বাঁক,৩৩,৩৪
জবরুল ইসলাম
( ৩৩ পর্ব )
মানহা আরেক ঢোক জল খেয়ে বলতে শুরু করলো,
‘আমি আর ইরফান ভাই আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইশি এমদাদ খানের রুমে যাবার কিছুক্ষণ পরেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কৌতূহলে চুপিচুপি দরজায় এসে কান পেতে ধস্তাধস্তি টের পেয়ে ইরফান ভাইকে ইশারা করলাম। কিন্তু সে ভয়ে আর এদিকে না এসে উলটো দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। খানিক পরেই দেখি মানিক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছে।’
উকিল থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘মানিককে ইরফানই দড়ি খুলে দিয়েছে গিয়ে তাইতো?’
ইরফান পাশ থেকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি মানিক ভাইয়ের সাথে দরজার কাছে যাইনি। সিঁড়ির ওদিকে ছিলাম।’
– ‘কেন?’
– ‘আব্বা আর চাচাদের প্রচণ্ড ভয় পেতাম। তাও আবার লুকিয়ে দড়ি খুলে দিয়েছি।’
– ‘আপনি ঝুঁকি নিয়ে দড়ি খুলে দিতে গিয়েছিলেন কেন? তখন কী বুঝতেন দরজা বন্ধ করা মানে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে?’
– ‘না, তবে মানহা ইশারা করার সময় আমিও দূর থেকে ভেতরের ধস্তাধস্তি টের পাচ্ছিলাম। ভেবেছি হয়তো চাচা ইশিকে দরজা বন্ধ করে মারছেন। তাই দৌড়ে গিয়ে মানিক ভাইকে বললাম। সে তখন খুব করে দড়ি খুলে দিতে বলে। আমিও ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে খুলে দেই।’
– ‘আচ্ছা তারপর কী দেখলেন?’
মানহাই আবার বললো,
‘মানিক এসে দরজায় ধাক্কা দেয়ার আগেই খুলে গেল। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম ইশির হাতে রক্তাক্ত ছুরি।’
উকিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘উনিই তো ইশি।’
সবাই তাকিয়ে দেখলো তাদের পেছনের সোফায় বসে ইশি দুই হাতে মুখ ঢেকে নীরবে কাঁদছে। আফতাব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। উকিল উঠে গেলেন চেয়ার থেকে। চেয়ার টেনে ইশির সামনে বসে বললেন,
– ‘আপনি ভেতরে ছুরি পেলেন কী করে?’
ইশি চোখের জল মুছে নিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে বললো,
– ‘দরজা বন্ধ করে এমদাদ খান আমাকে ধরতে এলে চিৎকার করে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার মুখ চেপে ধরে। দু’জনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। তখন সে পালঙ্কের নিচ থেকে ছুরি বের করে।’
উকিল থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘পালঙ্কের নিচে ছুরি কেন রেখেছিল? আপনি ওখানে যাবেন কি-না সে তো আগে থেকে জানতো না। সুতরাং আগে থেকে প্রস্তুত থাকার কথা নয়।’
– ‘এর ক’দিন আগে কোরবানি হয়েছিল। মানহা বললো না সে ঈদের ছুটিতে সুন্দরপুর গিয়েছিল। তখন ঈদ গেছে সপ্তাহ খানেক হবে। কোরবানির ছুরি পালঙ্কের নিচ থেকে তুলে রাখা হয়নি।’
– ‘ও হ্যাঁ বুঝেছি, মানে তুলবো তুলবো করে দেরি হচ্ছিল। তারপর কি হলো?’
– ‘সে অশ্লীল ভাষায় গালি আর ধমক দিয়ে ছুরি দেখিয়ে বলছিল চিৎকার করলে গলা কেটে দেবো। চোখ রাঙিয়ে বারবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলছিল একদম আওয়াজ করবি না বললাম। চুপচাপ কাপড় খুল। কোনো ভয় নেই৷ শুধু কাপড় খুল। না হলে গলা কেটে দেবো।’
ইশি পুনরায় মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো। আফতাব পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বাইরে চলে গেল।
উকিল তাড়া দিয়ে বললেন,
– ‘তারপর কী হলো?’
– ‘আমি ভয়ে চুপচাপ কাপড় খুলে ফেললাম। সে আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিল। ছুরি রাখলো বালিশের পাশে। আমি তখনই ছুরি হাতে নিয়ে নিলাম।’
উকিল তাকে থামিয়ে বললেন,
– ‘সে ছুরি এরকম বালিশের পাশে রাখবে কেন?’
– ‘ছোট দেখে হয়তো বুঝতে পারেনি আমি পালটা আক্রমণ করবো, অথবা বেখেয়ালে রেখেছিল।’
– ‘আচ্ছা তারপর?’
– ‘ছুরি হাতে নিয়েই তার বুকে ঘা মারি, খুব বেশি কিছু হয়নি। চাকুটা বুকের বাঁ পাশে একটু ঢুকেছে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুলো। তবুও যেন অদ্ভুত এক কারণে সে দূর্বল হয়ে গেল অনেকটা। এমদাদ এক হাতে নিজের বুক চেপে আরেক হাতে আমার গলা টিপে ধরলো। আমি পলকে ছুরি চালিয়ে দিলাম তার পেটে৷ একহাত দিয়ে আমার গলা ধরে তাকায় আমার অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার বগলে লাগলো ছুরি। তখনই সে ছেড়ে দিল আমাকে। আমি বাইরে বের হয়ে এলাম। এসে দেখি মানিক ভাই আর মানহা। ওরা আমাকে দেখে বললো চাকু হাতে কেন? কোথায় পেলি? আমি খুলে বললাম সবকিছু। ভাইয়া দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখলো এমদাদ খান মারা গেছে৷’
উকিল থামিয়ে বললেন,
– ‘মানিকের তখন বয়স কত হবে?’
– ‘আমাদের সবার বড়ো ছিল। আনুমানিক চৌদ্দ হবে।’
– ‘আচ্ছা তারপর?’
– ‘তারপর মানিক ভাই আমার হাত থেকে ছুরি নিয়ে বললো তোর হাত আমার গেঞ্জিতে মুছে নে তাড়াতাড়ি। আমি তখন একটা ঘোরের ভেতর ছিলাম। কথামতো তাই করলাম। মানিক ভাই তখন মানহাকে মানে ওকে সবাই তখন তাসফিয়া ডাকতো আরকি। তাকে বললো তাসফিয়া কাউকে তুমি বলবে না ইশি খুন করেছে। তাসফিয়া তখন বললো তাহলে কী বলবো? ভাইয়া বললো বলবে মানিক কীভাবে দড়ি খুলে এসে চাকু দিয়ে খুন করেছে আমি জানি না। শুধু দেখেছি ওই ঘরে ঢুকে ছুরি হাতে বের হতে।’
ততক্ষণে বাড়ির মানুষ এদিকে আসতে থাকে। ভাইয়া চাকু তাক করে সবাইকে ভয় দেখিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপরের সবকিছু ইরফান ভাই বললেই ভালো হবে।’
উকিল উঠে গেলেন নিজের চেয়ারে।
– ‘ইরফান সাহেব এবার আপনি বলুন। যেহেতু আপনি ওই বাড়িরই ছেলে।’
ইরফান বলতে শুরু করলো,
‘আমি তখন ভয়ে কাঁপছিলাম। কারণ কেউ যদি জানে আমি মানিক ভাইকে দড়ি খুলে দিয়েছি তাহলে আব্বার মাইর খাব। বাড়িতে তখন হট্টগোল শুরু হলো। বাবাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো এমদাদ চাচা খুন হয়েছেন।’
উকিল থামিয়ে বললেন,
– ‘আপনার বাবা মানে চেয়ারম্যান তাইতো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তারপর বলুন।’
– ‘বাবা তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসার পর সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? মা বললেন সবকিছু তো জানি না। তবে ইরফান ছিল ওকে ভালো করে জিজ্ঞেস করতে হবে। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে বল। আমি ভয়ে সব সত্য কথা বলে দিলাম। বললাম ইশি গিয়েছিল চাচার ঘরে। তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর ইশি দেখেছি ছুরি হাতে বের হয়েছে।’
উকিল তাকে থামিয়ে বললেন,
– ‘কিন্তু মানিক তো তোমাদের অন্যকিছু শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।’
– ‘আমি সিঁড়ির ওখান থেকে শুনিনি। অবশ্য মানহা তখন প্রতিবাদ করে পাশ থেকে বাবাকে বললো না না মানিক এসে উনাকে খুন করছে। বাবা তখন ইশিকে ডাকলেন। নেহারা আন্টি আর ইশি এলো। ইশিকে জিজ্ঞেস করতেই সে কেঁদে কেঁদে বলে দিল তাকে চাচা ছুরি দেখিয়ে কাপড় খোলার ভয় দেখিয়েছিলেন। বাবা তখন মানহাকে ডেকে নিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
– ‘তুমি কেন বলেছিলে মানিক খুন করেছে?’
ধমক খেয়ে সে বলে দিল মানিক শিখিয়ে দিয়েছিল বলতে। তখনই আব্বার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ইশিদের যেতে বললেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সবকিছু বাইরে প্রকাশ পেলে ইজ্জত যাবে। বাড়ির সবাইকে বললেন লোকজনকে বলতে এমদাদ চাচাকে মানিক খুন করে পালিয়েছে। কেন খুন করেছে তারা জানেন না।
মা তখন বললেন,
– ‘ওর মা-বোন তো সবাইকে বলে দেবে সত্য কথা।
‘সেটা পরে দেখা যাবে’ বলে বাবা কল দিলেন ওঝা দাদা আর মেম্বারকে। আমি চুপিচুপি গিয়ে নেহারা আন্টিকে সবকিছু বললাম। তারা কেন যেন ভয় পেয়ে গেলেন। যেহেতু ইশি খুনি তাই আন্টি পালিয়ে যাওয়াটাই বেছে নিয়েছিলেন। সকলেই হঠাৎ দেখলো ওরাও নেই। ওঝা দাদা সব সময়ই তাদেরকে বুদ্ধি দিতো। বাবা আর মেম্বার তার পরামর্শ কানে নিতেন বেশি। সে বললো এমদাদের কান কেটে সরিয়ে ফেলো।
বাবা আর মেম্বার অবাক হয়ে বললেন,
– ‘কেন?’
ওঝা তখন বললো এই খুন কেন হয়েছে পুলিশ ছেলেটিকে ধরার আগ পর্যন্ত জানতে পারবে না৷ কিন্তু পরিবার সহ পালিয়ে যাওয়ায় সে খুন করেছে এলাকার মানুষ সহ সবাই জানবে। এখন তার খুনের আলাদা একটা ধরন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলে এই ধরনের যত খুন হবে পুলিশ তাকে সন্দেহ করবে। আর আমাদের গাঁজার ব্যবসা, কবিরাজি, আপনি চেয়ারম্যান আর ইউনিয়নে আমাদের লোকদের মেম্বার বানানো সবকিছুর জন্য প্রায়ই খুন-খারাবীর সঙ্গে জড়াতে হয়। আমরা নিজেদের কাজে খুন করে কান কেটে ফেলবো। পুলিশ খুঁজবে ওই ছেলেকে৷ ওঝার কথামতোই সবকিছু করা হয়। আমাদের জঙ্গলের পরিত্যক্ত বাড়ি হলো অবৈধ সবকিছুর কারখানা। জঙ্গলের পেছনের দিকে নদী থাকায় তাদের আরও সুবিধা হয়েছে। চোরাই পথের সবকিছু এনে এখানে সহজে রাখা যায়। তাছাড়া পুরো ইউনিয়নে তখন কবিরাজির ব্যবসা ছিল। তারা একটা চক্র মিলে কবিরাজের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে দিতো। শত শত মানুষ নানান অসুখ-বিসুখ নিয়ে হাজির হয়। প্রতিদিন একেকটা এলাকায় হাজার হাজার টাকা ইনকাম। তাছাড়া বর্ষাকালে ট্রলার দিয়ে ডাকাতি। এরকম সবকিছুতে কেউ বাঁধা দিলে প্রায়ই তাদের খুন করতে হতো। তারা খুন করে দুই কান কেটে নিতো। পুলিশ তখন মানিক ভাইয়ের খুনের সাথে সাদৃশ্য পেয়ে তাকেই খুঁজে বেড়াতো।’
উকিল এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন,
– ‘বুঝেছি, এখন আপনি বলুন এইসব কথা আদালতে কী বলতে পারবেন?’
– ‘হ্যাঁ অবশ্যই বলবো আমি।’
– ‘নিজের বাবার বিরুদ্ধে?’
– ‘শুধু আমি না, আমার মাও দেবেন সাক্ষী। তাছাড়া মানহাও আছে।’
– ‘তাহলে এতদিন দেরি হলো কেন?’
– ‘সত্যি কথা বলতে আমার বাবার সঙ্গে মায়ের তখন মিল ছিল। আমিও মানিক ভাইদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
– ‘আচ্ছা বুঝেছি, আপনি আর আপনার মা যদি সাক্ষী দেন কেসটা আমার জন্য খুবই সহজ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ইশি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তার উপর আত্মরক্ষার জন্য খুন করেছে।’
– ‘আমরা সাক্ষী দিতে প্রস্তুত আছি।’
___চলবে___
বাঁক ( ৩৪ পর্ব )
_____________
এডভোকেট মাহবুবুল আলমের কথাই ঠিক হলো। মামলা কোর্টে উঠার পর খুব সহজেই তিনি জিতে গেলেন। ইরফান এবং তার মায়ের সাক্ষী দেয়ার পর বাদী পক্ষের উকিলের কিছুই করার থাকলো না। উলটো প্রকাশ পেয়ে গেল সুন্দরপুরে চেয়ারম্যানের আধিপত্য। পত্র-পত্রিকায় উঠে এলো তার অবৈধ সকল ব্যবসা। মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং ওঝা সহ সবাইকে আইনের আওতায় আনা হলো। মৃদুল সসম্মানে মুক্তি পায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা আত্মরক্ষার জন্য খুন করায় ইশিরও কোনো শাস্তি পেতে হলো না।
এরপর ঘটে গেল কিছু সিনেমাটিক ঘটনা। অভিমানে টইটম্বুর মানহা কোর্ট থেকেই উধাও হয়ে গেল।
বাইরে এসে ইরফান তাকে কল দিলো,
– ‘মানহা তুমি কোথায়?’
– ‘ইরফান ভাই আমি বাসে। জলেস্বরী যাচ্ছি আমি। ওখানে আর থেকে কী হবে? জেলে যাওয়ার আগে তো ওরা আমাদের থেকে পালিয়েই গিয়েছিল। তাই মুক্তি পেয়ে গেছে দেখে নিজেই চলে যাচ্ছি। তুমিও চলে যাও বাসায়।’
ইরফানেরও অভিমান লোমশ বিড়ালের মতো নাড়া দিয়ে উঠলো।
– ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। আমিও বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি।’
সে ওদের কাছে গিয়ে ঘড়ি দেখে বললো,
‘তাহলে মা’কে নিয়ে আমি এখন যাচ্ছি, ভালো থাকো তোমরা’ কথাটি বলে তার মা আর স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা গাড়ি ডেকে চলে গেল। মৃদুল বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ইশি ইতিউতি করে বললো,
– ‘ইরফান ভাই এভাবে বিদায় নিয়ে চলে গেল কেন? আর মানহাও হুট করে কোথায় চলে গেল?’
– ‘বুঝতে পারছি না।’
– ‘আচ্ছা ইরফান ভাইয়ের হয়তো কোনো কাজ আছে। সে তো বিদায় নিয়েই গেল, আমি বরং মানহাকে কল দিয়ে দেখি।’
মৃদুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আফতাব গাড়ি নিয়ে এসে বললো,
– ‘গাড়িতে বসেই কল দেয়া যাবে। আন্টিকে নিয়ে উঠো।’
সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। ইশি মানহাকে দুইবার কল দিতেই রিসিভ হলো,
– ‘হ্যালো।’
– ‘মানহা তুমি কোথায়?’
– ‘ইশি আমার একটা জরুরি দরকার পড়ায় চলে এসেছি। তোমাদের যেকোনো প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় সব সময় বলবে। এখন রাখছি।’
– ‘বলেই তো যাওনি, কোনো সমস্যা?’
– ‘আরে না, এতদিন চেম্বার রেখে তো মামলার জন্য ছোটাছুটিতে ছিলাম। আজ জরুরি দরকার পড়লো। ওদিকেও সবকিছু সমাধান তাই চলে এলাম। তোমাদের একটু পর কল দিয়ে ঠিকই বলতাম।’
– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে।’
ইশি ফোন রেখে দিল। মৃদুল তাকিয়ে বললো,
– ‘কী হয়েছে?’
– ‘কি জানি ওর দরকার তাই চলে গেছে।’
‘ও আচ্ছা’ বলে মৃদুল আনমনা হয়ে গেল। মানহার নিশ্চয় অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তার জন্য মামা-মামীর সঙ্গে মনমালিন্য হয়েছিল। তবে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী নয়। সুতরাং তার শক্ত থাকতে হবে।
ওদিকে ফাতিহার কি অবস্থা কে জানে।
পুলিশের মাধ্যমে তাকেও গ্রেফতারের খবর জানিয়েছিল। ইশিকেও নাম্বার দিয়েছে। জেলে থাকতে শুনেছে ফাতিহা অন্তঃসত্ত্বা। এই সময়ে সে একা।
– ‘ফাতিহার সাথে তোর কথা হয়?’
– ‘হ্যাঁ ডেইলি কল দিয়ে তোমার খোঁজখবর নিয়েছে। তারও শরীর খারাপ। নয় মাসে পড়লো মনে হয়।’
– ‘মানহাকে বলিসনি তো বিয়ের কথা।’
– ‘তুমিই তো না করলে।’
– ‘হ্যাঁ।’
মৃদুল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু পুনরায় আনমনা হয়ে যায়। বিয়ের কথা মানহা জানলে তাকে প্রতারক স্বার্থপর ভাববে। তবুও তাকে জানানো উচিত। সহজে তার আশা ছাড়তে পারবে সে। এমনিতেই আবেগের বশে মানহকে অনেক প্রশ্রয় দিয়েছে। কিছুটা আবেগ আর কিছুটা স্বার্থ। সব মিলিয়ে মানহার জন্য জটিল হয়ে যাবে তাকে ভোলা। সেও যে মানহাকে পছন্দ করে না তাও না। তারও ভালো লাগে মানহাকে। সেটা হয়তো ভালোবাসাও। তবুও সে বিবাহিত। ওর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই মঙ্গল। সিএনজি চলে এলো খেয়াঘাট। তারা পৌঁছে গেল আফতাবের বাড়িতে।
প্রায় এক সপ্তাহ পর আফতাবের বাবা-মা এলেন। ইশিকে দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা আফতাব নিজ থেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ছেলে সংসারী হবে তাতেই তারা খুশি। আফতাব সব সময়ই ছন্নছাড়া ছিল। নেহারা বেগম আর মৃদুলের সঙ্গে তারা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিলেন। বিয়ে হবে আগামী শুক্রবার। বিয়ে খুবই ঘরোয়া ভাবেই হবে।
এর ভেতরে ফাতিহাকে গিয়ে দেখে এলো মৃদুল। তাকে এই অবস্থায় বিয়েতে আনা গেল না। ইশি মোবাইলে নেহারা বেগমকে দিয়ে ইরফান এবং মানহাকে বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। দু’জনই আসবে মনে হলো।
কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলেই মৃদুল খবর পায় ফাতিহার অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে সদর হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃদুল ছুটে যেতে হলো রূপগঞ্জ।
জুম্মার পরেই চলে এলো মানহা আর ইরফান। খেয়াঘাটে এসে ইশিকে তারা কল দেয়৷ ইশি আফতবাকে পাঠায়। আফতাব ভোরে উঠে সেলুনে গিয়ে মুখ সেভ করেছে। চুল কেটেছে। তার আজ এমনিতেই নিজেকে কেমন নতুন বর মনে হচ্ছে। সবার সামনে যেতেই বিব্রতবোধ করছে। মানহা আর ইরফানকে খেয়াঘাটে গিয়ে পেল। ইরফান কালো প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট ইন করে পরেছে। তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো,
– ‘মানিক ভাই কোথায়? আজ আপনার বিয়ে আপনাকেই আসতে হলো।’
আফতাব এমনিতেই বিব্রতবোধ করছিল। তার উপর আবার সরাসরি বিয়ের কথা এসে গেল।
– ‘ভাবি গুরুতর অসুস্থ তাই চলে যেতে হলো।’
মানহা পাশ থেকে বললো,
– ‘ভাবি অসুস্থ মানে?’
– ‘মানিক ভাইয়ের বউ।’
– ‘হোয়াট! সে আবার কবে বিয়ে করলো।’
আফতাব আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আপনারা জানেন না?’
ইরফান মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না জানতাম না, আচ্ছা হাঁটুন।’
তারা আফতাবের পিছু পিছু এলো বিয়ে বাড়িতে। মানহার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই। আফতাব হয়তো ভুল বলেছে। বাড়িতে আসার পর সামনের রুমে তাদেরকে বসতে দেয়া হলো। মানহার অশান্তি লাগছিল। সে চুপিচুপি রুম থেকে বাইরে এসে বারান্দার এক মাথায় গিয়ে মৃদুলকে কল দেয়। দুইবার রিং হয়ে কেটে এলো। মানহা দাঁত কটমট করে আবার দেয়। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।
– ‘হ্যালো মানহা।’
– ‘বিয়ে বাড়িতে এসে তুমি নেই দেখে কল দিলাম।’
– ‘ও আচ্ছা, একটু সমস্যার কারণে থাকতে পারিনি।’
‘সমস্যাটা কী’ মানহার জিজ্ঞেস করতে ভয় করছে। যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে সে মেনে নিতে পারবে না। তবুও অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললো,
– ‘তোমার স্ত্রীর এখন কি অবস্থা?’
মৃদুল খানিক নীরব রইল। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বললো,
– ‘আসলে ওর বাচ্চা ডেলিভারির সময় এখনও আসেনি। তবুও হঠাৎ ব্যথা করায় হসপিটাল নিয়ে এসেছি।’
মানহার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। সে গ্রিলে শক্ত করে ধরে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সবকিছু ঘোলাটে দেখছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। মোবাইল আস্তে আস্তে হাতে নিয়ে সাবার সামনে চলে গেল। বিয়ে পড়ানো শেষ হয়েছে তিনটার আগে। ভোজন পর্ব শেষে ইরফান আর সে বিদায় নিয়ে বের হতে হতে আছরের আজান হয়ে গেল। খেয়া পার হয়ে ইরফান বন্দর এসে তাকে বাস স্টেশনের সিএনজিতে তুলে দিয়ে বললো,
– ‘মা’কে নিয়ে কয়দিন পর নানাবাড়িতে যাব, তখন দেখা হবে।’
মানহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বিদায় দেয়। বাসে এসে বসলো জানালার পাশে।
মৃদুলের ব্যাপারে সবকিছু সে ছোট খালাকে বলেছে। তারা রাগারাগি করলেও শেষপর্যন্ত বুঝেছেন মানহা বিষয়টির সঙ্গে খানিকটা জড়িত। তাকে কেন্দ্র করেই এসব হয়েছে৷ তাই আবেগ থেকে হয়তো বাড়াবাড়ি করেছে। সবকিছু বাদ দিয়ে এখন সুন্দর করে যেন চলে এটাই তাদের শেষ কথা। এই এক সপ্তাহ মানহাও মামা-মামীর সঙ্গে ঝামেলাহীম কাটিয়ে দিয়েছে। এলাকার লোকজন বাঁকা চোখে তাকায়। আড়ালে নানান গল্প করে সবকিছু সে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু আজ আবার নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। একটা প্রতারক স্বার্থপরকে সে ভালোবেসেছে? এই মানুষটিকে নিয়ে সে সংসার করার স্বপ্ন দেখতো? ওর জন্য সে এলাকার মানুষের কাছে দুশ্চরিত্রা হয়েছে। মানহা আর ভাবতে পারছে না। জানালার পাশে সে বসেছে। পাশে আরেকজন মহিলা। আর কান্না পাওয়ার বুঝি সময় পেল না? মানহা জানালার বাইরে চোখ রাখে। বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে চোখের জল মুছে নেয়। গোধূলি পেরিয়ে অন্ধকার রাত হয়ে গেল জলেস্বরী আসতে। সোজা রিকশা নিয়ে চলে গেল নানাবাড়ি৷ গ্রিল খুলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বালিশে মুখ চেপে বোবা কান্নায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠলো। সেই ছোটবেলা থেকে মানুষের অবহেলা, অনাদর পেয়ে বড়ো হয়েছে। বাবা থাকলেও দেখা হয়নি কতটা বছর হয়ে গেল। মামীর হাজার রকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মুখবুজে। সব সময় যেন একজন মানুষেরই অপেক্ষা করেছিল সে। সেই মানুষটাই ছিল মৃদুল। নিজের সকল আবেগ অনুভূতি এই মানুষটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। তাকে পাওয়ার পর মনে হয়েছিল মায়ের পরে সবচেয়ে আপন মানুষটাকে পেয়ে গেছে সে। আর এই মানুষটাই তার সঙ্গে প্রতারণা করলো? বিবাহিত হয়ে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিল এতদিন? কেন এমনটা করলো সে? দুশ্চরিত্রার সঙ্গে চললে লোকে তাদেরও খারাপ বলবে ভেবে আজকাল বান্ধবীরা তাকে এখন এড়িয়ে চলে। এলাকার মানুষদের সাথে তো মিশতেই পারবে না। এসব ভেবেই একা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিল রুমে। মামী এসে রাতের খাবারের সময় ডাকলেন৷
– ‘এই মানহা খাইতে আয়, আইসাই দরজা বন্ধ কইরা শুইয়া পড়লি কেন?’
– ‘মামী আমি খাব না মাথা ব্যথা করছে।’
– ‘আরও কতকি তোমার করবো। আর কত নাটক দেখাইবা আল্লা কে জানে।’
কথাগুলো বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন। মানহার ভীষণ অসহায় লাগছে। খুবই একা মনে হচ্ছে নিজেকে। মৃদুল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সে অভিমান করে চলে এলেও আশা ছিল এখন ঠিকই তাকে বিয়ে করবে। আর তো কোনো সমস্যা দেখছে না সে। আগে পালিয়েছিল ইশির নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং সকল সমস্যা এক সপ্তাহ মুখবুজে সহ্য করেছে। এবার কী হবে তার? লোকে খারাপ কথা বললে কীভাবে মানিয়ে নেবে সে? এভাবে রাত তিনটা হয়ে গেল। মানহার চোখে ঘুম নেই। আচমকা মনে হলো এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে মায়ের মতো দুনিয়া থেকে চলে গেলে। উঠে টেবিলে গেল সে। খাতা আর কলম নিয়ে খানিক্ষণ আঁকিবুঁকি করলো। তারপর একটা খালি পাতায় লিখলো,
আমাকে তুমি অনেক কিছু দিয়েছো মৃদুল,
দিয়েছো অবহেলা, অনাদর আর প্রণয়ের নামে ছল,
আমার কাফনে মোড়ানো লাশ দেখে শেষ বিদায়ে দেবে কী?
তোমার চোখের চুইয়ে পড়া একটুখানি জল।
____চলবে__