বাঁক,২৮,২৯
জবরুল ইসলাম
(২৮ পর্ব )
মানহা ওর ক্রোধান্বিত চেহারা দেখে আঁজলা করা হাতটি ওর মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
– ‘এতো অস্থির হচ্ছ কেন? আমি ইরফানকে বেশিকিছু জিজ্ঞেস করিনি, বললো ইশির নাম্বার থেকে সে কল পেয়েছে। তাদের কথাও হয়েছে।
মৃদুল বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘আমজাদ তো বলেছিল ইশির মোবাইল ছিনতাই হয়েছে।’
– ‘সেটা তো জিজ্ঞেস করিনি, দেখা হলে জানা যাবে।’
– ‘লায়লার না ইরফানের নাম্বারে কল দিয়েছে ইশি?’
– ‘ইরফানের।’
– ‘তাহলে তো ইশির নাম্বার থেকেই দিয়েছে কল, এতদিন দেয়নি কেন? যাইহোক, এখন কী করবো আমরা?’
– ‘ইরফান বললো দুপুরে দেখা করবে ইশি।’
– ‘কোথায় দেখা করবে?’
– ‘বন্দর এসে কল দিয়ে দেখা করবে, আমরা এখনই বের হয়ে যাব।’
মৃদুল অস্থির হয়ে বললো,
– ‘তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’
মানহা বেডরুমে চলে যায়। ইচ্ছা ছিল বাসা দেখে এসে ঘুমোবে। ঘুম থেকে উঠে ভোরের অপ্রত্যাশিত দু’টো ঘটনা ভুলে যাবে। মামা আর মিরার ব্যাপারটা ভীষণ পোড়াচ্ছিল। এখন কাপড়-চোপড় নিয়ে বাথরুমে গেল শীতল জলের ধারায় সকল গ্লানি আর লাঞ্চনা দেহ থেকে ধুয়ে-মুছে ফেলতে। ইশিদের পেয়ে গেলে মৃদুল খুবই খুশি হবে। ওর আনন্দ দেখলে মানহারও মনে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। খুব বেশি সময় নিল না গোসলে। বের হয়ে দেখে মৃদুল সোফায় বসে অপেক্ষা করছে।
– ‘তুমি কি গোসল করবে না?’
– ‘না, তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাও।’
– ‘এতো অস্থির হচ্ছ কেন মৃদুল? ইশি বলছে ওরা দুপুরে এসে ইরফানকে কল দিয়ে দেখা করবে।’
– ‘সেটা বলুক, আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে ইরফানকে এনে ইশিকে কল দিব।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
তারা বের হতে হতে বেলা এগারোটা হয়ে গেল। পৌঁছে গেল জোহরের আগে। ইরফানও খানিক পর চলে এলো। মানহার কথামতো গিয়ে বসলো তারা সুরমা নদীর পাড়ে। এদিক দিয়ে সুন্দর নিরিবিলি পাকা রাস্তা গিয়েছে৷ নদীর পাড়ে রেলিঙ দেয়া। ফুটপাতে দোকান আছে। রঙিন ছাতা টাঙিয়ে মানুষের বসবার জায়গা করা। এখান থেকে বসে রাস্তার অপর পাশে দেখা যায় সিলেট সার্কিট হাউজ। সবুজ ঘাস আর ফুল গাছে ঢেলে সাজানো ঝলমলে একটি ভবন। পেছনে বয়ে গেছে সুরমা নদী। ইরফান চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ‘জায়গাটা খুব নিরিবিলি।’
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু এখান থেকে কিং ব্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখো গাড়ি আর মানুষে গিজগিজ করছে।’
মৃদুল চেয়ারে বসে বললো,
– ‘কল দাও ওদের।’
– ‘দিয়েছি, ওরা আসার পথে।’
মানহা চা দিতে বললো দোকানিকে। মৃদুল পুনরায় ইরফানকে বললো,
– ‘ইশির না মোবাইল ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল।’
– ‘হ্যাঁ তাইতো, এখন মোবাইল কীভাবে পেয়েছে এটা জিজ্ঞেস করিনি।’
মানহা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– ‘অস্থির হওয়ার কিছু নেই, ওরা এলেই সব জানা যাবে।’
ইরফান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। খানিক পর ওয়েটার চা এনে দিল। চা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই মৃদুলের ফোন বেজে উঠলো৷ ইরফান মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,
– ‘ইশি।’
– ‘রিসিভ করো।’
ইরফান রিসিভ করে বললো,
– ‘হ্যাঁ ইশি বলো।’
– ‘ভাইয়া আমরা তো বন্দর এসে গেছি।’
– ‘সার্কিট হাউজের সামনের দিকে আসো।’
– ‘আচ্ছা।’
ফোন রেখে দিল ইরফান। মানহা খানিক্ষণ কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘মৃদুল ওইযে রেলিঙের পাশে গাছ দেখা যাচ্ছে তুমি সেখানে চলে যাও।’
ইরফান অবাক হয়ে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘ওদের তো অনেকদিন পর দেখা হবে, যদি সিনক্রিয়েট হয়। আন্টি ধরো কান্না শুরু করলেন তখন আশপাশের দোকান থেকে মানুষ জড়ো হয়ে যাবে।’
– ‘হ্যাঁ, তা ঠিক বলছ, প্রথমে তারা ওখানে দেখা করুক।’
– ‘হ্যাঁ তাইতো বলছি। যাও মৃদুল, গাছের নিচে যাও। ওইদিকে গাড়ি যায় আসে শুধু। ফুটপাতে দোকান বা মানুষ নেই।’
মৃদুল হেঁটে হেঁটে চলে যায়। খানিক পরেই পুনরায় ইরফানের মোবাইল বেজে উঠে।
সে রিসিভ করলো,
– ‘হ্যাঁ কোথায় আছো তোমরা।’
– ‘সার্কিট হাউজের গেইটের সামনে দেখো একটা সিএনজি।’
মৃদুল তাকিয়ে দেখে সার্কিট হাউজের সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে আর ফোন কানে লাগিয়ে এক তরুণী এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা।
‘ইশি থাকো আসছি’ বলে ইরফান মানহাকে ইশারা করলো। দু’জন ছুটে গেল রাস্তার অপর পাশে। মানহার বুক অকারণ ধুকপুক করছে। ইরফান সিএনজির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীকে বললো,
– ‘ইশি না-কি?’
ইশি বিস্মিয় ভরা চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘তুমি কে?’
– ‘আমি ইরফান।’
উত্তেজনায় ইশির চোখে পানি এসে গেল। তাড়াতাড়ি সিএনজিতে মাথা ঢুকিয়ে নেহারা বেগমকে ধরে নামিয়ে বললো,
– ‘দেখো মা ইরফান ভাই এসেছে।’
তিনি ইরফানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। সিএনজি থেকে আরেকজন যুবক বের হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে মানহার পাশে দাঁড়াল। তার গলায় মোটা চেইন। গেঞ্জিতে চশমা ঝুলছে। ইশি চারদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। মানহা গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ইশি মানহার পা থেকে মাথা অবধি তাকিয়ে বললো,
– ‘আপনি কে?’
মানহা জবাব না দিয়ে আঙুল তাক করলো দূরের গাছের নিচে। ইশি সেদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কি?’
– ‘মৃদুল গাছের নিচে অপেক্ষা করছে।’
– ‘মৃদুল কে?’
মানহা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘মানিক।’
‘ইরফান ভাই তোমরা মা’কে নিয়ে আসো আমি যাচ্ছে’ বলেই ইশি সেদিকে ছুটে গেল।
মুচকি হাসলো মানহা৷ ইরফান রেহানা বেগমকে গাড়িতে আবার বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওই গাছের নিচে মানিক ভাই’ তারপর ড্রাইভারকে বললো, ‘উনাকে গাছের নিচে দিয়ে আপনি ওই চা’র দোকানের সামনে চলে আসবেন আমরা এক সঙ্গে চা খাব।’
ড্রাইভার সম্মতি জানিয়ে স্টার্ট দিল।
মৃদুল দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিল সিএনজি থেকে একটা মেয়ে নেমেছে৷ মানহা আর ইরফান গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। খানিক পর দেখলো একজন মহিলা নেমে ইরফানকে জড়িয়ে ধরেছে। মহিলাকে চিনতে তার ভুল হলো না। তারই মা জননী, সতেরো বছরে একদম বুড়ো হয়ে গেছেন। ইচ্ছা করছিল ছুটে যায়। তবুও নিজেকে দমিয়ে রাখে। তাদের একান্তে পাওয়া দরকার তার। একটু পরেই এদিকে ছুটে আসতে দেখে তরুণীকে। ও কি ইশি? ভাবতে ভাবতে কাছে চলে এলো মেয়েটি। সামনে এসে খানিক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরে তাকে। নির্বাক মৃদুল৷ তার যেন সমস্ত কথা ফুরিয়ে গেছে৷ পৃথিবী যেন দুলছে। ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। হাত রাখলো বোনের মাথায়। ইশি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
– ‘আমার জন্য এতকিছু হলো ভাই। এতকিছু একমাত্র আমার জন্য।’
মৃদুল ধরা গলায় বললো,
– ‘কিন্তু তুই তো আমার জন্যই গিয়েছিলি এমদাদ খানের কাছে৷’
সিএনজি এসে থামে তাদের কাছে।
‘মা এসেছেন’ বলে ইশি মৃদুলকে ছেড়ে সিএনজি থেকে নেহারা বেগমকে নামায়। পলকে সিএনজি চলে যায় আবার। মৃদুল মা’র দিকে এগিয়ে গেল। নেহারা বেগম আঁজলা করে ছেলের মুখ ধরলেন। কথা বলতে পারছেন না, ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলছেন। মৃদুলও মা’কে জড়িয়ে ধরে অনবরত চোখের জল ফেলছে। ইশি রেলিঙ ধরে নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। চলন্ত গাড়ি থেকে মানুষ বিস্মিত নয়নে তাদেরকে দেখছে।
– ‘তুই এতদিন কোথায় ছিলি রে বাবা।’
– ‘রূপগঞ্জ মা, কিন্তু তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে?’
– ‘বয়স কী কম হলো? শরীরেও রোগ বাসা বেঁধেছে।’
– ‘মা আমরা এখনও সেইফ না। ইশিকে বাঁচাতে হবে। ওকে ভালো জায়গা দেখে বিয়ে দিতে হবে।’
– ‘এখন কি করবি?’
মৃদুল ইশিকে ডেকে এনে বাঁ হাতে বুকে টেনে নিল। ডান পাশে মা। ফিসফিস করে বললো,
– ‘আমাদের আবার পালাতে হবে মা।’
– ‘আর এসব ভালো লাগে না বাবা।’
ইশি অবাক হয়ে বললো,
– ‘পালাব মানে কি? আমরা এক সাথে সতর্কভাবে থাকবো।’
– ‘তা ঠিক, কিন্তু ইরফান আর মানহা থেকে আমাদের পালাতে হবে।’
– ‘মানহা মানে? মানহা কে?’
– ‘তাসফিয়া, ইরফানের সাথে যাকে দেখলি।’
– ‘হ্যাঁ দেখেছি, কি মিষ্টি হয়েছে দেখতে। কিন্তু ওকে আবার পেলে কীভাবে?’
– ‘সে অনেক কথা, পরে বলা যাবে। এখন শোন, ওদের কাছে থেকে আজ কোনোভাবে তুই বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। আর আমার নাম্বার নিয়ে যাবি। পরে কথা হবে আমাদের। তারপর কোথাও চলে যাব।’
– ‘কিন্তু ইরফান ভাই আমাদের জন্য এতো কিছু করলো তাকে আবার না বলে চলে যাব?’
– ‘ইশি তুই বুঝবি না৷ তাসফিয়া চাইবে আমাকে ঝামেলা মুক্ত করতে তাই তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে।’
– ‘কি বলো এসব? সে এরকম করবে কেন? এতোদিন তো কাউকে কিছু বলেনি।’
– ‘ইশি ওর মাথার তার ছিঁড়া, তুই বুঝবি না। তাছাড়া ইরফান আর ওর মা নিয়াম খানের বিরুদ্ধে আমাদের দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে হয়তো। মাঝখান দিয়ে তুই ফেঁসে যাবি।’
– ‘তোমার কথার আগামাথা বুঝতে পারছি না ভাই। একবার তাসফিয়া আর ইরফান ভাইকে বলে দেখো যে তুমি চাও না আমি পুলিশে ধরা দেই।’
– ‘ তাতে মানহা যদি লুকিয়ে তোকে ধরিয়ে দেয়?’
– ‘তুমি এতো অবিশ্বাস করছো কেন তাদের? একবার তো বলে দেখো।’
– ‘তুই এসব বুঝবি না ইশি, যা বলছি তাই কর। তাসফিয়া কোনোভাবেই চাইবে না আমি তোর অপরাধ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে চলো।’
– ‘দাঁড়া আমার নাম্বার নিয়ে একটা মিসকল দে আগে।’
দু’জন নাম্বার আদান-প্রদান করে নেয়।
তারপর মৃদুল মা’কে ধরে বলে, ‘চলো ওদের কাছে যাই।’
____চলবে___
বাঁক ( ২৯ পর্ব )
_____________
মৃদুল মা’কে নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। ইশি যাচ্ছে তাদের পিছু পিছু। এতবছর পর ভাইকে পেয়ে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আনন্দ-অশ্রুতে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ৷ পাশের নদীটা মেঘাচ্ছন্ন লাগছে, অদূরের ওই ব্রিজের মানুষ এবং গাড়ি সবকিছুই কেমন ঝাপসা।
ইরফানদের কাছাকাছি চলে এলো তারা। লাল হলুদ এবং সবুজ রঙের মিশ্রণে একটি ছাতার নিচে চেয়ারে বসে আছে ইরফান আর মানহা। মৃদুলও মা’কে নিয়ে বসে। ইশি আচমকা চেয়ার সুদ্ধ মানহাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উল্লাসে বললো,
– ‘তুমি তাসফিয়া, আমি একদম চিনতে পারিনি।’
মানহাও হাসতে হাসতে বললো,
– ‘আচ্ছা ছাড়ো চেয়ার নিয়ে পড়ে যাব।’
ইশি ছেড়ে দেয়, মানহা দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
– ‘তুমি দেখতে কী যে সুন্দর হয়েছো তাসফিয়া।’
– ‘তুমিও, আমি তো দেখে চিনতেই পারিনি।’
– ‘ভাইয়া তোমাকে কীভাবে পেল? সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে আমার।’
– ‘চেয়ারে বসো সব বলছি ধীরে ধীরে।’
ইশি মানহার পাশে বসে পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। আফতাব ভাই কোথায়? চারদিকে তাকিয়ে ফুটপাতের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় নদীর পাড়ের রেলিঙে হেলান দিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করতে করতে সিগারেট টানছে সে।
‘তোমরা বসো আসছি আমি’ বলে ইশি সেদিকে ছুটে যায়। আফতাব নামের এই বাউন্ডুলে ছেলেটিই তাকে আলেয়ার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল। সেদিন আমজাদের সঙ্গে আলেয়ার বাড়ি যাবার পথে মোড়ের চা’র দোকান থেকে তাকে দেখতে পায় আফতাব। এই দেখাতেই বুকের ভেতর ‘মন কেমন করা’ এক অচেনা অনূভূতি হয় তার। আমজাদকে সে চিনে। লোকটি আলেয়ার বাড়িতে প্রায়ই মেয়ে মানুষ নিয়ে যায়। সবকিছুই আফতাবের নখদর্পনে, তবুও কোনোদিন ঘাটাতে যায়নি। এলাকার চেয়ারম্যান থেকে থানার অফিসার পর্যন্ত সবার সঙ্গে আলেয়ার খাতির আছে সেটা কারও অজানা নেই। সুতরাং তার মতো পুচকে বাউন্ডুলের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। কিন্তু ইশিকে দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠলো সে। এমন একটি নিষ্পাপ চেহারার মেয়ে কী আদৌও দেহ ব্যবসা করতে পারে? তাছাড়া মেয়েটির সাথে বয়স্ক মহিলাটি কে? দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে। কিছুই মাথায় ঢুকছিল না তার। কেবল ইশির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। পিছু নেয় তাদের। মাঝে মাঝে আমজাদের সঙ্গে ইশির আলাপচারিতা শুনতে পাচ্ছিল। সেটুকু থেকে বুঝতে পারে আমজাদ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা অবগত নয়। অনুসরণ করে একেবারে গেইট পর্যন্ত চলে আসে আফতাব। ওরা ভেতরে চলে যায়। অনেকক্ষণ দূর থেকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে সে বিরক্ত হয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে হাঁটতে শুরু করে। পুনরায় ফিরে যায় চা স্টলে। বন্ধু-বান্ধব সবাই ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত কিন্তু তার কিছুতেই ভালো লাগছে না। আড্ডায় আজ আর মন বসবে না বুঝতে পেরে সে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। কিন্তু পুরো রাত তার চোখে ঘুম এলো না। ক্লান্ত বিধ্বস্ত আর অসহায় একটি চেহারা সারাক্ষণ মাথায় গেঁথে রইল। আফতাব রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় ভোরের আলো ফুটলে সে ওই বাড়িতে খদ্দের সেজে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী সে সকাল দশটায় গিয়ে পৌঁছে। দারোয়ান গেইটের সামনে বসে আছে।
তাকে দেখে বললো,
– ‘এখানে কী?’
আফতাব মুখ টিপে হেঁসে বললো,
– ‘আসছিলাম আরকি, আজ কী হবে না?’
দারোয়ান তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বললো,
– ‘কার মাধ্যমে আসছেন?’
আফতাব কোনো সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। সে জানে এখানে দালাল ধরে আসে মানুষ। মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘মাধ্যম দিয়ে কী হবে? আমি তো চিনি জানি সবকিছু।’
– ‘কিন্তু মাধ্যম ছাড়া কথা বলবে কে? মাধ্যমই টাকার আলাপ করে। আপনাকে রুমে রুমে নিয়ে মাল দেখায়।’
আফতাব খানিক ভেবে বললো,
– ‘আরে ভাই আপনিই আমার মাধ্যম চলুন তো।’
দারোয়ান পান খাওয়া দাঁত বের করে খিকখিক করে হেঁসে বললো,
– ‘কী ভাই তর সইছে না মনে হচ্ছে?’
আফতাব বুঝতে পারে দারোয়ান লাইনে এসেছে। সে আরেকটু ভাব জমানোর জন্য বললো,
– ‘আর বইলেন না ভাই, অনেকদিন হলো বউ বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে।’
দারোয়ান হাসতে হাসতে গেইট খুলে দিল। আফতাব ভেতরে গিয়ে পিলারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল দারোয়ানকে।
লোকটি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টান দিয়ে বললো,
– ‘এখন তো টাকা বেশি লাগে।’
– ‘কত?’
– ‘এক হাজার।’
আফতাব সিগারেটে টান দিয়ে বললো,
– ‘গতকাল রাতে একটা নতুন মাল আসছে দেখলাম ওইটাও এক হাজার না-কি?’
লোকটি চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘ওইটা হবে না ভাই, অন্য যেকোনো একটা হবে। আপনাকে সব মাল দেখাবো। যাকে চয়েজ হয় এক হাজার।’
আফতাব অবাক হয়ে বললো,
– ‘কিন্তু এই মাল হবে না কেন?’
– ‘এটাকে অন্য কাজে আনছে।’
– ‘কী কাজ?’
– ‘ভিডিয়ো কলে পাইবা শুধু।’
আফতাব সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললো,
– ‘টাকা বেশি দেবো দেখেন হয় কি-না।’
– ‘আমি ম্যাডামের সাথে কথা বলে দেখি।’
– ‘আচ্ছা দেখেন।’
দারোয়ান উঠে চলে গেল। খানিক পর এসে বললো ‘আমার সাথে আসেন’।
সে পিছু পিছু গেল। দোতলায় গিয়ে দেখলো বারান্দায় একটা চেয়ারে মোটা একজন মহিলা বসা। তাকে বসতে বললো সামনের বেঞ্চে।
মহিলা পাশে রাখা ডাস্টবিনে ‘ফুরুত’ করে পানের লাল পিক ফেলে বললো,
– ‘ওই মেয়ে হবে না, অন্য একটায় যান।’
আফতাব নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
– ‘আপনারা বুঝতেছেন না কেন আমার ওই মেয়েই লাগবো। কাল রাতে রাস্তায় দেইখা ঘুমাতে পারছি না।’
মহিলা ‘হা-হা-হা’ করে হেঁসে উঠলো। তারপর বললো,
– ‘এই মেয়েকে শুধু ভিডিয়ো কলে পাবেন।’
আফতাব খানিক ভেবে বললো,
– ‘তাহলে দিন ভিডিয়ো কলে। এখানে একটা রুমে যাচ্ছি আমার ইমু নাম্বার নিন।’
মহিলা খানিক্ষণ ভেবে বললো,
– ‘এখনও আমাদের এই কাজ শুরু হয়নি।’
আফতাব কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,
– ‘বুঝলাম না, প্রথমে বললাম যত টাকা লাগে দিব এই মেয়েকে চাই। আপনারা বললেন ভিডিয়ো কলে। তাও রাজি হলাম, এখন আবার পরে বলছেন।’
মহিলা ইতিউতি করে ‘আচ্ছা আমি আসছি’ বলে চলে গেল। দারোয়ানের সঙ্গে আফতাব বসে রইল। মহিলা অনেক্ষণ পর ক্রোধান্বিত চেহারায় ফিরে এলো। রাগে যেন ফুঁসছে।
– ‘কি অবস্থা ম্যাডাম, হবে?’
মাহিলা চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ‘খানকিটারে জোর করে করতে পারবেন? পারলে যান দরজা বন্ধ করে দিব। এই খানকি ভিডিয়ো কলেও রাজি হয় না। ওরে জোর করে গুঁতা খাওয়াইলে ঠিক হবে।’
আফতাব বিস্মিত হয়ে গেল। জোর করে মানে? তাহলে এই মেয়ে এখানে এলো কেন? ভিডিয়ো কলে যে রাজি হচ্ছে না সে তো দেহ ব্যবসা করতে আসবার কথা নয়। আফতাবের শরীর ঘেমে গেল। মহিলাকে বললো,
– ‘পারবো।’
‘কাজ হলে তিন হাজার টাকা দিবেন, বুঝতেই পারছেন টাটকা মাল’ তারপর মহিলা দারোয়ানকে বললো,
– ‘নিয়া যা।’
– ‘ভেতরে তো মেয়ের মাও আছে ম্যাডাম।’
– ‘থাকুক বুইড়া খানকিও, যা দরজা বন্ধ করে দিছ।’
কথা মতো দারোয়ান আফতাবকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। নেহারা বেগম তখন ঘুমাচ্ছেন। ইশি বসে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। কাউকে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বললো,
‘আপনি কে ভাই? কেন আসছেন? দরজা বন্ধ করলো কে’ কথাটি বলে ইশি দরজা খোলার জন্য ছুটে যাচ্ছিল। আফতাব হাত ধরে হেঁচকা টানে তাকে বুকে এনে বুঁদ হয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ইশি ভয়ে ভয়ে বললো,
– ‘ভাই আমি এসব করবো না। ওরা আমাদের জোর করে আঁটকে রাখছে।’
আফতাব ফিসফিস করে বললো,
– ‘ভয় নেই, আমি তোমাদের বাইরে নিয়ে যাব। আন্টিকে ডেকে তুলে রেডি হও।’
ইশির বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবুও সে মা’কে ডেকে তুলে ব্যাগ-প্যাক হাতে নেয়।
আফতাব গিয়ে দরজায় নক করে। দরোয়ান দরজা খুলে দিল।
– ‘আসেন আপনারা।’
ইশি মা’কে নিয়ে বের হলো। দারোয়ান পথ আঁটকে বললো,
– ‘এই এই কোথায় যান আপনারা? ম্যাডাম ম্যাডাম…।’
মহিলা ছুটে এলো এদিকে। ইশির হাতে ব্যাগ-প্যাক দেখে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে বললো ‘এই তোমরা কোথা যাচ্ছ?’ তারপর আফতাবের দিকে তাকিয়ে দারোয়ানকে বললো ‘বসির, কাওছার সবাইরে ডাক দিয়ে আন’।
আফতাব মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘ডাকাডাকি করে লাভ নাই।’
– ‘কী লাভ নাই? মাস্তানি দেখাচ্ছ?’
আফতাব শান্ত গলায় বললো,
– ‘এলাকার নেতাদের সাথে আপনার খাতির আছে, থানায় নিয়মিত সম্মানি পাঠান সব ঠিক আছে। আপনার কোমর শক্ত তাও মানি। কিন্তু আপনি জোর করে কাউকে আটকিয়ে রাখতে পারবেন এটা ভাবেন কীভাবে?’
মহিলা তার দিকে তেড়ে এসে কলার ধরে বললো,
– ‘জোর করে কী জোর কী? এই মেয়েকে দিয়ে আমজাদ আমার কাছ থেকে নগদ টাকা নিছে।’
– ‘আমজাদ টাকা নিছে তাতে এই মেয়ের কী ছেঁড়া গেছে? সে কী বলছে আমজাদকে টাকা দিন আপনার হয়ে কাজ করবো?’
– ‘এই ব্যাটা তুই কে? তোকে এতকিছু বলবো কেন?’
তখনই আরও কয়েকটা ছেলে এলো। একজন এগিয়ে এসে বললো,
– ‘কী হয়েছে খালা?’
– ‘এই পোলা নায়ক হইছে। এদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।’
ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘নেতাগিরি এখানে দেখাবি না, পেট কিন্তু মেলাইয়া দেবো।’
আফতাব মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘এটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপনারা আমাকে মেরে ফেললে বেঁচে যাবেন। না হলে যতই ক্ষমতা থাকুক। নেতা-খেতা পকেটে থাকুক বিপদে পড়বেন।’
– ‘কী বিপদ?’
– ‘এই ধরুন আমি ভয় পেয়ে চলে গেলেম এদেরকে রেখে৷ তারপর পুরো এলাকার মানুষকে জানাবো জোর করে একটা মেয়েকে আঁটকিয়ে রেখেছেন। সাংবাদিকদেরও খবর দেবো। তাছাড়া পুলিশ টাকা খেয়ে ব্যবসা করতে দিলেও নিশ্চয় কাউকে জোর করে দেহ ব্যবসা করাতে দেবে না? আমি যদি আরও কিছু লোকজন নিয়ে এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং থানায় গিয়ে বলি এখানে জোর করে একটা মেয়েকে আঁটকে রেখেছেন কী হবে? আপনারা নিশ্চয় জানেন দুনিয়াটা একেবারে মগের মুল্লুক না। এখন সিদ্ধান্ত নিন এই সামান্য ঘটনার জন্য আমাকে খুন করবেন না-কি ভয় দেখিয়ে বিদায় করে দিবেন?’
ছেলেগুলো তেড়ে আসছিল তাকে শায়েস্তা করতে। মহিলা বাঁধা দিল।
আফতাব পুনরায় বললো,
– ‘এখন এসব ব্যবসা করাই তো অনেক কঠিন। তার উপর জোর করে আঁটকে খুব একটা কাজ হবে না আপনাদের। নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না।’
তারপর ইশিকে বললো,
– ‘আন্টিকে নিয়ে আসো।’
আলেয়া বেগম সবকিছু ভেবে-চিন্তে নিভে গেল একদম। চোখের সামনে আফতাব তাদের নিয়ে চলে এলো।
ইশি আফতাবের কাছে গিয়ে বললো,
– ‘আপনারা দু’জন আলাদা এখানে কেন? আমাদের সাথে বসবেন আসুন।’
আফতাব সিগারেটে ফেলে বললো,
– ‘চলো।’
ইশি আফতাবকে বললো,
‘আপনি একটু দাঁড়ান, উনি যাক।’
সে রেলিঙ ধরে আবার দাঁড়ায়। ইশি আস্তে আস্তে বললো,
– ‘আমার ভাইয়া বলছে এখান থেকে আমরা একটা অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতে। ওরা আপনার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলবেন না। শেষে আমাদেরকে না পেলে আপনার বাড়িতে চলে যাবে।’
আফতাব মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
– ‘চলো ওদের সঙ্গে গিয়ে বসি।’
দু’জন গিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসে। মানহা প্রথমেই বললো,
– ‘তোমাদের খুঁজে আমি আর মৃদুল আমজাদের কাছে গিয়েছিলাম।’
ইশি বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘বলো কী? কীভাবে চিনলে?’
– ‘সেটা থাক, কিন্তু ও তো বলেছিল তোমার মোবাইল ছিনতাই হয়েছে।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘মোবাইল সিম তো আছে দেখছি।’
– ‘সিম রেজিস্ট্রেশন ছিল আফতাব ভাই তুলে দিছে। আর মোবাইল উনারই এটা।’
– ‘আমরা আলেয়ার বাড়িও গিয়েছিলাম।’
– ‘বলো কী?’
– ‘হ্যাঁ, আমজাদকে টাকা দিয়ে ওখানে যাই আমরা। কিন্তু ওরা বললো চলে গেছো তোমরা।’
ইশি কৌশলে আফতাবের কথা এড়িয়ে গিয়ে বললো,
– ‘ওখানে কাজ করবো না বলে বের হয়ে টাউনে আসি। আফতাব ভাই পূর্ব পরিচিত৷ উনার নাম্বার মুখস্থ ছিল, পথচারী একজনের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে কল দিলাম আরকি। তারপর উনার বাড়িতেই ছিলাম।’
মানহা আফতাবের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললো,
– ‘ধন্যবাদ ভাই, আপনি অনেক হেল্প করেছেন।’
আফতাব কী বলবে ভেবে পেল না। শুধু মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না ঠিক আছে ওসব কিছু না।’
ইরফান চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখানে খাওয়ার তেমন কিছু নাই, আমরা চা খেয়েছি তোমরাও খাও’ বলে সে দোকানিকে চা দিতে বললো।
ইশি মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত। ইরফান ভাই আমজাদকে টাকা দিয়ে তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। আজকের এই দিনটির জন্য এই মানুষটিরই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব। অথচ তাকেই ধোঁকা দিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া যতদূর বুঝা যাচ্ছে তাসফিয়াও অনেক কষ্ট করেছে৷ ওয়েটার ততক্ষণে চা এনে দিলো তাদের টেবিলে৷ ইশি চা’র কাপে চুমুক দিয়ে অভিনয় করে মৃদুলকে বললো,
– ‘আজ আফতাব ভাইয়ের সাথে চলে যেতে হবে। উনার বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাল আবার দেখা করে তোমার কাছে চলে যাব।’
মানহা অবাক হয়ে বললো,
– ‘বলো কী? উনার বাড়ি কোথায়?’
ইশি খানিক ভেবে মনগড়া বলে দিল, ‘উনার বাড়ি জকিগঞ্জ।’
_____চলবে_____