বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #সূচনা পর্ব

0
174

কাল শাড়ি পরিহিতা এক শ্যামাঙ্গী তরুণী হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুঠামদেহী, গৌরবর্ণা পুরুষের বাহুডোরে। চোখে মুখে একরাশ গম্ভীরতা বিরাজ করছে তার। কুচকুচে কালো চোখের মণি দুটো স্থির হলো না এক মূহুর্তের জন্যও। বিরক্তি প্রকাশ্যে ঠোঁটদুটো চেপে ধরল একে অপরের সাথে। হাতে ধরে রাখা ফোনটা কানে চেপে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“আই’ল কল ইউ ব্যাক।”

শ্যামা কন্যা এক চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো শুভ্রবর্ণা, সুদৃশ্য একটি অবয়ব। নিজের এত কাছে কোনো পুরুষকে দেখে খানিকটা ভড়কে গেল সে। কিন্তু স্বভাবগত কাঠিন্যতা বজায় রাখতে নড়েচড়ে উঠল। পরক্ষণেই খেয়ালে এলো উন্মুক্ত কোমরে সুদর্শন পুরুষটির খোলা হাতের স্পর্শ। শিরশির করে উঠল গোটা শরীর। বিতৃষ্ণা জন্মাল নিজের উপর। তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে দাঁড়াল শ্যামাঙ্গী তরুণী।

মুখে কিছু বলার আগেই সুমধুর সুরে বেজে উঠল হাতে ধরে রাখা ফোনটা। আড়চোখে একবার সামনে বিরক্তভরা নেত্রে তাকিয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়ে ফোন কানে তুলে রিনরিনে গলায় বলল,
“হ্যা সিজান? কোথায় তোরা?”
অপর প্রান্ত থেকে কিছু কথা ভেসে এলো তরঙ্গের সাহায্যে। শ্যামাকন্যা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি আসছিলাম অডিটোরিয়ামের দিকেই। হঠাৎ দুটো নেড়ি কুত্তা তাড়া করল। তাদের থেকে বাঁচতে দৌড় লাগালাম। এখন আবার জাতীয় ক্রাশের সাথে ফেঁসে গেছি। আজ মনে হয় তোর মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছি ভাই। তাই ঝামেলা পিছু ছাড়ছে না।”

গৌড়বর্ণা পুরুষটি ভ্রু কুঁচকে বিরবির করে বলল, “জাতীয় ক্রাশ! হু ইজ হি?”

শ্যামাঙ্গী কন্যা পুনরায় বলল,
“হ্যা বলছে তোরে। তিয়াসা তপা পাবলিক প্রোপার্টির দিকে নজর দেয় না। এত খারাপ দিনও আসেনি, ওকে? তিয়াসাকে পেতে হলে তাজমহল থেকে স্বয়ং শাহজাহান কে উঠে আসতে হবে। এসব পাবলিক প্রোপার্টির কাজ নয় তিয়াসা কে পটানো। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে বুঝে নে, কেমন!”

ফোনে নিজের মত আলাপচারিতা শেষে সামনের সুদর্শন পুরুষের দিকে নজর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল তপা। কারণ সামনের মানুষটিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝাঁঝরা করছে তাকে।
তপা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি? এভাবে দেখছেন কেন? মিস্টার… হুয়াটএভার!”

গৌড়বর্ণা পুরুষটি দু’হাত পকেটে গুঁজে ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে থমথমে গলায় বলল,
” পলক তাজওয়ার। আই থিংক এটা আপনার জানা।”

তপা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
“ইয়াহ! এটা সবারই জানা। পাবলিক প্রোপার্টি বলে কথা।”

পলক কপালের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি বেশি বলে ফেলছেন?”

তপা মাথা নাড়িয়ে, ঠোঁট উল্টে না বোঝাল।

পলক পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। যাই হোক ল্যাদাবাচ্চাসম মেয়ের সাথে এ নিয়ে তর্ক করা তার সাজে না। বরং এটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ।

তিয়াসা তপা! একটি স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটির বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শ্যামা রঙের চলনসই সৌন্দর্যের অধিকারিনী তিয়াসা পুরোটাই স্নিগ্ধতায় মোড়ানো।
সিজান এবং পৃথা তপার একমাত্র কাছের বন্ধু। সিজানকে পেয়েছে মাধ্যমিকের প্রথম দিন থেকে। আর পৃথা! তার সাথে প্রণয় ঘটেছে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডিতে। কিন্তু পৃথা এখন প্রথম বর্ষে। তপা, সিজানের সাথে উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি টপকালেও মায়ের মারাত্মক অসুস্থতার দরুন একটা বছর হারিয়ে গেছে পৃথার জীবন থেকে। সাথে হারিয়ে গেছে মা নামক মানুষটিও।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে একটি স্মরণ সভা, আলোচনা সভার। সেখানেই উপস্থিত পলক তাজওয়ার। তপার ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন শিক্ষার্থী সে। একসময়ের ক্যাম্পাস কাঁপানো ছাত্রনেতা। যাকে ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্য হিসেবেই জানেন সকলে।

তপা অডিটোরিয়ামের সামনে গিয়েই দেখতে পেল সিজান এবং পৃথাকে। কাল পাঞ্জাবি ও কাল শাড়িতে দুজন কে দেখে প্রসন্ন হলো সে। প্রশংসাসূচক মন্তব্য করার আগেই ভেতরে ডাক পড়ল তার। বিশালাকার আয়োজনের উপস্থাপিকা তিয়াসা তপা। তার দেরি হলে চলে!

রিনরিনে, স্নিগ্ধ কণ্ঠে নিঃসৃত করল একের পর এক শব্দ, বাক্য। নন প্রফেশনাল অথচ কোনো জড়তা নেই কণ্ঠনালীতে। জড়তা বিহীন পুরো কার্যক্রম নিজের মত সম্পন্ন করছে সে।
মোহনীয় কণ্ঠে এবার অডিটোরিয়াম জুড়ে ধ্বনিত হলো-
“এবার আপনাদের মাঝে তার মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করবেন অত্র প্রতিষ্ঠানের সুযোগ্য শিক্ষার্থী , আমাদের গর্ব জনাব পলক তাজওয়ার। আমি জনাবকে অনুরোধ করছি তার মূল্যবান বক্তব্য রাখার জন্য।”

অপরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে খানিকটা নড়েচড়ে বসল পলক। পরক্ষণেই স্বীয় স্বভাবে উঠে দাঁড়াল। মৃদু হেসে দর্শন সারির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল নিজের লক্ষ্যে।
স্বল্প পরিসরে নানাবিধ আলোচনা সেরে চলে আসার পথে উঁকি দিল উপস্থাপিকা কন্যার দিকে। কিন্তু ব্যর্থ হলো তার পরিশ্রম। একগাদা স্তূপীকৃত ফুলের জন্য দেখা মিলল না লাস্যময়ী কণ্ঠের অধিকারিণী কন্যার।

নিজের কাজ সেরে হলরুম ত্যাগ করার সময় দরজার কাছে এসে পুনরায় মুখোমুখি হলো পলক তাজওয়ারের। পলক তপা কে দেখে ভ্রুকুটি করে তাকাল। কিছু বলার আগেই পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল তপা। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেছে তার। কাজ করার বাহানায় তারই ইউনিভার্সিটির এক রাজনীতিবিদ ছুঁয়ে দিয়েছে তাকে। ইচ্ছাকৃত এই স্পর্শে সারা শরীর রি রি করছে রাগে। হলরুমের বারান্দায় অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে করতে বারংবার কল দিতে লাগল একটাই নম্বরে। নাম্বারটা সিজানের। তপা কে অডিটোরিয়ামে ব্যস্ত দেখে সে পৃথা কে নিয়ে সফরে বের হয়েছে। উদ্দেশ্য কিছুটা সময় একান্তে কাটানো।

তপার শোচনীয় মনোভাব চেহারায় ফুটে উঠেছে। তিরিক্ষি মেজাজের প্রতিফলন শ্যামবর্ণা স্নিগ্ধ মুখে ভেসে আছে শুভ্র কাগজে ফুটে থাকা কৃষ্ণ বরণ অক্ষরের ন্যায়। বিচক্ষণতার শীর্ষে বসবাসরত পলক টের পেল তপার ভেতরের অস্থিরতা। দায়িত্বশীল, সচেতন নাগরিক হিসেবে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“এনিথিং রং?”

তপা নিজের সামনে পুনরায় পলক কে দেখে কোমরে হাত রেখে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে বলল,
“আপনাকে বলতে হবে? কে হে আপনি?”

পলকের কপালের রগ দপদপ করে উঠল। কে এই মেয়ে! এত কিসের তেজ! শক্ত গলায় ধমকের সুরে বলল,
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না?”

তপা নিভে গেল না। কণ্ঠে আরও দ্বিগুণ তেজ ঢেলে বলল,
“না হচ্ছে না। কে আপনি? নেতা? সকলের প্রিয় ভাই? নাকি মেয়েদের ক্রাশ? এর কোনোটাই আমার কাছে ম্যাটার করে না। না আপনাকে আমার সমস্যার কথা বলব; আর না কোনো সাহায্য চাইব। তিয়াসা তপা নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করার ক্ষমতা রাখে। আর রইল বাকি আপনার পরোপকারী মানসিকতা! এটা তো পাবলিক বোকা বানানোর ফন্দিমাত্র। আপনার মতোই হাজারো নেতা ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষ কে মানুষ বলেই গন্য করে না। নির্বাচনের পর তো ছাঁই দিয়েও ধরা যায় না। হাহ্! আসছে পরোপকার করতে। কত এলো, কত গেলো!”

শেষোক্ত কথাগুলো হাত ঝেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল তপা। পলক বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল। কে এই মেয়ে! আদৌ মেয়ে তো? নাকি টাইফুন! নারী জাতির নমনীয়, মায়ময়ী স্বভাব আছে নাকি এর ভেতর, বাহির কোথাও!

তপা এক হাতে শাড়ির কুচি ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলে পলক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পাবনা ফেরত রোগী রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রোপার চেকআপ করায় না নাকি আজকাল! আশ্চর্য!”

কথাটা আবছা ভাবে স্পর্শ করল তপার শ্রবণেন্দ্রিয়ে। পিছু ফিরে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“মেজাজ ঠিক নেই তাই কথা বাড়ালাম না। পাগলের তান্ডব যেদিন মাথায় উঠে দেখাব সেদিন বুঝবেন, পাবনা নাকি পঞ্চগড়! সি ইউ সুন।”

বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেল হলরুমের সামনে থেকে। পেছনে আটাশ বছরের জীবনে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে বাকশূন্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল শত নারীর হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম পলক তাজওয়ার।

“নবাবজাদী; এই নবাবজাদী। মহারানী ; আপনি কি আজ উঠে পায়ের ধুলো দেবেন? নাকি খাবার বিছানায় পাঠিয়ে দেয়া লাগবে আমার?”

আদি টাঙ্গাইলের তিনতলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলার ড্রয়িংরুম থেকে এক মহিলা কণ্ঠ উচ্চ আওয়াজে জপে চলেছে এই মন্ত্র।

কিয়ৎক্ষণ পর ভেসে এলো আরও একটি নারীকণ্ঠ। তবে এই কণ্ঠ ভীষণ নির্জীব। স্নিগ্ধ, শান্ত ও নমনীয়।

“আমার শরীরটা ভালো নেই মা। আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও দয়া করে।”

আগের উচ্চ কণ্ঠী মহিলা এবার রুষ্ট হলেন। গলায় জোর দ্বিগুণ বাড়িয়ে বললেন,
“হারামজাদি, আমিই যদি কাজকাম করি, তাইলে তোরে ভাত দিয়া পালতাছি ক্যান? বাইর হইয়া যাস না কেন বাড়ি থেকে। কলেজের নাম কইরা যে পোলাগো গতর ঘেঁষবার যাস তহন শরীর খারাপ থাকে না? বাইর হ আজ। চড়িয়ে সিধে করুম আজ।”

করুণকণ্ঠী মেয়েটা আর শব্দ করল না। উঠে এলো নিভৃতে; বিছানা ছেড়ে। জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের পানে। কত্ত কাজ তার! তার শুয়ে থাকার ফুরসত কোথায়! ভাগ্যের উপর করুণা হয় তার আজকাল। অভিযোগ নেই মোটেও! শুধুই করুণা।

চলবে…

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here