বাঁক,৮,৯

0
233

বাঁক,৮,৯
জবরুল ইসলাম
( ৮ম পর্ব )

– ‘মাঝ রাস্তায় বমি শুরু করছো কেন? রাস্তার পাশে চলো।’

মানহা বমি করতে করতে রাস্তার পাশে যায়। মৃদুল পেছন থেকে তাকে ধরে রেখেছে। খানিক পরেই নেতিয়ে পড়ে মানহা।

মৃদুল তাকে টেনে ধরে রেখে বললো,

– ‘কী হলো পড়ে যাচ্ছ কেন?’

– ‘শরীর কেমন জানি করছে। আমি এখানে কিছু সময় শুয়ে থাকি।’ কথাটি গোঙানোর মতো শোনাল।

– ‘আরে না এখনে ধুলোবালি আছে তো। আচ্ছা আমি তোমাকে কোলে করে নিচ্ছি। মাঠে গিয়ে শুয়ে থাকবে।’

মানহা কোনো জবাব দিলো না। মৃদুল ওর নেতিয়ে পড়া দেহখানি টেনে তুলে পাঁজাকোলা করে হাঁটতে থাকে। ইটের রাস্তা পেরিয়ে কুঁড়েঘরের সামনে এসে পুকুর পাড়ে থামে। পুকুরের পানিতে চাঁদ ডুবে গেছে। জলে একটু নাড়া দিলেই কাঁপবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দৃশ্যটি দেখা থেকে প্রয়োজন হচ্ছে মানহার বমি লেগে থাকা মুখটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা।

মৃদুল তাকে নারিকেল গাছের নিচে রেখে ফিসফিস করে বলে,

– ‘তুমি হেলান দিয়ে এখানে বসো, আমি ঘাট থেকে আঁজলা ভরে জল আনি।’

মানহা দূর্বল গলায় বললো,

– ‘আচ্ছা।’

তাকে বসিয়ে রেখে মৃদুল মাথা তুলে তাকায়। গাছের টুকরো ফেলে ঘাট বানানো। ধীরে ধীরে যায় সেদিকে। চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে একটা কাঠ দেখে পা দিতেই কীভাবে যেন বাঁ পাশ দিয়ে সরে গেল। ছিটকে গিয়ে তার কোমর পর্যন্ত পড়লো ডান পাশের জলে। বাকিটা গাছের টুকরোতে। প্রচন্ড ব্যথা পায় হাঁটুতে। হাত দিয়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে কাদায় গেড়ে গেল দু-হাত। তাড়াতাড়ি পুরো শরীর টেনে পানিতে নেমে পায়ে ভর দিয়ে আবার উঠে এলো কিনারে। কুঁড়েঘর থেকে বুড়ো লোকটি কাকে যেন ডাকছে। মৃদুল মানহাকে পাঁজাকোলা করে নেয়ার জন্য নুইয়ে হাত বাড়াতেই মানহা অস্ফুটে বললো,

– ‘তুমি পড়ে গেলে কীভাবে?’

সে কোনো জবাব দিলো না। দ্রুত কোলে করে তুলতে গেয়ে দেখে পানিতে এখনও ঢেউ রয়ে গেছে। পূব পাড়ের বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে চাঁদ পুকুরে ডুব দিয়ে জলের ভেতর কাঁপছে।

মৃদুল ফিসফিস করে বললো,

– ‘মানহা পুকুরের দিকে চোখ মেলে তাকাও।’

মানহা চোখ মেলে তাকায়। তখনই কুঁড়েঘরের দরজার খিল খোলার শব্দ শুনেই মৃদুল তাড়াতাড়ি উঠোন পেরিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল। বুড়ো প্রথমে গেল পুকুরের দিকে। তারপর রাস্তায়। এই সময়ে মৃদুল আহত পা টেনে টেনে দ্রুত নেমে গেল হাওরে। খানিক হেঁটে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ঘাসের ওপর রাখে মানহাকে। সেও মাঠে শুয়ে হাঁপাতে থাকে।

– ‘মানহা এখন কেমন লাগছে?’

– ‘জলের পিপাসায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

– ‘এখানে তো জল পাওয়া যাবে না। তবে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলে তুমি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। জর্দা দিয়ে সুপারি খেলে এরকম একটু হয়ই।’

– ‘হু, কিন্তু আমার ঘুম পাচ্ছে।’

– ‘ঘুমালে হবে না মানহা। হাওরটা তোমার হেঁটেই যেতে হবে। আমাকে ধরে ধরে তুমি হাঁটবে।’

– ‘আচ্ছা।’

মৃদুল আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ডান পায়ের হাঁটুতে প্রচণ্ড আঘাত টের পাচ্ছে।
ধীরে ধীরে শার্টের বোতামগুলো খুলে চিপা দেয়। তারপর ঝেড়ে-ঝুড়ে শার্ট পিঠে ফেলে হাতা দু’টা গলার সঙ্গে বাঁধে।

– ‘মানহা আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠো। রাত অনেক হয়ে গেছে যেতে হবে তো।’

মানহা উঠে বসে। মৃদুল তাকে ধরে দাঁড় করায়।

– ‘আমার হাত ধরে হাঁটতে পারবে না?’

– ‘না, তুমি আমার পিঠের দিকে হাত নিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরে রাখলে পারবো।’

মৃদুল পিঠের দিকে হাত নিয়ে ধরে বললো,

– ‘এভাবে?’

– ‘হু।’

– ‘ঠিকাছে এবার যাই।’

চাঁদের মিহি আলোয় দু’জন শ্লথ গতিতে হাঁটতে থাকে৷ ধীরে ধীরে মানহার শরীর পুরোপুরি ঠিক হয়ে আসলেও মৃদুলের পা ব্যথা বাড়ছে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মানহাও সেটা বুঝতে পারে।

– ‘পুকুরে পড়ে কি পায়ে ব্যথা পাইছো?’

– ‘হ্যাঁ, গাছের টুকরোতে হাঁটু লেগেছে।’

– ‘ইশ, হাঁটুতে দেখো কী হয়েছে।’

– ‘না, একেবারে গিয়ে দেখবো এখন থাক।’

– ‘আমার পাগলামির কারণে এগুলো হলো।’

– ‘তা ঠিক।’

মানহা আহত নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘ঠিক হলেও এভাবে বুঝি মুখের উপর বলে কেউ?’

মৃদুল মুচকি হাসে। মানহা বাঁ হাত মৃদুলের নগ্ন পিঠের দিকে নিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরে বললো,

– ‘শুধু তুমি না, আমিও তোমাকে ধরেছি, এবার হাঁটো।’

– ‘আমি তো তোমাকে কোলে নিয়েছি তুমি আমাকে নাও।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘বাবারে বাবা, এতো বড়ো ব্যাটা মানুষ আমি জীবনেও কোলে নিতে পারবো না।’

মৃদুল খানিক হেঁসে বললো,

– ‘এখন তুমি পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছো।’

– ‘হু।’

– ‘জর্দা চুন দিয়ে ঠোঁট লাল করে আর কখনও পান খাবে?’

– ‘জীবনেও না৷ কিন্তু কিসের জন্য এরকম হলো? সিগারেট না-কি পান?’

– ‘দু’টাই। হঠাৎ সিগারেট খেলেও একটু একটু মাথা ধরে। তাও আবার তুমি মেয়ে মানুষ।’

– ‘তাহলে পানের জন্য না। পঁচা সিগারেটের জন্য।’

– ‘তোমারে বলছে, সিগারেট থেকেও জর্দা আর চুন দিয়ে পান খাওয়া মারাত্মক। মাথা ঘুরে শরীর ঘেমে যায়।’

– ‘তা জানি, কিন্তু এতটাও ভাবিনি।’

– ‘এবার শিক্ষা হইছে তাহলে।’

– ‘আচ্ছা তুমি এতো পাগল কেন?’

– ‘কেন আমি আবার কী করলাম?’

– ‘এমনিতেই পানিতে পড়ার প্রচণ্ড শব্দ হইছে। তখন তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা না করে আমাকে আবার পুকুরে চাঁদ দেখাচ্ছ। ওদিকে বুড়ো এসে যদি ধরে ফেলতো।’

– ‘তুমি সবকিছু বুঝতে পারছিলে? আমি তো দেখলাম তুমি অজ্ঞানের মতো।’

– ‘মাথা ঘুরলে সেটা বেশিক্ষণ থাকে না। হুট করে মাথা ঘুরে পড়ে ঘেমে-নেয়ে খানিক পরে মানুষ ঠিক হয়ে যায়। আমি মনে হয় বমি করায় বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আর পানি খাইনি এখনও।’

– ‘বেশি পানির পিপাসা?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু এখানে তো পাওয়া যাবে না৷ তাছাড়া আর বেশিদূর না। চেম্বারে গিয়েই এক চুমুকে এক বোতল পানি খাব দেখে নিয়ো।’

– ‘এক বোতল শিওর?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এক গ্লাসও খেতে পারবা না।’

তারা গল্প করতে করতে বাজারের রাস্তায় এসে উঠে। বাজারে মানুষ নেই। দোকানগুলোর স্যাটার বন্ধ হয়ে গেছে। পাহারাদার অন্যকোনো গলিতে আছে হয়তো। তারা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে মামণি ফার্মেসির সামনে চলে আসে।

– ‘আমি কী চলে যাব?’

– ‘আরে না উপরে আসো।’

– ‘কেউ দেখলে সমস্যা হবে তো।’

– ‘এখানে দাঁড়িয়ে কথা না বলে তাড়াতাড়ি উপরে চলো।’

দু’জন সিঁড়ি দিয়ে উপরে এলো। মানহা ফুলের টবের নিচ থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলে বললো,

– ‘ভেতরে যাও।’

মৃদুল ইতিউতি করে ভেতরে গেল। মানহা গ্লাস লাগিয়ে নিয়ে বললো,

– ‘তুমি আগে বাথরুমে গিয়ে গোসল করো। সকালের গামছা আর যে কাপড় পরে এসেছিলে সেগুলো তো আছেই।’

– ‘হ্যাঁ, আর তুমি ততক্ষণে কিছু খাও।’

– ‘আচ্ছা চলো।’

মৃদুল জানালায় রাখা সকালের গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। মানহা টি-টেবিল থেকে জগ নিয়ে প্রথমে মুখ ধুয়ে ভালো করে কুলি করে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে টি-টেবিলে রেখে সোফায় বসে রইল। যতই পিপাসা থাকুক সে এখন একফোঁটাও জল খাবে না৷ মৃদুলের চোখের সামনে পুরো বোতল খেয়ে দেখাবে।
মৃদুল বাথরুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে খালি গায়ে বের হলো।

– ‘ভেজা কাপড় কী করবো?’

– ‘রান্না ঘরের ওদিকে বেলকনিতে দড়ি আছে, সেখানে দিয়ে দাও।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘এই দাঁড়াও, আমার প্রচণ্ড পানির পিপাসা আর অপেক্ষা করতে পারবো না৷’

– ‘তুমি অপেক্ষা করছো কেন?’

– ‘পুরো এক বোতল খেয়ে দেখাবো।’

– ‘তুমি দেখছি পুরাই উন্মাদিনী, আচ্ছা খেতে শুরু করো আমি কাপড় নিয়ে আসছি।’

– ‘না পরে বলবা পানি বাইরে ফেলে দিছি এখানে দাঁড়াও।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

মানহা গ্লাসে পানি ঢেলে প্রথম গ্লাস এক টানে খেয়ে নিল। তারপর আরেক গ্লাস। এভাবে পর পর তিন গ্লাস খেয়ে সে টের পেল পানি কেমন বাজে লাগছে৷ আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘ফ্রিজের পানি থাকে ঠাণ্ডা, তাই বেশি খাওয়া যায় না।’

মৃদুল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বাথরুমে গিয়ে নিজের কাপড় নিয়ে এসে বললো,

– ‘তুমিও গোসল করো।’

– ‘হ্যাঁ, তা তো করতেই হবে। কিন্তু তোমার হাঁটুর অবস্থা কী?’

– ‘অল্প কিছু জায়গা ফুলে গেছে, ও কিছু না তুমি যাও।’

মানহা সবকিছু নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। মৃদুল বেলকনির দড়িতে কাপড় মেলে এসে সোফায় বসে রইল। খানিক পরে মানহা সকালের শাড়ি পরেই পুনরায় বের হয়। মৃদুলকে দেখে চুল ভালো করে মুছতে মুছতে বললো,

– ‘গোসল করে ফ্রেশ হয়ে এসে আবার ময়লা কাপড় না পরলেই হতো।’

মৃদুল নিজের গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘এটা পরেই রাতে ঘুমিয়েছিলাম। ভোরে তো এভাবেই এসে এখানে গোসল করলাম।’

– ‘হু বুঝেছি, এখন ময়লা গেঞ্জি খুলে ফেলতে পারো, এখানে তো আর কেউ নেই।’

– ‘তুমি তো আছো।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘হ্যাঁ তাও ঠিক।’

মৃদুল খানিক ভেবে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আমি আজই তোমার এখানে সহকারী হিসেবে এলাম৷ কিন্তু এতো দ্রুত কীভাবে আপনি থেকে তুমিতে এসে একেবারে ফ্রেন্ডদের মতো হয়ে গেলাম?’

– ‘যাদু করেছি, আমি যাদু জানি।’

– ‘আসলেই মনে হয় জানো। তা তুমি ডাইনি, রাক্ষসী না-কি পেত্নী?’

– ‘তুমি এতো আনরোমান্টিক কেন?’

– ‘এটা কেন বলছো?’

– ‘ডাইনি, পেত্নী না বলে কি পরি বলতে পারতে না?’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘আসলেই পরি বলা উচিত ছিল।’

– ‘কেন?’

– ‘শাড়িতে পরির মতো সুন্দর লাগছে?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘মাঝ রাতে কোনো বদ মতলবে পটাতে চাচ্ছ না তো আবার?’

– ‘তার সুযোগ তো নেই, কারণ আমি একটু পরেই চলে যাব গুদামঘরে ঘুমোতে।’

– ‘আরে ধুরো থাকবে এখানে, যেতে হবে কেন?’

– ‘তোমার কী মাথা খারাপ? লোকে জানলে কী হবে ভেবে দেখেছো? তাছাড়া তুমি এখানে একা থাকবে কীভাবে? চলো বাসায় দিয়ে আসি।’

মানহা এসে মৃদুলের পাশে সোফায় বসে, তারপর তার দিকে এক অদ্ভুত ঘোর লাগা চাহনিতে তাকিয়ে বললো,

– ‘তোমার কী স্মৃতি শক্তি এতটাই দূর্বল?’

মৃদুল অবাক হয়ে বলে,

– ‘মানে?’

– ‘পরে বলছি, তার আগে বলো তোমার কী প্রেমিকা আছে?’

– ‘না।’

– ‘আমার মতোই অবিবাহিত, প্রেমিকাও নেই। তাহলে মানুষ জানা নিয়ে চিন্তার কিছু দেখছি না।’

‘আমি বিবাহিত’ বলতে গিয়েও মৃদুল আঁটকে গেল। এই মেয়েকে তার বড্ড প্রয়োজন৷
মানহা পুনরায় বললো,

– ‘তুমি গেঞ্জিটা খুলে বিছানায় যাও, গেঞ্জি থেকে গন্ধ আসছে।’

– ‘বিছানায় কেন যাব?’

– ‘আমি বলছি তাই।’

মৃদুল কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে বসে। মানহা কোত্থেকে ভিক্স নিয়ে এসে বললো

– ‘ট্রাউজার তুলো, দেখি হাঁটুতে বেশি ফোলা কি-না।’

– ‘আরে ও কিছু না, ভিক্স দিতে হবে না।’

– ‘আমি তুলতে বলছি।’

মৃদুল ধীরে ধীরে ট্রাউজার হাঁটু অবধি টেনে তুলে।

– ‘বালিশে গিয়ে শান্তিমতো শুয়ে থাকলে কী জাত যাবে?’

মৃদুলের কাছে কেমন রহস্যময় লাগছে মানহাকে। সে ধীরে ধীরে বালিশে গিয়ে মাথা রাখে। মানহা তর্জনীর আগায় অল্প ভিক্স নিয়ে ফোলা জায়গায় আলগোছে লাগিয়ে দেয়। মৃদুলের চাহনিতে শত শত প্রশ্ন, বিস্ময়।

মানহা জলে ঝাপসা চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। তারপর ধরা গলায় বলে,

– ‘মৃদুল কারও সঙ্গে একযুগ থেকেও বেশিদিন পরে দেখা হলে কী জড়িয়ে ধরে না?’

মৃদুল অবাক হয়ে বিছানা থেকে উঠে বললো,

– ‘হ্যাঁ ধরে, তো কী হয়েছে?’

– ‘তাহলে আমি কী মানুষ না?’

– ‘মানে কী? প্লিজ রহস্য না করে তাড়াতাড়ি বলো কে তুমি?’

— চলবে —

বাঁক ( ৯ম পর্ব )
_______________

মানহা ঈষৎ সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে স্মিথ হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা সবকিছুই বলবো, এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’

– ‘হ্যাঁ, তাহলে বলো।’

– ‘আমরা বেলকনিতে কফি নিয়ে বসে কথা বলি? যেহেতু দু’জনই ক্লান্ত, কফি খেলে ভালো লাগবে।’

– ‘তুমি এতো রহস্য করছো কেন বুঝতে পারছি না মানহা।’

– ‘হু, আমারও তাই মনে হচ্ছে৷ এখনই সবকিছু খুলে বলা দরকার।’

– ‘তাহলে বলছো না কেন?’

– ‘তুমি বেলকনিতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসো, আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

মৃদুল খানিক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে তাড়াতাড়ি আসো।’

সে বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে। মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বইছে। মেয়েটি আসলে কে? নিশ্চয় পরিচিত, শুধু পরিচিতই না। যতদূর বুঝা যাচ্ছে এই মেয়েটি তার জন্য রাহু নয়। বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবে না। এমন একজনের বড্ড দরকার ছিল। যে তার সবকিছু জেনেও কোনো ক্ষতি করবে না। যার সঙ্গে লুকোচুরি করা অনাবশ্যক। যে চাইলেই তাকে সহযোগিতা করতে পারবে। সুতরাং মানহা যেইই হোক ওর সঙ্গে ভালো রকম মিশতে হবে। যা চায় তাই করতে হবে। অবশ্য আগেই বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে৷ অযুক্তিক হলেও যতটুকু মনে হয়ে কোনো এক কারণে মেয়েটি তাকে পছন্দ করে। সুতরাং এটাই প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, বিশ্বস্ত একজন মানুষ পাশে পেলে অনেক কিছুই সহজ হবে। অতি অল্প সময়ে সে মনস্থির করে নেয় মানহা যা চায় সে তাই করবে। অন্তত অভিনয় করে যাবে। কারণ সতেরো বছরের ভ্রাম্যমাণ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে যতটুকু বুঝতে পেরেছে বিনিময় ব্যতীত কেউ সহযোগিতা করে না। ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়’ প্রচলিত এই কথা বড়ই বাস্তবিক।

– ‘কফি নাও।’ মানহার কথায় মৃদুল ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।

– ‘হ্যাঁ, দাও।’

মানহা ওর দিকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দেয়। মৃদুল কাপ হাতে নিয়ে মানহা মুখের থেকে কিছু শোনার জন্য চতক পাখির মতো অপেক্ষা করে।

– ‘আমি তোমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না। তুমি আমাকে আশাও করছো না৷ বরং আমার পরিচয় দিলে এতদিন ভণিতা করেছি বলে রাগও করতে পারো।’

– ‘মানহা তুমি যেইই হও আমার কাছে তুমি গুরুত্বপূর্ণ, সবকিছু আমাকে খুলে বলো প্লিজ।’

– ‘এতদিন অতিরিক্ত দুষ্টামি করার কারণে আমি দুঃখিত। বারবার মনে হচ্ছিল দুষ্টামি করা ঠিক হচ্ছে না৷ তবুও তুমি চিনতে পারছো না দেখে মজা করার লোভ সমলাতে পারিনি।’

– ‘আচ্ছা সমস্যা নেই বলো।’

– ‘মৃদুল আমি খুব বেশি ধার্মিক না হলেও বিশ্বাসী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি এই জগতের সবকিছু কারও ইশারায় চলে। আমাদের সম্পর্কটা তেমনই কারও সাজানো। যেকেউ শুনলে বলতে পারে এগুলো কাকতালীয়৷ কিন্তু না, আমার মনে হয় এটা অদৃশ্যের ইচ্ছায় হচ্ছে। তুমি হারিয়ে গেলে। বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ, পরিবারকে খুঁজে পাচ্ছ না। অথচ দেখো এতো বড়ো পৃথিবীতে, অসংখ্য মানুষের মধ্যে আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তারপর দেখো, আমি তোমার সঙ্গে আজ স্টেশনে গেলাম। আসার পথে ঠিকই অজ্ঞান হয়ে ফিরতে হয়েছে, এটা কী কাকতালীয় বলো? ছোটবেলার কথা মনে আছে তোমার? আমার বয়স সাত থেকে আট হবে তখন। তোমার হবে তেরো বা চৌদ্দ। ঠিক এভাবেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম আমি। তুমি আমাকে পাঁজাকোলা করে ভূতের বাড়ি থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে ফিরেছিলে। মৃদুল তুমি বিশ্বাস করবে না। কত যুক্তি দাঁড় করাবে তুমি কিংবা লোকজন। কেউ কেউ পাগলামি বলবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি এই সতেরোটা বছর তোমার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছি। ওই ছোট্ট মেয়েটির মাথায় মানিক নামটি গেঁথে রয়েছিল। আমার অবেচতন মন বলতো তোমাকে একদিন পাবো। কীভাবে পাব আমি জানতাম না। আমি কেবল বিশ্বাস করতাম পাব। আমি প্রতিটি ক্ষণে তোমার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করে আসছি। আমার জন্যই কেবল তোমার এই যন্ত্রণার জীবনকে যাপন করতে হয়েছে। আর হ্যাঁ, শুধু আমিই তো আসল ঘটনাটা জানি। পেপার পত্রিকা আর লোকমুখে পিচ্চি মানিক নামে কত আজগুবি মিথ্যে গল্প শুনি। তবুও আমি মুখ খুলে বলতে পারি না এগুলো মিথ্যে। কারণ তুমিই যে আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলে সেদিন।
আমার সব সময় মনে হয় এই ঘটনাটা তো আমাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।
তাই এখন তোমার সকল পরিস্থিতির, বিপদের, দুঃখের ভাগীদার আমি হতে চাই মৃদুল। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি বিয়ে করবো তোমাকে৷ লুকিয়ে রাখবো নিজের বুকের ভেতর৷ মানিক নামে কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তুমি আমার স্বামী হয়ে বাঁচবে, আমার মৃদুল হয়ে। আমি শুনেছি তুমি সবাইকে বলো এক ফকির তোমায় রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। তোমার জন্ম পরিচয় জানো না। ব্যস, এটাই তোমার পরিচয় থাকুক। এভাবেই তুমি নতুন করে বাঁচবে আমার সঙ্গে।’

মৃদুল বিস্মিত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে ওর সামনে গিয়ে বললো,

– ‘তুমি ইরফানদের বাড়ির সেই মেহমান মেয়েটি তাই না? কিন্তু তোমার নাম তো মানহা না, আরও কী যেন।’

– ‘স্কুলের সার্টিফিকেটে আমার নাম মানহা, ছোটবেলায় সবাই ডাকতো তাসফিয়া।’

– ‘হ্যাঁ তাইতো, কিন্তু কী আশ্চর্য আমি তো একটুও চিনতে পারিনি, তুমি চিনলে কী করে?’

– ‘আমি তখন বেশি হলে আট বছরের ছিলাম। এখন পঁচিশ বছর। মেয়েদের চেহারার পরিবর্তনও হুট করে বেশি হয়। আর তুমি তখনও অনেকটা বড়ো ছিলে। তাছাড়া গঠন খুব একটা বদলায়নি। চোখের নিচের কালো তিলটাও আছে।’

মৃদুল ওর হাত দু’টা ধরে বললো,

– ‘মানহা সেদিন আমি পালিয়ে গেলাম৷ তারপর আমার মা বোন কোথায় গেল? তাছাড়া পত্রিকায় পিচ্চি মানিক এতো প্রতিষ্ঠিত হলো কীভাবে? আমি তো এতো বছর সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছি। এসব ঘটনার সাথে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।’

– ‘তখনও কিন্তু পিচ্চি মানিক কিছুই করেনি।’

– ‘মানহা আমি তোমার পায়ে ধরি, তুমি ওই কথাগুলো কাউকে বলবে না৷’

– ‘এতো বছর কিন্তু বলিনি।’

– ‘হ্যাঁ, আমাকে কখনও পুলিশে ধরে নিয়ে গেলেও তুমি সত্য কথা কাউকে বলবে না।’

– ‘পা ছাড়ো, আমি এখনও কাউকে বলিনি।’

মৃদুল উঠে দাঁড়ায়, আঁজলা করে মানহার মুখ ধরে বলে,

– ‘মানহা তুমি পড়ালেখা করে অনেক বড়ো হয়েছো। দেশ, রাজনীতি, আইন কতকিছু জানো।
আমি সারাজীবন আজকের রাতের মতো তোমাকে নিয়ে ঘুরবো ফিরবো৷ ছোটবেলার মতো তোমার সকল আবদার পূরণ করবো, তুমি শুধু আমার মা বোনকে খুঁজে বের করে দেবে? আমার এখন আর পালাতে ইচ্ছা করে না মানহা। পুলিশ ধরলে ধরুক, শুধু নিজের মা বোনকে চাই।’

– ‘তা কীভাবে?’

– ‘আমিই বলবো কীভাবে খুঁজতে হবে, তুমি হেল্প করবে না বলো?’

মানহা আচমকা উঠে দাঁড়ায়। মৃদুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। তার নগ্ন লোমশ বুক চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলে,

– ‘কীভাবে ভাবো আমি তোমাকে হেল্প করবো না? আমি সুন্দর পুরের ওই সুন্দর দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো এক এক বের করলে দেখা যাবে তোমার উপহার দেয়া সেদিনগুলোই শুধু আছে। আজ রাতের কথাই ধরো, তোমার সঙ্গ ছাড়া এমন উপভোগ্য হতো বলো? তুমি অন্যরকম মানুষ, এতটা বছর আমি মন খারাপ থাকলেই কল্পনায় তোমার মুখটা দেখতাম।
তুমি মানেই যেন অপার্থিব কিছু। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে কত স্মার্ট সুদর্শন ছেলের সঙ্গে ওঠা-বসা হলো আমার। তবুও কেউ যেন তোমার মতো নয়।
আজও আমার সবকিছু কেমন স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে। তোমার পালিয়ে যাবার সিনেমাটিক দৃশ্যটা গেঁথে আছে মস্তিষ্কে।
আমি এতদিন বিয়েটা অবধি করিনি। আমার মাথায় যে ছোটবেলা থেকেই তুমি গেঁথে আছো। একজনের জায়গায় আরেকজন কীভাবে আসবে।
কেউ না জানুক, আমি যে সবকিছু জানি। তুমি যে বাস্তব জীবনের হিরো।’

– ‘মানহা শান্ত হও, আমি তো এখন তোমার কাছেই আছি, তুমি যা বলবে তাই হবে।’

– ‘মৃদুল, আমার এখানে কাজ করলে তুমি আপাতত সেইফ। কিছুদিন আগেও একটা গ্রামের ঘটনার সঙ্গে পুলিশ পিচ্চি মানিকের মিল খুঁজে পায়। ডিবি পুলিশ হন্যে হয়ে খুজে বেড়াচ্ছে তোমাকে।’

– ‘হ্যাঁ, আমি সবকিছু জানি মানহা। আমি শুধু আমার মা বোনকে খুঁজে বের করার আগপর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনোভাবেই ধরা পড়তে চাই না।’

– ‘তুমি ধরা পড়বে না মৃদুল। তুমি এখানে থাকবে আর আমার সঙ্গে কাজ করবে।’

– ‘কিন্তু আমরা এক সাথে থাকলে তো লোকে সন্দেহ করবে।’

– ‘আমি এখানে থাকবো না, তুমি একা থাকবে। আর কিছুদিনের ভেতরেই আমরা বিয়ে করে নেব।’

মৃদুলের মাথায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বুদ্ধি উদয় হলো। যতটুকু সম্ভব বিয়ে এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে তার।

– ‘মানহা আমরা এখনই বিয়ে করা ভুল হবে।’

– ‘কেন?’

– ‘একটা ডাক্তার মেয়ে রাস্তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে বিয়ে করেছে এটা লোকে সহজে হজম করতে পারবে না, ঘাটাঘাটি শুরু করবে। উল্টো আমার ঝামেলা হবে।’

– ‘তাহলে?’

– ‘আমরা পরে বিয়ে করবো। আপাতত এরকম গোপন সম্পর্ক থাকুক।’

– ‘ঠিকাছে।’

– ‘এখন রুমে চলো।’

মৃদুল চেয়ার দু’টা নিয়ে যাচ্ছে। মানহা কাপ নিয়ে পিছু পিছু আসে। মৃদুলের নগ্ন পিঠের দিকে পিটপিট করে তাকায়৷
চওড়া বুক, দুই হাতের বাহু শক্তপোক্ত, পেটানো শরীর। মানহার বুকটা শিরশির করে উঠে। লোকটা কতটা বছর আপনজন ছাড়া দেশে দেশে ঘুরছে। কোনো না কোনোভাবে তো সেও এর জন্য দায়ী। তাছাড়া আজ তাকে কত যত্নে কাঁধে করে রেলস্টেশন নিয়ে গেল। বমি করার পর একটুও ঘেন্না না করে কোলে তুলে নিল। এমনও বুঝি মানুষ পুরুষ হয়? আমার বাবা তো এমন না? মায়ের সঙ্গে কত অবিচার করেছেন। অবশ্য মৃদুল ছোটবেলায়ও এমন ছিল। কেমন যেন, মানুষটা অন্য রকম। একটুও বদলায়নি। মৃদুলের সকল দুঃখ, বিষাদ কী চুষে নিতে পারবে না সে? ওর জীবনটা কী একটু রাঙিয়ে দিতে পারবে ভালোবাসার রঙিন তুলি দিয়ে? পারবে সে, অবশ্যই পারবে।

– ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’ মানহার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় মৃদুল।

– ‘কিছু না।’

– ‘কী দেখছিলে এমন করে?’

– ‘তুমি দেখতে মোটামুটি ভালোই। হয়তো এতো কষ্টে না থাকলে আরও সুদর্শন হতে।’

– ‘তুমি আসলেই উন্মাদিনী। কাপ দু’টা হাতে কেন? রেখে আসো।’

মানহা কাপ রেখে এসে শাড়ি গুটিয়ে নিয়ে বিছানায় আসন পেতে বসে। মৃদুলও বালিশ কোলে নিয়ে মুখোমুখি হয়ে বললো,

– ‘আন্টি কেমন আছেন?’

মানহার মুখটি ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

– ‘মারা গেছেন।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘এসব কথা বাদ দাও, এখন শুনো, তুমি মুখ সেভ দাও কেন? সুন্দর করে কাট দিয়ে দাড়ি রাখবে।’

– ‘পারবো না, আমার মুখ চুলকায়।’

– ‘রাখলে অভ্যাস হয়ে যাবে, আর চুল এমন পাখির বাসা না বানিয়ে সাইটের চুল খাটো করে ফেলে নিবে।’

– ‘আচ্ছা বাবা ঠিকাছে, এখন শুনো সুন্দর পুর যেতে…।’

মানহা ঠোঁটে হাত দিয়ে আঁটকে দিয়ে বললো,

– ‘সব সময় কাজের কথা না। এগুলো কাল প্ল্যান করা হবে।’

– ‘তাহলে আজ কী করবো?’

– ‘আমি জানি না।’

—-চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here