#বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️,০৪
#লেখনীতে:সারা মেহেক
রাকিবের নিকট হতে ‘ভাবী’ সম্বোধন শুনে হকচকালো সুহানা। তৎক্ষনাৎ রাকিবের ভুল শুধরে বললো,
” আপনি যাকে ভাবছেন, আমি সে নই৷ আপনাদের ভাবী আমার ছোট বোন সাগরিকা। আর আমি সুহানা। ”
সুহানার এহেন কথায় নাজ বাদে প্রত্যেকেই একে অপরের মুখের দিকে চাইলো। আর নাজ যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। তন্ময় খানিক বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” ছোট বোন? সাগরিকা ভাবী আপনার ছোট বোন হয়?”
তন্ময়ের কথার সুরে সুহানা খানিক সংকুচিত হলো। বললো,
” জি। আমার ছোট বোন। ”
এই বলে সে শরবতের ট্রে’টা টেবিলে রেখে বললো,
” আপনারা শরবত খেয়ে গলা ভেজান। আমি আসছি। ”
বলেই সে কোনোপ্রকার বিলম্ব ছাড়া ঘর হতে বেরিয়ে গেলো। সে জানে, রায়হানের মামাতো ভাইয়েরা তাকে সাগরিকা হতে বড় দেখে বেশ অবাকই হয়েছে এবং সে নিশ্চিত, আরো কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করলে এ বিষয়ে তাকে জবাবদিহি করতে হতো। যা সে মোটেও চাইছে না৷ এজন্য সে ভালোয় ভালোয় চলে এসেছে।
এদিকে সুহানার প্রস্থান করা মাত্রই নাজ তন্ময়ের কানের নিকট ফিসফিস করে বললো,
” তুই ওকে সাগরিকা ভাবী ভাবলি কেনো? তখন দেখিসনি ওকে?”
তন্ময় কিঞ্চিৎ বিস্মিত চাহনিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নাজের পানে চেয়ে বললো,
” কখন! আমার সাথে তো উনার দেখা হয়নি। ”
তন্ময়ের কথা নাকচ করে নাজ জোরপূর্বক বললো,
” আরে তখনই তো দেখলি ওকে। ঐ যে, পুকুরপাড়ে যার কাছে ঠিকানা জানলাম সে-ই মেয়েটাই তো এই মেয়ে। ”
” পুকুরপাড়ে মেয়েটার চেহারা বুঝা যাচ্ছিলো না। আমি দেখিনি উনাকে। এবার আর কথা বলিস না প্লিজ। আমাকে একটু শরবতটা খেতে দে। বেশ তৃষ্ণা পেয়েছে। ”
এই বলে তন্ময় একটি গ্লাস উঠিয়ে ঢকঢক করো সবটুকু শরবত পান করে নিলো। নাজ আর তন্ময়ের কথার প্রত্যুত্তর করলো না। কথা না বাড়িয়ে শরবত নিয়ে ধীরেসুস্থে পান করলো।
সুহানার নামটা সবার অজানা থাকলেও নাজের জানা ছিলো। কিন্তু তবুও সে সুহানাকে রায়হানের হবু বউ ভেবে বসেছিলো। কারণ অতি উৎসুকতার ভীড়ে রায়হানের নিকট হতে তার বউয়ের নামই জানা হয়নি তার। শুধুমাত্র বেড়িয়ে যাওয়ার পূর্বে বাড়ির পুরোনো এক কাজের লোকের নিকট হতে ওমর মোল্লার নাম জেনে বেড়িয়ে পড়েছিলো তারা।
মায়ের কথানুসারে সাগরিকা খানিক পরিপাটি হয়ে নাজদের সামনে গেলো। তার হাতে নাস্তার ট্রে। এ পর্যায়ে সুহানা ব্যতিত অন্য মেয়েকে দেখে নাজসহ সকলেই প্রায় নিশ্চিত হলো, এই সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়ে যার সাথে দেখা করার জন্য তারা এতো দূর পাড়ি দিয়েছে। যদিও দু বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। বৃষ্টির কারণে তাদের এ ছোট পথও দীর্ঘ মনে হয়েছে।
সাগরিকা গিয়ে সামনের একটি চেয়ারে বসতেই ঘরে রশিদা বেগমের আগমন ঘটলো। তিনি গিয়েই অতি ভদ্রতার সহিত বললেন,
” এ হইলো আমার মেয়ে সাগরিকা। যার সাথে তোমাগো ভাইয়ের বিয়ের কথা। আমার মেয়ে কিন্তু দেখতে একদম চান্দের টুকরা। আশেপাশের কত গ্রাম থেইকা আমার মেয়ের লাইগা বিয়ের প্রস্তাব আসে! কিন্তু আমরা সব মানা করে দেই। কারণ আমরা চাইতেছিলাম মেয়ের বিয়ে একই গেরামে দিমু। এরপর আসে তোমাগোর ভাইয়ের প্রস্তাব। সে বলে আমার মেয়েরে খুব পছন্দ করে। আর পছন্দ করবোই না বা কেন। আমার মেয়ে দেখতেই যে এত্ত সুন্দর। যে দেখবে সেই পছন্দ করবো। তা বলো, তোমাগোর কাছে কেমন লাগলো সাগরিকা?”
রশিদা বেগমের বিরামহীন বাচনে সাগরিকা ব্যতিত উপস্থিত সকলেই অপ্রতিভ হলো। সকলের অন্তরালে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খেলো,
” রায়হানের হবু শাশুড়ী এতো বা’চা’ল! এ যেনো লাগামহীন ছুটন্ত এক ঘোড়া!”
এদিকে হবু দেবরগণের সম্মুখে মায়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খানিক বিব্রত বোধ করলো সাগরিকা। সাথে মৃদু লজ্জাও পেলো সে। রশিদা বেগম পুনরায় তার বাচন শুনাতে উদ্যত হলেন। কিন্তু এর পূর্বেই সাগরিকা রশিদা বেগমের শাড়ির আঁচল আড়ালে টেনে ফিসফিস করে বললো,
” হয়েছে আম্মা৷ অনেক বলেছো। এবার একটু চুপ করো। ”
রশিদা বেগমের মন চাইছিলো, মেয়ের প্রশংসা, বাড়ির প্রশংসা, হবু জামাইয়ের প্রশংসা শুনিয়ে সকলকে ব্যস্ত রাখতে। কিন্তু মেয়ের নিষেধাজ্ঞায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি নিশ্চুপ বসে রইলেন। অতঃপর নাজ সাগরিকাকে টুকটাক কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। উপস্থিত বাকি তিনজনেও সাগরিকার সাথে কথাবার্তা বললো। কথা শেষে সাগরিকা মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
” আজকে রাতের খাবার আমাদের বাড়িতেই খেয়ে যাবেন কিন্তু। কোনোরকম ‘না’ শুনবো না। আপনারা আমাদের বাড়ির মেহমান৷ আর মেহমানদের ভারী খাবার না খাইয়ে বিদায় করতে নেই। ”
সাগরিকার প্রস্তাব শোনামাত্র পেটুক রাকিব প্রচণ্ড উৎসুকতার সহিত বললো,
” অবশ্যই ভাবী। আজ রাতে এখানেই খাওয়াদাওয়া করবো। আপনি চিন্তা করবেন না। ”
পেটুক রাকিবের কথায় তন্ময়,মিরাজ ও হাবিবের কপাল চাপড়ানোর জোগাড় হয়ে পড়লো। শুধুমাত্র নাজ ব্যতিত। কারণ এ বাড়িতে রাতের খাবার খেতে হবে ভেবেই সে খুশিতে ডগমগ করে উঠেছিলো। কারণ একটাই, ক্ষণে ক্ষণে নানা বাহানায় সুহানাকে দেখা যাবে। তবে তন্ময় চাইছিলো, সন্ধ্যা নামার পূর্বেই এ বাড়ি হতে চলে যেতে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। রাকিবের এরূপ কথার পর আর কোনোভাবেই এ প্রস্তাবে নাকচ করা যায় না। এরূপ করলে ব্যাপারটা ভীষণ বে’য়া’দবির পর্যায়ে পড়বে। ফলে তারা রাতের খাবার এখানেই খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
.
পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে বহু পূর্বে। কিন্তু আজকের সূর্য্যিমামার ডুবন্ত দৃশ্যটি অদৃশ্য রূপে হয়েছে। কারণ বৃষ্টি পরবর্তী অম্বরের গাঢ় মেঘপুঞ্জ সূর্য্যিমামাকে আড়াল করে রেখেছে। যদিও আজকে সকলের আড়ালে সূর্য অস্ত গিয়েছে, কিন্তু অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে সে তার রাঙা রূপের একাংশ পশ্চিমাকাশে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে পশ্চিমাকাশ গাঢ় কমলা, হলদে রঙে রাঙায়িত হয়েছে। ফলে বর্ষণ পরবর্তী বাতাবরণ রঙিন অম্বরের ছোঁয়ায় রাঙায়িত হয়েছে।
চারিপাশে শীতল হাওয়া বইছে। দিনশেষে মুক্ত বিহঙ্গগুলো নিজেদের নীড়ে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছে। নীড়ের পথে ফিরতে ফিরতে কিচিরমিচির ধ্বনিতে সকলকে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। নিকটস্থ মসজিদে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। নামাজের টানে নিকটস্থ মুসুল্লিরা কর্দমাক্ত পথ পেরিয়ে মসজিদে ছুটে আসছে। সেই দৃশ্যই ঘরের ভেতর বসে উপভোগ করছে নাজ। খানিক বাদে ঘরে অবস্থিত খাট হতে উঠে গিয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়ালো সে। বারান্দায় দাঁড়াতেই এক ঝাঁক হিম শীতল হাওয়া এসে তার সর্বাঙ্গ ছুঁইয়ে দিলো। অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলো শহুরে ছোঁয়ায় বেড়ে উঠা তার নাজুক দেহখানা।
বাড়ির চারিধারে অবস্থিত বৃক্ষরাজি নিজেদের পত্রপল্লব হাওয়ায় দোলাতে লাগলো। উৎপন্ন করলো পত্র নৃত্যের এক মধুর ধ্বনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টিজোড়া আশেপাশে ঘোরালো নাজ। বাতাবরণে আঁধার নেমে আসছে। সন্ধ্যা নামক অস্থায়ী সময়টির সূচনা ঘটেছে। তারই সাথে সূচনা ঘটেছে নয়া রূপে ধরণীতে বর্ষণ বর্ষিত করা মেঘপুঞ্জের। দূর গগনে আলোর ঝিলিক দেখা দিলো। নাজের আঁখিজুগলে বাড়ি খেলো মেঘেদের ঘর্ষণের এ আলোকিত রূপ। মুহূর্তেই ধরণী কাঁপিয়ে শব্দ উৎপন্ন করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলো ক্রোধিত মেঘপুঞ্জরা।
কিয়ৎক্ষণের মাঝেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো ধরণীতে৷ মুহূর্তেই চারপাশ ভারী বর্ষণে ছেয়ে গেলো। নাজ লক্ষ্য করলো, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা এ ঘরের টিনের চালে আঘাত হানছে। ফলে তাতে অবিরাম ঝিরিঝিরি ধ্বনি উৎপন্ন হচ্ছে। নাজ কান খাড়া করে মুগ্ধ হয়ে সে ধ্বনি শুনছে। রুদ্ধ নেত্রজুগল দ্বারা চলমান পরিবেশ দৃষ্টির অগোচরে রেখে উৎপন্ন ধ্বনি শুনছে সে। আহা, কি হৃদয় শীতল করা ধ্বনি! বৃষ্টির দিনে টিনের চালে বুঝি এমনই দারুণ ধ্বনির সৃষ্টি হয়! গ্রামীণ বাতাবরণে বর্ষণের পরিবেশ এতোই মনোমুগ্ধকর হয়!
মিনিট পাঁচেক বাদে নেত্রজুগল মেলে চাইলো নাজ। চারপাশ আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। আলোর উৎস বলতে সম্মুখের ঘরের বারান্দায় ও রসুইঘরে উপস্থিত একটি হলদে রঙের বাতি। এই দুটো হলদে বাতির আলোয় বাড়ির ভেতরকার উঠোন আলোকিত হয়ে আছে। সে আলোর ছিঁটেফোঁটা এসে পড়ছে নতুন ঘরেরে বারান্দায়। এ ঘরে এখনও বাতির ব্যবস্থা করা হয়ে উঠেনি। তবে বাড়িতে কুটুম আসার কথা শুনে ওমর মোল্লা মাঠ হতে বাড়ি না ফিরে বাজারে গিয়েছেন বাতিসহ আরো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সদাই করতে।
পরনের প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে পুরোনো ঘরটির পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে নাজ। সে দেখেছে, সুহানা এ ঘরেই প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ সুহানা ঐ ঘরেই থাকে।
রশিদা বেগমকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে ঘর হতে নতুন পাতিল নিয়ে রসুইঘরের দিকে ছুটলো সুহানা। তার কাছে নেই কোনো ছাতা। বাড়ির একটি মাত্র ছাতাটা তার বাবা মাঠে যাওয়ার পূর্বে নিয়ে গিয়েছে। আর দ্বিতীয় ছাতাটি বেশ কদিন ধরেই নষ্ট। ফলে ঘোর বর্ষনেও ছাতা ব্যতিত চলতে হচ্ছে তাকে। এক হাতে পাতিল নিয়ে সেটিই মাথার উপর কোনোভাবে দিয়ে অপর হাত দিয়ে সালোয়ার খানিক উঁচু করে রসুইঘরের দিকে ছুটছে সুহানা। সে দৃশ্যই অপলক দেখে যাচ্ছে নাজ। দু জায়গার হলদে আবছা আলোয় চলন্ত বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও হলদে রঙের মনে হচ্ছে। ওদিকে সুহানা যখন ঘর হতে রসুইঘরের দিকে ছুট দিলো সে মুহূর্তে আবছা হলদে আলোয় বৃষ্টির ফোঁটার সমন্বয়ে সুহানার রহস্যময়ী এক ছায়ার সৃষ্টি হলো। দেখে মনে হলো যেনো, সুহানা ঘোর বর্ষনে রহস্যময়ী এক নিশাচর নারী। যার কণ্ঠের প্রেমে, রূপের প্রেমে নাজকে নিজের সম্মোহনে আবদ্ধ করে নিয়েছে সে।
#চলবে