#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ২২
সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমের বিলাসবহুল সোফায় বসে তটিনী শোভাবর্ধক একটা কৃত্রিম গাছের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। সহসা সুমিষ্ট এক পুরুষালী কণ্ঠ কর্ণকুহরে মৃদু ধাক্কা মারল।
“এক্সকিউজ মি..”
তটিনী পেছন ফিরে ভ্রু যুগল খানিকটা কুঞ্চিত করে বলল,
“জ্বি আমাকে বলছেন?”
প্রান্ত বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। তটিনী তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। সামনের পুরুষ সুলভ মানুষটিকে এমন আহাম্মক বনে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাকও হলো কিঞ্চিৎ পরিমাণ।
গলা খাকাড়ি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতেই প্রান্ত সম্ভিত ফিরে পেল। মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তুমি?”
তটিনী সুবোধ বালিকার ন্যায় মাথা নিচু করে বলল,
“তটিনী। ওই সামনের বাসাতে থাকি।”
“তুমি ফিজিক্স পড়তে এসেছো?”
মাথা নাড়ায় তটিনী। কিন্তু এটা বোধগম্য হয় না এই লোকটা ওর পড়ার ব্যাপারে জানলো কি করে! আর কেই-বা বা ইনি? এই বাসায় কি করছে?
প্রান্ত তাড়া দিয়ে বলল,
“তাহলে এমন কাকতাড়ুয়ার বেশ ধরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? দ্রুত বই বের করো। ফাঁকিবাজি কিন্তু আমি টলারেট করব না। আমার কাছে পড়তে হলে মনোযোগী হতে হবে।”
তটিনী ভ্রুকুটি করে তাকাল। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি…”
” আরামের ঘুম হারাম করে এই ভোর বেলা এখানে এসে বসে আছি, আর তুমি মেয়ে আমাকে বলছো আমি কে! তপা কিছু বলে নি?”
তটিনী কিছুক্ষণ আগের চিত্র মনে করে। তপা তাড়াহুড়ায় বেরোতে বেরোতে শুধু বলে গেছে -ভাইয়া এসে পড়া বুঝিয়ে দেবে। তুই খবরদার যাবি না। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর।”
কিন্তু তটিনী তো ভেবেছিল পলক আসবে। এখানে যে আস্ত আরেকজন মানুষের উৎপত্তি হয়েছে সেটাতো ও টেরই পায় নি। কিন্তু কে ইনি?
প্রান্ত তটিনীর মনের প্রশ্নগুলো আন্দাজ করতে পারল বোধহয়। তাই তো হাত বাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“হাই; আমি প্রান্ত শাহরিয়ার। তপার একমাত্র ভাই।”
তটিনীও বিনিময়ে একটুখানি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল উষ্ঠকোণে। হাতের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
“তটিনী মেহবুবা।”
প্রান্ত হাতের দিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে হাস সরিয়ে চুল ঠিক করল। বিরবির করে বলল, “ইমপ্রেসিভ।”
“এক কাপ চা দিয়ে যা না তপা..” গলা উঁচিয়ে বলল প্রান্ত।
তটিনী প্রান্তর কিছুক্ষণ আগে জেগে ওঠা ঘুম ঘুম চেহারা দেখে চায়ের তৃষ্ণাটা টের পেল বোধহয়। বই ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
“আপু বেরিয়েছে সেই কখন। আপনি বসুন। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”
বলেই কালবিলম্ব না করে কিচেনের দিকে ছুটল তটিনী। প্রান্ত বাঁধা দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে এই.. নিজের সাইজ দেখেছো? এই টুকুনি তো করমচার সাইজ। তুমি যাচ্ছো চা বানাতে? হাত পা পুড়িয়ে শেষে আমাকে ফাঁসাবে তুমি। সকাল সকাল হসপিটালে দৌড়াতে পারব না আমি। চুপচাপ পড়তে বসো। দ্রুত।”
তটিনী কোমরে হাত রেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। কোমর সমান লম্বা বিনুনি এক ঝটকায় পেছনে দিয়ে বলল,
“সাইজে ছোট হতে পারি, অভিজ্ঞতায় না। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”
অন্যদিকে তাজমহলের একমাত্র কর্তৃ পায়েল তাজওয়ার রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানানোর সময় পলক কে খেয়াল করলেন বেশ কয়েকবার রান্নাঘরের সামনে দিয়ে ঘুরতে। এমনটা যে কোনোদিনও ঘটে না তা নয়। এহেন ঘটনা তখনই ঘটে যখন পলকের কিছু বলার থাকে, কিছু চাওয়ার থাকে মায়ের কাছে।
পলক আরও একবার রান্নাঘরের সামনে আসতেই পায়েল তাজওয়ার গলা বাড়িয়ে বললেন,
“ভেতরে আয়।”
পলক যেন এই সুযোগটাই খুঁজছিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল। পায়েল তাজওয়ার সবে কড়াইতে পেয়াজ কুচি ছড়িয়েছেন। পলক খুন্তি হাতে নাড়তে নাড়তে বলল,
“কিছু বলবে মা?”
পায়েল মুচকি হেসে বললেন,
“প্রশ্নটাকি আমার করা উচিৎ না?”
উত্তরে পলকও মুচকি হাসল। এই মা টা যেন সবটা বুঝে যায়। কিসের এত ঐশ্বরিক ক্ষমতা! কই তার তো নেই!
পায়েল পুনরায় বললেন,
“কিছু হয়েছে? কিছু লাগবে?”
পলক আমতা আমতা করে বলল,
“তোমার একা একা রান্নাবান্না করতে কষ্ট হয় না মা? আমি আর বাবা বাইরে গেলে একা একা লাগে না?”
পায়েল থমকালেন খানিকটা। পরক্ষণেই চাপা হেসে বললেন,
“তা তো হয়ই। একাও লাগে। কিন্তু তাই বলে তোরা তো আর আমার জন্য বাড়িতে বসে থাকবি না তাই না? তাছাড়া কষ্ট হলেও নিজের রান্না তো আমি নিজে করতেই পছন্দ করি। জানিস তো অন্য কারো রান্না, মানে কাজের মানুষের রান্না খেতে আর তোদের খাওয়াতে পছন্দ করি না আমি। তাই কষ্ট হলেও একাই করতে হবে, থাকতে হবে।” কথার সাথে দীর্ঘশ্বাস যোগ করলেন তিনি।
পলক খুন্তি নাড়ানো থামিয়ে হতাশাজনক দৃষ্টিতে তাকাল। ধীরে ধীরে বলল,
“কাজের লোক না মা। অন্য কেউ আরকি..”
পায়েল মুখ টিপে হেসে বললেন,
“অন্য আর কে থাকবে বাবা? না কোনো বোন টোন আছে আমার আর না আর কোনো সন্তান। তাহলে?”
পলক পেছন ঘুরে চলে যেতে চেয়েও ফিরে এসে চোখ বন্ধ করে ঝটপট বলল,
“মা আমি বিয়ে করতে চাই।”
পায়েল শব্দ করে হেসে উঠল এবার। হাসতে হাসতেই বলল,
“এটা বলতে এতক্ষণ লাগল তোর? আমি তো প্রথমেই বুঝেছি পাগল ছেলে। তা কে এমন করে নেতা সাহেবের মাথা ঘুরিয়ে দিল? এমন বেয়াক্কেলের গলায় কে মালা পড়াতে রাজি হলো?”
পলক মাথা চুলকে খানিকটা ব্লাশ করল। মুচকি হেসে বলল,
“আছে একজন।”
পায়েল ছেলের খুশি খুশি মুখ দেখে আপ্লুত হলো।
“একদিন নিয়ে আয় তাকে। আমি একটু দেখি। চোখ জুড়াই।”
পলক ইতস্তত করে বলল,
“কিন্তু মা.. ও কিন্তু আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট বয়সেও, হাইটেও।”
পায়েল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
পলক পুনরায় বলল,
“ওর গায়ের রংটা সুন্দর। কিন্তু ফর্সা নয় তোমার আমার মত। ও শ্যামা। শ্যামাঙ্গিনী। মায়াবতী চিনো তো, সেরকম। তোমার আপত্তি নেই তো মা?”
পায়েল কড়া গলায় বললেন,
“তোর আমাকে ভিলেন মনে হয় ফাজিল ছেলে? কবে নিয়ে আসবি বল। আমার ছেলে পছন্দ করেছে মানেই সে অমূল্য রতন। আর রত্নের কদর করতে পায়েল তাজওয়ার জানে। নাহলে তুই আর তোর বাবা এ বাড়িতে এত আরামে থাকতে পারতি না।”
পলক মুচকি হাসল। তার মা তো এমনই। তবুও আরেকটু ইয়ার্কি মারতে বলল,
“ধরো আমাদের কিচেনের সেল্ফের উপরের তাকে কিছু রাখা আছে। ও কিন্তু নিজে নিয়ে নিতে পারবে না। এক্ষেত্রে হয় টুলের দরকার হবে নয়তো আমার ওকে কোলে নিয়ে পেরে নিতে সাহায্য করতে হবে। এতটাই ছোট ও। তোমার আপত্তি নেই তো?”
পায়েল হাত জোর করে মুখের সামনে এনে বললেন,
“তোর বউ তুই রান্নাঘরে কোলে নিবি নাকি সারা বাড়ি কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবি সেটা একান্তই তোর ইচ্ছা বাপ। এক্ষেত্রে আমার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”
চলবে…
নোটঃ যারা এখনো #এই_রাত_তোমার_আমার পড়েন নি। তারা জলদি কিনে ফেলুন।