#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৯
পলকের কথার প্রতিত্তোরে প্রান্ত শান্ত গলায় বলল,
“সেটার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
পলক প্রান্তর কাঁধ চাপড়ে স্মিত হেসে বলল,
“অবশ্যই বাধ্য। কারণ তোর হঠাৎ টপকানো বোন আমার ভবিষ্যৎ।”
প্রান্ত চমকায়। তৎক্ষণাৎ তপার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“পিচ্চি!”
তপা কি বলবে? সে তো আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। হ্যা সে জানে পলকের মনে তার জন্য সফট কর্ণার রয়েছে। তার মনেও রয়েছে পলকের জন্য এক ঢাল ভালবাসা। তাই বলে সরাসরি ভাইয়ের সামনে এভাবে বলবে? তাও আবার ভাইকেই পিঞ্চ মেরে! বিরবির করে বলল,
“নেতাটা কি অসভ্য মাইরি। নেতাগুলা আসলেই ঠোঁটকাটা স্বভাব সঙ্গে নিয়ে জন্মায়।”
প্রান্ত পুনরায় বলল,
“কি হলো কিছু বলবি তো? পলক কি বলছে এসব? তুই ওর ভবিষ্যৎ মানে কি? আমাকে তো কিছু জানাস নি।”
তপা চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল। নিচু গলায় বলল,
“আসলে ভাইয়া তেমন কিছু না।”
“তাহলে কেমন কিছু?”
পাশ থেকে পলক মাথা এগিয়ে তপার মুখোমুখি হয়। মাঝে কেবল কয়েক সেন্টিমিটারের ফারাক। আকস্মিক ঘটনায় তপার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। প্রান্ত কিছু বলতে চাইলে পলক বাম হাত উঁচিয়ে ইশারায় থামতে বলে।
তপার চোখে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমাকে মিস করো?”
তপা সম্মোহনীর ন্যায় উপর নিচ মাথা নাড়ায়।
পলক মুচকি হাসে। পুনরায় কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি কাছে এলে বুকের ভেতর ধ্রিম ধ্রিম শব্দে মাদল বাজে?”
এবারেও মাথা নাড়ায় তপা।
“আমায় মনে করে কল্পনায় আকাশে উড়েছো? অথবা হাওয়া গা ভাসিয়ে দিয়েছো?”
“আমার বিরহে অনূভুতিরা হৃদপিণ্ডে সূচ ফুটানোর মতো যন্ত্রণা দেয়?”
“আমায় উদ্দেশ্য করে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রেম পত্র হাওয়ায় ভাসিয়েছো?”
পরপর মাথা নাড়িয়ে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে হ্যা বোধক সম্মতি দেয় তপা।
সরে আসে পলক। প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বিজয়ী হেসে বলল,
“আর কিছু বলার আছে? এনিওয়ে এটা ভাবিস না তোর বোন একাই প্রেমে পাগল হয়েছে। সমান তালে আমিও আছি। তাই আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমার জানার অধিকার আছে। আর যদি বলতে না চাস তবে আমার কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমেই পাতাল ফুঁড়ে খবর বের করে আনার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তিয়াসার ব্যাপারে আমি সেটা চাই না। আমি চাই না আমার কোনো সোর্স কাজে লাগিয়ে ওর খবর বের করতে হোক। বিকজ ইট’স মাই পার্সোনাল প্রোপার্টি।”
তপা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিরবির করে বলল,
“যাহ্ শালা। পাবলিক প্রোপার্টি শেষে কি-না আমাকে পার্সোনাল প্রোপার্টি বানিয়ে ফেলল!”
প্রান্ত শান্ত চোখে তপার দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল,
“কথাগুলো আমার বোনটার একান্ত ব্যক্তিগত। ও চাইলে বলতেই পারে। তবে তোকে আগে এটা বোঝাতে হবে তুই ওকে কতটা চাস, কতটা ভালবাসিস।”
পলক হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,
“পলক তাজওয়ার কে পরীক্ষা দিতে হবে তাও আবার প্রান্ত শাহরিয়ারের কাছে। যে প্রান্ত শাহরিয়ারের কাছে পলক তাজওয়ার একটা খোলা ডায়েরী। যার প্রতিটা পদক্ষেপ তার নখদর্পনে। এটা কি নিতান্তই হাস্য রসাত্মক গল্প না?”
প্রান্ত সরু গলায় বলল,
“বোনের বেলায় ভাইয়েরা একটু বেশিই সতর্ক জানিস না?”
“আর নিজের ভাইয়ের বেলায়?” পলকের কথায় প্রান্ত আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে চোখের পাতায়।
গলা খাকাড়ি দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“কথা অনেক হয়েছে। বাড়ি যেতে হবে। মা একা আছে।”
“আমি কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছি। আন্টি বোধহয় ঘুমোচ্ছে। ডেকেছি কিন্তু সাড়া দিল না।”
প্রান্ত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুই ডাকলি মানে?”
“উনি উপর তলার ভাড়াটিয়া ভাইয়া।”
প্রান্ত আবারও রেগে গেল। চোখ গরম করে বলল,
“তুই তাহলে সেই কালপ্রিট ; যার জন্য আমার বোন বিপদে পড়েছে।”
“কিন্তু তুই আগে নাম বলতে পারতি তো পিচ্চি। তাহলে আমার চিন্তা কিছুটা হলেও কমতে পারতো।”
“আজমল হোসেন ; ভালবেসে বিয়ে করেন শেলী জামান নামে এক সুন্দরী রমণীকে। বছর গড়াতেই তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক শ্যামা কন্যা। বাবা তখন ভালবেসে নাম দেয় তিয়াসা। মা অবশ্য তপা বলেই ডাকতো। বাবার তখন রাজনীতির মাঠে তুমুল জনপ্রিয়তা। মায়েরও তাই। সমানতালে পাল্লা দিয়ে রাজনীতি অঙ্গনে নাম কিনছিল তারা। তিয়াসা তপার জন্মের প্রথম কয়েকটা মাস কাটে বেশ আনন্দেই। কিন্তু তারপরই আসে নির্বাচন। শেলী জামান মেয়ের প্রয়োজনে পিছিয়ে আসে নির্বাচন থেকে। কিন্তু বাবা আজমল হোসেন! তার তো দায় নেই মেয়ের জন্য। সে যথা নিয়মে খেলে যায় রাজনীতির মাঠে। পূর্ব নির্ধারিত জয় তার ঝুলিতেই আসে। বেড়ে যায় তার ব্যস্ততা। এদিকে শেলী জামান দিন দিন নিজেকে ঘরবন্দী রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে ওঠে। ঘর সংসার থেকে মন ওঠে যায়। বিরক্তবোধ আসে একমাত্র কন্যার উপরও। এরপর থেকে শুরু হয় অবহেলা। নাওয়া খাওয়ার সময় ভুলে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটা। সেদিকে যেন খেয়াল নেই কারোরই। এক সময়ের মাখো মাখো প্রেম গিয়ে ঠেকে তলানীতে। সেখানে কেবল উচ্ছিষ্ট হিসেবে পড়ে আছে বিরক্তবোধ আর অবহেলা। সম্পর্ক গিয়ে ঠেকল আদালতের কাঠগড়ায়। হয়ে গেল ডিভোর্স। ফাল হিসেবে ঝুলে রইল কেবল তিন বছরের ছোট্ট তিয়াসা।”
তপা ফোঁত করে শ্বাস ফেলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসে।
পলক কৌতুহলী গলায় বলল,
“তারপর… তারপর কি হলো?”
চলবে…