বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ২৩

0
84

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ২৩

নেইম-প্লেটে ‘তাজমহল’ লেখা বিলাসবহুল বাড়িটার সামনে দুরুদুরু বুকে এসে দাঁড়াল তপা। এই তো সেদিনের সেই বাড়ি, সেই গেইট, সেই দারোয়ান। তপা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দারোয়ান ওঠে এসে গেইট খুলপ দিতে দিতে বলল,
“আসেন ম্যাডাম।”
তপা খানিকটা অবাকই হলো। সেদিন তো এভাবে খাতিরযত্ন দেখায় নি। উল্টো ভেতরেই ঢুকতে দেয় নি। তবে আজ কি হলো এর?
বিস্ময় প্রকাশ করে তপা বলল,
“আজকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন যে বড়? আরেক দিন তো ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেন নাই।”
দারোয়ান লোকটা অনুশোচনা সূচক হেসে বলল,
“মাফ কইরা দিয়েন ম্যাডাম। ওইদিন আপনেরে চিনতে পারি নাই। তয় আজকে স্যার নিজে আইসা বইলা গেছে আপনে আসলে জানি সাথে সাথে ভেতরে যাইতে দেই। কি করমু কন না চিনা যারে তারে ভেতরে যাইতে দিলে তো স্যারেরই বিপদ। হ্যার তো শত্তুরের শ্যাষ নাই। ভালো মানুষটার চারদিকেই শত্তুর।”
তপা মুচকি হাসল দারোয়ানের কথা শুনে। এ যে মনিব ভক্ত প্রজা; এটা তার আচরণই বলে দিচ্ছে।

পায়ে পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে তপা। গেইট থেকে খানিকটা দূরে শুভ্র রঙা প্রাসাদ। যার একপাশে গাছ ভর্তি হয়ে ফুটে আছে গন্ধভরা গন্ধরাজ। শুভ্রতায় ঢেকে গেছে প্রায় গাছটির সবুজাভ পাতা। অপর পাশে রয়েছে সুদৃশ্য দোতলা। দোলনায় দুইপাশে আবার কৃত্রিম কুঞ্জলতায় সাজানো। ভেতরে প্রবেশের আগেই তপার মনটা প্রসন্নতায় ভরে যায়।

কলিং বেল চেপে মিনিট খানেক দাঁড়াতেই দরজা খুলে হাস্যজ্জল মুখে দাঁড়াল পলক। তপা কে দেখে ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু যেন আরও প্রসস্ত হলো। বুকের বা পাশে হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে রাজকীয় ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানানোর মত করে বলল,
“স্বাগতম রাণী সাহেবা। আপনার ব্যক্তিগত শাহজাহানের তাজমহলে আপনাকে সহস্র লাল গোলাপের অজস্র শুভেচ্ছা।”
তপার মনটাও সকাল সকাল ছুঁয়ে যায় সুখের আবেশে। চোখে মুখে খানিকটা চঞ্চলতা ফুটে উঠে তার। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“কিন্তু স্বাগতম তো আগেই জানানো হয়ে গেছে। তবে লাল গোলাপ নয়। শুদ্ধতম শুভ্রতায়।”
পলক বুঝতে না পেরে ভ্রুকুটি করে তাকাল। তপা মুচকি হেসে আঙুল উঁচিয়ে গন্ধরাজ গাছটি দেখিয়ে দিল। পলক মৃদু হেসে বলল,
“আমার মায়ের প্রাণপ্রিয় সঙ্গী।”

পায়ে পায়ে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা দুজনে। পায়েল তখনো মনোনিবেশ করে আছে রান্নায়। পলক মৃদুস্বরে ডেকে বলল,
“মা একবার তাকাবে?”
পায়েল কড়া গলায় বলল,
“শয়তান ছেলে একবার সমস্ত রান্না নষ্ট করে দিয়েছিস। এখন আবার বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করলে খুন্তির বাড়ি একটাও মাটিতে পড়বে না। সবটা তোর পিঠে। যা এখান থেকে।”
পলক গেল না। বরং আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি বাগড়া দিতে আসি নি মা। আমি তো তোমার জন্য শেফ নিয়ে এসেছি। যে কি-না খুব সুন্দর পোলাও আর কচুর লতি বানাতে পারে।”
পায়েল বিরক্ত ভঙ্গিতে পলকের দিকে তাকাতেই চোখের কোণে দেখতে পেল দরজার বাইরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। পুরোপুরি নজর ফেলতেই মুখাবয়ব হাসি হাসি হয়ে যায় তার। কিছুক্ষণ আগে ছেলের দেওয়া বিবরণের সাথে মিলে যাওয়ায় তার চতুর মস্তিষ্ক সহজেই সবটা আয়ত্ত করে নেয়। তবুও পলকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালো,
“কে?”
পলক অমায়িক হেসে বলল,
“তোমার পরবর্তী প্রজন্ম।”

প্রান্তর সামনে চুনোপুঁটির ন্যায় চুপসে বসে আছে তটিনী। যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী সে। পরিশ্রমীও বটে। পড়ার সময় একফোঁটা মনোযোগও এদিক ওদিক করে না সে। সেই সুযোগটাই কখনো পায় নি সে। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সামলে যতটা সময় পেয়েছে সবটুকুই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজ এই লোকটার কাছে পড়তে এসে প্রথমবারের মতো মনোযোগ ভ্রষ্ট হয়েছে তার। গম্ভীর অথচ মধুময় কণ্ঠে পাঠ প্রদর্শন করার সময় সহসাই প্রান্তর কণ্ঠ তার কর্ণকুহর ভেদ করে হৃদয়ের এক কোণে বিঁধে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে মনোযোগ ক্ষুন্ন। হা মুখে তাকিয়ে গ্রোগাসে গিলছিল প্রান্তর কথা। প্রান্ত টের পেয়ে আগে বুঝিয়ে দেওয়া টপিক থেকে দুটো প্রশ্ন করে। তটিনী উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মূহুর্তেই মধুময় কণ্ঠের পরিবর্তে ঝাঁঝালো কণ্ঠের আবির্ভাব ঘটে। তারপর থেকেই এককোণে চুপসে বসে জোর পূর্বক গলাধঃকরণ করছে প্রতিটি পয়েন্ট।

পড়ার পাঠ চুকিয়ে তটিনী চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই প্রান্ত গলায় জোর লাগিয়ে বলল,
“কাল সকাল ছয়টার আগে যেন চেহারা এই সোফায় দেখি। নইলে বাড়ি থেকে তুলে আনব।”
তটিনী চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিস্ময়ের সহিত বলল,
“কাল কেন আসব?”
“বাহ্! ঘন্টা দেড়েক ধরে ঘোড়ার কাছে কোরআন পড়লাম কি’না জানতে হবে না? কাল এই টপিক্সের উপর পরীক্ষা হবে।”
তটিনী বিরবির করে বলল,
“আল্লাহ! এ কোথায় ফাঁসিয়ে দিলে?”
আবার দরজার দিকে পা ফেলতেই থমথমে গলায় বলল,
“এক কাপ চা করে দিয়ে যাও।”
তটিনী এবার পারে না ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ইহজীবনে আর এদিকে পা মাড়াবে না। কিন্তু প্রান্ত বোধহয় তার মনের কথা মূহুর্তেই পড়ে নিল। সরু হেসে বলল,
“প্রান্ত শাহরিয়ার ফাঁকা আওয়াজ দেয় না।”
তটিনী চুপসে গেল আরও খানিকটা। বই রেখে এক দৌড়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। চা বানাতে হবে যে!

তপা কে পেয়ে পায়েক তাজওয়ার যেন ঈদের আনন্দ পেয়েছেন। আসার পর থেকে সেই যে গল্প জুড়েছেন শেষ হওয়ার নামই নেই। এদিকে পলক বেচারা তপা কে দুমিনিট একা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মায়ের ব্যবহার দেখে দরজার উপর আক্রোশ খাঁটিয়ে বিরবির করে বলল,
“শালা প্রেমিকাকে বাসায় আনাই চরম ভুল। ইনি কি মা নাকি কাবাবের ইয়া বড় একটা হাড্ডি।”
তপা পলকের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় পায়েল তাজওয়ারের কথায় মনোযোগ দিল। পায়েলও রসিয়ে রসিয়ে আলাপ করছেন।
পলক উপায় না পেয়ে বাবা রায়হান তাজওয়ার কে কল দিয়ে সরাসরি বলল,
“বাবা তোমার বউ তোমার বিরহে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি আছো ব্যবসার কাজ নিয়ে। ছিহ্ বাবা। এই তুমি তাজমহলের সিনিয়র শাহজাহান?”
রায়হান তাজওয়ার সকাল সকাল ছেলের মুখে এসব শুনে ভীমড়ি খাওয়ার যোগাড়। কোনো রকমে বললেন,
“বাপ রাতে কিছু খাইছোস? আবোল তাবোল বকতেছিস কেন?”
পলকের মেজাজ এবার সপ্তমে পৌঁছে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোমার বউকে কল দিয়ে বলো আমার বউ কে ছাড়তে। নইলে তোমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা কিন্তু আমি নিজে করব। মাইন্ড ইট!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here