#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৪,০৫,০৬
#সুমাইয়া মনি।
০৪
কুয়াশা ঢেকে আছে পথঘাট। পূর্বদিগন্ত থেকে সূর্যের রশ্মি উদিত হতেই ধীরে ধীরে কুয়াশার রেশ বিলিন হয়ে যায়।
ক্ষণে ক্ষণে সূর্যের তাপমাত্রা তীব্র হতে থাকে। রৌদ পোয়াতে অনেকেই ছাদে কিংবা বারান্দায় উপস্থিত হয়েছে।
বিভা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল সকাল কলেজে যাওয়ার ফলে গোসল করতে হয় তাকে। শরীর হাত-পা উষ্ণ গরম করার জন্য খাটে বসে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে নেয়। কাঁপা-কাঁপি করার মুহূর্তে আবিরদের বারান্দার কথা মনে পড়ে। একবার নিজের ঘরের দিকে নজর বুলিয়ে নেয়। চার কোণাচে টিন দিয়ে তৈরি একটি ঘরে তারা বসবাস করে। ঘরটি এতটাও বড়ো নয়। সঙ্গে এডজাস্ট বাথরুম ও ছোট্ট একটা রান্নাঘর। গরমের দিনে যেমন তীব্র গরম অনুভব হয়, শীতের সময়ও তেমনি ঠান্ডা দ্বিগুণ লাগে। এইটুকু ঘরের ভাড়া চার হাজার টাকা। যদি কোনো বড়োলোক ঘরে জন্ম হতো। এতক্ষণ বিছানার মধ্যে থেকে গরম কফির মজা নিতো। তবে বিভা আফসোস করে না।
কাঁথা সরিয়ে তৈরি হয়ে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য।
হেঁটেই তাকে কলেজে যেতে হয়। ববির কাছ থেকে রোজ বিশ টাকা নেয়। সেটা রেখে দেয় রিকশা দিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য। কারণ এখান থেকে আফিনদের বাড়ি দুই কিলোমিটারের কাছাকাছি। কলেজে এসে মোহনার সঙ্গে দেখা হয়। ক্লাসরুমে একদম লাস্টের বেঞ্চে উদাস মনে বসেছিল। যখন থেকে পরিচয় হয়েছে এভাবে উদাস হতে দেখেনি মোহনাকে। বিভা পাশে বসে। উপস্থিতি টের পেয়েও মোহনা একই ভাবে বসে আছে, অদ্ভুত! বিভা কাঁধে হাত রেখে ‘মন খারাপ.. ‘ বাক্যটি শেষ করার আগেই মোহনা ওঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বিভা অবাক হয়ে যায়। এক নজরে পর্যবেক্ষণ করে নেয় সকলের দিকে। আপাতত কেউ বিষয়টি খেয়াল করেনি। বিভা মোহনার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
‘কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল?’
কান্নার গতিবেগ যেন আরো বেড়ে যায় মোহনার। বিভা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
‘এভাবে কাঁদিস না। সবাই দেখলে প্রশ্ন তুলবে। চুপ কর। বাহিরে চল। কি হয়েছে মাঠে গিয়ে শুনবো।’
মোহনা কান্না থামায় না। বিভা এক প্রকার টেনে বাহিরে নিয়ে আসে। গাছের নিচে বসে চোখ মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে পুনোরায়। মোহনা হেঁচকি তুলে বলে,
‘সাকিব আমার সঙ্গে ব্রেকআপ করেছে।’
বিভা সরু চোখে তাকায়। এর আগে সাকিবের কথা ওঁকে বলেনি। হঠাৎ বলাতে বিভা মেকি রাগ দেখায়। মোহনা কান্না কণ্ঠে বলে উঠে,
‘স্যরি! সাকিবের কথা আমি তোকে বলিনি।’
‘তাহলে এখনো বলার দরকার নেই।’ বলে বিভা প্রস্থান করে।
মোহনা আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। কিছুটা পথ গিয়েও থেমে যায় বিভা। ফিরে এসে মোহনার হাত ধরে টেনে তুলে সান্ত্বনা দেয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
মনঃক্ষুণ্ন রেখে তো আর ক্লাসে মন দেওয়া যায় না।
ছুটির পর একা একা প্রাইভেটে আসতে হয় তাকে। পড়ার কক্ষে এসে কাউকে না দেখতে পেয়ে বারান্দায় যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু আইরিন ম্যামও বাসায় ছিল না বিধায় যায় না। বই বিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদে একজন, দু জন করে স্টুডেন্ট হাজির হয়। তখন আফিনও চলে আসে।
ম্যাথ করাতে থাকে। পড়ার মাঝে বিভার কালকের কথা মনে পড়ে। আবিরের যন্ত্রণায় বিভা না পড়েই বাড়িতে চলে এসেছিল। দিনটাই যেন মাটি করে দিল এমনটা মনে হতে থাকে তার।
‘বিভা..’
আফিনের ডাক শুনে বিভার ভাবনা কেঁটে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠি দাঁড়িয়ে বলল,
‘বলুন স্যার।’
‘তুমি কি আম্মুর রুম থেকে সাইনপেন নিয়ে আসবে? এটির কালি শেষ হয়ে গেছে। আম্মু কলেজ থেকে এসেছে। চাইলেই দিবে।’
‘জি আনছি স্যার।’ বলে বিভা বের হতে নিলে আফিন পিছন থেকে আবার বলল,
‘আম্মুর রুম তুমি তো চিনো?’
‘হ্যাঁ!’
‘তাহলে যাও।’
বিভা ওপরে আসে। আবিরের রুমের পাশের রুমটি আইরিন বেগমের। বিভা সরাসরি সেই রুমে নক করে প্রবেশ করে। আইরিন বেগম তখন শাড়ির পিন খুলছিল। বিভাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘নিশ্চয় আফিন পাঠিয়েছে তোমাকে সাইনপেন বা কলমের জন্য?’
বিভা কিছুটা অবাক হয়ে চুপ করে রয়। আইরিন বেগম ঠোঁটের হাসি চওড়া করে বলল,
‘আফিন প্রায় স্টুডেন্টদের সাইনপেন, কলমের জন্য আমার কাছে পাঠায়। একটু ওয়েট করো দিচ্ছি।’ বলে তিনি তার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঢয়ার খুলে দেখলেন সাইনপেনের প্যাকেট নেই। তিনি ফিরে এসে বললেন,
‘বোধহয় আবির নিয়েছে। ওর রুমে গিয়ে চাও দিয়ে দিবে।’
কথাটা শুনে বিভা বিরক্ত হলো। কিন্তু সেটা তার সামনে প্রকাশ করল না। নেতিবাচক মাথা নাচিয়ে বের হয়ে এলো।
‘এখন আবির পাঠার রুমে যেতে হবে ভেবেই রাগ লাগছে বাল।’ আবিরের রুমের সামনে দৃষ্টি নত রেখে দাঁড়ায়। সে আরো ভাবে তাকেই কেন পাঠানো হলো। অন্য কেউকে তো পাঠাতে পারতো। সব সময় তাকেই কেন বাঁশের চিপায় পড়তে হয়। এখন রাগ হয় আফিনের ওপর।
আপাতত এসব সাইডে রেখে পর্দা সরিয়ে দরজায় নক করে।
‘আসতে পারি?’
‘মোটেও না।’ ভেতর থেকে জবাব আসে আবিরের।
‘আফিন স্যার সাইনপেনের জন্য পাঠিয়েছে। সাইপেন নাকি আপনার কাছে আইরিন ম্যাম বলল।’
‘কাম!’
বিভা বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখে আবির বিছানায় চিৎ হয়ে ফোন ঘাটছে। পরনে সাদা রঙের সিল্কের গেঞ্জি আর কালো ফুল প্যান্ট। পর্যবেক্ষণ করার পর নজর সরিয়ে নেয়। আবির ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। বিভার দিকে তাকিয়ে আগাগোড়া দেখে নেয়। বলে,
‘সাইনপেন নিতে হলে ট্যাক্স দিতে হবে।’
বিভা ভ্রু কুঁচকে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এমন কোনো নিয়ম নেই। আর পেন আমার নয় স্যার চেয়েছে।’
‘যে-ই চাক’না কেন। ট্যাক্স দিতে হবে।’
‘আচ্ছা স্যারকে গিয়ে বলছি।’
‘এই না দাঁড়াও দিচ্ছি।’
‘লাইনে এসেছে ট্রেন।’ মনে মনে বলে বিভা।
আবির এক ডজন সাইনপেন আলমারি থেকে বের করে বিভার দিকে এগিয়ে দেয়। বিভা সাইনপেন নিতে নিলে আবির শক্ত করে ধরে রাখে। নজর আবিরের দিকে ফেলতেই দুষ্টু হাসি ঠোঁটে দেখতে পায়। বিভা কন্ঠে তেজ এনে বলে,
‘ছাড়ুন।’
‘ছাড়িয়ে নেও।’ মুচকি হেসে।
বিভা অন্য হাত দিকে আবিরের কব্জিতে চিমটি কাটে। ‘আউচ’ শব্দ তুলে কলম ছেড়ে দেয়। বিভা কলম গুলো নিয়ে দ্রুত বের হতে নিলে আবির এক ছুটে বিভার সামনে এসে দাঁড়ায়। যার দরুন বিভা আবিরের বাহুতে জোরে ধাক্কা খেয়ে পিছন দিকে পড়ে যায়। আবির হো হো করে হাসতে শুরু করে। বিভা কটমট চোখে তাকায়। উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে।
আবির হেসে হেসে বলে,
‘অতি চালাকে পায়ে দড়ি।’
‘সরুন সামনে থেকে।’ ঝাড়ি দিয়ে বলে বিভা।
আবির হাসি থামিয়ে হাত টুকু পিছনে নিয়ে বিভার দিকে একটু ঝুঁকে বলে,
‘না সরলে কি করবে?’
বিভা পিছনে সরে গিয়ে বলে,
‘চিৎকার দিবো।’
‘হাহ! মানসম্মান তোমার যাবে আমার না। কারণ এটা আমার বাড়ি, আর তুমি এখন আমার রুমে আছো।’ তাচ্ছিল্য করে বলে।
‘আপনি খারাপ এটা জানতাম, এতটা খারাপ সেটা বুঝি নি।’ ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে।
‘বুঝে নেও, দেখে নেও।’
‘সরুন সামনে থেকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘তাতে আমার গেঞ্জি ছেঁড়া গেল।’
বিভা দরজার ডান দিকে এগিয়ে গেলে হাত রেখে আঁটকে দেয় আবির। বাঁ দিক থেকে যাওয়ার সময়ও আবির একই কাজ করে। দু পাশে হাত দিয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
বিভা এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। এমন অহেতুক ফাজলামো তার মোটেও পছন্দ নয়। বলল,
‘এখন কিন্তু বেশি হচ্ছে।’
‘কম হবে, যদি সুন্দর করে স্যরি বলো।’
‘নাহ!’ মুখ ঘুরিয়ে বলে।
‘আমিও নাহ!’ আবিরও উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে।
বিভা কপালে হাত রাখে। আবির বিভার কপি করে কপালে হাত রাখে। আপাতত নিজেকে শান্ত স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। রাগ ফেলে বলে,
‘স্যরি! এবার যেতে দিন।’
‘উঁমম! যাও।’ বলে সরে দাঁড়ায়। বিভা এগিয়ে আসলে আবির পুনরায় দরজার কাছে হাত রাখে। এবার আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না বিভা। হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। আবির আস্তে করে চিৎকার দিয়ে বিভাকে ধরতে যাবে ওমনি ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। আবির দু কদম সরে গিয়ে হাত ঝাড়তে শুরু করে। বিভার পালানো দেখে ফিক করে হেসে দেয়। বিভাকে ছোটখাটো টর্চার করে প্রচণ্ড মজা পাচ্ছে আবির।
______
সাথীর অপারেশন কাল সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন তার কাছে ওর মা এবং ববি রয়েছে। মেনেজার কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছে। গার্মেন্টসের কর্মচারীরাও এসেছিল। ফলমূল দিয়ে গেছে। ববি বেশ খুশি হয় এই ফ্যাক্টরির মালিকের ওপর৷ তাদের জন্যই সাথীর জীবন বেঁচে গেছে। আল্লাহ রহম করেছে। ববি আরো কিছুক্ষণ থেকে ফ্যাক্টরিতে আসে।
কাজ শুরু করার জন্য। পথিমধ্যে আকবর আলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ববির জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল।
‘বেবি শোনো।’
‘ববি!’ বিরক্ত নিয়ে বলে তার নামটি।
‘কি যে করমু কও। খালি ভুইল্লা যাই।’ হেসে বললেন।
‘কিছু বলবেন?’
‘হয়, কইতে তো চাই কত কিছু, তুমি কি হুনবা?’
‘তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘আমি তোমারে প্রথম দিন দেইখা ভালোবাইসা ফালাইছি। বিয়া করতে চাই তোমারে।’
নিমিষেই ববির মেজাজ চড়ে যায়। তবুও নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
‘বাবার বয়সি লোক হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আপনার লজ্জা করেনা।’
‘লজ্জা করব ক্যা? তুমি কি আমার মাইয়া নাকি। ভাইবা দেখো। আমারে বিয়া করলে রাজরানীর মতো থাকবা।’
‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন আমি দেখিনা। সেখানে রাজরানীর হবার কথা দূর থাক। আর আপনি কীভাবে ভেবে নিলেন আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হবো। সাফসাফ বলে দিচ্ছি, পরর্বতীতে আমাকে বিয়ের কথা বললে পরিণতি ভালো হবে না।’ বলে ববি দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আকবর আলি ববির যাওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় ক্রোধ চোখে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘পরিণত তোমার ভালো হইবো না, দেইখা নিও বেবি।’
_________________
পড়া শেষে বিভাকে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ফিরতে হয়। কারণ হাতে টাকা নেই। বাহিরে বেশ ঠান্ডা। রৌদের তাপমাত্রা এতটাও প্রখর নয়। লোকজনও তেমন নেই বললেই চলে। ধীরেধীরে হেঁটে চলেছে সে। আবিরের সঙ্গে তখনকার ঘটনার কথা ভেবে ক্ষুব্ধ রাগ জমাট বাঁধে মনে। কেন জানি আবিরকে সে মেনে নিতে পারছে না। সব কিছুতেই তার বাড়াবাড়ি একদম সহ্য হয় না তার। হঠাৎ মাঝপথে বিভার সামনে একটি বাইক এসে থামে। চকিতে তাকায় বিভা। সঙ্গে তীব্র পারফিউমের সুগন্ধ ভেবে আসে। হেলমেট সরানোর পর চেহারা নজরে আসে। আবির! বিভা ইগনোর করে চলে যেতে চাইলে আবির বলে,
‘হেই ব্রাইট কুইন চলো বাসায় নামিয়ে দেই।’
‘দরকার নেই।’ কপট রাগ নিয়ে বলে।
‘হোয়াই ব্রাইট কুইন?’
বিভা আবিরের পানে তাকায়। প্রথম দিনের ঘটনা তার মনে পড়ে। একটু দম নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি জানি না প্রথম দিনের জন্য আপনি আমার উপর এখনো রেগে আছেন কি-না। তবে সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত! আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। রাগের বশে বলে ফেলেছি। আমার সেই ভুলটি যদি আপনি ধরে রাখেন। এবং ভবিষ্যতে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার চিন্তাভাবনা করেন, আমি বাঁধা দিবো না। এমনটাই হয়ে আসছে। গল্পে, নাটকে, মুভিতে এবং-কি বাস্তবেও। আমি গরীব ঘরের মেয়ে। গরীবদের শুধু বড়োলোক হবার স্বপ্ন থাকে না, বড়ো কিছু হবারও স্বপ্ন তারা দেখে। বড়ো বোন পরিশ্রমের উপার্জিত টাকা ব্যয় করে আমাকে পড়াশোনা করাচ্ছে। তার স্বপ্ন আমি বড়ো কিছু হবো। আমি চাইনা সেই স্বপ্নটা মাঝ পথে কোনো কারণে ভেঙে যাক। আমাকে মাফ করবেন। আমি এটাও চাইনা আমাদের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব থাকুক। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। স্যরি।’ কথা গুলো শেষ করে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। নিজের গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করে।
.
.
.
#চলবে?
Sumaiya Moni
#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৫
#সুমাইয়া মনি।
আবির নিজের কক্ষে শুয়ে অন্যমনস্ক হয়ে টেনিস বল দিয়ে খেলছে। বার বার বলটি দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ফিরে আসার পর ক্যাচ ধরছে। তার ভাবনার সাগর জুড়ে বিভার বসবাস। বিভার পুরো কথা শুনে নিরুত্তর থেকে যায় আবির। যাওয়ার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। রাগ, জেদ্দ কাজ করেছে মনে। ক্যাম্পাসের সামনে তাকে এভাবে অপমানসূচক কথা বলায় ফলে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নতুনে বিভার সঙ্গে সেধে কথা বলেছে। ভেবেছিল ভালোবাসা নয়তো বন্ধুত্বের জালে ফেলবে ওঁকে। কিন্তু বিভা তার ভাবনার উর্ধ্বে ছিল। সহজ ভাবে ক্ষমা চেয়েছে। অথচ ভুল তার ছিলই না। সেই মুহূর্তটায় বিভার প্রতি চুম্বকের মতো আকর্ষন করেছিল তাকে। সাদামাটা ভাবে চলতে বিভা পছন্দ করে। তার এই স্বভাব সবার কাছে ঘৃণামিশ্রিত হলেও, তার কাছে ভালো লাগে। বল হাতে নিয়েই উঠে বসে আবির। এক মুহূর্তের জন্য নিজের উপরই অবাক হয়। বিভার কথা ভাবছে সে। অদ্ভুত বিষয়! আর ভাবতে পারে না। বল ফেলে রেখে বাহিরে বেরিয়ে যায়।
___
আজ বেতন দিয়েছে। তাই বাজার করতে এসেছে ববি। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ধীরেধীরে ঠান্ডা বাড়ছে। শুক্রবার বেতন দিলে হয়তো সুবিধা হতো। আবার ভাবে তাদের ঘরে তো ফ্রিজ নেই। তাই সল্প কিছু বাজার করে বাড়ির পথে হাঁটছে। মাঝ রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ আফিনের গাড়ির মুখোমুখি এসে যায় ববি। আফিন দ্রুত ব্রেক কষে।
ববি ভয়তে থমথমে খেয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়।
আফিন সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসে। রীতিমতো এই ঘটনা কিছু লোকের নজরে পড়েছে, তারা এগিয়ে আসে।
‘আপনার কোথাও লাগে নি তো।’ আফিনের গলা শুনে ববি চোখ খুলে। নিজের দিকে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
‘ঠি..ঠিক আছি।’
‘আই’ম স্যরি।’ অপরাধসূচক কণ্ঠে বলল।
‘নাহ! ভুলটা আমার ছিল। আমিই রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলাম।’
তাদের দু’জনার কথপোকথন শুনে যারা এগিয়ে এসেছিল তারা ফিরে যায়। আফিন বলে,
‘গাড়িতে উঠুন আমি আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।’
‘দরকার হবে না। আমি চলে যাব।’
‘না গেলে মনে করব আপনি আমার ওপর রেগে আছেন।’
আফিনের পানে তাকায় ববি। এমন বিনয়ীকন্ঠে বলা কথাটি শুনে ববি কিছু বলতে পারে না। মন না চাইতেও উঠতে হবে ভাবে সে। বলে,
‘আচ্ছা চলুন।’
আফিন খুশি হয়ে দরজা খুলে দেয়। উঠে বসে ববি। গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে তাদের মাঝে। তারপর আফিন নিজে থেকেই ববির নাম জিজ্ঞেস করে। উত্তরে ববি নিজের নাম বলে আফিনের নামও জিজ্ঞেস করে।
‘আফিন আহমেদ।’
নামটা শুনে ববির চেনাচেনা লাগে। কৌতূহল মিটাতে জিজ্ঞেস করে,
‘বিভার প্রাইভেট চিটার আপনি?’
‘আপনি বিভাকে চিনেন নাকি?’ অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে আফিন।
‘বিভা আমার ছোট বোন।’
‘মানে আপনারা আপন দুই বোন?’
‘জি।’
‘কি ভাগ্য আমার।’ মৃদু হেসে বলে।
‘খারাপ ভাগ্য তাই তো।’
‘নাহ! তেমন কিছু না। আসলে আমি বলতে চাইছি আমার নাম না বললে হয়তো আমাকে চিনতে পারতেন না।’
‘সেটা ঠিক।’
‘আপনি কি কাজ করেন?’
‘হ্যাঁ!’
‘কোথায়?’
‘গার্মেন্টে।’
‘ওহ! সেখান থেকে বাজার করে ফিরছেন বুঝি?’
‘হুম, আপনি কি আমাকে খারাপ মনে করছেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘আসলে গার্মেন্টে চাকরি করা ছেলে-মেয়েরা নাকি ভালো না।’
‘নিজের বুকে হাত রেখে জিজ্ঞেস করুন আপনি খারাপ নাকি ভালো।’
ববি সরল চোখে তাকায় আফিনের দিকে। আফিন ড্রাইভ করা অবস্থা আবার বলে,
‘কি জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘নাহ!’
‘আচ্ছা, নিজে তো জানেন কতটুকু ভালে বা খারাপ সত্তা লুকিয়ে আছের আপনার মাঝে। কী জানেন না?’
‘জানি।’
‘ব্যস! ভরসা রাখতে শিখুন। মানুষের মধ্যে ভালো, খারাপ গুন মিশ্রিত। তবে অনেকের ধারণা গার্মেন্টের মেয়েরা নাকি খারাপ। তাতের চরিত্র ভালো না। যারা এই বিষয়টি ভাবে তারা কতটুকু ভালো একবারও বলতে পারবে বা প্রমাণ দিতে পারবে? পারবে না। অহেতুক কেন একটি মানুষকে খারাপ বলে গন্য করব। অথচ আদৌও সে খারাপ কি-না আমরা তা জানি না।’
আফিনের প্রতিটা কথার লাইন ববির হৃদয়ে স্পর্শ করে। খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা দিয়েছে সে। বেশিদূর পড়াশোনা না করার দরুন গার্মেন্টে চাকরি করতে হচ্ছে তাকে। অনেকের মুখেই কটু বাক্য শুনতে হয়েছে, শুধু মাত্র গার্মেন্টে চাকরি করে বলে। কিন্তু আজ আফিনের মুখে গার্মেন্টের মেয়েদের প্রতি সম্মান দেখে ভরসা পায়, আশ্বাস পেয়েছে কথায়।
‘কোনো কাজ ছোট নয়। যাদের মন ছোট, তারা সব কিছুকেই ছোট ও কটু দৃষ্টিতে দেখে। অন্যকে বলার আগে নিজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলান উচিত। তাহলেই সব কিছু সহজ মনে হবে।’ আফিন কথা গুলো বলে ববির দিকে এক নজর তাকায়।
ববির দৃষ্টি নিচু। এভাবে নিরুত্তর দেখে আফিন জিজ্ঞেস করে,
‘একটু বেশি বলে ফেললাম কি। আসলে আমি কথা একটু বেশিই বলি।’
ববি আফিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। আফিনও হাসে। তার সঙ্গে পরিচয় না হলে বুঝতেই পারতো না আফিন এতটা সভ্য, মার্জিত লোক।
__________
পরেরদিন কলেজে গিয়ে আবিরকে এভয়েড করা শুরু করে বিভা। আবিরের প্রতি তার কোনো দূর্বলতা নেই। তবে সে চায় না আবিরের মুখোমুখি হতে। তাদের মধ্যকার রেশারেশিকে কালই ভেঙে দিয়েছে। অনেক আশা নিয়ে কলেজে পড়তে পাঠয়েছে আপু। আবেগ, জেদের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই আশা ভঙ্গ করতে চায় না। আজ মোহনা কলেজে আসে নি। হয়তো ব্রেকআপ হবার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফোনে যোগাযোগ করবে তারও উপায় নেই। টিফিন ক্লাস রুমে বসেই খেয়ে নেয়। ছুটির পর প্রাইভেটে আসে। এসেই বিপত্তি কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আজও নাকি আফিন পড়াতে পারবে না। আপাতত পড়ার দায়িত্ব আবিরকে দেওয়া হয়েছে। শুনে দাঁত কিড়মিড় করে বসে থাকে বিভা। না কিছু বলতে পারছে, না সইতে। আবির রুমে প্রবেশ করেই বিভার দিকে নজর ফেলে মৃদু হাসে। বিভা ভেবেছিল সেও আবিরের ওপর প্রতিশোধ নিবে। পরপরই সেটা চাপা দিয়ে দেয়। পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এসব চিন্তাভাবনা।
আবির অসভ্যতার সাথে চেয়ারে বসে পা উঠিয়ে। দেখেই বিভার মেজাজ চওড়া হয়ে যায়। এ ছেলে বড়ো হয়েছে ঠিকিই, কিন্তু তার মধ্যে আদবকায়দার তুমুল অভাব। অঙ্ক বই হাতে নেয়। মনে হচ্ছে আজ অঙ্ক করাবে। সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। মুখে মৃদু হাসি রেখে টেনে বিভার নাম ধরে ডাকে।
‘বিভাআআআ।’
বিভা কান্না ফেইস বানিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘বলুন।’
‘বোর্ডে অঙ্কটা একটু লিখে দিয়ে যাও।’
‘এটা তো স্যারদের কাজ। আপনি কেন লিখেছেন না?’
‘হাতে জং ধরেছে তাই। আসো!’ কিছুটা ধমকের গলায় বলে।
ধমক শুনে বিভাকে যেতে হয়৷ কালো সাইনপেন নিয়ে হোয়াইট বোর্ডে অঙ্কটা তুলতে শুরু করে। আর বিড়বিড় করে যত প্রকার গালাগালি আছে আবিরকে দিতে থাকে। বিভার রাগী আদল দেখে আবির মজা পায়। লেখা শেষ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘লিখেছি।’
‘এবার বুঝাও। কীভাবে কি লিখেছো।’
মুখ ঘুচে আসে বিভার। বলে,
‘আপনি কি করবেন?’
‘আমি দেখবো ঠিক মতো বুঝিয়েছো কি-না।’
বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘ঠেঙ্গা।’
বিভা বুঝাতে আরম্ভ করে। সবাই বিভার অঙ্কটি খাতায় লিখছে। আবির বিভাকে দেখতে ব্যস্ত। মন না চাইতেও নজর সরিয়ে নিতে পারছে না। আটকে গেছে কোন মায়া মুগ্ধতার মাঝে জানা নেই তার। তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে কখন যে বিভা ওর সামনে এসে ওঁকে ডাকছে টেরও পাচ্ছে না।
‘শুনছেন? শুনছেন…’ লাস্টের ডাকটি এক প্রকার চিল্লিয়ে দেয় বিভা৷ আবির হকচকিয়ে উঠে। সকলে হেসে দেয়। আবির বিব্রত বোধ করে। বিভা নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনতে আবির বলে,
‘শেষ বুঝানো?’
‘হ্যাঁ!’
আবির বিভাকে সিটে গিয়ে বসতে বলে। বিভা চলে যায়।
আবির বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আজকের মতো ছুটি। আমার ভালো লাগছে না, আর পড়াতে পারব না।’
সকলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বিভা মনে মনে স্বস্তি পায় তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়ার জন্য। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে আবির বিভাকে ডেকে থামিয়ে দেয়,
‘বিভা শোনো।’
বিভা চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। পিছনে ঘুরে বলে,
‘আবার কি?’
‘কথা ছিল।’
‘এক মিনিট। আমি একটু আসছি।’ বলে স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে যায় বিভা। আবির টেবিলের উপর হাতে ভর রেখে দাঁড়ায়। হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবুও অপেক্ষা করতে প্রস্তুত সে। বিভা রুম থেকে বেরিয়ে দুই তিন কদম এগিয়ে গিয়ে বো দৌঁড় দেয়। বাকি রা বিভার এভাবে দৌঁড়ানোর কারণ বুঝতে পারে না। বিভা এক দৌঁড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে শালীনতা বজায় রেখে হাঁটতে আরম্ভ করে। মূলত সে চাইছে না আবিরের কথা শুনতে। তাই এভাবে পালিয়ে এসেছে। এদিকে আবির বসে থাকে। এখনো বিভাকে না আসতে দেখে বিরক্ত হয়। রুম থেকে বের হয়ে হল রুমে খুঁজে। দেখতে পায় না বিভাকে। বাহিরে বের হয়ে সেখানেও দেখে না৷ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হেসে ফেলে। বিভা যে ওঁকে বোকা বানিয়ে পালিয়েছে সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না তার। চোখের উপর আঙুল রেখে হাসতে থাকে।
.
.
#চলবে?
#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৬
#সুমাইয়া মনি।
ইগনোর কত প্রকার। ও কী কী? সেটা আবির এই তিনদিনে ঠিক বুঝতে পেরেছে। বিভা ওঁকে ইগনোর করছে। শুধু ইগনোর নয় কঁড়া ভাবে ইগনোর করছে। কথা বলতে আসলেই উল্টোদিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। যেটা দেখে আবির প্রচণ্ড ক্ষেপেছে। বিভার এতটা ইগনোর করার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আগের মতো ক্যান্টিনেও আসে না। লাইব্রেরীতে যায় না। মাঠেও বসতে দেখা যায় না। হঠাৎ এমন পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলছে আবিরকে। আবির জামিলা, মারুফ, সামিম দের সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে রয়েছে।
‘এমন চুপ করে আছিস কেন আবির? তুই কি সত্যি বিভার প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?’ জামিলা প্রশ্ন করে।
‘জানি না। আপাতত বিভাকে সামনে চাই। ওর এমন ইগনোর আমি মেনে নিতে পরছি না। ভীষণ পীড়া দিচ্ছে।’ রেগেমেগে বলে উঠল আবির।
‘কাম সারছে। আবির বিভাকে ভালোবাসে কনফার্ম।’
আবির সামিমের কথায় পাত্তা না দিয়ে জামিলাকে রিকুয়েস্ট করে বলল,
‘জামিলা বোইন আমার, তুই একটু বিভার সঙ্গে দেখা করিয়ে দে আমায়।’
‘আরে বাপরে! কত ভালো ব্যবহার। কেন রে তুই তো ক্লাসরুমে গিয়েও কথা বলতে পারিস ওর সঙ্গে।’
‘নাহ! সেখানে আরো স্টুডেন্ট রয়েছে। তাদের সামনে ও যদি আমার সঙ্গে কথা না বলে ইগনোর করে তখন প্রচণ্ড রাগ হবে। যদি সিনক্রিয়েট করে বসি, বুঝতে পারছিস আমার কথা।’
‘বুঝালাম। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। ঐটুকু একটা আনস্মার্ট মেয়ের জন্য তুই এত পাগলামি করছিস। হাউ ফানি ফানি..’ জামিলা ভাব নিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ! জামিলা ঠিক বলেছে। সেখানে কলেজের অনেক মেয়েই তোর উপর ক্রাস। বাহিরেও আছে। আর তুই সেখানে বিভার জন্য… ‘ বলে সামিম থামে। বাকি কথা মারুফ বলে,
‘আমার তো লজ্জা হয় তোর জন্য আবির।’
বন্ধুদের এরূপ লাগামহীন কথা কর্ণপাত হতেই আবির ভীষণ রেগে যায়। টেবিলের উপর মুঠোবন্দী হাত দিয়ে সজোরে ভারি মেরে ‘সেট-আপ’ বলার ফলে ভয়তে কেঁপে উঠলো ওরা সহ আরো কিছু স্টুডেন্ট। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে আবিরের। কিছু স্টুডেন্ট ক্যান্টিন থেকে প্রস্থান করেছে এই ভয়ে রেগে আবির চেয়ার না উড়িয়ে মারে তাদের গায়ে।
‘তুই বিভার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবি কি-না?’ ধমক দিয়ে বলে আবির।
জামিলা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
‘চেষ্টা করব।’
‘চেষ্টা নয় দেখা করিয়ে দিতে হবে ব্যস!’
‘এর আগের বারও তো আমি ওঁকে ডাকতে গিয়েছিলাম
বিভা কি এসেছিল? আসেনি।’
আবির সামিমের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায়। সামিম কিছুটা ধমে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলে না। আবির আবার বলে,
‘ছুটির পর ওঁকে লাইব্রেরীতে নিয়ে আসবি। না করলে কথা শুনবি না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসবি। আর সামিম, মারুফ লাইব্রেরীতে গিয়ে বাকি স্টুডেন্টদের বের করে দিবি। বলবি আজ লাইব্রেরী বন্ধ, যাহ!’
‘আচ্ছা।’
ছুটির পর জামিলা বিভাকে কথা শোনার বাহানায় লাইব্রেরীতে নিয়ে আসে। আগে থেকেই আবির সেখানে উপস্থিত ছিল। ওঁকে দেখেই জামিলার লাইব্রেরী আনার কারণ বুঝে যায়। বেরিয়ে যেতে নিলে আবির খপ করে বিভার হাত ধরে ফেলে। জামিলাকে ইশারায় মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বলে। জামিলা মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বিভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আবির কন্ঠে ক্রোধ নিয়ে বলল,
‘বেশি জবরদস্তি কোরো না, হাতে ব্যথা পাবে।’
‘আমার হাত ছাড়ুন, কি অসভ্যতামী শুরু করেছেন।’
‘আমায় ইগনোর কেন করছো?’
‘ইগনোর করার মতো সম্পর্ক আপনার আমার মধ্যে নেই।’
‘নেই, তবুও তুমি আগে এমন ছিলে না।’
‘ভুল ধারণা। আমি আগেও এমন ছিলাম।’
‘এমন কেন করছো আমার সঙ্গে?’
‘আমি আপনাকে আগেই সব বলে দিয়েছি। আপনার আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরী হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে কলেজে পড়তে এসেছি, শান্তিপূর্ণভাবেই পড়তে চাই।’
‘বিভা আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমাকে ভালো…’
‘থামুন! প্রেম, ভালোবাসা আমাদের মতো গরীবদের জন্য নয়। আর আমি কখনোই রিলেশনে জড়াব না। কথাটা মনে রাখবেন।’
‘বিভা…’ বাকিটা বলার আগেই হাত ছাড়িয়ে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আবির ফের বিভার হাত ধরতে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিভার ওড়না আবিরের হাতে লেগে কাঁধ থেকে সরে যায়। আবির সেটা খেয়াল করে দ্রুত ওড়না ছেড়ে দিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। প্রচণ্ড রেগে যায় বিভা। কাঁধে ওড়না উঠিয়ে পিছনে ফিরে সজোরে আবিরের গালে চড় মারে।
আবির ঘাড় ডান দিকে কাত করে রাখে। বিভার দিকে নজর ফেরানোর স্পর্ধা তার নেই। সে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ভুলের শিকার হয়েছে। সেটা বিভাকে কীভাবে বোঝাবে। কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল,
‘স্যরি, বিভা। আমি ইচ্ছে করে…’
বিভা অবশিষ্ট কথা বলতে না দিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠে,
‘চুপ করুন! সাফাই গাওয়ার দরকার নেই। আপনার মতো বড়োলোক ঘরের ছেলেরা ভালোবাসা তো দূর, প্রেমিকাকে সম্মানটুকু করার ক্ষমতা রাখে না।’
আবির বিভার কথা শুনে ডাম হাত মুঠোবন্দী করে নেয়।
বিভা হাত জোর করে বলে,
‘দয়া করে, আজকের পর থেকে আমার থেকে দূরে থাকবেন আপনি। যতোটা দূরে থাকলে আমি ভালো থাকবো। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন। থাকতে দিন প্লিজ!’ কথাটা বলে বিভা দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যায়।
আবির ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে চোখ জোড়া হালকা বন্ধ করে নেয়। বিভাকে তার অনুভূতি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। বোঝাতে পারল না তার প্রতি এমন এক অনুভূতি কাজ করে, যেটা তাকে ক্ষণে ক্ষণে তার প্রতি কাবু করে দিচ্ছে। হৃদয়ে এক শূন্য অনুভব হচ্ছে। দরজার দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাইব্রেরী ত্যাগ করে সে।
__________
ববি মেশিন চালানোর এক পর্যায়ে হঠাৎ আফিনের কথা মনে উঠে। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে রয়। তার জীবনে এমন ভাবে উপস্থিত হওয়া পুরুষ ছিল আফিন। যার আচরণে মুগ্ধ হয়েছে ববি। মৃদু হাসি ফুটে ঠোঁটে। আগের ন্যার কাজ শুরু করে। দূর থেকে আকবর আলি ববিকে দেখে জ্বলছে। ক্ষোভ হচ্ছে মনে। এ যাবৎ সে তিনটি বিয়ে করেছে। বিনাকারণে বিয়ের এক বছরের মাথায় তিন বউকে ডিভোর্স দিয়েছে। আপাতত সে সিঙ্গেল। এই জন্য ববিকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ববি রিজেক্ট করার দরুন সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। অপমানের জ্বালা মিটাবেই সে, এই ভেবে চলে যায়। ববির পাশের মেয়েটি বাথরুমে গিয়েছিল। মেয়েটি ফিয়ে আসার পর ববির উদ্দেশ্যে বলল,
‘ববি আফা জানেন, পাশের সিপ্টে আরেকটা মাইয়া সাথীর মতো মাথা ঘুরাইয়া পইড়া গেছে। হেই মাইয়ার নাকি ইপান্টিস(এপান্টিস) নামের একটা রোগ হইছে। তারেও নাকি অপারেশন করাইতে হইবো। এর খরচও নাকি কোম্পানির মালিক বহন করব।’
ববি মেয়েটির কথা শুনে চুপ রয় কিছু সময়৷ পরমুহূর্তে বলে,
‘মেয়েটি এখন কোথায়?’
‘মেডিকেলে নিয়া গেছে।’
‘আচ্ছা।’
‘যাইবেন নি ওরে দেখবার?’
‘হুম, ছুটির পর যাব।’
‘আপনের লগে আমিও যামু নে।’
ববি কিছু বলে না। কাজ করতে আরম্ভ করে। তবে তার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভাবনা এসে জড়ো হয়।
___
বিভা বাড়িতে এসে আবিরকে চড় দেওয়ার মুহূর্তের কথা ভেবে রাগ হয় তার। ঠিক কারণেই সে চড় দিয়েছে বলে মনে করে। ওড়না ধরে টানাটানি কিছুতেই মেনে নিবে না সে। অসভ্যতামীর লিমিট ক্রস করেছে। পছন্দ করলেই কি হাত, ওড়না ধরে টান দিনে? এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। বই পড়া বন্ধ করে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে ববি বিভাকে প্রশ্ন করে বসে,
‘পড়া রেখে এমন কি ভাবছিস বিভা?’
বিভার ভাবনা ফেলে পড়তে পড়তে বলে,
‘কিছু না।’
‘ওহ! তোকে একটা কথা বলা হয়নি।’
বইয়ের থেকে মুখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকায়। বলে,
‘কি কথা আপু?’
‘তোর প্রাইভেট টিচার আফিনের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল।’
‘দেখা হয়েছিল বলতে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বিভা।
ববি দেখা হবার বিষয়টি বলে বিভাকে। কথা শেষ করে বলল,
‘খুব বিনয়ী লোক সে।’
‘প্রচুর ভালো স্যার। একদম সরল-সুন্দরের অধিকারী।’
‘সেটা বুঝতে পেরেছি। জানিস যখন গাড়ি থেকে নামলাম, এলাকার লোকজন আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন আমরা কোনো ক্রাইম করেছি।’
‘ছাড়ো তো। কিছু মানুষের কাজই তো কটু দৃষ্টি ফেলানো।’
‘বিষয়টি বিব্রতকর ছিল রে বিভা।’
‘আরে ভুলে যাও। তুমি একটা কথা জানো আপু? আমার সঙ্গে একটি ছেলের কলেজের প্রথম দিন দেখা হয়েছিল পাঁচশো টাকা নিয়ে, সেই ছেলেটি আফিন স্যারের ছোট ভাই আবির।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ! আপু। আইরিন ম্যামের দু ছেলে আফিন, আবির।’
‘বলিস কি!’কিছুটা অবাক হয়ে।
‘ঠিক বলছি। আইরিন ম্যাম, আফিন স্যার কত ভালো তারা। আর এই আবির একটা আনলিমিটেড ফাজিল পোলা।’ রেগে বলল বিভা৷
‘কেন, কি করেছে?’
‘সে আ…’ বলে বিভা থেমে যায়। সে চায় না আপুকে সব সত্যি বলতে। এড়িয়ে যায়। পুনোরায় বলে,
‘কিছু করে নি। তাকে দেখে বুঝা যায়।’
‘বিভা একটা মানুষকে চিনতে হলে তার সঙ্গে সময় বা বাক্যবিনিময় করতে হবে। মিশতে হবে। ওপর থেকে মানুষকে যাচাই করা বোকামি।’
‘গাঁধি মেয়ে সেটা বুঝবে নাকি।’ বিলকিস বানু কথাটি তেজি কণ্ঠে ছুঁড়ে দিল। এতক্ষণ চুপ থেকে দু মেয়ের কথপোকথন শুনছিল।
‘না আমি তো বুঝি না কিছু। বাচ্চা তো আমি।’ মেকি রাগ নিয়ে বলে বিভা।
‘বাচ্চাই। কাছে আয় ফিটার খাইয়ে দেই।’
মায়ের এরূপ কথায় ববি হাসে। বিভাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘এমন কোরো না মা। শত হলেও আমার ছোট আদরের বোন বলে কথা।’
‘তোমার মা’কে একটু বুঝাও আপু। আমি এখনো ছোট নই।’
‘বলব তো।’ হেসে বলে।
দু মা মেয়ের খুনসুটি চলছে। ববি মজা পাচ্ছে তাদের ঝগড়ায়।
.
.
#চলবে?