বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১৫

0
78

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৫

সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে তপা দুইতলা ভবনের চিলেকোঠার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল দূর সীমানায়।প্রকৃতি ছিল নির্জন, নিস্তব্ধ। নিরালায় দাঁড়িয়ে তপা ভাবতে থাকে স্বীয় পরিবর্তন সম্পর্কে। অন্তরের সুক্ষ্ম পরিবর্তন সে খেয়াল করছে বেশ ক’দিন। হৃদয়ের ছোট্ট কুঠুরিতে জমা হওয়া অনুভূতির নাম নিয়ে সে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্থ। এটাই কি ভালবাসা? নাকি কেবলই ভাললাগা। যা ক্ষণিকের ভালো থাকার সুপ্ত প্রয়াস। নাকি আজন্মকাল বয়ে বেড়ানোর মত দৃঢ়, প্রগাঢ় অভিলাষ!উত্তর মেলে না। বক্ষস্থল উলোটপালোট করেও এক রত্তি শব্দগুচ্ছও বহির্মুখী হয় না।

আনমনে, অভিমানে নিকষ কৃষ্ণ কেশরাশি কখন কাঁধ ডিঙিয়ে পিঠ ছাপিয়ে ভুমি স্পর্শ করেছে টেরও পায় নি সে। টের পেল গম্ভীর ভরাট গলায় বলা তিক্ত বাক্য শ্রবণেন্দ্রিয়ে স্পর্শ করতেই।

“আল্লাহ সৌন্দর্য দিয়েছে বলেই কি এক্সিবিশন করতে হবে।”

আকস্মিক আওয়াজে তপা চমকে উঠে পেছনে তাকায়। কথার মর্মার্থ ধরতে না পেরে ভ্রুকুটি করে বলল,
“কিছু বলছিলেন?”

“এখানে প্রদর্শনী চলছে? হেয়ারস্টাইল প্রদর্শনী?” পকেটে হাত গুঁজে বলল পলক।

তপা দ্বিধান্বিত বোধ করল। চুলের গোছায় হাত দিতেই টের পেল তা আর গচ্ছিত নেই ; পৌঁছে গেছে নিজেদের মর্জিমত। দ্রুত হাতে খোঁপা করতে চাইলে পলক বাঁধা দেওয়ার সুরে বলল,
“এখন বাঁধছো কেন? আমিও তো এক্সিবিশনের দর্শক। সনামধন্য ক্রেতাও। পছন্দ হলে কিনেও নিতে পারি।”

তপা মুচকি হাসল। স্পষ্ট গলায় বলল,
“সব সৌন্দর্য কেনা যায়?”

“আদায় করে নিতে হয়।” কথা শেষ হতেই ঠোঁট কামড়ে চোখ টিপল।
ভড়কায় না তপা। ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আদায় করতে জানেন?”

“সেটা সময় বলবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।”

কাছাকাছি একটা ছাঁদে নজর পড়তেই তপার মেজাজ ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে বেঁকে যায়। পারদ মিটারে উত্তীর্ণ হয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। চোখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে হিংসাত্মক তৎপরতা। পলকের দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“এই সময় ছাঁদে কি আপনার?”
পলক অবাক হলো খানিকটা। এতক্ষণের মিষ্টভাষিণীর কণ্ঠ হঠাৎ তিতকুটে স্বাদ রোধ করার হেতু খুঁজে পেল না সে।
“আমি তো রোজই আসি ছাঁদে। কেন কোনো সমস্যা?”

আইবাই তো, আইবা না? সুন্দর খোমাটা দেখাইতে তো তোমার আইতেই হইব। মেয়েদের যদি পাগল করতে না পারো তবে আর এই সিক্স প্যাকের কি দরকার। ব্যাডা বেত্তমিজ কোনহানকার। মেয়েগুলারও বলিহারি! এত ব্যাডাছেলে থাকতে এর উপরই নজর দিতে হবে? দুনিয়ায় আর কেউ নাই? ফাজিলের ফাজিল। হারামির হারামি।

তপা কে বিরবির করতে দেখে পলক সরু গলায় বলল,
“কার গুষ্টি উদ্ধার করছো এভাবে বিরবির করে?”

তপা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনার না এটা নিশ্চিত থাকেন।”

মেজাজ খারাপ করে অন্য দিকে ঘুরে গেল তপা। দেখবে না আর জাতীয় ক্রাশ কে। খাবে না আর বাঁশ। আনমনে বিরবির করতে করতে চুলগুলো হাতখোপা করে ফেলল। উল্টোদিকের রেলিংয়ে হাত রেখে টানটান হয়ে দাঁড়াল।মনের আকাশে উঁকি দিল এক ঝাঁক কাল মেঘের ছায়া।
হঠাৎই পলক পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিহি গলায় বলল,
“রাগলে বোধহয় মেয়েদের প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।”

নিমিষেই সমস্ত মেঘ কেটে রোদ্দুরের দেখা মিলল। দেখা মিলল সাত রঙা রংধনুরও।

প্রতিত্তোর করল না তপা। পলক পুনরায় বলল,
“আর প্রকাশ পায় লজ্জা পেলে। লাজুক অবস্থায় হয়তো একটা মেয়ে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠে।”

তপাও কি খানিকটা লজ্জা পেল? শ্যামবরণ মুখটায় হঠাৎই এক চিলতে রক্তিম আভা দেখা দিল? নাকি নিছকই গোধূলির আলোয় আলোকিত ধরার এক ছটা আলোর প্রতিফলন!

“তোমার কাছে ভালবাসা মানে কি?”

এবারে চোখ তুলে চাইল তপা। চোখে চোখ রেখে তাকাল। উপলব্ধি করার চেষ্টা করল সামনের মানুষটার হৃদয়ের অভ্যন্তরের লুকোনো কিছু সত্যবাণ। পুরোটা ব্যর্থ বোধহয় তাকে হতে হলো না। একরাশ আকুতি নিয়েই যেন মিটমিট করে জ্বলছে ওই আঁখিদ্বয়।

পলক পুনরায় ইশারা করে কিছু বলতে। তপা গলা ঝেড়ে বলল,
“আমার কাছে ভালবাসা মানে সাতরং। একেক সময় একেক রূপে ধরা দেওয়া। একেক রূপে রাঙিয়ে দেওয়া। আমার কাছে ভালবাসা মানে জীবনের ভার বইতে বইতে যখন ক্লান্ত হয়ে নুইয়ে পড়ব, যখন মনে হবে একটু বিশ্রাম দরকার ; নিজের জন্য একটু সময় দরকার ; একটু শান্তির ঘুম দরকার ; দরকার একটু সুখের আশ্রয় । ঠিক সেই সময়টায় একটা বিশ্বস্ত কাঁধ, একজোড়া বিশ্বস্ত হাত এসে বলবে এই তো আমি। এত ক্লান্তি কিসের! আমার কাছে এটাই ভালবাসা। আমার কাছে ভালবাসা মানে রক্তের সম্পর্ক না হয়েও অগাধ বিশ্বাস, ভরসা আর মমতায় আগলে রাখা। আমার কাছে ভালবাসা মানে একজন মায়ের ব্যাগ হাতড়ে শেষ সম্বলটুকু তুলে দিয়েও হাসিমুখে বলা, আরও লাগবে? লাগলে বল এনে দিচ্ছি এক্ষুণি। আমার কাছে এটাই ভালবাসা। একটা জোৎস্না রাতে অথবা কোনো এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় সব ফেলে দূরে যেতে ইচ্ছে করলে একজোড়া ভরসার হাত বাড়িয়ে বলবে চলো না ওই দূর আকাশের দেশে। আমার কাছে এটাই ভালবাসা। দিনশেষে এমন একজন মানুষের বুকে মাথা রেখে ক্লান্তির নিশ্বাস নেওয়া যার বুকে শান্তি মিলে, মিলে সুখের আবেশ।”

পলক অপলক তাকিয়ে বলল, “তোমার সে খুব ভাগ্যবান।”

বিনিময়ে তপা কেবল মুচকি হাসল। কিঞ্চিৎ সময় পর বলল,
“আপনার কাছে ভালবাসার সংঙ্গা কি?”

পলক মৃদু হাসল প্রশ্ন শুনে। পরক্ষণেই স্বীয় স্বভাবে বলল,
“আমার কাছে ভালবাসা অসংঙ্গায়িত। যার কোনো সংঙ্গা হয় না। সীমা পরিসীমা হয় না। তুমি বলছিলে না যার বুকে ক্লান্তির নিশ্বাস নেওয়া যার, আমার কাছে ভালবাসা মানে যে তোমাকে কখনো ক্লান্ত অনুভবই করতে দেবে না। সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে সজীবতায়। জীবনের ভার বইতে সেও এগোবে সমান তালে। আমার কাছে ভালবাসা এটাই যার কোনো ভাষা নেই। আছে কেবল প্রখর অনুভূতিশক্তি। আছে হৃদয়ের টান। আছে প্রনয়ের দহন।”

তপা বাইরে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করে ভরাট গলায় বলা প্রতিটি শব্দবাণ। জর্জরিত হয় প্রবল বিষাক্ত যন্ত্রণায়।

“আমার কাছে ভালবাসা মানে প্রেয়সীর মুক্ত কেশের তীব্র সুগন্ধি। যা দূর বহুদূর থেকেও মাতাল করে আমাকে। আমার কাছে ভালবাসা মানে ক্যাম্পাসে আড্ডারত অবস্থায় চরম অমনোযোগী মেয়েটা। আমার কাছে ভালবাসা মানে বৃষ্টি ভেজা ওই স্নিগ্ধ ফুলটা। যে সামান্য বর্জ্যপাতের ভয়েই নুয়ে পড়ে আমার শক্ত খোলসে মুণ্ডিত বক্ষপিঞ্জরে। আমার কাছে ভালবাসা মানে তো এই মেয়েটিই। যার ছোট্ট দেহের পরদে পরদে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য চৌম্বক। যা প্রতি নিয়ত টানছে আমাকে।”

তপা চোখ খুলে পলক কে নিজের দিকে ঘোর লাগা নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইতস্তত করে বলল,
“কি দেখছেন?”
পলক মাথা নাড়ায়। কিন্তু নজর সরায় না। নির্নিমেষ চেয়ে রয় ওই মুখ পানে। তপা ঈষৎ লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি করে নামতে নামতে বলল,
“আজান দিচ্ছে। আমি যাই।”

পলক পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“শ্যামাঙ্গিনী, আমার রক্তে শুধু হিমোগ্লোবিন না, তুমিও থাকো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here