#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ২০
“তিন বছরের ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে শুরু হয় টানা হেঁচড়া। কে পাবে বাচ্চার দায়িত্ব! কাস্টাডি নিয়ে এক প্রকার যুদ্ধ শুরু হয়। মায়ের দিকে বিচারকের সদয় দৃষ্টি পড়ে। যার ফলে সে-ই পায় বাচ্চার দায়িত্ব। এটা কিন্তু বাচ্চাটাকে ভালবেসে নয়। কেবল এবং কেবলমাত্র আজমল হোসেন কে হারানোর জন্য। কেবলই প্রতিহিংসা থেকে একটা বাচ্চার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করে। আদালত থেকে বাড়ি আসা অবধি সব ঠিকঠাক থাকলেও, ড্রয়িংরুমে পৌঁছাতেই বেরিয়ে আসে আসল চেহারা। সোফার উপর ছোট্ট মেয়েটাকে ছুঁড়ে ফেলে স্বস্তির শ্বাস নেয় শেলী জামান। জন্মের পরই মেয়ের নামে ডিপোজিট করা মোটা অংকের টাকা চলে আসে শেলী জামানের কব্জায়। হাতে আসে আরও কিছু প্রোপার্টি। দরকারটা যেন এগুলোরই ছিল। ওই ছোট্ট মেয়েটাকে ভুলে নতুন উদ্যোমে রাজনীতিতে নাম লেখায় শেলী জামান। মেয়েটা বাঁচল কি মরল তাতে যেন তার কোনো দায় নেই। অসহায় মেয়েটার তখন একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায় আয়েশা। যিনি আজও তিয়াশার মা হয়ে হুইলচেয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
এতটুকু বলে তপা ছোট্ট করে দম ফেলল।
পলক বলল,
“কিন্তু আন্টি তোমাকে পেল কি করে? আন্টি আসলে সম্পর্কে কি হয় তোমার?”
তপা তাচ্ছিল্য হাসে। সে রকম গলায়ই বলল,
“আমাকে যিনি জন্ম দিয়েছেন তার খুব কাছের বান্ধবী ছিল। রক্তের সম্পর্ক নেই আমাদের। রয়েছে আত্মার বন্ধন। এই যে মানুষটাকে দেখছেন; আমার ভাই। তার কলিজার একাংশ আমি। অথচ জিনগত বলুন আর রক্ত; কোনোটারই মিল খুঁজে পাবেন না আপনি। অথচ দেখুন নিজের রক্ত আমাকে কি দিল আর রক্তের না হয়েও আমার মা আর ভাই আমাকে কিভাবে আগলে রাখল। আজমল হোসেন আর শেলী জামানের ডিভোর্সের কিছুদিন আগেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান ভাইয়ার বাবা। নিজেদের অর্থ সম্পদের সবটা শেষ করেও তাকে বাঁচাতে পারে নি মা। ভাইয়া নাকি তখন দশ এগারো বছরের। আন্টি দিশ কূল হারিয়ে যখন পথে নেমে আসে তখন সেই নেত্রীসুলভ মহিলার নজরে পড়ে। নিজের প্রয়োজনে তাকে আশ্রয়ের নামে রেখে দেয়। সেদিন থেকেই আমার দায়িত্ব পায় মা। আর ডিভোর্সের পর পুরোটা। এভাবে হেলায় অবহেলায় কাটে বছর খানেক। এরমধ্যে একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মা ওই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। ছেড়ে আসতে হয় আমাকেও। আমি আবার অসহায় হয়ে পড়ি। পরের ঘটনাগুলো আমি জানিনা। মনেও নেই। এতটুকু মায়ের কাছেই শোনা। এরপরে ঘটনা আমার বয়স আট দশের সময় তখনকার হবে। একটা চাইল্ড কেয়ার হোমে বেড়ে উঠতে থাকি আমি। বছরে দু’বছরে আমাকে নিয়ে যেতো ওই মহিলা। দু’চারদিন থেকে আবার ফিরে যেতাম সেখানে। কিন্তু ওই দু’চারদিনেই যেন নরক দেখে আসতাম। সেই ব্যস্ত মহিলা, সাথে জনা কয়েক সাগরেদ। এসবই চলতো। তখনো কিন্তু তিনি বিয়ে টিয়ে করেন নি। তবে তার একজন ব্যক্তিগত লোক ছিল। যা ওই বয়সেই আমি বুঝতে পারতাম। সেজন্যই বিয়ের প্রয়োজন হয় নি তার। আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে থাকে আমার। প্রাইমারি লেবেল পার হয়ে হাইস্কুলে পা রাখি। বন্ধুবান্ধব আমাকে সমীহ করে চলতো। বাবা মা থেকেও কেউ ছিল না আমার। কারো কটু কথা শুনে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদার ভাগ্য হয় নি আমার। হয় নি বাবার কাছে নালিশ করা। আমার জীবনটা শুধুমাত্র ওই মানুষ দুটোর রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য এমন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। হাইস্কুলে পা দেওয়ার পর থেকে ওই মহিলার সাথেই থাকতে শুরু করি। সারাদিন স্কুলে থেকে রাতটা বন্ধ ঘরে কাটিয়েই দিন পার করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন উনারই সেই বিশ্বস্ত সঙ্গী উনার খাবারে নেশা মিশিয়ে তার খাবার বানাতে চায় আমাকে। যদিও আমি আজও জানি না উনি সজ্ঞানে থাকলে আদৌ বাঁধা দিতেন কি-না। যিনি নারীর টান ভুলতে পারে তার কাছে এগুলো ম্যাটার করে কি-না আমার জানা নেই। ছোট্ট আমি সেই ভয়টা কাটাতে পারি নি। খোলা বেলকনিতে কনকনে শীতের রাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পরদিন সকাল হতেই ছুটে পালাই ওই নরক থেকে। ঘটনাক্রমে দেখা পেয়ে যাই ভাইয়া আর মায়ের সাথে। মা তখন সুস্থই ছিল। একটা প্রাইবেট স্কুলে চাকরি করতেন তখন। তখন থেকে আমি মায়ের সাথেই আছি। সেদিনের পর কিন্তু ওই মহিলা একটাবারও খোঁজ নেয় নি আমার। এমনকি আমি বেঁচে আছি কি-না সেটাও তিনি জানেন না। আমি তো ছিলাম তার জীবনের একমাত্র ঝঞ্জাট। বেশ আছে তারা এখন। আমিও খুব সুখে আছি, আমার মা আর ভাইয়ের রাজ্যে রাজকন্যা হয়ে।”
“আর তোমার বাবা? তিনি খোঁজ নেয় নি?” বেশ অবাক হয়েই বলল পলক।
তপা পুনরায় তাচ্ছিল্য হাসে। কণ্ঠে তাচ্ছিল্যভাব ফুটিয়ে বলল,
“সে তো কাস্টাডি পেতে চেয়েছিল কেবল তার স্ত্রীর সাথে বিনা অস্ত্রের যুদ্ধে জিতে যেতে। তা বৈ কিছু নয়। তারা দুজন জুয়ায় নেমেছিল। আমি ছিলাম কেবল বাজির ঘোড়া।”
“কিন্তু তিয়াসা.. তুমি তো বললে আন্টির সব সম্পত্তি আংকেলের চিকিৎসায় খরচ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে এই বাড়ি?”
“ভাইয়ার গ্রামের বাড়ির কিছু জমি ছিল। আর মামা বাড়ি থেকে কিছু আনা। সেগুলো বিক্রি করেই মা এই জমিটা কিনেছিল। এরকমটাই শুনেছি মায়ের কাছে।”
পলকের খটকা লাগে। টাঙ্গাইল শহরের বুকে এরকম একটা বাড়ি বানানো বেশ ব্যয়বহুল। অসহায় একজন মহিলা দু’টো বাচ্চা নিয়ে কিভাবে কি করলেন? মনের খটকা চুপচাপ গিলে ফেলে নরম গলায় বলল,
“এজন্যই আমাকে পছন্দ নয়, তাই না? শুধুমাত্র রাজনীতি করি বলে?”
তপা মুচকি হেসে আকাশের দিকে তাকাল।
“আপনাকে পছন্দ নয় এই কথাটা কি ধ্রুব মিথ্যা নয়?”
“ধ্রুব সত্য শুনেছি। কিন্তু ধ্রুব মিথ্যা, সেটা আবার কি?”
“যাহা ধ্রুব সত্য তাহার বিপরীতই ধ্রুব মিথ্যা।”
পলক বাঁকা হেসে বলল,
“তাহলে ধ্রুব সত্যটা কি?”
তপার ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। মানুষটা যে তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ধরা তো দেবে না সে। ফুচকা হাউজে করা চেঁচামেচি আর ওই সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ভুলে গেছে নাকি সে! মোটেও না। ভুগতে হবে এই রগচটা তাজওয়ার কে।
তপা কাটকাট গলায় বলল,
“ধ্রুব সত্যটা হলো যে রাজনীতি আমার শিশুকাল শেষ করেছে আমি চাই না সেই রাজনীতি আমার পরবর্তী জীবনটাও নষ্ট করে ফেলুক। তাই আমি আপনার রাজনীতি পছন্দ করি না। আর রাজনীতি পছন্দ না করাটা যদি আপনাকে পছন্দ না করার মধ্যে পড়ে তবে আমার কি করার!”
পলক হতাশা জড়িত শ্বাস ছাড়ে। এই মেয়েটা কে বোঝাবে কি করে সে! এত এত কষ্টের ভীড়ে কি করে নিজের সুখস্বপ্নের অঙ্কুরোদগম শুরু হবে!
চলবে…