বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১৪

0
120

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৪

ঝলমলে রোদ্দুর বেষ্টিত ক্লান্ত দুপুর। অথচ একঝাঁক তরুণ তরুণী, যুবক যুবতীরা মত্ত নিজেদের পাঠ প্রদর্শনে। যেখানে গোটা দুনিয়া ঝিম ধরা রোদে অবসন্ন হয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত সেখানে তারা ব্যস্ত একের পর এক প্রেজেন্টেশন সাবমিট করতে।
বাংলা ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের ভীরে তপা সিজান কোনো রকমে নিজেদের দক্ষতা দেখিয়ে বাইরে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচল। এদিক ওদিক তাকাতেই কাল পোশাকধারী লোক দুটোর উপর নজর পড়তেই তপা বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক আওয়াজ করে। সিজান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হলো আবার তোর? গুঁড়া কৃমি উতাল দিল নাকি?”

তপা সজোরে কিল বসিয়ে দিল সিজানের পিঠে। সিজান বাঁকা হয়ে নিজের ব্যথা উপশমের চেষ্টা করে। পরক্ষণেই প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
“তুই কি খাস বল তো? একেকটা কিল এক মণ করে ওজন। এই কিল যদি তোর জামাই রে দেস বেচারা সাথে সাথেই অক্কা পাবে মিলিয়ে নিস।”
তপা গালে হাত রেখে আয়েস করে বসল। সামনে তাকিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,
“আমার জামাই রে আমি সারাদিন শুধু চুমামু দোস্ত। কিল ঘুষি সব তোর জন্যই বরাদ্দ।”

সামনে থেকে একটা পরিচিত অবয়ব যেন বাতাসের সুরে ফিসফিস করে বলল,”কি করবে সারাদিন? চুুমাবে? সিরিয়াসলি?”

তপা চমকে ওঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় গাল থেকে হাত ফসকে সরে যায়। দ্রুত আশেপাশে তাকিয়ে সিজান কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এখানে কেউ ছিল?”
সিজান তপার মতিভ্রম বুঝতে পেরে মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,
“তুই মরবি। জামাইয়ের কথা কইতেই কাউরে কল্পনায় দেখোস। জামাই পাইলে কি করবি আল্লাহই জানে।”

তপা তোয়াক্কা করে না সিজানের কথার। তার চোখ তো কেবল আশেপাশে ঘুরছে। মন বলছে সে আছে। চোখ বলছে ভুল। মন যা ভাবছে সবটা ভুল। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। সে যে বড্ড নাছোড়বান্দা। প্রিয়জনের উপস্থিতি যেন ঠিক বুঝে নয় অদৃশ্য ঘ্রাণ শক্তি দ্বারা। যেভাবে অবুঝ শিশু বুঝতে পারে মায়ের উপস্থিতি।

কৃষ্ণচূড়ার তলায় বসে থাকতে থাকতেই পৃথা এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে বসে বলল,
“পলক তাজওয়ার আসছে ক্যাম্পাসে।”

তপা চমকে ওঠে। মন তবে ঠিকই বলছিল। আশেপাশে তাকিয়ে শুধায়,
“কোথায় রে?”

পৃথা সরু চোখে তাকাল। কৌতূহলী গলায় বলল,
“তুই আবার এসবে আগ্রহ বোধ করছিস কবে থেকে? তুই না নেতাটেতা ঘৃণা করিস। তাহলে পলক তাজওয়ার দিয়ে কি করবি?”

তপা কিছু বলার আগেই সিজান সুর তুলে বলল,
“প্রেমে পড়েছে তপা প্রেমে পড়েছে, অচেনা থুরি চেনা এক মানুষ তপাকে পাগলি করেছে।”

তপা পুনরায় কিল বসিয়ে দিল সিজানের পিঠে। সিজান দ্রুত সরে পৃথার পাশে বসে বলল,
“দোস্ত বাঁচা আমারে। দশ মিনিটে দুই মণ কিল দিছে। আর দুই একটা দিলে আমি শ্যাষ।”

পৃথা সেসবে কান দিল না। তপার দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“তুই সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছিস তপা?”
তপা মেকি হেসে বলল,
“ওসব কিছু না। এমনি জাস্ট..?

পৃথা ভাবুক হলো। কিঞ্চিৎ সময় পর বলল,
” প্রেম খারাপ নয় তপা। কিন্তু ভুল মানুষের প্রেমে পড়া খারাপ। প্রথমত তুই রাজনীতি পছন্দ করিস না। কিন্তু পলক তাজওয়ার তুখোড় রাজনীতিবিদ। তুই জানিস কি-না জানিনা উনি এবার সংসদ নির্বাচন করবে। দ্বিতীয়ত উনারা অনেক বড়লোক। সেদিক থেকে তোরা আমরা কিচ্ছু না। তৃতীয়ত উনি ড্যাম হ্যান্ডসাম। আমি তোকে অসুন্দর বলছি না। তুই যথেষ্ট মায়াবী। কিন্তু উনার ধারে কাছে কিন্তু নেই। আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ। উনার আশেপাশের অনেক মেয়েদের নজর উনার সুন্দর মুখশ্রী আর টাকা পয়সার দিকে। তুই নিজেই উনাকে জাতীয় ক্রাশ বলেছিস আগে। তুই যে পরিমাণ পজেসিভ, পারবি সব মেয়েদের নজর সহ্য করতে? উনার দিক থেকে হ্যা সূচক ইঙ্গিত আছে কি-না আমি জানিনা। তবে গুঞ্জন উঠেছে পলক তাজওয়ার আজ এসেছে কেউ একজন উনার গার্লফ্রেন্ড কে অ্যাটাক করেছে তার ফয়সালা করতে। এতকিছুর মধ্যে তোর নিজের জায়গাটা কোথায় বুঝতে পারছিস তো? জেনে বুঝে আগুনে ঝাপ দিস না। পারবি না সইতে। পুড়ার আগে সরে যা। পুড়ে যাওয়া ক্ষতে মলম লাগিয়ে লাভ নেই।”

“পুড়ে গেলে লাগানোর জন্যই মলম আবিষ্কার করছে। না পুড়াইলে মলম লাগাইব কেমনে? মলম কোম্পানি লসে পড়ব না? মাথায় বুদ্ধি নিয়া ঘুরোস নাকি বালিশের তলায় খুইলা পইড়া রইছে?” পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলল সিজান।

“বেশি পকপক করিস না তুই। আমি ওর ভালোর জন্যই বলছি।”

“বাল ভালো বলছো তুমি। তুই আমারে ভালবাসোস?”

পৃথা মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।
সিজান মৃদু হেসে বলল,
“ক্যান ক্যান ভালোবাসোস? আমি তো এতিম। বাপ মা নাই। বাড়িঘর নাই। টাকা পয়সাও নাই। তাইলে? দেখতেও তোর ধারেকাছেও নাই। সারাদিন ঝগড়া করি। তাইলে? ক্যান ভালবাসলি? একটা কারণ দেখা।”

“তুই আমারে ভালোবাসিস। তাই ভালবাসি। আমার তো আর কিছুর প্রয়োজন নাই।”

সিজান আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“পয়েন্ট টু বি নোটেড..আমি তোকে ভালবাসি তাই তুই আমারে ভালোবাসোস। তেমনি তপা পলক তাজওয়ার রে ভালবাসে তাই পলক তাজওয়ারও তপারে ভালবাসব। আমগো তপা কি ফেলনা নাকি।পলক তাজওয়ারের সাত পুরুষের ভাগ্য তপা তার প্রেমে পড়ছে।। পলক তাজওয়ার সুন্দর এটা ওর প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু তপারও এরকম বহু প্লাস পয়েন্ট আছে। আমরা ওর জাস্ট বন্ধু। তাই জান দিয়ে দিতে পারে আমাদের জন্য। যে ওরে ভালবাসবে, যারে ও ভালবাসবে তার জন্য ঠিক কি কি করতে পারবে তুই ধারণাও করতে পারবি না। কিছুক্ষণ আগেই বলছিল সারাদিন চুমাবে। জিজ্ঞেস কর।” পৃথাকে পাশ কাটিয়ে তপা কে চোখ টিপল সিজান।

তপা ফিক করে হেসে ফেলল। সে কি-না পলক তাজওয়ার কে চুমু দিবে। সামনে আসলেই আজকাল পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়ে। গুড়গুড় শব্দ করে। আলতো করে চোখ বন্ধ করতেই দ্রুত খুলে ফেলল। বিরবির করে বলল, “ওরে বাবারে। পারব না। ভয়ংকর ব্যাপার।”

“কিন্তু উনার গার্লফ্রেন্ড?” দ্বিধান্বিত গলায় বলল পৃথা।

“এরকম হাজারটা গার্লফ্রেন্ড উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তপা। তাই না বল?” তপার উদ্দেশ্যে বলল সিজান।

“জি নাহ্। তিয়াসা তপা সেকেন্ড হ্যান্ড মালে আকৃষ্ট হয় না। তপা যেমন পিওর তার ভালবাসার মানুষটিও হতে হবে পিওর। যাকে বলে সলিড গোল্ড।”

“ক্লাস বাদ দিয়ে কি হচ্ছে এখানে?” গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাগুলো কর্ণকুহরে ধাক্কা মারতেই পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেল মাত্রই মাতিয়ে রাখা আড্ডা আসর।
তপা ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
“প্রেজেন্টেশন শেষ হয়েছে। তাই আড্ডা দিচ্ছিলাম।”

“এখানে আড্ডা দেওয়া যে সেফ নয় জানা ছিল না?” থমথমে গলায় বলল পলক।

“আপনার গুন্ডা বাহিনী তো আছেই।” মিনমিন করে বলল তপা।

“ওরা গুন্ডা নয়। ওরা আমার বডিগার্ড।”

তপা চোখ বড় বড় করে তাকাল। এর কানে কি সুপার পাওয়ার লাগানো আছে নাকি!

পলক পুনরায় বলল,
“একটুকুর জন্য সুপার পাওয়ারের প্রয়োজন হয় না। কমনসেন্স থাকলেই হয়। যা আমার সামনের মানুষটার নেই।”

তপা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে মুখ চেপে ধরল। আর কিছু বলবে না সে। ভাববেও না।

পলক চোখের ইশারায় তপাকে সাইডে ডাকে। গুটিগুটি পায়ে কাছে যেতেই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এসব কি ধরনের পোশাক? বাসায় অন্য পোশাক নেই?”

তপা চোখ গোল গোল করে বলল,
“ভাল লাগছে না?”

“তুমি ভাল লাগানোর জন্য ভার্সিটি এসেছো ফাজিল মেয়ে। ঠাটিয়ে দুটো লাগাব। পেছনে কোমরসহ পুরো পিঠ বের করে এসছে ভাললাগাইতে। শাড়ি ঠিক করো জলদি।”

তপা তৎক্ষণাৎ পেছনে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কখন থেকে এই অবস্থা হয়েছে কে জানে! চোখ ছলছল হয়ে যায় তার। কে কে দেখে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। পৃথার উপর রাগ হয় খুব। এসে থেকে বকবক করেই চলেছে। কোনো দিকে খেয়াল নেই।

তপার মলিন মুখ, ছলছল আঁখি দেখে শান্ত গলায় বলল,
“হয়েছে মন খারাপ করতে হবে না। কেউ দেখেনি। কেবলই সরে গিয়েছিল। এরপর খেয়াল রাখবে। কারো পার্সোনাল প্রোপার্টি এভাবে পাবলিক করো না। শাস্তিটা ভয়বহ হবে।”

তপা সরু চোখে তাকাল। সন্দিগ্ধ গলায় শুধালো,
“কার পার্সোনাল প্রোপার্টি?”

“দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস।”

ব্যস আর এক সেকেন্ডও নয়। পিছু ফিরে বুকে ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাস চোখে পরতে পরতে চলে গেল নিজের গন্তব্যে। পেছনে আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল একজোড়া কাজল কালো আঁখি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here