বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায় #সূচনা_পর্ব

0
1385

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#সূচনা_পর্ব
#সুমাইয়া মনি

ভরা ক্যাম্পাসের সামনে আবিরের মুখের ওপর পাঁচশো টাকার নোট ছুঁড়ে মারল বিভা। আবিরের বন্ধুসহ বাকিরা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শুধু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বিভা। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিয়ে ডাট দু’টো ভেঙে আবিরের হাতে দিয়ে রেগে চেঁচিয়ে বলল,
‘আমি কলগার্ল না! নেক্সট টাইম কাউকে টাকা দেওয়ার আগে চোখের সানগ্লাস খুলে ভালো করে দেখে নিবেন।”

কথা গুলো বলেই হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো বিভা। এতক্ষণে যাদের নজরে বিষয়টি পড়ে নি তারাও দেখেছে। আবির ভাঙা সানগ্লাসটির দিকে একবার তাকিয়ে ক্রোধ চোখে বিভার যাওয়ার দিকে তাকায়। ততক্ষণে বিভা তার দৃষ্টির সীমানার বাহিরে চলে গেছে।
অপমানে লজ্জায় দাঁতে দাঁত চেপে রাখে আবির। কে এই মেয়ে? কেন এমনটা করল সে জানে না। আগে কখনো এই ক্যাম্পাসে দেখেনি তাকে। আশেপাশের ছাত্রছাত্রীরা কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলা বলি করছে। আবির ভাঙা সানগ্লাস ফেলে ক্লাস রুমে আসে। সঙ্গে ওর বন্ধুরাও ভেতরে আসে। আবিরের ক্ষোভিত চেহারা দেখে আপাতত কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগ্রহ করছে না। রাগ কমলে নিজে থেকে বলবে ভেবে চুপ থাকে তারা।
____
কলেজের সামনে এসে নিবর হয়ে দাঁড়িয়ে রয় বিভা। অনেক মেহনতের পর তার প্রিয় কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে। খুশি যেন ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। ভর্তির কাজ সম্পূর্ণ করে বড়ো বোন ববির সঙ্গে বাড়িতে ফিরছিল বিভা। রিকশার জন্য রাস্তার অপর পাশে অপেক্ষা করছে। পথমধ্যে বাইকের মধ্যে বসা সানগ্লাস পরিধান একটি ছেলে ওর দিকে পাঁচশো টাকার নোট ছুঁড়ে দেয়। বিভা স্তব্ধ, বিস্মিত! সঙ্গে সঙ্গে বাইকটি এগিয়ে কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। পাশের লোকজনকে দেখে বিভা লজ্জা পায়। ববি বিষয়টি খেয়াল করেনি। সে বুঝতে পারছে না রাস্তার মধ্যে এভাবে তাকে টাকা ছুঁড়ে দিয়ে কি বুঝাতে চাইলো, সে একজন কলগার্ল? রাগ হয় তার। হাতে নিয়ে ববিকে একটু দাঁড়াতে বলে কলেজে প্রবেশ করে। মাঝপথেই আবিরকে দেখতে পায় বিভা। টাকা ছুঁড়ে দিয়ে আসে মুখের উপর। সঙ্গে কিছু কঁড়া জবাব।

আবির বাইকে বসা অবস্থায় অন্যমনস্ক হয়ে ফোনে কথা বলছিল। বাইক চালাচ্ছিল ওর বন্ধু মারুফ। তখন একজন মহিলা এসে তার কাছে সাহায্যের জন্য। মারুফকে দাঁড়াতে বলে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে। ততক্ষণে মহিলাটি আরেকজন লোকের কাছে টাকার জন্য হাত পাতে। এর মধ্যেই সেখানে বিভা, ববি এসে দাঁড়ায়। আবির পিছনে না তাকিয়ে টাকা বের করে ছুঁড়ে দেয় বিভার দিকে। হাতের ইশারায় মারুফকে বাইক চালাতে বলে।
আবির ঘটনাটি কাঠিন্যে গলায় বলল তার বন্ধুদের।
‘আমি সেই মহিলাকে টাকা দিয়েছি। তাকে না।” আবির রাগী কন্ঠে বলে।

‘দোস্ত এখানে বড়ো মিস্টেক হইছে। তোরও দোষ না, মেয়োটিরও দোষ না।’ সামিম বলল।

‘আবিরকে সবার সামনে এভাবে অপমান না করলেও হতো। মানে অন্য ভাবেও মেয়েটি বলতে পারতো।’ মাহিন আবিবের কাঁধে হাত রেখে বলল।

‘মেয়েটি তোকে ভুল বুঝেছে। এত রাগ হবার কিছু নেই আবির।’ জামিলা বিনয়ী কন্ঠে বলল।

‘যাই হোক না কেন। মেয়েটি যদি এই কলেজে পড়ে থাকে। তাহলে এই অপমানের জন্য আমি ওর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলব।” ক্ষেপে বলল আবির।

‘সেই পুরান কাহিনি। নতুন কিছু ভাব আবির।’ বিরক্তি নিয়ে বলল মারুফ।

‘মারু আবিরকে উস্কে দিস না হারামি।’ জামিলা আঙুল তুলে বলল।

‘কাজটা ঠিক করেনি মেয়েটি। সুন্দর করে বলতে পারতো।’ আবির বলল।

‘তুইও তো ছুঁড়ে না দিয়ে ভালোভাবে টাকা দিতে পারতি। নিজের দোষ খোঁজ আগে।’ জামিলা জোরে জোরে বলল।

আবির জামিলার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে রুম প্রস্থান করে। পিছন থেকে মারুফ, সামিম ডাকলেও সাড়া দেয় না আবির।
__
রিকশায় বসে ববিকে আবিরের কথা খুলে বলে। ববি রাস্তায় কিছু না বললেও এখন বিভার উদ্দেশ্যে অনেক কিছু বলে।

‘কি দরকার ছিল এমনটা করার বিভা।’ ববি বলল।

‘ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে আমি নই আপু। আমরা গরীব, তাই বলে কি মানুষ না। সে আমাকে কলগার্ল মনে করেছে নাকি।’ রাগী কন্ঠে বলল বিভা।

‘হয়তো ভুল করেছে ছেলেটি। তাই বলে মুখের উপর টাকা ছুঁড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি।’

‘ভুল-টুল আমি বুঝি না আপু।’

‘কাকে বোঝাচ্ছিস ববি। ও যে ত্যাড়া জানিস না।’ বিলকিস বানু কথাটি বলে এগিয়ে এলেন তার মেয়েদের নিকট।

বিভা মা’কে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ববি নরম স্বরে বলল,
‘বিভা বহু কষ্টে তোর পছন্দের কলেজে ভর্তি করিয়েছি। আমরা চাই তুই পড়াশোনা করে বড়ো কিছু হবি। এমন কিছু করিস না, যাতে আমাদের সেই চাইয়াটা অপূরণ রয়ে যায়।’

‘হবো, হবো। মন-প্রাণ খুলে দোয়া করো আপু। আর তোমার মা’কেও একটু বইলো দোয়া করতে।’ আড়চোখে তাকিয়ে বলল বিভা।

‘কেন তোর বলতে লজ্জা লাগে, আমি কি তোর সৎ মা।’ মেকি রাগ নিলে বলল বিলকিস বানু।

‘আমি তোমার মেয়ে নাকি। তোমার মেয়ে তো আপু একাই।’ বলে বিভা বাথরুম ঢুকে যায়।

বিলকিস বানুর বাকি কথা শুনে না।

‘মা শোনো, কিছু টাকা আছে রেখে দেও।’

বিলকিস বানু টাকার দিকে একবার তাকিয়ে ববির উদ্দেশ্যে বলল,
‘আর কত করবি রে মা তুই। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারে হাল একা ধরেছিস। আমাকেও কাজ করতে দিচ্ছিস না। এখন তো বিভা বড়ো কলেজে ভর্তি হয়েছে। একা সামলাতে পারবি না রে। তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।’

‘আপাতত আমার ভবিষ্যৎ বলতে বিভা। এসব কথা রাখো এখন মা। শুনতে ভালো লাগছে না।’

বিলকিস বানু থেমে যায়। মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। স্বামীকে হারানোর পর এখন দুই মেয়েই তার জীবনের অংশ। মাঝে মাঝে ববির কষ্ট গুলো উপলব্ধি করে বুক ভার হয়ে আসে তার। সংসারের জন্য কত খাটে মেয়েটি।
_____
পরেরদিন কলেজের গেটের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয় বিভা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক, বুকে ঈষৎ ভয় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আজ কলেজের প্রথম দিন। সবার অনুভূতি কেমন হয় সে জানে না। তবে তার একদিকে ভয় লাগছে, আবার আনন্দ হচ্ছে। ছোট ছোট কদমে এগিয়ে যায় ভবনের দিকে। ক্যাম্পাসের বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল তখন পিছন থেকে বিভার উদ্দেশ্যে করে একজন বলে,
‘অ্যাই লালু-ব্লু এদিকে আসো।”

বিভা আশেপাশে একবার নজর বুলায়। সেটি দেখে ছেলোটি হেসে পূনরায় বলল,
‘তোমাকেই বলছি আসো।’

ভয়ে ভয়ে বিভা এগিয়ে যায়। ছেলেটি একা নয়। সঙ্গে আরো তিনজন ছেলে আছে। তাদের সে চিনে না। তবে একজন বিভাকে দেখে উঠে যায়। ছেলেটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল,
‘ফার্স্ট ইয়ার না?’
বিভা মাথা ওপর, নিচ দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। পাশে তাকাতেই কিছু ছেলেদের মুরগীর মতো বসে থাকতে দেখে।
আর কিছু মেয়েরা কাগজে কিছু একটা লিখতে ব্যস্ত। বিভা বুঝতে পারে তারা তাদের Rag দিচ্ছে। বিভা এরকম Rag দেওয়ার বিষয় অনেক শুনেছে। ভয়ে অবস্থা খারাপ তার।
ছেলেটি আবার বলে,
‘অভিনয় জানো?’
বিভা মাথা এদিক,সেদিক দুলায়। যার উত্তর না।
‘বোবা নাকি? কথা বলতে পারো না?’
‘না।’
‘না মানে?’
‘অভিনয় জানি না।’
‘না জানলেও অভিনয় করে দেখাতে হবে।’
‘আশ্চর্য! যে যেটা পারে না তাকে দিয়ে সেটা করানো মূল্যহীন।’ কথাটি বলে বিভা ভেতরে ভেতরে জিহ্বায় কামড় বসায়। কিছুতেই জবান বন্ধ রাখতে পারল না।
‘সিনিয়রদের মুখে মুখে তর্ক করছো। মূল্য, অমূল্য বিষয় আমাদের শিখাবে তুমি?’
বিভা না সূচক মাথা নাড়ায়।
‘আমি যখন বলেছি তোমাকে অভিনয় দেখাতেই হবে। এটা সিনিয়রদের নির্দেশ।’
বিভা মেনে নেয়। কারণ সে চায় না সিনিয়রদের সঙ্গে অযথা তর্ক করতে। বলল,
‘কিসের অভিনয় করতে হবে?’
‘আমি বলছি…’ পিছন থেকে একটি তেজী কণ্ঠের স্বর ভেসে আসে। বিভা সহ বাকিরা তাকিয়ে দেখে আবির। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরিধান। কপালে সিল্কি চুলগুলো মৃদু বাতাসে দোলখাচ্ছে। আজও চোখে কালো সানগ্লাস পড়েছিল। আদল জুড়ে বিচরণ করছে এক ফালি জেদ্দ। বিভার চিনতে অসুবিধা হয়না। নজর সরিয়ে নেয়। শুকানো গলায় ঢোক গিলে বিভা। অনুমান করে বুঝতে পারে সে-ও তাদের মতো সিনিয়র হবে। কালকের জন্য প্রতিশোধ সে ঠিক নিবে। আগে যদি জানতো সে তার সিনিয়র হবে, কক্ষণোই টাকা মুখে ছুঁড়ে মারত না, সানগ্লাস ভেঙে দিতো না। ভেবেই ভয়ে মাথা আরো নিচু করে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বিভা।

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here