#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ২৯
সাজ সাজ রব ওঠেছে আদি টাঙ্গাইলের বাসিন্দা আয়েশা খানমের বাড়িতে। সবে গতকালই একমাত্র ছেলে বউয়ের মুখ দর্শন করেছেন তিনি। তারওপর বখশিশ হিসেবে আজই নিজের পছন্দের পাত্র পুত্রতুল্য পলক তাজওয়ারের বাড়ি থেকে একমাত্র কন্যার জন্য বিবাহের সম্বন্ধ এসেছে। এ যেন মেঘ না চাইতেই অঢেল জলের ধারা।
পায়েলের পাশে লাজুক বেশে বসে আছে তপা। সামনেই স্থিরচিত্তে তাকিয়ে পলক তাজওয়ার।
“বেশরম।”
তপা নিঃশব্দে ঠোঁট আওড়াল। পলক কর্ণকুহরে কিছু শ্রবণ না করলেও টের পেল স্পষ্ট। হৃদয়ের খুব কাছ থেকে যেন লাজুক লতিকা নিখুঁতভাবে পিয়ানোয় সুর তুলছে। ‘বেশরম’ শব্দটিই বারংবার বেজে উঠল চারদিকে।
পলক ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। তপা চোখ রাঙায়। পলক আরও একটু বাড়াবাড়ি করে। চুমু দেওয়ার ভঙ্গিমায় ঠোঁট উঁচু করে পাশে তাকাতেই পায়েল তাজওয়ারের চোখে চোখ পড়ে। পায়েল বা হাতে মুখ ঢেকে হাসি লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করলে পলক গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। লাজ লজ্জা ভুলে স্পষ্ট গলায় বলল,
“তোমরা বড়রা কথা বলো। আমরা বিয়ের ডেট ফিক্সড করে আসছি কেমন?”
পায়েল চোখ রাঙিয়ে পলক কে থামানোর চেষ্টায় বলল,
“তোমরা ফিক্সড করবে মানে? তাহলে আমরা কেন এসেছি?”
“বউমার মুখ দর্শন করতে। আর বিয়ে যখন আমাদের ডেটও আমাদেরই ঠিক করা উচিৎ। কি বলো ডার্লিং?”
তপার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল পলক।
তপা থতমত খেয়ে কেশে উঠল।
অগত্যা পলক তপার হাত ধরে টানতে টানতে চোখের আড়ালে অবস্থান নিল।
বারান্দার একপাশে ছোট্ট খাঁচায় দুটো লাভবার্ড প্রেমরত অবস্থায় মগ্ন। পলক চোখের ইশারায় তপাকে পাখি দুটি দেখালে তপা ঈষৎ লজ্জারাঙা হলো। পলক পকেটে দু-হাত গুঁজে বড় করে শ্বাস ফেলে বলল,
“মা টা বড্ড পাগলামি করছে তিয়াশা। ভেবেছিলাম নির্বাচনের ঝামেলা শেষ হলে তারপর নির্ঝঞ্ঝাট একটা লাইফ উপহার দেব তোমাকে। কিন্তু দেখো মা বাড়াবাড়ি করছে। মানাতেই পারলাম না।”
তপা পলকের এক হাত পকেট থেকে টেনে বের করে শক্ত করে চেপে ধরল। মসৃণ গলায় বলল,
“আমি সব পরিস্থিতিতেই আপনার পাশে থাকতে চাই আমার ব্যক্তিগত নেতা। সেটা হোক ঝামেলাপূর্ণ বা ঝামেলা মুক্ত।”
পলক ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে বুকের বা পাশ দেখিয়ে বলল,
“তুমি তো প্রতিটি মূহুর্তে এখানে আছো আমার শ্যামাঙ্গিণী।”
তপা লাজুক হাসলে পলক সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“মা হয়তো তোমাকে দিয়ে আমাকে এই রিস্কি জীবন থেকে সরিয়ে আনতে চাইছে।”
তপা ভ্রুকুটি করে তাকাল। প্রশ্নাত্মক গলায় বলল,
“মানে?”
“মানেটা খুব সোজা তিয়াসা। মা চায় আমি মানুষের সাহায্য করি। আমার প্রফেশন নিয়েও মায়ের অনেক গর্ব। কিন্তু ভয়ও পায়। একবার তো নিজেই দেখলে কি অবস্থায় ছিলাম। নিজেই তো সুস্থ করে তুললে। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেল চারদিকে। এরকমটা একবার নয়। অহরহবার হয়। এসব নিয়ে মা খুবই আতঙ্কে থাকে। যদি কোনোদিন সত্যি ঘটে যায়, তখন?”
তপা তৎক্ষণাৎ পলকের হাত খামচে ধরল। পলক মুচকি হাসে। ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
“আমার কিছু হলে আমার মায়ের জন্য আমার বাবা আছে। বাবার জন্য মা। কিন্তু তোমার জন্য? তোমাকে আমি কার কাছে রেখে যাব তিয়াসা? মরেও তো শান্তি পাব না। আমার তোমার জন্য খুব ভয় হয় তিয়াসা। তোমার বাকি জীবনটা সুখী দেখার জন্য হলেও আমি আল্লাহর কাছে কিছু হায়াত ভিক্ষা চাই। তোমাকে আরও বেশি ভালবাসার জন্য হলেও।”
তপা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। মানুষটা কি করে পারে এমন করে ভালবাসতে?
কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পলক মৃদুস্বরে বলল,
“মা এই ভালবাসাটাকেই আমার দুর্বলতা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বোধহয়। তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে বাঁধা সৃষ্টি করতে চাইছে। যাতে তোমার জন্য হলেও আমি এই পথে হালকা হয়ে দাঁড়াই। কিন্তু কি করব বলো? রাজনীতি যে আজকাল রক্তে মিশে গেছে। মানুষের কাছে, পাশে থাকার জন্য এটাই তো একমাত্র পথ।”
তপা পলকের হাত দু’হাতের মুঠোয় পুরে নিল। ভরসা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কখনোই আপনার চলার পথে বাঁধা হব না পলক। আপনি আপনার লক্ষ্যে স্থির থাকুন। আমি আপনার সহযোদ্ধা হতে চাই। পথের কাটা নয়। মায়ের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমি চাই আপনি মায়ের সেই ভয়কে জয় করে জয়ী বেশে ফিরুন।”
চলবে…