বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ০৮

0
97

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০৮

“তুই পলক তাজওয়ারের বাড়ি চিনিস সিজান?” মিনমিনে গলায় তপার বলা বাক্য শুনে সিজান সরু দৃষ্টিতে তাকাল। গলায় সন্দেহের বীজ ঢেলে বলল,
“পলক তাজওয়ারের বাড়ি দিয়ে তুই কি করবি?”
তপা এদিক ওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি লুকাতে চেষ্টা করলে সিজান পুনরায় বলল,
“বল, পলক তাজওয়ারের বাড়িতে তোর কি কাজ?”

“উনি অসুস্থ।”

“সেটা সবাই জানে তপা। কিন্তু তার অসুস্থতা দিয়ে তোর কি কাজ? তার বাড়িতেই বা তোর কি? ঝেড়ে কাশ তো। আমি যতদূর জানি তুই তাকে সহ্য করতে পারিস না। তাহলে?”

তপা বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বলল,
“এত প্যাচাল না পেরে বল ঠিকানা জানিস কি-না। জানলে চল আমার সাথে। নইলে আমি একাই গেলাম।”

তপা উঠে দাঁড়াল। বা’হাতে জামার পেছনে লেগে থাকা ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে গেল কয়েক পা। সিজান হন্তদন্ত হয়ে পিছু নিয়ে বলল,
“আমি ঠিকঠাক চিনি না। তবে যতদূর জানি আশিকপুরেই তার বাড়ি।”

“তবে চল। বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই। নেতা সাহেব বলে কথা।”

“কিন্তু তুই পলক তাজওয়ারের বাড়ি খুঁজে কি করবি? ভেতরে ঢুকবি নাকি? আমাদের মত সাধারণ পাবলিক কে ঢুকতে দেবে?”

তপা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“উনি কোন রাজ্যের রাজকুমার শুনি? নেহাৎই বিবেকের তাড়নায় মরছি। নইলে কে যায় তাকে দেখতে! তার বাড়ির খোঁজ করতে আমার ঠ্যাকা পড়ছে।”

“বিবেকের তাড়না?” সিজান কৌতূহলী বোধ করল।

তপা ছোট করে দম ফেলে বলল,
“হুম। তোর মনে আছে আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার দিন পলক তাজওয়ারের মার্ডারের খবর এসেছিল। আর সেদিনই উনি আবার সশরীরে হাজির হলেন ক্যাম্পাসে। যদিও অসুস্থ ছিলেন।”

“মনে থাকবে না কেন? চার পাঁচ দিন আগের কথা। এখনই ভুলে যাব?”

“কোনো একজন মেয়ে তাকে বাঁচিয়ে ছিল, এটা জানিস?”

সিজান পায়ের গতি থামিয়ে দিল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। ধরা গলায় বলল,
“এখন বলিস না মেয়েটা তুই।”

তপা মৃদু হেসে স্বগতোক্তি করল।
“মেয়েটা আমিই রে। সেদিন সন্ধ্যায় পৃথার বাসা থেকে ফেরার পথে তাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাই। কিছু সন্ত্রাসীর হাত থেকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচাই তাকে। এখন কি অবস্থায় আছে একবার না দেখে শান্তি পাচ্ছি না। আমার বিবেক আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমি কি ভুল করছি দোস্ত?”

সিজান মুচকি হেসে তপার মাথায় হাত রেখে বলল,
“অনেক বড় হ । যুগে যুগে এভাবেই লোকের প্রাণ বাঁচা। শুধু নিজের প্রাণটা রক্ষা করিস আম্মা।”

সত্যি সত্যি পলকের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পেল না তপা সিজান। মেইন গেইট থেকে শুকনো মুখে ফিরে আসতে হলো তাদের। কারণ স্বরুপ জানানো হলো তাজওয়ার সাহেব বাড়িতে নেই। শারীরিক অবস্থার অবনতির দায়ে তার স্থান হয়েছে হাসপাতালের বিছানা। গত দুদিন থেকে তিনি আয়েশা খানম মেমোরিয়াল হসপিটালে শয্যাশায়ী।চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তপার ফুসফুস ভেদ করে। শ্যামবরণ মুখটায় আরও একটু শ্যামা রঙের আস্তরণ পড়ে।

সিজান তপার মুখাবয়ব লক্ষ করে কাঁধে হাত রেখে বলল,
“হাসপাতালে যাবি?”
মুখে কিছু বলল না তপা। কেবল মাথা কাত করে সায় জানালো। ফের ছুটল দুজন। আশিকপুর ছেড়ে ; হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

এখানে এসেও বিড়ম্বনায় পড়তে হলো তাদের। কড়া পাহারায় সুরক্ষিত রাখা হয়েছে আগামীর ভবিষ্যৎ পলক তাজওয়ার কে। অনুমতি বিহীন একটা মাছিও গলতে দিতে নারাজ বিশালদেহী দেহরক্ষীর দল। মেইন গেইট থেকে শুরু করে হসপিটালের করিডোর প্রতিটি জায়গায় শকুনি দৃষ্টি মেলে রেখেছে তারা। যেন একটা মাছি গলতে দেখলেও ঝাঁঝরা করে দেবে।

“আমরা উনার ক্ষতি করতে আসি নি। আমি উনার পূর্ব পরিচিত। বিশ্বাস না হলে উনাকে গিয়ে বলুন আমার কথা। উনি নিশ্চয়ই পারমিশন দেবেন।”

তপার কথায় কৃষ্ণবর্ণ এক দেহরক্ষী থমথমে গলায় বলল,
“আপনার নাম?”

“তিয়াসা তপা।”

হঠাৎই লোকটার ব্যবহারে বিশাল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো। বদলে গেল চোখের ভাষাও। নিচু স্বরে বলল,
“ম্যাম আপনি… আগে বলবেন তো। প্লিজ ভেতরে যান।”

তপা সিজান টাস্কি খেয়ে তাকিয়ে রইল। কি হলো এটা! একজন আরেক জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ইশারায় বোঝালো গার্ডের মতিভ্রম ঘটল কোন জাদুবলে!

ভেতরে গিয়ে নজরে এলো আরও এক বিরল দৃশ্যের। হাসপাতালের বিছানা দখল করে শুয়ে থাকা রোগী জনাব পলক তাজওয়ার মনের সুখে টপাটপ বিরিয়ানি গিলছেন। আর রাজার মত সুর তুলে বলছেন,
“ঢিলেমি, আলসেমি আমি পছন্দ করি না। সেটা সেই হাফপ্যান্ট পরা অবস্থা থেকে শুনে আসছিস। তাহলে আজ এত ঢিলেমি করছিস কেন তোরা? তিনজন মানুষ সকাল থেকে একটা পুঁচকে মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারিস না। এই তোরা দিবি আমার সিকিউরিটি? হসপিটালের বাইরে একবার বের হই সব কটার সিগনাল ড্যামেজ করে ফেলব। যতসব অকর্মণ্যের দল পুষছি আমি টাকা দিয়ে। তোদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমার নিজেরই বের হতে হবে ওর সিকিউরিটির জন্য…”

পলকের কথা শেষ হওয়ার আগেই তপা নিজ ভঙ্গিতে বলল,
“দিব্যি তো সুস্থ আছেন। হসপিটালে বসে গান্ডেপিন্ডে গিলছেন। আয়েশ করে আবার হাড্ডি চিবুচ্ছেন। তবে বাইরে বের হতে আবার কি সমস্যা? অন্যের উপর ভরসা না করে নিজেই খুঁজে আনুন না কাকে খুঁজছেন। এতে আপনার কাজও হয় আর হসপিটালের একটা বেডও মুক্তি পায়।”

তপার কথায় পলক চমকে উঠল। এই তো সে! যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে! যাকে খুঁজে তার লোকেরা দিশেহারা স্বয়ং তিনি এসে পলকের সামনে হাজির। আশ্চর্যজনকই বটে!

“তুমি এখানে?” পলক কৌতূহলী গলায় শুধালো।

তপা আশেপাশে দৃষ্টি মেলে কক্ষের বিলাসবহুল বেশ দেখে মুচকি হেসে বলল,
“হুম ; এলাম। না এলে তো দেখতেই পেতাম না হসপিটালও মানুষের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে পরিবর্তন হতে পারে।”

পলক সরু চোখে তাকাল। থমথমে গলায় বলল,
“টিটকিরি মারছো?”

“আপনি হসপিটালে আছেন কেন বলুন তো? দিব্যি তো সুস্থ আছেন। বাড়ির লোকজন কে কেন প্রেসার দিচ্ছেন?”

সজল এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুলল। নমনীয় গলায় বলল,
“আপনি ভুল বুঝছেন ভাইকে। ভাই দুদিন আগে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে সেন্সলেস হয়ে যায়। হাতের আঘাতে পুনরায় আঘাত লাগে। রক্তক্ষরণ হয়। ঘাড়ের আঘাত থেকে নার্ভে সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতালে নিয়ে আসলে ডাক্তার অবজারভেশনে রাখতে চায়। ভাই বাড়ি যেতে চেয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু আন্টি মানে ভাইয়ের আম্মা ওই কথা কানেও তুলে নাই, মাথায়ও না। তাই তো ভাই এখনো এখানে আছে।”

তপা অবাক হয়ে তাকাল পলকের দিকে। মানুষটা তবে সত্যি অসুস্থ!

“ডিসচার্জ দেবে কবে?”

সজলই পুনরায় বলল,
“সব ঠিক থাকলে আগামীকাল।”

তপা পলকের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
“আই’ম সরি।”

পলক ঠোঁট বেঁকিয়ে তপার অগোচরে খানিকটা হাসল। কিন্তু মুখে টিপ্পনী কেটে বলল,
“আমার সৌভাগ্য।”

ব্যস তপার আগুনে আবার ঘি ঢালা পড়ল। নিভে যাওয়া আগুন আবার দাবানলে রূপান্তরিত হলো। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি মেলে তাকাল পলকের দিকে।

“কিন্তু তুমি এখানে পৌঁছালে কি করে? জানলে কি করে আমি এখানে?”

তপা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“দ্যাট্স নান অফ ইউর বিজনেস মিস্টার কুলক তাজওয়ার।”

সিজানের দিকে দৃষ্টি মেলে বলল, “চল।”

আর অপেক্ষা করল না কারও কথার। সিজানের আসার তোয়াক্কা না করেই গটগট করে বেরিয়ে এলো কেবিন ছেড়ে। পর্যায়ক্রমে হাসপাতাল ছেড়ে।

বেশ কিছুদিন পর।
“তপা উপর তলায় এক কাপ চা আর সাথে কিছু নাস্তা বানিয়ে দিয়ে আসিস তো মা।”
আয়েশার কথা শুনে তপা ভ্রুকুটি করে তাকায়। মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,
“চা নাস্তা কে খাবে মা? কেউ এসেছে? আমাদের তো কেউ নেই মা। তবে কে এলো?”

“উপরের রুমে একজন ভাড়াটিয়া উঠেছে।” আয়েশা নরম সুরে বলল।

তপা অবাক হলো। একবার উপরে তাকাল। অতঃপর বলল,
“ভাইয়া তো তোমাকে ভাড়া দিতে বারণ করেছিল মা। তাহলে?”

“আসলে ছেলেটা এত করে বলছিল আমি আর না করতে পারি নি মা। রেগে যাস না যেন। প্রান্ত কে আমি ঠিক সামলে নেব। তুই এখন যা চা দিয়ে আয়।”

“তাই বলে তুমি একটা ছেলেকে ঘর ভাড়া দিয়ে দিলে! এখন তোমার মেয়ে যদি এই ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায় তখন?”

আয়েশা মুচকি হেসে বললেন,
“আমার আপত্তি নেই।”

তপাও এবার হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
“তুমি পারোও বটে। যেদিন সত্যি সত্যি ভেগে যাব সেদিন বুঝবে।”

ট্রে হাতে একেকটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে কাঙ্ক্ষিত কক্ষের সামনে এসে ধুকপুক করতে থাকা বুকে ফু দিয়ে নিজেকে শান্ত করল তপা। এক হাতে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল খানিকটা। তপা গলা বাড়িয়ে বলল,
“আসতে পারি?”

তপার ভেতরে প্রবেশ করতে হলো না। ভেতরের মানুষটাই সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তপার চক্ষুগোচর হতেই ঠোঁট দুটো স্বমহিমায় আলাদা হয়ে গেল। তপার ভড়কে যাওয়া মুখটা দেখে বোধহয় সে খানিকটা আনন্দ জোয়ারে ভাসল। ঠোঁট কামড়ে চোখ টিপে দরজায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল ভড়কে যাওয়া অপ্রস্তুত মুখপানে।

কিঞ্চিৎ সময় পর তপা খানিকটা চেঁচিয়ে বলল,
“আপনি!”

“ইয়াহ্ আমি! কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?”

চলবে…

নোট-১ঃ আসবে একদিন পর পর। আমি খানিকটা অসুস্থ। মাঝে মাঝে দুই একদিন বিলম্ব হলে মাফ করবেন।
নোট-২ঃ পেইজের রিচ ডাউন। তাই যারা পড়বেন অনুগ্রহ করে রিয়াক্ট – কমেন্ট করবেন। যেন সবাই পড়ার সুযোগ পায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here