বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ০৪

0
100

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০৪

অল্পবয়সী রোগামতন একটা ছেলের ডানহাত মুচড়ে পেছনে ধরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পলক। যেন কিছুই হয় নি। অন্যদিকে ছেলেটা অবিরত চিৎকার করেই চলেছে। তপা করুণ সুরে আর্তনাদ শুনে কানে হাত চেপে ধরল। তবুও ছাড়ছে না দেখে নরম গলায় বলল,
“ছেড়ে দিন, প্লিজ!”

পলক শক্ত চোখে তাকাল তপার দিকে। কড়া গলায় বলল,
“মায়া হচ্ছে?”

তপা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। নিচু গলায় বলল,
“ছোট মানুষ। বুঝিয়ে বলুন।”

পলক ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ল। হাত ছেড়ে এক ঝটকায় ছেলেটাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“দেখ; যার শরীরে আঘাত করছিলি, কামনার দৃষ্টি দিয়েছিলি সেই তোকে বাঁচাতে চাইছে। বুঝাতে চাইছে। কিন্তু তার তো জানা নেই তোরা এসব বুঝাবুঝির অনেক উপরে বাস করিস। এরা মায়ের জাত। আর তোদের মত কিছু কুলাঙ্গার মায়ের জাতকেই মাঝ রাস্তায় নোংরা করতে দ্বিধা করিস না।”

বলতে বলতেই ধাক্কা মেরে তপার পায়ের কাছে ফেলে দিল। পুনরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মাফ চা; বল আজ থেকে আপনি আমার মা।”

তপা লাফিয়ে পেছনে সরে গেল হাত খানেক। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ ক্রন্দনরত গলায় বলল,
“আজকে থেকে আপনি আমার মা। শুধু আপনি না দুনিয়ায় সব মেয়েই আমার মা। মাফ কইরা দেন আম্মা।”

তপা চোখ বড় বড় করে একবার পলকের দিকে তাকাল, আর একবার মাটিতে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকাল।
পলক তপার হতবিহবল মুখ দেখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখা সান গ্লাস চোখে পরতে পরতে স্থান ত্যাগ করল। কিছুক্ষণেই কমে গেল আশেপাশের ভীড়। এতক্ষণ ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন এক আগুন্তকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে হতে ফিরে গেল নিজকার্যে।

পার্টি অফিসের পরিবেশ আজ আগুন গরম। আসন্ন নির্বাচন কে কেন্দ্র করেই যত শোরগোল। অপজিশন পার্টির মূল হোতা আজমল হোসেন উঠেপড়ে লেগেছে পলক কে দাবিয়ে নিজের গদি আঁকড়ে রাখতে। এই সময়ে গদিচ্যুত হওয়া মানেই তারজন্য বিরাট লস। কিন্তু পলক তাজওয়ার! তাকে পিছু হটানো বা তাকে হারানো তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দেশের জনগণের একমাত্র আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। কোণায় কোণায়, অলিতে-গলিতে লোকজন ভাই বলতে কেবল পলকের নামই জানে। আসন্ন নির্বাচনে হাতে সময় থাকলেও তার থেকে বেশি রয়েছে চিন্তা। কি হবে অদূর ভবিষ্যতে! কি হতে চলেছে!

ক্যাম্পাসে এসে স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে গিয়েও লাইব্রেরীর পথ ধরল তপা। মনটা ভালো লাগছে না তার। কিছু একটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির। কিন্তু কি সেটা সে জানে না। ফুচকা পয়েন্টে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। এরমধ্যে আর অযাচিত কোনো ঘটনা বা সাক্ষাৎ কোনোটাই হয় নি। তবুও মনটা অকারণ অস্থির।

লাইব্রেরীতে গিয়ে টেবিলে ব্যাগ রেখে তার উপর মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল তপা। চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে সেদিনের সেই শক্তপোক্ত পেশিবহুল পুরুষালী হাতটা। যা শক্ত করে মুচড়ে ধরেছিল নাজুক একটা বিগড়ে যাওয়া কচি হাত। তপা পুনরায় অস্থির চিত্তে মাথা তুলে সামনে তাকায়। মনটা খচখচ করছে তার। অস্থির লাগছে। পৃথাকে কল দেওয়ার লক্ষ্যে ফোনের অনুসন্ধান চালায় ব্যাগজুড়ে। কিন্তু সন্ধান মিলল না কোথাও। পরক্ষণেই মনে পড়ল স্টাডি টেবিলের উপর কত যত্ন করেই না রেখে এসেছে ফোনটা। মেজাজ বিগড়ে যায় আরও। ব্যাগ হাতে ধপাধপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। একটা সিঁড়ি অতিক্রম করলেই নিচ তলার ফ্লোর। ঠিক সেখানটায় মুখোমুখি হলো স্বাধীনের । বিগড়ে যাওয়া মনটা এবার সপ্তমে পৌঁছে গেল তার। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলে সে সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়াল। তপা বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“সমস্যা কি আপনার? ছ্যাচড়ার মত বিহেব করছেন কেন? হয় যান নয়তো যেতে দিন।”

স্বাধীন দাঁত কেলিয়ে হাসল। চিবুকে হাত বুলাতে বুলাতে তপার পা থেকে মাথা অবধি নজর বুলিয়ে বলল,
“মুক্ত আকাশে আর কদ্দিন পাখি! ডানা ছাটার সময় যে আসন্ন!”

তপা ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“মুক্ত বিহঙ্গ আজন্মকাল মুক্ত। স্বাধীন নামে কোনো কীটের ক্ষমতা নেই তাকে পরাধীন করার। আর না আছে তার ক্ষমতাধারী শিরের।”

ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা ত্রিকোণ বন্ধু্যুগলের নাম তপা পৃথা এবং সিজান। যাদের হৈ-হুল্লোড়ে উচ্ছ্বসিত থাকে গোটা বাংলা সাহিত্যের ক্যাম্পাস। বাংলা ভবন থেকে কয়েক গজ দূরে বিশালাকার একটা রেইনট্রি গাছ। তার নিচেই রয়েছে শান বাঁধানো বসার জায়গা। সেখানে দলে দলে আড্ডা দিচ্ছে সহপাঠীরা। মেতে থাকছে নিজেদের খেয়ালে।

তপা সেখানেই মন ভার করে বসে আছে ঘন্টাখানেক সময় ধরে। পৃথা ক্লাস শেষে তপার পাশে গিয়ে বসল। নির্লিপ্ত মুখশ্রী দেখে স্নেহময় কণ্ঠে শুধালো,
“তপা কি হয়েছে সোনা? মন খারাপ?”

তপা মলিন হাসল। নিস্প্রভ গলায় বলল,
“ভাল লাগছে না রে। সিজান কোথায়? ক্লাস শেষ তোর?”

পৃথা আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
“ক্লাসে হয়তো। আমার আছে আর একটা ক্লাস। করব না আজ। তুই ক্লাসে কেন গেলি না? ফোনটাও ধরলি না। কি হয়েছে বেবস?”

তপা আহ্লাদিত হয়ে পৃথার কাঁধে মাথা রাখল। নিচু স্বরে বলল,
“কিছু হয় নি। আবার মনে হচ্ছে অনেক কিছু হয়েছে। অকারণ মন খারাপ। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত। কি যে হয় না আমার। সময়ে অসময়ে এই মুড সুয়িংয়ের জ্বালায় আমি অতিষ্ট।”
পৃথা দূরের পানে দৃষ্টি মেলে আফসোসের সুরে বলল,
“তুই আর তোর মুড সুয়িং। দিনে যতবার তোর মুড সুয়িং হয়, ততবার আমি নিশ্বাসও নেই না রে।”

তপা তৎক্ষণাৎ কাঁধ থেকে মাথা তুলে ফেলল। পৃথার মুখ চোখ দেখে বলল,
“তুই কি শান্তনা দিচ্ছিস নাকি খোঁচা মারছিস ফাজিল মহিলা?”

পৃথা হেসে লুটিয়ে পড়ল তপার উপর। হাসতে হাসতেই বলল,
“এই তোর মুড আবার অন্যদিকে বিগড়ে গেল না?”

ক্যাম্পাসের অপর প্রান্ত থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে মৃদুস্বরে কিছু ভাঙা ভাঙা সুর এসে লাগছে তপা পৃথার কানে। দু’টো প্রাণ যেন কান উঁচিয়ে শুনতে চাইল আরও স্পষ্ট আরও নিখুঁত সুরে।

“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে।”

সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে তপা পৃথার বাসা থেকে বের হয় নিজের বাসায় আসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে এক অবাঞ্ছিত ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় সে। স্কুটির গতি থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তমাখা মানুষটার দিকে। সাদা পাঞ্জাবির বুক পিঠ ভেসে যাচ্ছে লাল রঙা তরল পদার্থে। পায়ের কাছটায়ও ভিজে জবজবে। ভাগ্যিস তপার ব্লাড ফোবিয়া নেই! নইলে এতক্ষণে লুটিয়ে পড়ত পিচঢালা রাস্তায়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেকে সামলে সম্মুখ থেকে আসা একেকটা আঘাত প্রতিঘাত হিসেবে ফিরিয়ে দিচ্ছে পলক। কিন্তু আহত হওয়ার দরুন সুবিধা করতে পারছে না। আরও একটা ছুরিকাঘাতে হাতটা ক্ষতবিক্ষত হতেই চাপা স্বরে আর্তনাদ করল সে। অপরপক্ষে জনসংখ্যার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ।তারওপর পা টা মারাত্মক ভাবে জখম। গুলিবিদ্ধ!

তপা এতক্ষণ নীরবে দেখলেও পলকের টালমাটাল অবস্থা থেকে স্কুটি স্টার্ট করল। চোখের পলকে সামনে এসে দ্রুত গলায় বলল,
“উঠে আসুন। ফার্স্ট!”

পলক বোধহয় অপেক্ষা করছিল এই ক্ষণের। তৎক্ষণাৎ নিজের জরাজীর্ণ দেহটা টেনে তুলল স্কুটির পেছনে। বাঁহাতে গলার একপাশ চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেখানটায় ছুড়ির আচরে চামড়া ছিঁড়ে রক্তপাত হচ্ছে। তপা স্কুটির গতি বাড়িয়ে একবার পেছন ফিরে দেখল তিন তিনটে মোটর বাইক নিজেদের সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ধেয়ে আসছে তারই পেছনে। তপা দিশেহারা বোধ করল। কি করবে সে! অন্যদিকে পলকের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মাথা থেকে থেকে চক্কর কাটছে। গা গুলিয়ে আসছে। তপা একহাতে গলা থেকে স্কার্ফ খুলে পলকের দিকে বাড়িয়ে দিল। সামনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“আপনার গলা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পেঁচিয়ে নিন। আর দয়া করে জ্ঞান হারাবেন না। পড়ে যাবেন না। আমাকে ধরে বসুন। একটু সহ্য করে নিন। সামনের হসপিটালেই নেমে যাব।”

পলক স্কার্ফটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিল। পুরো শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে তার। তপার কোমরের কাছটায় এক হাত চেপে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“হসপিটালে যাব না। আমি ঠিক আছি। ভয় নেই।”

তপা শিউরে উঠল। অনিচ্ছাকৃত হলেও পুরুষালী ছোঁয়া। চঞ্চল কিশোরী শরীর, মন খানিকটা নেচে উঠল তার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরন বয়ে গেল। কিন্তু টিকল না বেশিক্ষণ। পলক নিস্তেজ হয়ে তপার উপর এলিয়ে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল সে।
“পলক! মিস্টার তাজওয়ার! আপনি.. ”
স্কুটি থামিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ। পেছনে তাকিয়ে দেখতে চাইল তিনটে বাইকের দুরত্ব ঠিক কতখানি। কিন্তু নজরে এলো না তাদের। তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে পলকের উপর ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোয় পলকের নত মাথা তপার কাঁধ ছেড়ে গলায় এসে ঠেকেছে।
তপা হাত রাখল পলকের মাথায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“মিস্টার তাজওয়ার! কি করব আমি এখন? কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? একটা পথ দেখান প্লিজ। আমার হেল্পলেস লাগছে। কি করব আমি! কি করে বাঁচাব আপনাকে?”

পলক নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকাল অসহায় মেয়েটির দিকে। দিশার আশায় সে তখনো পলকের নিভু নিভু আঁখি পানে দৃষ্টি মেলে রেখেছে। পলক নিস্তেজ গলায় বলল,
“গলিতে ঢুকে পড়ুন তিয়াসা। অন্ধকার কোনো গলিতে।”

তপা তাই করল। মেইন রাস্তা ছেড়ে স্কুটি নামিয়ে নিল সরু পথে। আধো আলো আধো আঁধার ভেদ করে এগিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে। পেছনে ফেলে গেল তিনটে বাইকের মোট নয়জন মানুষের নয়জোড়া চোখের শকুনি দৃষ্টি। যা তখনো হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছে মেইন রাস্তার আনাচে-কানাচেতে।

চলবে…

অল্পবয়সী রোগামতন একটা ছেলের ডানহাত মুচড়ে পেছনে ধরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পলক। যেন কিছুই হয় নি। অন্যদিকে ছেলেটা অবিরত চিৎকার করেই চলেছে। তপা করুণ সুরে আর্তনাদ শুনে কানে হাত চেপে ধরল। তবুও ছাড়ছে না দেখে নরম গলায় বলল,
“ছেড়ে দিন, প্লিজ!”

পলক শক্ত চোখে তাকাল তপার দিকে। কড়া গলায় বলল,
“মায়া হচ্ছে?”

তপা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। নিচু গলায় বলল,
“ছোট মানুষ। বুঝিয়ে বলুন।”

পলক ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ল। হাত ছেড়ে এক ঝটকায় ছেলেটাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“দেখ; যার শরীরে আঘাত করছিলি, কামনার দৃষ্টি দিয়েছিলি সেই তোকে বাঁচাতে চাইছে। বুঝাতে চাইছে। কিন্তু তার তো জানা নেই তোরা এসব বুঝাবুঝির অনেক উপরে বাস করিস। এরা মায়ের জাত। আর তোদের মত কিছু কুলাঙ্গার মায়ের জাতকেই মাঝ রাস্তায় নোংরা করতে দ্বিধা করিস না।”

বলতে বলতেই ধাক্কা মেরে তপার পায়ের কাছে ফেলে দিল। পুনরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মাফ চা; বল আজ থেকে আপনি আমার মা।”

তপা লাফিয়ে পেছনে সরে গেল হাত খানেক। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ ক্রন্দনরত গলায় বলল,
“আজকে থেকে আপনি আমার মা। শুধু আপনি না দুনিয়ায় সব মেয়েই আমার মা। মাফ কইরা দেন আম্মা।”

তপা চোখ বড় বড় করে একবার পলকের দিকে তাকাল, আর একবার মাটিতে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকাল।
পলক তপার হতবিহবল মুখ দেখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখা সান গ্লাস চোখে পরতে পরতে স্থান ত্যাগ করল। কিছুক্ষণেই কমে গেল আশেপাশের ভীড়। এতক্ষণ ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন এক আগুন্তকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে হতে ফিরে গেল নিজকার্যে।

পার্টি অফিসের পরিবেশ আজ আগুন গরম। আসন্ন নির্বাচন কে কেন্দ্র করেই যত শোরগোল। অপজিশন পার্টির মূল হোতা আজমল হোসেন উঠেপড়ে লেগেছে পলক কে দাবিয়ে নিজের গদি আঁকড়ে রাখতে। এই সময়ে গদিচ্যুত হওয়া মানেই তারজন্য বিরাট লস। কিন্তু পলক তাজওয়ার! তাকে পিছু হটানো বা তাকে হারানো তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দেশের জনগণের একমাত্র আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। কোণায় কোণায়, অলিতে-গলিতে লোকজন ভাই বলতে কেবল পলকের নামই জানে। আসন্ন নির্বাচনে হাতে সময় থাকলেও তার থেকে বেশি রয়েছে চিন্তা। কি হবে অদূর ভবিষ্যতে! কি হতে চলেছে!

ক্যাম্পাসে এসে স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে গিয়েও লাইব্রেরীর পথ ধরল তপা। মনটা ভালো লাগছে না তার। কিছু একটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির। কিন্তু কি সেটা সে জানে না। ফুচকা পয়েন্টে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। এরমধ্যে আর অযাচিত কোনো ঘটনা বা সাক্ষাৎ কোনোটাই হয় নি। তবুও মনটা অকারণ অস্থির।

লাইব্রেরীতে গিয়ে টেবিলে ব্যাগ রেখে তার উপর মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল তপা। চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে সেদিনের সেই শক্তপোক্ত পেশিবহুল পুরুষালী হাতটা। যা শক্ত করে মুচড়ে ধরেছিল নাজুক একটা বিগড়ে যাওয়া কচি হাত। তপা পুনরায় অস্থির চিত্তে মাথা তুলে সামনে তাকায়। মনটা খচখচ করছে তার। অস্থির লাগছে। পৃথাকে কল দেওয়ার লক্ষ্যে ফোনের অনুসন্ধান চালায় ব্যাগজুড়ে। কিন্তু সন্ধান মিলল না কোথাও। পরক্ষণেই মনে পড়ল স্টাডি টেবিলের উপর কত যত্ন করেই না রেখে এসেছে ফোনটা। মেজাজ বিগড়ে যায় আরও। ব্যাগ হাতে ধপাধপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। একটা সিঁড়ি অতিক্রম করলেই নিচ তলার ফ্লোর। ঠিক সেখানটায় মুখোমুখি হলো স্বাধীনের । বিগড়ে যাওয়া মনটা এবার সপ্তমে পৌঁছে গেল তার। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলে সে সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়াল। তপা বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“সমস্যা কি আপনার? ছ্যাচড়ার মত বিহেব করছেন কেন? হয় যান নয়তো যেতে দিন।”

স্বাধীন দাঁত কেলিয়ে হাসল। চিবুকে হাত বুলাতে বুলাতে তপার পা থেকে মাথা অবধি নজর বুলিয়ে বলল,
“মুক্ত আকাশে আর কদ্দিন পাখি! ডানা ছাটার সময় যে আসন্ন!”

তপা ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“মুক্ত বিহঙ্গ আজন্মকাল মুক্ত। স্বাধীন নামে কোনো কীটের ক্ষমতা নেই তাকে পরাধীন করার। আর না আছে তার ক্ষমতাধারী শিরের।”

ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা ত্রিকোণ বন্ধু্যুগলের নাম তপা পৃথা এবং সিজান। যাদের হৈ-হুল্লোড়ে উচ্ছ্বসিত থাকে গোটা বাংলা সাহিত্যের ক্যাম্পাস। বাংলা ভবন থেকে কয়েক গজ দূরে বিশালাকার একটা রেইনট্রি গাছ। তার নিচেই রয়েছে শান বাঁধানো বসার জায়গা। সেখানে দলে দলে আড্ডা দিচ্ছে সহপাঠীরা। মেতে থাকছে নিজেদের খেয়ালে।

তপা সেখানেই মন ভার করে বসে আছে ঘন্টাখানেক সময় ধরে। পৃথা ক্লাস শেষে তপার পাশে গিয়ে বসল। নির্লিপ্ত মুখশ্রী দেখে স্নেহময় কণ্ঠে শুধালো,
“তপা কি হয়েছে সোনা? মন খারাপ?”

তপা মলিন হাসল। নিস্প্রভ গলায় বলল,
“ভাল লাগছে না রে। সিজান কোথায়? ক্লাস শেষ তোর?”

পৃথা আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
“ক্লাসে হয়তো। আমার আছে আর একটা ক্লাস। করব না আজ। তুই ক্লাসে কেন গেলি না? ফোনটাও ধরলি না। কি হয়েছে বেবস?”

তপা আহ্লাদিত হয়ে পৃথার কাঁধে মাথা রাখল। নিচু স্বরে বলল,
“কিছু হয় নি। আবার মনে হচ্ছে অনেক কিছু হয়েছে। অকারণ মন খারাপ। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত। কি যে হয় না আমার। সময়ে অসময়ে এই মুড সুয়িংয়ের জ্বালায় আমি অতিষ্ট।”
পৃথা দূরের পানে দৃষ্টি মেলে আফসোসের সুরে বলল,
“তুই আর তোর মুড সুয়িং। দিনে যতবার তোর মুড সুয়িং হয়, ততবার আমি নিশ্বাসও নেই না রে।”

তপা তৎক্ষণাৎ কাঁধ থেকে মাথা তুলে ফেলল। পৃথার মুখ চোখ দেখে বলল,
“তুই কি শান্তনা দিচ্ছিস নাকি খোঁচা মারছিস ফাজিল মহিলা?”

পৃথা হেসে লুটিয়ে পড়ল তপার উপর। হাসতে হাসতেই বলল,
“এই তোর মুড আবার অন্যদিকে বিগড়ে গেল না?”

ক্যাম্পাসের অপর প্রান্ত থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে মৃদুস্বরে কিছু ভাঙা ভাঙা সুর এসে লাগছে তপা পৃথার কানে। দু’টো প্রাণ যেন কান উঁচিয়ে শুনতে চাইল আরও স্পষ্ট আরও নিখুঁত সুরে।

“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে।”

সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে তপা পৃথার বাসা থেকে বের হয় নিজের বাসায় আসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে এক অবাঞ্ছিত ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় সে। স্কুটির গতি থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তমাখা মানুষটার দিকে। সাদা পাঞ্জাবির বুক পিঠ ভেসে যাচ্ছে লাল রঙা তরল পদার্থে। পায়ের কাছটায়ও ভিজে জবজবে। ভাগ্যিস তপার ব্লাড ফোবিয়া নেই! নইলে এতক্ষণে লুটিয়ে পড়ত পিচঢালা রাস্তায়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেকে সামলে সম্মুখ থেকে আসা একেকটা আঘাত প্রতিঘাত হিসেবে ফিরিয়ে দিচ্ছে পলক। কিন্তু আহত হওয়ার দরুন সুবিধা করতে পারছে না। আরও একটা ছুরিকাঘাতে হাতটা ক্ষতবিক্ষত হতেই চাপা স্বরে আর্তনাদ করল সে। অপরপক্ষে জনসংখ্যার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ।তারওপর পা টা মারাত্মক ভাবে জখম। গুলিবিদ্ধ!

তপা এতক্ষণ নীরবে দেখলেও পলকের টালমাটাল অবস্থা থেকে স্কুটি স্টার্ট করল। চোখের পলকে সামনে এসে দ্রুত গলায় বলল,
“উঠে আসুন। ফার্স্ট!”

পলক বোধহয় অপেক্ষা করছিল এই ক্ষণের। তৎক্ষণাৎ নিজের জরাজীর্ণ দেহটা টেনে তুলল স্কুটির পেছনে। বাঁহাতে গলার একপাশ চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেখানটায় ছুড়ির আচরে চামড়া ছিঁড়ে রক্তপাত হচ্ছে। তপা স্কুটির গতি বাড়িয়ে একবার পেছন ফিরে দেখল তিন তিনটে মোটর বাইক নিজেদের সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ধেয়ে আসছে তারই পেছনে। তপা দিশেহারা বোধ করল। কি করবে সে! অন্যদিকে পলকের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মাথা থেকে থেকে চক্কর কাটছে। গা গুলিয়ে আসছে। তপা একহাতে গলা থেকে স্কার্ফ খুলে পলকের দিকে বাড়িয়ে দিল। সামনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“আপনার গলা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পেঁচিয়ে নিন। আর দয়া করে জ্ঞান হারাবেন না। পড়ে যাবেন না। আমাকে ধরে বসুন। একটু সহ্য করে নিন। সামনের হসপিটালেই নেমে যাব।”

পলক স্কার্ফটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিল। পুরো শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে তার। তপার কোমরের কাছটায় এক হাত চেপে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“হসপিটালে যাব না। আমি ঠিক আছি। ভয় নেই।”

তপা শিউরে উঠল। অনিচ্ছাকৃত হলেও পুরুষালী ছোঁয়া। চঞ্চল কিশোরী শরীর, মন খানিকটা নেচে উঠল তার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরন বয়ে গেল। কিন্তু টিকল না বেশিক্ষণ। পলক নিস্তেজ হয়ে তপার উপর এলিয়ে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল সে।
“পলক! মিস্টার তাজওয়ার! আপনি.. ”
স্কুটি থামিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ। পেছনে তাকিয়ে দেখতে চাইল তিনটে বাইকের দুরত্ব ঠিক কতখানি। কিন্তু নজরে এলো না তাদের। তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে পলকের উপর ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোয় পলকের নত মাথা তপার কাঁধ ছেড়ে গলায় এসে ঠেকেছে।
তপা হাত রাখল পলকের মাথায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“মিস্টার তাজওয়ার! কি করব আমি এখন? কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? একটা পথ দেখান প্লিজ। আমার হেল্পলেস লাগছে। কি করব আমি! কি করে বাঁচাব আপনাকে?”

পলক নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকাল অসহায় মেয়েটির দিকে। দিশার আশায় সে তখনো পলকের নিভু নিভু আঁখি পানে দৃষ্টি মেলে রেখেছে। পলক নিস্তেজ গলায় বলল,
“গলিতে ঢুকে পড়ুন তিয়াসা। অন্ধকার কোনো গলিতে।”

তপা তাই করল। মেইন রাস্তা ছেড়ে স্কুটি নামিয়ে নিল সরু পথে। আধো আলো আধো আঁধার ভেদ করে এগিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে। পেছনে ফেলে গেল তিনটে বাইকের মোট নয়জন মানুষের নয়জোড়া চোখের শকুনি দৃষ্টি। যা তখনো হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছে মেইন রাস্তার আনাচে-কানাচেতে।

চলবে…রাহা
#পর্বঃ০৪

অল্পবয়সী রোগামতন একটা ছেলের ডানহাত মুচড়ে পেছনে ধরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পলক। যেন কিছুই হয় নি। অন্যদিকে ছেলেটা অবিরত চিৎকার করেই চলেছে। তপা করুণ সুরে আর্তনাদ শুনে কানে হাত চেপে ধরল। তবুও ছাড়ছে না দেখে নরম গলায় বলল,
“ছেড়ে দিন, প্লিজ!”

পলক শক্ত চোখে তাকাল তপার দিকে। কড়া গলায় বলল,
“মায়া হচ্ছে?”

তপা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। নিচু গলায় বলল,
“ছোট মানুষ। বুঝিয়ে বলুন।”

পলক ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ল। হাত ছেড়ে এক ঝটকায় ছেলেটাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“দেখ; যার শরীরে আঘাত করছিলি, কামনার দৃষ্টি দিয়েছিলি সেই তোকে বাঁচাতে চাইছে। বুঝাতে চাইছে। কিন্তু তার তো জানা নেই তোরা এসব বুঝাবুঝির অনেক উপরে বাস করিস। এরা মায়ের জাত। আর তোদের মত কিছু কুলাঙ্গার মায়ের জাতকেই মাঝ রাস্তায় নোংরা করতে দ্বিধা করিস না।”

বলতে বলতেই ধাক্কা মেরে তপার পায়ের কাছে ফেলে দিল। পুনরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মাফ চা; বল আজ থেকে আপনি আমার মা।”

তপা লাফিয়ে পেছনে সরে গেল হাত খানেক। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ ক্রন্দনরত গলায় বলল,
“আজকে থেকে আপনি আমার মা। শুধু আপনি না দুনিয়ায় সব মেয়েই আমার মা। মাফ কইরা দেন আম্মা।”

তপা চোখ বড় বড় করে একবার পলকের দিকে তাকাল, আর একবার মাটিতে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকাল।
পলক তপার হতবিহবল মুখ দেখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখা সান গ্লাস চোখে পরতে পরতে স্থান ত্যাগ করল। কিছুক্ষণেই কমে গেল আশেপাশের ভীড়। এতক্ষণ ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন এক আগুন্তকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে হতে ফিরে গেল নিজকার্যে।

পার্টি অফিসের পরিবেশ আজ আগুন গরম। আসন্ন নির্বাচন কে কেন্দ্র করেই যত শোরগোল। অপজিশন পার্টির মূল হোতা আজমল হোসেন উঠেপড়ে লেগেছে পলক কে দাবিয়ে নিজের গদি আঁকড়ে রাখতে। এই সময়ে গদিচ্যুত হওয়া মানেই তারজন্য বিরাট লস। কিন্তু পলক তাজওয়ার! তাকে পিছু হটানো বা তাকে হারানো তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দেশের জনগণের একমাত্র আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। কোণায় কোণায়, অলিতে-গলিতে লোকজন ভাই বলতে কেবল পলকের নামই জানে। আসন্ন নির্বাচনে হাতে সময় থাকলেও তার থেকে বেশি রয়েছে চিন্তা। কি হবে অদূর ভবিষ্যতে! কি হতে চলেছে!

ক্যাম্পাসে এসে স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে গিয়েও লাইব্রেরীর পথ ধরল তপা। মনটা ভালো লাগছে না তার। কিছু একটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির। কিন্তু কি সেটা সে জানে না। ফুচকা পয়েন্টে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। এরমধ্যে আর অযাচিত কোনো ঘটনা বা সাক্ষাৎ কোনোটাই হয় নি। তবুও মনটা অকারণ অস্থির।

লাইব্রেরীতে গিয়ে টেবিলে ব্যাগ রেখে তার উপর মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল তপা। চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে সেদিনের সেই শক্তপোক্ত পেশিবহুল পুরুষালী হাতটা। যা শক্ত করে মুচড়ে ধরেছিল নাজুক একটা বিগড়ে যাওয়া কচি হাত। তপা পুনরায় অস্থির চিত্তে মাথা তুলে সামনে তাকায়। মনটা খচখচ করছে তার। অস্থির লাগছে। পৃথাকে কল দেওয়ার লক্ষ্যে ফোনের অনুসন্ধান চালায় ব্যাগজুড়ে। কিন্তু সন্ধান মিলল না কোথাও। পরক্ষণেই মনে পড়ল স্টাডি টেবিলের উপর কত যত্ন করেই না রেখে এসেছে ফোনটা। মেজাজ বিগড়ে যায় আরও। ব্যাগ হাতে ধপাধপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। একটা সিঁড়ি অতিক্রম করলেই নিচ তলার ফ্লোর। ঠিক সেখানটায় মুখোমুখি হলো স্বাধীনের । বিগড়ে যাওয়া মনটা এবার সপ্তমে পৌঁছে গেল তার। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলে সে সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়াল। তপা বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“সমস্যা কি আপনার? ছ্যাচড়ার মত বিহেব করছেন কেন? হয় যান নয়তো যেতে দিন।”

স্বাধীন দাঁত কেলিয়ে হাসল। চিবুকে হাত বুলাতে বুলাতে তপার পা থেকে মাথা অবধি নজর বুলিয়ে বলল,
“মুক্ত আকাশে আর কদ্দিন পাখি! ডানা ছাটার সময় যে আসন্ন!”

তপা ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল,
“মুক্ত বিহঙ্গ আজন্মকাল মুক্ত। স্বাধীন নামে কোনো কীটের ক্ষমতা নেই তাকে পরাধীন করার। আর না আছে তার ক্ষমতাধারী শিরের।”

ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা ত্রিকোণ বন্ধু্যুগলের নাম তপা পৃথা এবং সিজান। যাদের হৈ-হুল্লোড়ে উচ্ছ্বসিত থাকে গোটা বাংলা সাহিত্যের ক্যাম্পাস। বাংলা ভবন থেকে কয়েক গজ দূরে বিশালাকার একটা রেইনট্রি গাছ। তার নিচেই রয়েছে শান বাঁধানো বসার জায়গা। সেখানে দলে দলে আড্ডা দিচ্ছে সহপাঠীরা। মেতে থাকছে নিজেদের খেয়ালে।

তপা সেখানেই মন ভার করে বসে আছে ঘন্টাখানেক সময় ধরে। পৃথা ক্লাস শেষে তপার পাশে গিয়ে বসল। নির্লিপ্ত মুখশ্রী দেখে স্নেহময় কণ্ঠে শুধালো,
“তপা কি হয়েছে সোনা? মন খারাপ?”

তপা মলিন হাসল। নিস্প্রভ গলায় বলল,
“ভাল লাগছে না রে। সিজান কোথায়? ক্লাস শেষ তোর?”

পৃথা আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
“ক্লাসে হয়তো। আমার আছে আর একটা ক্লাস। করব না আজ। তুই ক্লাসে কেন গেলি না? ফোনটাও ধরলি না। কি হয়েছে বেবস?”

তপা আহ্লাদিত হয়ে পৃথার কাঁধে মাথা রাখল। নিচু স্বরে বলল,
“কিছু হয় নি। আবার মনে হচ্ছে অনেক কিছু হয়েছে। অকারণ মন খারাপ। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত। কি যে হয় না আমার। সময়ে অসময়ে এই মুড সুয়িংয়ের জ্বালায় আমি অতিষ্ট।”
পৃথা দূরের পানে দৃষ্টি মেলে আফসোসের সুরে বলল,
“তুই আর তোর মুড সুয়িং। দিনে যতবার তোর মুড সুয়িং হয়, ততবার আমি নিশ্বাসও নেই না রে।”

তপা তৎক্ষণাৎ কাঁধ থেকে মাথা তুলে ফেলল। পৃথার মুখ চোখ দেখে বলল,
“তুই কি শান্তনা দিচ্ছিস নাকি খোঁচা মারছিস ফাজিল মহিলা?”

পৃথা হেসে লুটিয়ে পড়ল তপার উপর। হাসতে হাসতেই বলল,
“এই তোর মুড আবার অন্যদিকে বিগড়ে গেল না?”

ক্যাম্পাসের অপর প্রান্ত থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে মৃদুস্বরে কিছু ভাঙা ভাঙা সুর এসে লাগছে তপা পৃথার কানে। দু’টো প্রাণ যেন কান উঁচিয়ে শুনতে চাইল আরও স্পষ্ট আরও নিখুঁত সুরে।

“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে।”

সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে তপা পৃথার বাসা থেকে বের হয় নিজের বাসায় আসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে এক অবাঞ্ছিত ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় সে। স্কুটির গতি থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তমাখা মানুষটার দিকে। সাদা পাঞ্জাবির বুক পিঠ ভেসে যাচ্ছে লাল রঙা তরল পদার্থে। পায়ের কাছটায়ও ভিজে জবজবে। ভাগ্যিস তপার ব্লাড ফোবিয়া নেই! নইলে এতক্ষণে লুটিয়ে পড়ত পিচঢালা রাস্তায়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেকে সামলে সম্মুখ থেকে আসা একেকটা আঘাত প্রতিঘাত হিসেবে ফিরিয়ে দিচ্ছে পলক। কিন্তু আহত হওয়ার দরুন সুবিধা করতে পারছে না। আরও একটা ছুরিকাঘাতে হাতটা ক্ষতবিক্ষত হতেই চাপা স্বরে আর্তনাদ করল সে। অপরপক্ষে জনসংখ্যার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ।তারওপর পা টা মারাত্মক ভাবে জখম। গুলিবিদ্ধ!

তপা এতক্ষণ নীরবে দেখলেও পলকের টালমাটাল অবস্থা থেকে স্কুটি স্টার্ট করল। চোখের পলকে সামনে এসে দ্রুত গলায় বলল,
“উঠে আসুন। ফার্স্ট!”

পলক বোধহয় অপেক্ষা করছিল এই ক্ষণের। তৎক্ষণাৎ নিজের জরাজীর্ণ দেহটা টেনে তুলল স্কুটির পেছনে। বাঁহাতে গলার একপাশ চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেখানটায় ছুড়ির আচরে চামড়া ছিঁড়ে রক্তপাত হচ্ছে। তপা স্কুটির গতি বাড়িয়ে একবার পেছন ফিরে দেখল তিন তিনটে মোটর বাইক নিজেদের সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ধেয়ে আসছে তারই পেছনে। তপা দিশেহারা বোধ করল। কি করবে সে! অন্যদিকে পলকের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মাথা থেকে থেকে চক্কর কাটছে। গা গুলিয়ে আসছে। তপা একহাতে গলা থেকে স্কার্ফ খুলে পলকের দিকে বাড়িয়ে দিল। সামনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“আপনার গলা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পেঁচিয়ে নিন। আর দয়া করে জ্ঞান হারাবেন না। পড়ে যাবেন না। আমাকে ধরে বসুন। একটু সহ্য করে নিন। সামনের হসপিটালেই নেমে যাব।”

পলক স্কার্ফটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিল। পুরো শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে তার। তপার কোমরের কাছটায় এক হাত চেপে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“হসপিটালে যাব না। আমি ঠিক আছি। ভয় নেই।”

তপা শিউরে উঠল। অনিচ্ছাকৃত হলেও পুরুষালী ছোঁয়া। চঞ্চল কিশোরী শরীর, মন খানিকটা নেচে উঠল তার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরন বয়ে গেল। কিন্তু টিকল না বেশিক্ষণ। পলক নিস্তেজ হয়ে তপার উপর এলিয়ে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল সে।
“পলক! মিস্টার তাজওয়ার! আপনি.. ”
স্কুটি থামিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ। পেছনে তাকিয়ে দেখতে চাইল তিনটে বাইকের দুরত্ব ঠিক কতখানি। কিন্তু নজরে এলো না তাদের। তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে পলকের উপর ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোয় পলকের নত মাথা তপার কাঁধ ছেড়ে গলায় এসে ঠেকেছে।
তপা হাত রাখল পলকের মাথায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“মিস্টার তাজওয়ার! কি করব আমি এখন? কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? একটা পথ দেখান প্লিজ। আমার হেল্পলেস লাগছে। কি করব আমি! কি করে বাঁচাব আপনাকে?”

পলক নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকাল অসহায় মেয়েটির দিকে। দিশার আশায় সে তখনো পলকের নিভু নিভু আঁখি পানে দৃষ্টি মেলে রেখেছে। পলক নিস্তেজ গলায় বলল,
“গলিতে ঢুকে পড়ুন তিয়াসা। অন্ধকার কোনো গলিতে।”

তপা তাই করল। মেইন রাস্তা ছেড়ে স্কুটি নামিয়ে নিল সরু পথে। আধো আলো আধো আঁধার ভেদ করে এগিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে। পেছনে ফেলে গেল তিনটে বাইকের মোট নয়জন মানুষের নয়জোড়া চোখের শকুনি দৃষ্টি। যা তখনো হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছে মেইন রাস্তার আনাচে-কানাচেতে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here