বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১৭

0
83

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৭

পলক ঢাকার বাইরে আজ চারদিন। পার্টির কাজে ব্যস্ত। নির্বাচন এগিয়ে আসায় ব্যস্ততা বাড়ছে তার। তপার দিন কাটছে একাকী। কাছে থাকলে মানুষটাকে না বুঝলেও মানুষটার অনুপস্থিতি তাকে সুক্ষ্ম পীড়া দিচ্ছে। দিচ্ছে বিরহ যন্ত্রণা। ছাঁদে দাঁড়িয়ে শূন্যে দৃষ্টি মেলে বলল,
“আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন পলক? আমার নীরব যন্ত্রণাটুকু অনুভব করতে পারছেন? নাকি আমি একাই পুড়ছি বিরহে। একাই জ্বলছি অনলে? আপনি কি জানেন, এই মূহুর্তে আপনাকে না পেয়ে আমার নিঃশ্বাসটুকু স্থির হয়ে আসছে। অসার হয়ে আসছে গোটা দেহ। ঝাপসা হয়ে আসছে জ্যোতিশক্তি, শুধুমাত্র আপনাকে দেখতে না পেয়ে। আপনি কি বোঝেন এসব? রাজনীতিবিদ বলে অনুভূতি শক্তি ভোতা হয়ে গেছে পলক? আপনিও কি তার মত? তাদের মত? আপনি তো আলাদা। আমি যাকে চিনি সেই পলক তো অনুভূতি প্রবণ, আবেগী। তবে কেন কাছে থেকেও আমাকে বোঝেন নি আপনি? কেন আমি জ্বলছি একা একা? আমি ভালো নেই পলক। একদম ভালো নেই। আপনাকে আমার ঠিক ততটুকু প্রয়োজন যতটা প্রয়োজন একজন শাসকষ্টের রোগীর ইনহেলারের।”

আকাশের কাছে অভিযোগ জানিয়ে পিছু ঘুরল তপা। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি পলক। ভালোবাসি আপনাকে।”

সহসা ফোনের শব্দে মনোযোগ নষ্ট হয় তার। মেজাজটা খিঁচড়ে গেলেও রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
অপর পাশ থেকে ভরাট গলায় উত্তর,
“ওয়ালাইকুম সালাম।”
পরেরটুকু আর বলার প্রয়োজন হলো না। তপা বিস্মিত গলায় বলল,
“পলক!”
পলক কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
“বাহ্। আওয়াজ শুনেই চিনে নিলে! ইমপ্রেসিভ।”
তপা আড়ালে হাসে। মনে মনে বলে,”আওয়াজ কেন আমি তো আপনার নিশ্বাসের শব্দও চিনে নিতে সক্ষম।”
পলক পুনরায় বলল,
“কোথায় হারালে মেয়ে?”
“কখনো হাওয়ায় গা ভাসিয়েছেন?”
“কিভাবে?”
তপা চোখ বন্ধ করে। মোহনীয় গলায় বলে,
“দু’হাত দু’দিকে মেলে নির্দিষ্ট একজন কে ভেবে মনে মনে উড়েছেন আকাশে? অনুভব করেছেন তাকে? মনে হয়েছে সে আপনার কাছে ; খুব কাছে। যতটা কাছে থাকলে একে অপর কে ছুঁয়ে দেয়া যায়। অনুভব করা যায় নিশ্বাসের আওয়াজটুকুও। মনে হয়েছে সে ছাড়া এই মূহুর্তে আপনার ত্রিভুবনে কেউ নেই। কেবল সে সে সে এবং কেবলই সে।”
পলক মৃদু হাসল। মেয়ে যে পুরোদস্তুর ডুবে গেছে।
মুখে বলল,
“তুমি প্রেমে পড়েছো মেয়ে।”
“শুধু প্রেমে?”
“উঁহু; ভয়ংকর প্রেমে।”
“এ প্রেমের পরিণতি কি মিস্টার তাজওয়ার?”
“মিলন অথবা মৃত্যু।”
ভরাট গলায় এহেন ভবিষ্যৎ শুনে তপা কেঁপে কেঁপে ওঠে। আড়ষ্ট হয়ে বলে,
“এই অনূভুতি ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক মিস্টার তাজওয়ার।”
“শুধু যন্ত্রণা?”
“উঁহু! মিষ্টি যন্ত্রণা। যা প্রতিনিয়ত হৃদপিণ্ডটাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। এর শেষ কোথায় পলক?”
পলক নেশা ধরানো গলায় বলল,
“আমি আসছি তিয়াসা। খুব তাড়াতাড়ি।”
“আপনি আমাকে বোঝেন?”
“তোমার চেয়েও বেশি।”
তপা মুচকি হাসে। শব্দ হয় না সে হাসির। কেবল ঠোঁটের কোণ বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো অবয়বে।

“তোমার কোনো প্রবলেম হচ্ছে তিয়াসা?কেউ কোনো ঝামেলা করেছে?” খানিকটা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায় পলকের কণ্ঠে।
“আপনি থাকতে সে সাধ্যি কার?”
“আমি তো নেই।” পলকের কণ্ঠ মলিন।
তপা পুনরায় হাসে। এবার একটুখানি শব্দ হয়। পরক্ষণেই ভীত কণ্ঠে বলল,
“আমার খুব ভয় করছে পলক। চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। ভয় করছে আমার। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি।”
পলক হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে তিয়াসা? এমন করছো কেন?”
তপা থেমে থেমে বলল,
“আমার খুব ভয় করছে।”
“আমি আছি তো। চোখ বন্ধ করো। অনুভব করো আমাকে। তোমার খুব কাছে। যতটা কাছে থাকলে ছুঁয়ে দেয়া যায় একে অপর কে। অনুভব করা যায় উভয়ের নিশ্বাস। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখা যায় বক্ষপিঞ্জরে।”

তপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসিটুকু বজায় রেখেই বলল,
“কে যেন বলেছিল সে নেই?”
পলক সরু গলায় বলল,
“ভারী দুষ্ট আছো তো মেয়ে।”
তপার হাসি থামে না। ঠিক যেন কলকল করে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী। অপর পাশের মানুষটির হৃদয়ে ঢেউ তুলে বয়েই চলেছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে।

সিজান আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে পার্থিব মোজাম্মেলের সামনে। ভদ্রলোক মিনিট পাঁচেক সময় ধরে কেবল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেই যাচ্ছে। কনে দেখতে এলেও বোধহয় এত দেখে না। পার্থিব মোজাম্মেলের দৃষ্টির বাইরে গিয়ে সে নড়তেও পারছে না। কেবল বার কয়েক অসহায় দৃষ্টি মেলে পৃথার দিকে তাকিয়েছে। বিনিময়ে পৃথাও ফিরিয়ে দিয়েছে অসহায় দৃষ্টি।
একপর্যায়ে মুখ খুললেন তিনি। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তাহলে… তুমিই সে? যার জন্য আমার মেয়েটার চোখে পানি এসেছিল।”
সিজান কণ্ঠের গভীরতা শুনে ভয়ে ঢোক চাপতে লাগল। একবার পৃথার দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
“আসলে আংকেল আমি… ”
পার্থিব মোজাম্মেল হাত তুলে মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেন। নিজেই পুনরায় বললেন,
“আরেকটা কোথায়? তাকে কেন ডাকা হয় নি?”

“কাকে বাবা?”
“কাকে আবার? পালের গোদা টাকে ডাকা ডাক।”
“তুমি কি তপার কথা বলছো বাবা?”
“হ্যা। এক্ষুণি ডাক। আর ওকে শুকনো মুখে বসিয়ে না রেখে চা নাস্তা কিছু দে। বেচারার গলা শুকিয়ে গেছে বোধহয়।”
সিজান বিস্ময়ে তাকাল। লোকটা কি ইয়ার্কি মারল নাকি সিরিয়াস? বোধগম্য হলো না তার। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার পশ্চাতগমনের পানে।

তপা আসতেই তিনি হুংকার ছেড়ে বললেন,
“তুমি ভাবলে কি করে এই ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব? কি আছে এর?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here