#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০৩
গরম পানি পড়ে লম্বালম্বিভাবে দু’টো ফোসকা পড়েছে তটিনীর ডান পায়ে। নাহ! ভুলবশত বা অবহেলা জনিত কারণে নয়। বরং ইচ্ছাকৃত! তটিনীর বড় বোন রেশমি ফুটন্ত গরম পানি ছিটকে দিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করেছে। সকালে চা দিতে দেরি হওয়ায় চায়ের পানি-ই ছড়িয়ে দিয়েছে গায়ের উপর। ভাগ্যবশত তা কেবল পায়ের উপর দিয়েই গড়িয়েছে।
ফর্সা পা রক্তলাল বর্ণে ছেপে গেছে। তবুও মুখে যেন এক বিন্দু আর্তনাদ নেই। এক টুকরো অভিযোগ নেই। চোখে কেবল একরাশ যন্ত্রণা! আহাজারি!
ব্যথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর মুছে নিজের ঘরে আসতেই মা আমবিয়া খাতুন দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললেন,
“নবাবজাদি পালঙ্কে আইসা শুইছেন, ময়লা কাপড় কি আপনের আম্মায় কবর থাইকা আইসা ধুইয়া দিব? নাকি নিজে গতর নড়াইবেন?”
তটিনী নিভু নিভু আঁখি মেলে নিচু গলায় বলল,
“মা আমার পায়ে খুব জ্বলছে। কাল ধুয়ে দেই?”
আমবিয়া খাতুন চটে গেলেন। এগিয়ে এসে মুখের ওপর ময়লা কাপড় ছুঁড়ে মেরে বললেন,
“দশ মিনিটের মধ্যে কাপড় পরিষ্কার চাই আমার। তুই ধুবি না তোর মায়রে কবর থেকে তুইলা আনবি তুই জানোস।”
অগ্যতা বিছানা ছাড়ল মেয়েটা। পায়ে কাপড় পেঁচিয়ে তারওপর পলিথিন মুড়ে ব্যস্ত হলো নিজ কার্য সম্পাদনে। পোড়া ঘায়ে সাবান পানি না লাগানোর পরিকল্পনায় করা কার্যক্রম কাজে দিলেও আবদ্ধ জায়গায় পা পুনরায় গরম হয়ে উঠল মূহুর্তেই।
প্রেসক্লাবের ভেতর ঢুকে আশেপাশে নজর বুলাতেই চক্ষু চড়কগাছ তপার। সব সাদা পাঞ্জাবি পড়া বিশালদেহী লোকজন। কিছুসংখ্যক মহিলা থাকলেও তাদের সংখ্যা অতি ক্ষুদ্র এবং তারাও নিজেকে সাদায় সজ্জিত করেছে। তপা আশেপাশে তাকিয়ে মুখে জোর করে মুচকি হাসি ফুটিয়ে নিচু গলায় বলল,
“সিজান ভাই আমার, এইখানে তো আমি সব বিধবা বিধবা ব্যাডালোক দেখতে পাচ্ছি। আমারে একটা সদবা ব্যাডা খুঁজে দে না। চক্ষু সার্থক করি।”
সিজান আগাগোড়া বুঝতে না পেরে নিজেও চুপিসারে বলল,
“ফিসফাস বাদ দিয়ে নিজের কাজে মন দে।”
“কি কাজ করতাম আমি এখন?” ঠোঁট উল্টে বলল তপা।
সিজান কিছু বলার আগেই পাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বিনয়ের সহিত বলল,
“সিজান, উপস্থাপিকা এসেছে?”
তপা পিছু ঘুরল বক্তার মুখ দর্শন করতে। ছিমছাম গোছের সাদামাটা একজন লোক। বয়স ওই পঁচিশের কোঠায়ই হবে বোধহয়। মুখে হাসি আর চোখে প্রশ্ন নিয়ে পুনরায় বলল,
“উপস্থাপিকা? মেলা দেরি হয়ে গেল যে!”
সিজান তপা কে দেখিয়ে বলল,
“সজল ভাই! এই যে আপনার উপস্থাপিকা। নিয়া যান। এতক্ষণ পকপক কইরা আমার মাথা খাইতেছিল। ওরে কামে বসাই দেন নিয়া।”
তপা রক্তচক্ষু করে শাসালো সিজান কে। সিজান দাঁত কেলিয়ে হাসল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বেস্ট অফ লাক জানিয়ে আসন গেড়ে বসল সে।
এক টুকরো আকাশে মুড়িয়ে থাকা তপা সজলের পিছুপিছু ছুটল। সজল ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক দেখে একটা ঝকঝকে মোড়কে আবৃত চারকোণা বস্তু ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ওদিকে চেঞ্জিং রুম। আপনার হাতে আধঘন্টা টাইম। ঝটপট তৈরী হয়ে নিন। ভাই কিন্তু দেরি পছন্দ করে না।”
তপা বেয়াক্কেলের মত তাকিয়ে রইল হাতের প্যাকেটের দিকে। আকাশী রঙা শাড়ি রেখে আবার নতুন করে রেডি হওয়ার কি হলো আল্লাহ মালুম! আবার বলছে ভাই! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলেও মুখে নমনীয়তা ফুটিয়ে তুলে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি তো প্রপার রেডি হয়েই এসেছি ভাইয়া। আবার রেডি হব কেন? খারাপ দেখতে লাগছে?”
সজল মুচকি হাসল। বিনয়ের সহিত বলল,
“আপনাকে যথেষ্ট সুন্দরীই দেখাচ্ছে। কিন্তু আপনি আশপাশে তাকিয়ে দেখুন ; রঙটা বেমানান। আজকের অনুষ্ঠানের ড্রেস কোড সাদা। এটা ভাইয়ের অর্ডার। প্লিজ যান এখন। দেরি হলে আমার গর্দান কাটা যাবে। অধমের উপর কৃপা করুন।”
তপা ভাই ভাই শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বলল,
“আপনার ভাই কোন চুলোয় আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত শুনি? কোথায় সে? তার চাঁদবদনটা একটু দেখি!”
সজল অমায়িক হাসল। হাসতে হাসতেই বলল,
“ভাই ভেতরের দিকে আছে। আপনি রেডি হয়ে আসুন। তার চাঁদবদন নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন। আসলেই চাঁদ সে। দেখতেও, স্বভাবেও। কলঙ্ক বিহীন চাঁদ।”
অগ্যতা তপা নিজের মত বকতে বকতে চেঞ্জ করতে চলে গেল। এক টুকরো নীল আকাশের খোলস ছেড়ে নিজের আবৃত করল শুদ্ধতম শুভ্রতায়। শ্যামাবরণ গায়ে ছোঁয়া পেল পবিত্রতার প্রতীকী রংমহল।
গতকাল হাতে ধরিয়ে দেওয়া স্ক্রিপ্টের সাথে নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে আরও কিছু অংশ। তপা সেগুলোতে নজর বুলিয়ে নেওয়ার সময় চোখ আটকালো দু’টো শব্দে। সাদা কাগজে কাল বর্ণে লেখা দুটো শব্দ! পলক তাজওয়ার! তারই উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান। তপার মেজাজ তৎক্ষণাৎ তুঙ্গে আবিষ্কার করল। দূর থেকেই সিজানের দিকে কড়া দৃষ্টি ফেলল। চিবিয়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করলেও মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুলে আয়ত্ত করে নিল সাজানো গোছানো বর্ণ বিন্যাস।
রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলা সেটা তপা জানতো। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ের তা বুঝতে পারে নি ঘুণাক্ষরেও। শহরের সব দাপুটে নেতাদের আগমনে মুখরিত চারপাশ। তপার অস্বস্তি হলো। মারাত্মক দ্বিধা সংকোচ, উৎকণ্ঠা নিয়ে নিঃসৃত করল একের পর এক শব্দ, বাক্য। উতরে দিল ছোট পরিসরে করা বিশাল আয়োজন।
অনুষ্ঠান শেষে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই সজল এসে পাশে দাঁড়াল তপার। আগের ন্যায় বিনয়ী হেসে বলল,
“ভাই আপনাকে দেখা করে যেতে বলেছে।”
তপা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোন ভাই?”
“আমাদের বড় ভাই। পলক তাজওয়ার ভাই!”
পূর্ব আদালত পাড়ার একটা ছোট্ট বাড়িতে আজ উৎসব লেগেছে। বাবা মেয়ের ছোট্ট সংসারে আনন্দ উৎসব। পৃথার বাবা পার্থিব মোজাম্মেলের আজ পদোন্নতি হয়েছে। সেই উপলক্ষেই মা হারা পৃথা রান্নাঘরে পা রেখেছে। বিশটি বছর পেরিয়ে গেলেও মা হারা সংসারের ঘানি টানতে হয় নি তাকে। নিতে হয় নি কোনো দায়িত্ব। বাবা পার্থিব মোজাম্মেল অফিস সামলে নিজ কন্যার সমস্ত দায়িত্ব স্বহস্তে পালন করে চলেছেন। পেশায় তিনি প্রাইভেট ব্যাংক ম্যানেজার। পৃথার মা ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণা গৃহিণী। বছর কয়েক আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পৃথা তখন এইচএসসির প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। হাসপাতাল ঘুরে জানা গেল তার মরণঘাতী ব্যাধির কথা। ক্যান্সার! হারিয়ে গেল জীবন থেকে দেড়টা বছর। হারিয়ে গেল মানুষটাও। এইচএসসি শেষ করলেও মায়ের শেষ সময়ের আহাজারিতে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ে পৃথা। ফলস্বরূপ তপাদের থেকে এক বছর পিছিয়ে যায় সে। পরবর্তী বছর পুনরোদ্যমে শুরু করে। আয়ত্তে আনে যা হারিয়ে ছিল করুণ মূহুর্তে। শুধু আরাধ্যের বাইরে রয়ে যায় মা নামক মানুষটা।
মা কে হারিয়ে পৃথা যখন অকুল পাথারে, গিন্নি বিনা সংসার যখন জলে ভাসা পদ্মের ন্যায় ভাসছে তখন নিকট আত্মীয়দের অনেকেই পার্থিব মোজাম্মেল কে বিয়ের জন্য তাগাদা দেন। কিন্তু ফিরিয়ে দেয় সে। শক্ত হাতে হাল ধরে সংসারের, মেয়ের। সঙ্গীহীন কাটিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন নিজের কাছে। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতিটুকু আঁকড়ে পাড়ি দিতে চান পরবর্তী আয়ুটুকু।
রান্না থেকে শুরু করে পৃথার খুটিনাটি বিষয়ের সঙ্গী হয়ে উঠেন খুব সহজেই। সকালে উঠে নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের ঘুমোতে যাওয়ার আগের সময়টুকু পর্যন্ত ব্যয় করেন একমাত্র এবং একমাত্র মেয়ের পেছনে। পাছে মেয়েটা এতিম না ভেবে বসে নিজেকে!
“বাবা! বাবা এসো না একবার!” রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে ডাকল পৃথা।
দরজার বাইরে এযাবতকাল ধরে অপেক্ষারত পার্থিব মোজাম্মেল তৎক্ষণাৎ ভেতরে ঢুকে পড়ল। উৎকণ্ঠার সহিত বলল,
“কি হয়েছে মা? কোথাও লাগল?”
পৃথা কোমরে হাত রেখে সরু চোখে তাকাল। গাল ফুলিয়ে বলল,
“তুমি এখানে কি করছিলে বাবা? তুমি কি আমাকে বড় হতে দেবে না নাকি? এরকম করলে কিন্তু হবে না?”
পার্থিব মোজাম্মেল মেয়ের অভিমান দেখে চাপা হেসে বললেন,
“তাই তো! আমার আম্মাজানকে তো বড় হতে হবে। এভাবে করলে কিভাবে হবে! এরপর তো বিয়ে দিতে হবে। বড় না হলে লাল টুকটুকে রাজকুমার আনব কি করে আমি। আমার ঘোরতর অপরাধ হয়ে গেছে আম্মাজান। আমাকে এবারের মত ক্ষমা করুন। আর কখনো রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি মারব না।”
পৃথা বাবার অভিনয় দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল। কিঞ্চিৎ সময় পর দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,
“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না বাবা। সারাজীবন এখানেই থাকব। তোমার কাছে।”
পার্থিব মোজাম্মেল মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহময় কণ্ঠে বললেন,
“পাগলি মা আমার।”
বিছানার উপর এক টুকরো কাগজ অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখা। তার দিকেই মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তপা। কাগজটার উপর প্যাচানো বর্ণে সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা ‘ পলক তাজওয়ার’। সাথে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অংক বসানো।
সজলের পেছনে গিয়ে পলকের সামনে দাঁড়াতেই বিনা প্রশ্নে চেকটা ধরিয়ে দিয়েছে সে। সাথে সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপনার জন্য ছোট্ট একটা শুকনো ধন্যবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা এখানে নয়। সমস্যা হয়েছে পলকের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অপর আরেকটি মুখ দেখে। ‘স্বাধীন’ পুরো নাম স্বাধীন রহমান। তপার ইউনিভার্সিটির এক উঠতি নেতা। যিনি জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে হওয়া আলোচনা সভার শেষে ইচ্ছাকৃত ভাবে ছুঁয়ে দিয়েছিল তপার হাত। শুধু সেদিন নয় এটা প্রতিনিয়ত ঘটছে। যখন পারছে, যেভাবে পারছে ছুঁয়ে দিচ্ছে যে কাউকে।
তপার ছোট্ট মস্তিষ্ক পলকের চরিত্রেও স্বাধীনের চরিত্রের ছাপ ফেলে মুখটা বিকৃত করে দিয়েছে। অথচ সে জানতেও পারল না সদ্য ফোঁটা গোলাপের ন্যায় পবিত্র ও স্বচ্ছতার ঘেরা চরিত্রের উপর সে আঙুল তুলতে চাওয়ার সাহস করছে।
ভিক্টোরিয়া রোডের সাইডে ক্যাপসুল মার্কেট সংলগ্ন ফুচকা পয়েন্টে দাঁড়িয়ে টপাটপ একের পর এক টকজলযুক্ত ফুলকো ফুলকো ফুচকা মুখে পুড়ছে তপা। সাথে রয়েছে পৃথা। সিজান কাছাকাছিই একটা কাজে গিয়েছে। ভীড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকার প্লেটে মত্ত তপা হঠাৎ পিঠে অযাচিত স্পর্শ পেয়ে কুঁকড়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে অনেকগুলো মুখ দেখে ঠাওর করতে পারল না কালো মস্তিষ্কের মুখটার। সামনে তাকাতেই পুনরায় শক্ত হাতে খামচে দিল কেউ। তপা পিছু ফিরে শক্ত চোখে তাকিয়ে আসল কালপ্রিট খুঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে পৃথার উদ্দেশ্যে বলল,
“চল এখান থেকে।”
পৃথা কিছু বুঝতে না পেরে গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলল,
“সবে শুরু করলাম। এখনই কোথায় যাবি? সিজান আসুক আগে।”
তপা শক্ত গলায় কিছু বলার আগেই পেছনে কারো করুণ আর্তনাদ শুনে ঝটপট পেছনে তাকাল। পেছনের দৃশ্য চোখে পড়তেই বিস্ময়ে অক্ষিদ্বয় কোটর হতে বেরিয়ে আসার জন্য ঘোরতর আন্দোলন শুরু করল।
চলবে….