বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ২৭

0
79

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ২৭

“পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিলে কেন?” বাসর ঘরে ঢুকেই নব বিবাহিত স্ত্রীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল প্রান্ত।
ঘোমটার আড়ালে থাকা তটিনীর সুশ্রী মুখটায় খানিকটা বিস্ময়ের রেশ ধরা পড়ল। মনে মনে বলল,
“ব্যাস শুরু হয়ে গেল জেরা করা। রোসো বাপু রোসো। বাসর ঘরে বসো। ধীরে সুস্থে শ্বাস নাও। দুটো ভালো ভালো কথা বলো। তারপর নাহয় শুরু করো প্রশ্নোত্তর পর্ব। তা না এসেই পুরুষালী দাম্ভিকতা দেখানো শুরু হয়ে গেছে। এরাই বোধহয় রসকষহীন ব্যাডা মানুষ।”
প্রান্ত পুনরায় গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু জিজ্ঞেস করেছি। আন্সার মি।”
তটিনী কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। মিনমিনে গলায় বলল,
“কি করতাম তাহলে?”
প্রান্ত ঈষৎ রাগান্বিত গলায় বলল,
“কি মিউ মিউ করছো? গলায় জোর নেই?”
তটিনী একহাতে অন্য হাত কচলাতে কচলাতে বলল,
“কি করতাম আমি? নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে কতটুকু করার ক্ষমতা আছে আমার?”
প্রান্ত তাচ্ছিল্য হাসে। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল,
“পরিবার! তোমার পরিবার! পরিবার মাই ফুট। ওটা পরিবার হলে নরক কোনটা বলো আমাকে? কোন পরিবারের সদস্য নিজের লোকের সাথে এমন নৃশংস কাজ করতে পারে? তুই পারো নি ওই মহিলার আঘাতের পর আঘাত করতে থাকা হাতদুটো মুচড়ে ভেঙে দিতে? হাতে জোর নেই? ভাত খাও নি? ছোট থেকে হাওয়া খেয়ে মানুষ হয়েছো?”
তটিনী অবাক হয়ে তাকাল। এই প্রথম বার দুচোখে উপচে পড়ছে শ্রদ্ধা। কই তার নিজের বাবাও তো কখনো তাকে নিয়ে এভাবে ভাবে নি। হয়তো ভেবেছে, কিন্তু প্রকাশ করার অবকাশ পায় নি।
তটিনীর বিস্মিত চোখ দেখে প্রান্ত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি দেখছো? আমার মাথায় শিং গজিয়েছে?”
তটিনী মাথা নিচু করে নেয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে এক চিলতে মৃদু হাসির রেখা।
প্রান্ত পুনরায় বলল,
“কি হলো কিছু বলো? কেন মার খাচ্ছিলে ওই মহিলার কাছে? তুমি কেন কিছু বলো না? এতটাই অবলা তুমি?”

তটিনী ঠোঁটে হাসির রেখাটুকু ঠোঁটের কোণে রেখেই নমনীয় গলায় বলল,
“উনি আমার মা হয়। হতে পারে তিনি আমাকে সহ্য করতে পারে না বা মেয়েই মনে করেন না। কিন্তু আমি তো মানি উনি আমার মা। আমার জন্মদায়িনী মা মারা যাওয়ার পর উনাকেই মা হিসেবে জেনেছি, বুঝেছি। আদর করে না হলেও দুইবেলা উনিই আমার মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে। এখন স্বার্থে আঘাত লাগায় ভয়ংকর হয়ে গেছে। এটা শুধু উনি না, সব মানুষের বেলায়ই হয়। স্বার্থে আঘাত লাগলে তো একটা পশুও ঘুরে দাঁড়ায়। আঘাত করে প্রতিপক্ষ কে। এক্ষেত্রে মানুষ তো আরও স্বার্থান্বেষী প্রাণী। তাহলে তার দোষই বা কিভাবে দেই বলুন?”

এবার অবাক হওয়ার পালা প্রান্তর। হলোও তাই। বিস্ময়ের সহিত তাকিয়ে রইল কিছু প্রহর। কিন্তু স্বার্থের কথা স্মরণ হতেই কৌতূহলী গলায় বলল,
“তুমি উনার স্বার্থে কিভাবে আঘাত করলে? আমি যতদূর জানি তুমি তো তেমন কিছু করার মত মেয়ে নও।”
তটিনী চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“এত বিশ্বাস?”
“কথা ঘুরিও না। বলো কি করেছো?”
তটিনী সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মলিন গলায় বলল,
” আমি কিছু করি না। আমার ভাগ্যটাই এমন। কখনো আমাকে সাথ দেয় না। রেশমি আপুকে তো চেনেন। উনি মায়ের আগের পক্ষের সন্তান। তবে বাবা বা আমি নিজেদের বলেই জানি। মা আপুর বিয়ের সম্বন্ধ দেখছেন বেশ অনেক দিন। কিন্তু কিছুদিন আগে পাত্র পক্ষ আপুকে দেখতে আসলে ঘটনাক্রমে আমি সামনে পড়ে যাই। তারা আমাদের বাড়িতে বসে আপুর সামনে মায়ের কাছে আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। এতেই মা রেগে যায়। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। এটা আপুর জন্যও অপমান জনক।”
প্রান্ত বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নাড়ে।
“কিন্তু আজ কি হলো হঠাৎ? আজ কেন পাগলের মত আঘাত করেছে তোমাকে?”
তটিনী মলিন হাসল। প্রান্তর চোখে চোখ রেখে বলল,
“আপনার জন্য। এই যে ফর্সা চামড়ায় লাল লাল দাগ দেখতে পাচ্ছেন সবটাই আপনার জন্য আমার শরীরে উঠেছে। পারবেন কখনো মুছে দিতে?”

প্রান্ত চমকে উঠল। কি আবোল তাবোল বলছে এই মেয়ে!
কৌতুহলী গলায় বলল,
“আমার জন্য? কিভাবে?”
“রেশমি আপু আপনাকে পছন্দ করে এটা তো বুঝতে পেরেছেন?”
প্রান্ত মাথা নাড়ায়। সেদিনের আলাপচারিতায় সে স্পষ্ট টের পেয়েছে।
তটিনী পুনরায় বলল,
“মা ভেবেছিল আপনার সঙ্গেই আপুর বিয়েটা দিয়ে দিতে। এমন সোনার ডিম পারা হাস কে-ই বা হাত ছাড়া করতে চাইবে। বিয়ে হলেই বাইরের দেশে রাজরানী হয়ে বাস করার সুযোগ। এমন পাত্র হাত থেকে বের হতে দেওয়ার মত বোকা আমার মা বোন নয়। তাই তো আয়েশা আন্টির কাছে এসেছিল মা। কিন্তু বাঁধ সাধল আন্টি। আপুর পরিবর্তে চেয়ে বসল আমাকে। ব্যাস সব কোপানল এসে পড়ল আমার ওপর। আবারও বলির পাঠা হলাম আমি। অথচ এসবের কিছুই কিন্তু আমার বোধগম্য ছিল না। আমি তো মার খাওয়ার সময়ও কিছু জানতাম না। জানলাম তখন, যখন মারতে মারতে মা একে একে সব কিছু বলল। তখন তো শুধু বিয়ের কথা আন্টি বলেছিল বলেই এই অবস্থা। এখন তো আবার বিয়েও করে নিয়ে চলে এসেছেন। এরপর ওই বাড়িতে গেলে বোধহয় লাশ হওয়া ছাড়া বের হতে পারব না। কেন করলেন এমনটা?”

“ওই বাড়িতে আর কখনো যাবে না তুমি।” শক্ত গলায় বলল প্রান্ত।
তটিনী চোখ বড় বড় করে বলল,
“তাহলে থাকব কোথায় আমি?”

“আমার কাছে, আমার ঘরে।” স্পষ্ট গলায় বলল প্রান্ত।

“কিন্তু আমার বইগুলো সব রয়ে গেছে যে..”

“সব এনে দেব নতুন করে। নতুন করে বাঁচবে তুমি। এখানে কেউ তোমাকে এক ফোঁটাও আঘাত করবে না। শুধু আমার মা আর বোনটাকে ভালবেসো। ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থেকো। ব্যস আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। আমার মা টা বড্ড সাধ করে বউ করে এনেছে তোমাকে। তার মান রেখো।”

“আর আপনি? শুধুই মায়ের কথা রাখতে?” চোখে মুখে একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল তটিনী।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here