বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ০৯

0
106

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০৯

“ইয়াহ্ আমি! কেমন লাগল সারপ্রাইজ?”
“জঘন্য!” চোখ মুখ কুঁচকে বলল তপা।
“তাই! জঘন্য লাগার কারণটা জানতে পারি?”
ছোট্ট করে দম ফেলল তপা। চোখ মুদে নিজেকে শান্ত করে প্রশ্নসূচক গলায় বলল,
“আপনার এত বড় বাড়ি থাকতে আপনি এখানে কেন এসছেন? নিজের বাড়ি থাকতে ভাড়াটিয়া কেন?”

পলক এবার নিজের সত্বায় ফিরে গেলো। মুখাবয়ব ছাপিয়ে গেল গম্ভীরতায়। থমথমে গলায় বলল,
“আমি আমার নিজের মর্জির মালিক।”
তপা আর কথা বাড়ানোর হেতু খুঁজে পেল না। অগ্যতা নাস্তার ট্রে হাতে ধরিয়ে গটগট করে নেমে এলো ঝকঝকে টাইলসে মোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে।

“ও মা; এই আপদটাকে কেন বাড়িতে এনেছো? তুমি জানো এটা কে? এটা ছাত্রনেতা পলক তাজওয়ার। একে বাড়িতে রাখলে আমাদের বিপদে পড়তে হবে। এর পেছনে তো সারাক্ষণ গুন্ডা মাস্তান লেগে থাকে। আসলে কি বলো তো মা, উনি নিজেই একটা মাস্তা…”

নিজমনে গচ্ছিত শব্দবাণগুলো উচ্চারণ করার আগেই সম্মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে আপনাআপনিই থেমে গেল কণ্ঠনালী। মুখশ্রীতে ফুটে উঠল অপ্রস্তুত ভঙ্গিমা। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আপনি…এখানে?”
পলক দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে ভ্রুযুগল কুঁচকে বলল,
“না এলে তো জানতেই পারতাম না এত দারুণ গুণকীর্তন চলছিল!”
তপা এক পলক আয়েশার দিকে তাকাতেই দেখল তিনি মিটিমিটি হাসছেন। পুনরায় তাকাল সে পলকের দিকে। চেহারায় সরলতা ফুটিয়ে তুলে বলল,
“কিছু লাগবে?”
“নাহ! আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। গেইটে যেন তালা না লাগানো হয়।”

“রাতের খাবার বাড়িতে এসে আমাদের সাথে খাবে, কেমন?” স্নেহার্দ্র গলায় বললেন আয়েশা।

পলক মৃদু হেসে বলল,
“আপনাদের কষ্ট করতে হবে না আন্টি। আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসব।”

“নিজের মা বললে পারতে এভাবে না করতে? আমি তো আর নিজের মা নই। আমার ছেলেটা বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে আছে কতগুলো বছর ধরে। তাকে যত্ন করে খাওয়াতে পারি না কত বছর। সেই স্বাদটুকুই নাহয় পূরণ করার সুযোগ দাও।”

এরপর আর কিছু বলার থাকে না। সুযোগ থাকে না উপেক্ষা করারও। অগ্যতা রাজি হতে হলো পলক কে।

রাতের যখন দ্বিতীয় প্রহর। পলক দরজায় এসে বেল বাজায়। তপা বইয়ে মগ্ন থাকায় বিরক্ত হয়। রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস তার ছোট বেলা থেকেই। সে অভ্যাসবশতই পুরো বাড়ির আলো নিভিয়ে নিজ কক্ষে বইয়ে ডুবে ছিল সে। নৈশব্দ পরিবেশে হঠাৎ শব্দে বিরক্তির মাত্রা যেন আকাশ ছুঁলো। বই রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শব্দোৎসের দিকে।
দরজা খুলতেই ক্লান্ত শরীরে ভেতরে পদার্পণ করল দীর্ঘ দেহ বিশিষ্ট বলিষ্ঠ পুরুষ। শরীরে ক্লান্তি ভাব দেখা দিলেও চোখেমুখে উজ্জ্বল দীপ্তি।
তপা কোমরে হাত রেখে কঠিন গলায় শুধালো,
“কয়টা বাজে?”
পলক আবছা আলোয় ঘড়ি দেখতে ব্যর্থ হয়ে বলল,
“ধারণা করতে পারছি না। ঘরে নিশ্চয়ই ঘড়ি বা মোবাইল ফোন আছে? ঘরে গিয়ে দেখে নাও। এবার রাস্তা ছাড়ো।”

“এ বাড়িতে থাকতে হলে রাত আটটার ভেতর বাড়ি ঢুকতে হবে। শৃঙ্খলা মেনে থাকতে হলে থাকুন নইলে দরজা খোলা আছে।”

পলক নীরবতা মেনে ভ্রুকুটি করে তাকাল। মেয়ে কি তাকে অপমান করার চেষ্টা করছে!

পলকের নীরবতা লক্ষ করে তপা পুনরায় বলল,
“দেখুন আমি আপনার আমার ভালোর জন্যই বলছি আপনি চলে যান এ বাড়ি ছেড়ে। এখানে আমি আর আমার মা থাকি। আশেপাশের লোকজন আপনাকে নিয়ে কুৎসা রটাতে সময় নেবে না। তারওপর আপনি যদি এমন রাত বিরেতে বাড়ি ঢুকেন লোকের নজর কাড়বে আরও বেশি। বদনাম দিলে হজম করতে পারবেন তো?”

পলক শক্ত চোখে তাকাল। কাঠিন্য রূপে নিজেকে ভাসিয়ে গমগমে আওয়াজ তুলে বলল,
“কে রটাবে কুৎসা? কে দেবে বদনাম? মরুভূমি বানিয়ে ফেলব সমস্ত ধরাধাম। খরা লাগিয়ে দেব ভূলোক জুড়ে।”

তপা ভড়কে গেল। সাহস পেল না আর একটি টু শব্দ করার। নিঃশব্দে সরে গেল দরজা ছেড়ে। বুকের ভেতরটায় ধ্রিম ধ্রিম আওয়াজ করছে তার। এ যে ভয়ংকর পুরুষ। অতিশয় ভয়ংকর। এ পুরুষেই মৃত্যু সুনিশ্চিত।

দুইদিন পর গোধূলির কিছু প্রহর পূর্বে তপার বোধগম্য হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে অলিগলি পেরিয়ে পায়ে হেঁটে সে নিজ আলয়ে ফিরছে। বেশ কিছু সময় ধরেই মনে হচ্ছিল কেউ আছে তার পেছনে। দূর থেকেই নজর রাখছে তার উপর। জনমানবহীন গলিতে প্রবেশের পর সন্দেহ আরও গভীর থেকে গভীরতর হলো। অল্প খানিকটা দূরেই দুজন কালো পোশাকধারী লোকের দেখা পায় তপা। পেছনে ফিরতেই তারা উধাও। একবার দুবার করে বেশ কয়েকবার দেখার পর তপার মনে ভয়ের সঞ্চার ঘটে। এরা কারা? কি চায় তার কাছে? মনের ভেতর উঁকি দেয় নানা রকম অশনি ভাবনা।
পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয় তপা। পরনে কুর্তি আর জিন্স হওয়ায় জলদি হাঁটতে বেশ সুবিধা হচ্ছে। এক পর্যায়ে গিয়ে দৌড়াতে শুরু করে সে। আধঘন্টার পথ মিনিট পনেরোতে অতিক্রম করে স্বীয় নিবাসে পদার্পণ করে।
গেইটের ভেতর প্রবেশ করে হাঁটুতে দুইহাত রেখে উবু হয়ে দাঁড়ায় সে। বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই অক্ষি সম্মুখে দর্শন দেয় একজোড়া কুচকুচে কালো রঙের জুতো। চোখ মেলে সামনে তাকায় তপা। ফুসফুস নিঃসৃত করে তখনো বেরিয়ে আসছে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ সম শ্বাস প্রশ্বাস।

তটিনীর বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব। পাত্র পক্ষ এসে বসে আছে সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুমে। পাত্রের সঙ্গে এসেছেন তার মা এবং বড় বোন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের বাহ্যিক গঠনও মারাত্মক। ঈশ্বর প্রদত্ত সৌন্দর্য নিয়ে সে হাজির হয়েছে তটিনীর বড় বোন রেশমি কে বিয়ে করার লক্ষ্যে। যদিও রেশমি কে তারা আগে দেখেনি। ঘটক কর্তৃক এসেছে এই সম্বন্ধ।

রেশমি কে সাজিয়ে গুছিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে বসানো হয়। অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী রেশমি কারো কথার ধার না ধেরেই সোজা গিয়ে আসন গেড়ে বসল পাত্রের বাম পাশে। যদিও তার জন্য জায়গা ছেড়ে ছিলেন পাত্রের মা তার পাশে। ঘটনার আকষ্মিকতায় একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পরক্ষণেই সব ভুলে আন্তরিকতার সাথে সামাজিকতা রক্ষার্থে টুকটাক কথাবার্তা চালিয়ে গেল।

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় তটিনী। খাবারের ট্রে হাতে জনসম্মুখে যেতেই চোখ পড়ে সোফায় বসে থাকা সুদর্শন পুরুষটির। কালক্রমেই ঘটে যায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনাই বটে। ড্রয়িংরুমে ঘটা সাধারণ একটা ঘটনাই তটিনীর জীবনে টেনে নিয়ে আসবে ভয়ানক দুর্যোগ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here