইরফান বাঁধা দিয়ে সে নিজেই দিল। তিনজন বের হয়ে এলো রাস্তায়। ইরফান সিএনজি ডেকে জায়গার নাম বলে তাদের নিয়ে উঠে। বেশি সময় লাগলো না খেয়া ঘাটে আসতে। সিএনজি বিদায় করে তারা ঘাটে নামে। খেয়া অপর পাড়ে দেখা যাচ্ছে। ইরফান হাঁক ছেড়ে,

– ‘ও মাঝি ভাই আমাদের নিয়ে যান।’

অপার থেকে মাঝি জবাব দিল,

– ‘আইরাম তোরা দেরি অইব।’

– ‘দেরি কেন?’

– ‘আমার ফুয়ার লাগি বার চাইরাম।’

ইরফান ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘পাথরে বসো, আসতে দেরি হবে মনে হয়।’

মৃদুল আর ইরফান দু’টা বড়ো পাথর দেখে বসে৷ কিন্তু মানহা নদীর চারদিকে তাকাচ্ছে। কিনারায় বড়ো বড়ো পাথর৷ একের পর এক সেল্ফি তুলছে সে।
ইরফান আর মৃদুলের সামনে এসে বললো,

– ‘তোমরা তাকাও এদিকে।’

ইরফান মুচকি হেঁসে তাকায়। কিন্তু মৃদুল আচমকা দাঁড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

– ‘আরে কোথায় যাও? তিনজনের সেল্ফি তুলবো তো।’

– ‘আমি ছবি তুলি না।’

ইরফান আর মানহা বেশ অবাক হলো। মানহা পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য মুচকি হেঁসে ইরফানকে বললো,

– ‘ঠিক আছে ও না তুলুক আমরা তুলি।’

তারপর তারা দু’জন সেল্ফি তুলতে তুলতে দেখলো খেয়া ছেড়ে দিছে। মৃদুল দূরে একটা পাথরে ম্লান মুখে বসা। মানহা মোবাইল ব্যাগে রেখে ওর দিকে পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘তোমার আবার কী হয়েছে?’

– ‘কিছু না।’

– ‘আচ্ছা চলো খেয়া আসছে।’

মৃদুল উঠে দাঁড়ায়। ঘাটে গিয়ে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়া চলে আসে। ইরফান উঠে গেল সবার আগে। মৃদুল উঠতেই মানহা পেছন থেকে বললো,

– ‘আমার হাতটা একটু ধরো তো।’

মৃদুল না পারতে হাত ধরে তাকে খেয়ায় তুলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। মানহা গিয়ে বসলো তারই পাশে। ইরফান অবাক চোখে কেবল সবকিছু দেখছে। খেয়া চলতে শুরু করার পর ইরফান মাঝিকে বললো,

– ‘চাচা আলেয়ার বাড়ি কোথায়?’

মাঝি তাদের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘আফনারা খে?’

– ‘সাধারণ মানুষ, একটা দরকারে সেখানে যাব।’

– ‘পুলিশ না সাংবাদিক খও আগে।’

ইরফান মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘না চাচা আমরা দু’জন মানুষকে খুঁজে এসেছি।’

– ‘ইজাগার সন্ধান খে দিছে?’

– ‘চট্টগ্রামের একজন মানুষ।’

– ‘নাম কিতা তার?’

– ‘আমজাদ।’

– ‘ও আইচ্ছা চিনতাম ফারছি।’

– ‘আলেয়ার বাড়ি কোনদিকে জানেন?’

– ‘এখলা চিনতায় নায়, আমার ফুয়ায় দিয়া আইবোনে তারে চা ফানির টেখা দিবায় আরকি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে চাচা তা দেয়া যাবে।’

খেয়া ঘাটে আসার পর মানহাকে বাঁধা দিয়ে ইরফান ভাড়া দেয়। পিচ্চি ছেলেটি খেয়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলে,

– ‘আমার লগে আইন আফনারা।’

তারা পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। খানিক্ষণ পর ইরফান পিচ্চিকে বললো,

– ‘কতদূর আলেয়ার বাড়ি?’

– ‘বেশিদূর নায় ওউতো সামনে।’

অনেক্ষণ হেঁটে মানহা ক্লান্ত হয়ে মৃদুলের হাত ধরে বললো,

– ‘ক্ষুধা লেগে গেছে আর হাঁটতে পারছি না৷’

ইরফানও ক্লান্ত গলায় বললো,

– ‘আমারও পায়ে সমস্যা হচ্ছে।’

মৃদুল পিচ্চিকে ধমক দিয়ে বললো,

– ‘আর কতদূর সত্যি করে বল।’

সে পুনরায় বললো,

– ‘ওউতো সামনে আর বেশি নায়।’

মানহা মৃদুলের হাত ধরে হাঁটছে। তাদের এতো ঘনিষ্ঠতা দেখে ইরফান মনে মনে অবাক হচ্ছে। আরও খানিকটা পথ হেঁটে যাবার পর পিচ্চি উঁচু দেয়াল তোলা একটা বাড়ির গেইট দেখিয়ে বললো,

– ‘ওউটা আলেয়ার বাড়ি, আমারে টেখা দেইন আমি যাইগি।’

– ‘কত দেবো?’

– ‘পঞ্চাশ টেখা।’

ইরফান তাকে টাকা দিয়ে গেইটের সামনে গেল। বয়স্ক এক দারোয়ান তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘কী চান?’

– ‘আলেয়া বেগম আছেন?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘উনাকে দরকার।’

দারোয়ান তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘লগে মহিলা মানুষ দেখা যায়, কী দরকার বলুন আগে।’

– ‘আমাদেরকে আমজাদ সাহেব পাঠিয়েছেন।’

– ‘ও আচ্ছা তাহলে দাঁড়ান।’

দারোয়ান ভেতরে গিয়ে একজন মোটা মহিলাকে নিয়ে এলো।
মহিলা গেইটের ভেতর থেকে বললো,

– ‘কে আপনারা?’

মৃদুল সামনে গিয়ে বললো,

– ‘আমরা ইশি আর ওর মা’কে নিতে এসেছি।’

– ‘ইশি ফিশি তো এখানে নাই আপনাদের কে পাঠিয়েছে?’

– ‘আমজাদ সাহেব।’

– ‘আমজাদ বাটপার কোথায়? আপনাদের সঙ্গে এসেছে না-কি? এই গিয়ে দেখে আয় তো রাস্তা।’

দারোয়ান বাইরে গেল। মানহা শান্ত গলায় বললো,

– ‘আমজাদ সাহেব আসেননি। কিন্তু উনি বলেছেন এখানে ইশি আর এক বৃদ্ধ মহিলাকে কাজে দিয়েছেন।’

মহিলা বাজখাঁই গলায় বললো,

– ‘আমজাদ এদেরকে কাজে দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু ওরা থাকেনি এখানে, মা-মেয়ে চলে গেছে। টাকা ফিরত দিতে আমজাদকে কল দিলে এখন আর কল ধরে না।’

তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো,

– ‘মা মেয়ে চলে গেছে মানে?’

– ‘চলে গেছে মানে চলে গেছে এখানে নাই।’

মৃদুল অস্থির গলায় বললো,

– ‘কোথায় গেছে জানেন?’

– ‘না, জানি না।’

___চলবে___

বাঁক ( ২৫ পর্ব )
____________

মহিলার কথা শুনে গেইটের বাইর থেকে রূঢ় গলায় ইরফান বললো,

– ‘আমরা বাড়ি খুঁজে দেখতে চাই।’

মহিলা প্রতিবাদ করে কর্কশ গলায় বললো,

– ‘কেন? বাড়ি খুঁজে দেখবেন কেন? নাই বলছি বিশ্বাস হয় না?’

– ‘না বিশ্বাস হয় না, আমরা ভেতর দেখে তারপর যাব।’

– ‘আমি আপনাদের ভেতর দেখতে দেবো কেন?’

– ‘কারণ যে কাজে দিয়েছে সে নিজেই বলছে ওরা এখানে আছে।’

– ‘ছিল, কিন্তু এখন নাই।’

– ‘দেখুন আমরা থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করবো। সবকিছু বললে পুলিশ এসে ঠিকই আপনার বাড়ি তল্লাশি করবে।’

মহিলা হঠাৎ নিভে গেল, আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আচ্ছা আপনারা একজন আসুন।’

তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করার পর ইরফান পাশ থেকে বললো,

– ‘মৃদুল ভাই তুমিই যাও।’

মৃদুল ভেতরে যায়। পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি ওদের। ম্লান মুখে গেইটের সামনে ফিরে আসতে দেখে মানহা বললো,

– ‘কী হলো নাই ওরা?’

– ‘না, খুঁজে তো পেলাম না।’

‘এদেরকে বিদায় করে গেইট বন্ধ কর’ দারোয়ানকে রূঢ় গলায় কথাটি বলে মহিলা চলে যাচ্ছিল।

মানহা ডেকে বললো,

– ‘ওরা কোথায় গেছে জানলে একটু বলেন না প্লিজ।’

মহিলা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,

– ‘জানি না।’

ইরফান পাশ থেকে বললো,

– ‘মানহা আমজাদকে একটা কল দিয়ে দেখো।’

– ‘হ্যাঁ তাই করি।’

মানহা মোবাইল বের করে কল দেয়, দুইবার রিং হয়ে কেটে আসে।

– ‘ও তো রিসিভ করেনি।’

– ‘আমাকে দাও তো নাম্বার।’

ইরফান নাম্বার নিয়ে কয়েকবার কল দেয়। কিন্তু তারও কল রিসিভ হলো না।
মৃদুল পাশ থেকে বললো,

– ‘আমজাদ অপরিচিত নাম্বার থেকে রিসিভ করবে না। মানহার নাম্বার থেকেই বারবার চেষ্টা করো।’

– ‘আচ্ছা পরে দিচ্ছি, এখানে আর থেকে কী হবে? চলে যাই, ক্ষুধা লাগছে অনেক।’

ইরফানও সম্মতি জানায় মানহার কথায়। মৃদুল আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘হ্যাঁ তাহলে যাই।’

তারা পুনরায় চলে এলো বন্দর। বসলো গিয়ে একটা খাবার হোটেলে। ইরফান ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার দেয়। মৃদুল এই সুযোগে মানহাকে পুনরায় আমজাদকে কল দিতে বললো। এবার কল দিতেই আমজাদ রিসিভ করে।
মানহা সালাম দিয়ে বললো,

– ‘আমজাদ সাহেব আপনি কল রিসিভ করেন না কেন?’

আমজাদ আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আগে বলেন আপনারা এখন কোথায়।’

– ‘একটা রেস্টুরেন্টে, কেন?’

– ‘ভাবলাম আলেয়া কল দেওয়াচ্ছে আপনাদের দিয়ে তাই আগে রিসিভ করিনি। এখন অনেক সময় পর দেওয়ায় বুঝলাম আলেয়ার বাড়ি থেকে নিশ্চয় চলে গেছেন।’

– ‘মানে কী?’

– ‘কিছু না এখন বলেন পাইছেন ওদের?’

– ‘না, আপনি তো বললেন এখানে আছে। টাকাও নিলেন আমাদের কাছ থেকে।’

– ‘আমি ওই জায়গায় কাজে দিয়েছি। ওখান থেকে ওরা চলে গেছে আলেয়া বলেছিল। তাই আপনাদের আলেয়ার কাছে পাঠাইলাম। সে জানতে পারে কোথায় গেছে।’

– ‘আলেয়া বলছে সে জানে না কিছু।’

– ‘তাহলে আর কী করার?’

– ‘কী করার মানে? আপনি টাকা নিছেন ওর তথ্য দেয়ার জন্য।’

‘হ্যাঁ তথ্য তো দিলাম’ বলে লাইন কেটে দিল আমজাদ। ইরফান পাশ থেকে বললো
– ‘আমজাদকে বাদ দাও। ওকে দিয়ে আর কাজ হবে না।’

মানহা খানিক ভেবে ইরফানকে বললো,

– ইশির নিশ্চয় ওর মামাতো বোন লায়লার নাম্বার মুখস্থ আছে। যেহেতু আলেয়ার এখান থেকে চলে গেছে। সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কারও মোবাইল নিয়ে লায়লাকে কল দিতে পারে।’

মৃদুল সম্মতি জানায় মানহার কথায়। ইরফান বললো,

– ‘হ্যাঁ তা ঠিক, কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ।’

মানহা ওদের প্লেটে ভাত দিতে দিতে বললো,

– ‘ইরফান ভাই তাহলে তুমি একদিন সুন্দর পুর যাও। ওর মোবাইল কেন বন্ধ দেখো। এখন যেহেতু সবার সিম রেজিস্ট্রেশন করা তাহলে মোবাইল চুরি বা নষ্ট হলেও সিম তুলে অন করে দিয়ে আসতে পারবে।’

মৃদুল সম্মতি জানিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ ভালো একটা কথা বলছো, ওর মোবাইল চুরি বা নষ্ট হতে পারে। সিম তুলবে তুলবে করেও হয়তো তুলছে না।’

ইরফান তরকারি প্লেটে নিতে নিতে বললো,

– ‘হ্যাঁ তা করাই যায়, কিন্তু এই অবস্থায় আমি যাব?’

– ‘তুমি গেলেই ভালো, দেরি করাও ঠিক হবে না।’

মৃদুল কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে বললো,

– ‘আজই চলো আমাদের সঙ্গে। আমরা জলেস্বরী নামবো আর তুমি সেখানে চলে যাবে।’

মানহা বললো,

– ‘অবশ্য অন্য কাউকে কল দিয়ে তুমি ওর খবর নিতে পারো কী হয়েছে, সিম তুলে অন করতে বলতে পারো।’

ইরফান খানিক ভেবে বললো,

– ‘এভাবে হবে না। আমি যাওয়াই ভালো। বুঝিয়ে বলতে হবে সবকিছু। তাছাড়া ইশি কল দিলেই ও কোথায় আছে সবকিছু জিজ্ঞেস করে নিতে বলতে হবে।’

– ‘হ্যাঁ, সঙ্গে আমাদের নাম্বার দিতে বলবে।’

– ‘হ্যাঁ তাই করতে হবে।’

খাবার শেষে বিল চুকিয়ে তারা বাইরে এলো। ইরফান বাসায় কল দিয়ে বললো একটা জায়গায় যাচ্ছে ফিরতে দেরি হবে। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলেও সে পাশ কাটিয়ে ফোন রেখে দেয়। সিএনজি একটা নিয়ে তিনজন বাস স্টেশন আসে। ইরফান ঘড়িতে দেখে দশটা হয়ে গেছে। বাসে উঠে তিনজন। মৃদুলের পাশেই মানহা বসে। তাদের সামনের সিটে ইরফান। ধীরে ধীরে যাত্রী আসছে। বাসে উঠে মানহার কেমন যেন করছে। শরীর ঘেমে নেয়ে অবস্থা নাজেহাল। সে নিশ্চিত হলো কিছু সময়ের ভেতরেই বমি করবে। মৃদুলকে অস্ফুটে বললো,

– ‘একটু তাড়াতাড়ি গিয়ে পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে আসো তো।’

সে অবাক হয়ে বললো,

– ‘কেন? আর তুমি এভাবে ঘামছো কেন?’

– ‘কেমন যেন করছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।’

মৃদুল তাড়াতাড়ি গেল পলিথিনের ব্যাগ আনতে। ব্যাগ আনতে যেয়ে মনে হলো যদি বমি করে ফেলে পানি লাগবে। এক লিটার পানিও নিল। দূর থেকে তাকিয়ে দেখে বাস ছেড়ে দিচ্ছে৷ হাঁক ছেড়ে দৌড়ে আসছে মৃদুল। জানালা দিয়ে মানহা তাকিয়ে দেখে হেঁসে ফেললো। মানহা ড্রাইভারকে ডেকে কিছুই বললো না। মৃদুল দৌড়ে এসে বাসে উঠে হাঁপাতে লাগলো। পাশের সিটে বসে কপালে ঘাম মুছতে মুছতে মানহাকে বললো,

– ‘অদ্ভুত, তুমি ড্রাইভারকে বলতে পারলে একজন যাত্রী রয়ে গেছে?’

মানহা কিছু না বলে মুচকি হাসলো শুধু।

– ‘হাসছো কেন? আগে না বললে কেমন যেন করছে?’

– ‘হ্যাঁ, হুট করে আবার ঠিক হয়ে গেছে। তবুও পলিথিনের ব্যাগ রাখো। হঠাৎ বমি করে ফেলতে পারি। শরীর কেমন যেন করছে।’

– ‘এই নাও ব্যাগ আর পানি। বাসে উঠে বমি-টমি করার পচা অভ্যাস আছে দেখছি। এগুলো বাচ্চাদের কাজ।’

– ‘আমি সব সময় করি না। এখন হঠাৎ কেমন যেন লাগছে।’

– ‘বুঝেছি আর বলতে হবে না। ওইদিনও সুপারি খেয়ে বমি করছো। বমি করা মনে হয় তোমার অভ্যাস।’

মানহা খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘তুমি আমার উপর এতো বিরক্ত হচ্ছ কেন?’

– ‘কে বললো?’

– ‘সবকিছু বলতে হয় না।’

– ‘আমি কারও উপর বিরক্ত না।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, এখন শান্তিমতো বসো এতো ঘামছো কেন?’

– ‘দৌড়ে যে আসলাম।’

– ‘এইটুকু দৌড়ে এই অবস্থা।’

– ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমারও শরীর কেমন যেন করছে।’

– ‘আমি এখন ঠিক আছি তো, বাসে উঠে হুট করে গরমে মাথা কেমন জানি করছিল।’

মৃদুল আর কথা না বলে সামনের সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল। তার শরীর ঘামছে। পেট কেমন গুলিয়ে উঠছে। বাস চলতে শুরু করেছে। মানহা জানালার বাইরে চোখ রেখে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। খানিক পর মৃদুল তার হাঁটুতে ধাক্কা দিয়ে বললো,

– ‘পলিথিনের ব্যাগটা দাও তো।’

মানহা পানির বোতলের নিচে ব্যাগ চাপা দিয়ে রেখেছিল। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তুলে মৃদুলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। মৃদুল ব্যাগ হাতে নিয়ে গড়গড় করে বমি করা শুরু করে। তীব্র শব্দ করে বমি করছে। গাড়ির সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। মানহা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বমি করতে করতে মৃদুল একদম নেতিয়ে পড়েছে। বাস একপাশে থামায়। ইরফান পলিথিনের ব্যাগ রাস্তার পাশের খালে ফেলে আসে। মানহা সিট থেকে বের হয়ে মৃদুলকে জানালার পাশে দিয়ে বোতলের ছিপি খুলে দিল। মৃদুল কুলি করে অল্প পানি খেয়ে বোতল মানহার কাছে দেয়। মানহা বোতল রেখে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে তার হাতে দিল। মুখ মুছে মৃদুল সিটে হেলান দিয়ে চোখবুজে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। খানিক পর মানহা খেয়াল করে দেখে ঘুমন্ত মৃদুলের মুখে উপর সূর্য সরাসরি এসে পড়ছে। গ্লাস কী লাগিয়ে দিবে? কিন্তু তাতে গরম আরও বেশি লাগবে। মানহা ক্ষীণ সময় ভেবেচিন্তে মৃদুলকে নিজের কাঁধে জায়গা করে দেয়। খোঁপা ছেড়ে চুলগুলো দেয় ছড়িয়ে। মৃদুলের মাথা থেকে কাঁধ বেয়ে হাতে পড়ে ছায়া দিচ্ছে চুল। মানহা এক হাত ওর পিঠের দিকে নিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরে। বাসের ঝাঁকুনিতে মাথা না নড়ার জন্য আরেক হাত দিয়ে ঠেলে ধরা গাল। বাস জলেস্বরী আসার পর মৃদুলকে ডেকে তুলে সে। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। কয়েকটা হাঁচি দেয়। সর্দি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। মানহা ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরও এসেছে। সিট থেকে উঠে এক হাতে ভ্যানিটিব্যাগ আরেক হাতে মৃদুলকে ধরে বললো,

– ‘আসো।’

মৃদুল দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। মানহা কোনোভাবে ধরে রাখে তাকে।

– ‘ইরফান ভাই তুমিও নেমে যাও বাস থেকে। আমার চেম্বারে বসে তারপর যাবে সেখানে।’

– ‘কেন?’

– ‘এমনিই, এখন মৃদুলকে একটু ধরে নামাও।’

ইরফান দাঁড়িয়ে মৃদুলকে নিয়ে বাস থেকে নামে। মানহা এলো পিছু পিছু।

– ‘ইরফান ভাই আমার চেম্বার চলো, একেবারে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে যাও।

– ‘আরে না, আমাকে এখানকার সবাই চিনে। তোমার মামা দেখলেও চিনে ফেলবেন।’

– ‘ও হ্যাঁ তাও ঠিক, আচ্ছা চলে যাও তুমি।’

মানহা মৃদুলের এক হাত ধরে বললো,

– ‘পারবে না যেতে?’

মৃদুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মানহা তাকে নিয়ে হাত ধরে গাড়ি খেয়াল করে রাস্তা পার হয়। দুপুরের তপ্ত রোদ মাথার উপর পড়ায় সবকিছু কেমন বিরক্ত লাগছে। আশপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছে তাদের। এতো দেখার কী আছে মানহা বুঝতে পারছে না। ওড়না দিয়ে নিজের মুখের ঘামটা মুছে নিল সে। ফার্মেসির সামনে এসে দেখে মামা বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন চোখ বড়ো বড়ো করে। অনিদ্রা, বাইরের খাবার, ক্লান্ত দেহ আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মানহা নিজের অজান্তে মামাকে সালাম দিল। দিয়ে সে বুঝতে পারলো না এটা কী করেছে? সে কখনও মামার সঙ্গে ফার্মেসিতে দেখা হলে সালাম দেয় না। সিঁড়ি বেয়ে মৃদুলকে নিয়ে উপরে এলো। লোকজন কী তাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিল? মানহা আর ভাবতে গেল না। বড়ো ক্লান্ত লাগছে।

– ‘দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াও আমি দরজা খুলবো।’

মৃদুল দেয়ালে হেলান দেয়। মানহা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে বললো,

– ‘আসো।’

মৃদুল ভেতরে আসে। দরজা পুনরায় তালা মারে মানহা। মৃদুলের হাতটা ধরে নিয়ে যায় বেডরুমে৷

– ‘বসো বিছানায়।’

মৃদুল বিছানায় বসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। মানহা ওর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে সবকিছু নিয়ে গোসল করতে সোজা বাথরুমে যায়। শাওয়ারের নিচে চোখবুজে বসে। শীতল জলের ধারা যেন ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে নিচ্ছে। গোসল মানহার বড়ো প্রিয়। স্নান দেহের সঙ্গে মনেরও সজীবতা ফিরিয়ে আনে তার। সময় নিয়ে গোসল করে টাওয়াল প্যাঁচিয়ে বের হয় মানহা। ভেজা শাড়ি দড়িতে শুকোতে দিয়ে চুল ঝেড়ে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পাতলা একটা সুতির কামিজ পরে বের হয়। হঠাৎ মনে হলো মৃদুলের শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিলে ভালো হবে। একটু আরামবোধ আসবে মানুষটার শরীরে। বালতিতে করে পানি নিয়ে এলো। বিছানায় উঠে ওর পরনের শার্টের বোতাম খুলে নিল একটা একটা করে। মৃদুলই সুযোগ দিল শার্ট গা থেকে আলাদা করার। মানহা ওড়না ভিজিয়ে চিপে এনে ওর প্রথমে মুখ মুছে দেয়। তারপর গলা হাত আর বুক থেকে পেট অবধি। মানহার মনটা ভালো হয়ে গেল। ভালোবাসার মানুষের যত্ন নিতে পারলেও যেন কেমন প্রশান্তি আসে মনে। পাতলা কম্বলটা ওর গায়ে দিয়ে বলতি বাথরুমে রেখে ওড়না বেলকনির দড়িতে রেখে এসে চা’র পানি বসালো চুলোয়। জ্বর আর সর্দিতে চা খেলে ওর ভালো লাগবে। মানহা ঝুড়িতে দেখে নিল আদা আর লেবুও আছে। লিকার চায়ে এগুলো দিয়ে খেলে শরীরের অবসাদ দূর হয়। চা জ্বাল দিয়ে কাপে করে টি-টেবিলে রেখে মৃদুলকে গিয়ে ডাকে।

– ‘মৃদুল উঠো, তোমার সর্দি জ্বর এসেছে, চা খেলে দেখো ভালো লাগবে।’

বেশি ডাকতে হলো না। মৃদুল কম্বল সরিয়ে লাল লাল চোখে তাকিয়ে ঘোর লাগা গলায় বললো,

– ‘হু।’

মানহা মিষ্টি হেঁসে ওর মাথার নিচে হাত নিয়ে ঠেলে তুলে বসিয়ে বললো,

– ‘শার্ট পরে নাও।’

মৃদুল শার্ট গায়ে দিল। মানহা বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বললো,

– ‘সোফায় গিয়ে বসি আসো।’

– ‘শরীরটাও কেমন ব্যথা করছে।’

– ‘জার্নির কারণে হয়তো। তাছাড়া জ্বরও এসেছে, রাতে ওষুধ খেতে হবে তোমার।’

– ‘ঝামেলায় ফেলছি তোমাকে।’

– ‘তা তো একটু ফেলেছো, তবুও অসুস্থ হওয়ায় জনাবের সেবা করারও সুযোগ হলো।’

মৃদুল ফ্যাকাসে মুখে মুচকি হাসলো। গিয়ে বসলো সোফায়। চায়ে চুমুক দিয়ে অন্যরকম এক ভালো লাগায় তার শরীর মন যেন ছেয়ে গেল।

– ‘চা খেয়ে তুমি শুয়ে থাকবে, আমি বাইরে থেকে কেনাকাটা করে আসতে হবে।’

মৃদুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। চায়ে চুমুক দিয়ে আচমকা তার মাথায় আসে মানহা যে তাকে নিয়ে এখানে আছে। রাতেও যদি আজ থাকে, তাহলে তো মেয়েটার সর্বনাশ হয়ে যাবে।

___চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here