#বাদামি_চোখ-০৮,০৯
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
০৮
‘আলোর ন্যায় উদ্দাম বেগে কতো মানুষ আসে,
ক্ষনিক থেকেই ওরা আঁধার নামায় হেসে!
দিনক্ষণ পেরিয়ে আবার কেউ আসে বেশ ধীরে,
কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন থাকবে এক নীড়ে! ‘
সত্যি চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী রূপে আগমন ঘটতে দেখাটা ভীষণ সৌভাগ্যের!
আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে কেন জানি নিমিষেই নিজেকে শান্ত করতে সক্ষম হলাম।
ওর একটা হাতে আমার একটা হাত রেখে অন্য হাতে নিজের চোখ মুছে নিলাম। তনয় হেসে বললো,
‘ নিবিতা তুমি ওসব উল্টা পাল্টা মানুষের কাজকর্ম নিয়ে ভেবে একদম বিষন্ন হবেনা। হাসিখুশি থাকবে সর্বদা। আমি তোমার পাশে আছি, বুঝেছো?
বলেই তনয় উঠে যেতে চাইলো,কিন্তু আমি ওকে এক হাতে ধরে রেখেছি। তনয় পেছনে তাকিয়ে হেসে বললো,
‘ কিছু বলবে আর?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তনয় আবার আস্তে করে বসে বললো,
‘ তাহলে ভয় না পেয়ে বলো কি বলবে?
তনয় এতো নির্ভয় দেওয়া সত্ত্বেও আমি ঝিরিঝিরি করে ঘামছিলাম। তনয় রাগ নিয়ে বললো,
‘ কি হলো? আবার এমন চুপসে গেলে যে! আর ফ্যান চলছে তাও ঘামছো কেন?
আমি তনয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। তারপর ধির গলায় বললাম,
‘ আসলে আমার অতীত নিয়ে আপনাকে আরো অনেক আগেই আমার বলা উচিত ছিল। আর চেয়েছিও বলতে কিন্তু সাহস পাইনি। আর আপনিও কখনো জিজ্ঞেস করেন নি যে আমি পূর্বে কাউকে পছন্দ কিংবা ভালোবাসতাম কিনা! কিন্তু আমি সেটা নিয়ে আপনাকে বলতে চাই।
এইটুকু বলতেই তনয় চোখ ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ নিবিতা তোমার অতীত নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল না বলেই জানতে চাইনি। আর আমার মনে হয়না এটা জানা বিয়ের আগে জরুরী কিছু। এখনো তুমি বলতে চাচ্ছো তাও আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না, কেননা আমি জানি আগে যাই হোক এখন তুমি আমাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করছো এবং আমাকে ভালোবাসো!
আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আমারও এটা ভাবতে দ্বিধা হয়নি যে আমার জীবনে আমি সেরা মানুষটাকে পেতে চলেছি। যাকে এসব নিয়ে কিছু বলতে হবেনা। কিন্তু এখন আমি বাধ্য হয়ে বলতে প্রস্তুত হয়েছি। কারণ আমার প্রাক্তন সারাক্ষণ আমার সামনে ঘুরাঘুরি করছে এবং করবে! কখনো এটা হুট করে অতীতকে টান দিবে, আর আপনি তখন হঠাৎ শুনলে আমার প্রতি আপনার বিশ্বাসের দূর্বলতা অনূভব করবেন।
তনয় একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তার মানে কি তুমিই ছিলে লিয়ন ভাইয়ের সেই বাদামি চোখওয়ালি প্রেমিকা?
আমি তনয়ের কথায় কিছুটা চমৎকৃত হলাম, আর বললাম,
‘ তাহলে কি সবকিছুই জানতেন আপনি?
তনয় ইতস্তত গলায় বললো,
‘ হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু তুমি ছিলে তা জানতাম না। উনি আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে আগে বলেছিলো, তনয় জানিস আমার প্রাক্তন প্রেমিকার চোখ বাদামি ছিলো বলে ওকে আমি বিয়ে করিনি। আর তুই তোর হবু বউয়ের বাদামি চোখ দেখে পাগল পাগল হয়ে বিয়ে করছিস!
তখন আমি বলেছিলাম ভাই তোমার পছন্দ আমার পছন্দ সম্পূর্ণ বিপরীত, কিন্তু আমার বউকে কোনোদিন চোখের জন্য অসুন্দর বললে তোমার খবর আছে। তখন উনি হাসছিলেন আর বলছিলেন, নিঃসন্দেহে তোর বউকে অসুন্দর বলার অধিকার আমার এবং কারোর নেই!
তনয় এইটুকু বলার পরক্ষণেই তনয়ের মা দরজার ওপার থেকে বললো,
‘ চল রুমে এসে খেয়ে নে তনয়। আজকের পরে বউয়ের সাথে বসে কথা বলায় কোনো বাঁধা থাকবেনা। আর কিছুক্ষণ মাত্র!
তনয় আমার দিকে তাকিয়ে আবারও আস্বস্ত হওয়ার আহ্বান করলো, আমিও মাথা নেড়ে ওকে সায় দিলাম।
তনয় পেছনে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সেখান থেকে চলে গেলো।
ও চলে যাওয়ার পর পরেই আমি সোজা হয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ হালকা লাগছে ভেতরটা। অবশেষে আমি ওকে সবকিছু খুলে বলতে পারলাম! আমি ভাবিনি এতো সহজে তনয় বিষয়টাকে গ্রহণ করবে।
আর লিয়ন তাহলে সত্যিই আমার চোখকে অপছন্দ করে? তাহলে প্রেম করার সময় এতো ন্যাকা প্রশংসা করছিলো কেন?
মানুষকে আসলে ভেতর থেকে চিনতে যুগ যুগ চলে যাবে,তবুও ছিঁটেফোঁটাও চেনা হবেনা। কতো নির্বোধ ছিলাম আমি, একটুও বুঝতে পারিনি ওকে!
ঘন্টাখানেক পর থেকেই শুরু হলো বিয়ের আমেজ! আমি গোসল করে সাজগোজের প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
এখানকার সবাই-ই তৈরি হচ্ছে ধিরে ধিরে!
আজকে সন্ধ্যার দিকেই আমাকে তনয়দের বাসায় নিয়ে যাবে। তাই যা করার আজ দিনের বেলাতেই।
এদিকে তনয় আমাকে সিম খুলতে মানা করলো। কারণ আমাদের শুভযাত্রায় বাঁধাপ্রদানকারীর মুখখানা সে স্বচক্ষে দেখতে চায়।
ভালোভাবে সবাই তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ করে কাজী আসলো বিয়ে পড়াতে। মেহমানরারা তখনও ভালো করে জমা হয়নি।
এদিকে তনয় আমাকে ফোন করে বললো,
‘ আগে বিয়েটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত থাকবো! আমার আব্বুও আমার সাথে একমত হয়ে বললো বিয়ে যতো তাড়াতাড়ি হবে ততই তো ভালো।
তনয়ের এই সিদ্ধান্তটা আমার স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো।
যে কয়েকজন ইতোমধ্যে সেখানে ছিল তাদের নিয়েই আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। লিয়নের বাবা শুধু এখানে উপস্থিত ছিলেন, আর লিয়ন তার বউ এবং মাকে নিয়ে পার্লারে গেছে। তারও হয়তো বাইরে কোনো কাজ আছে।
তবে যাই হোক আড়াল থেকে যেই আগন্তুক আমাদের নতুন জীবনে বাঁধা হচ্ছে তার সাথে সম্পৃক্ত কেউ তাহলে বিষয়টা জানেনি। কেননা এখনো আমার ফোনে এমন কোনো কল আসেনি!
আমি একদম ফ্রেশ আর স্বচ্ছ মনে সাজার জন্য বসে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা বিয়েটা এতো ঝামেলাবিহীন হয়ে গেছে! এতক্ষণ খুব বেশি ভয় পাচ্ছিলাম আমি। যাক এখন দেখি কে কি করতে পারে?
মুখের সাজসজ্জা শেষ, অতঃপর যখন শাড়ী পরানো হচ্ছিলো তখনি সেই নাম্বার থেকে কল আসলো!
আমি এইবার সাহসিকতার সাথে ফোন রিসিভ করে বললাম,
‘ এখন নিশ্চয়ই আপনি মেয়ে! আমি রিসিভ করলেই তো মেয়ে হয়ে যান, আর আমার স্বামী রিসিভ করলে হয়ে যান ছেলে। আপনি কি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ?
আমি কথাটা বলতেই ওপাশ থেকে এখন একটা রাগান্বিত ছেলে কণ্ঠে আওয়াজ আসলো, যে রেগে বলছে..
‘ এই খুব বাড় বেড়েছিস না? তোর বিয়েটা হলেই তবে ওই ছেলেকে স্বামী দাবী করিস। বিয়েটা হতে দিলে তো আমি! আমাকে তুই কি যেন বললি? তৃতীয় লিঙ্গ? মনে রাখিস কথাটা।
বলেই ফোন কেটে দিলো। আমাকে শাড়ী পরাতে থাকাটা মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো আমি ফোন কেটে অযথা হাহাহা করে হাসছি। সে অপরপ্রান্তের কথা শুনেনি বলে হয়তো আমার হাসির কারণ আঁচ করতে পারছেনা। নইলে সে নিজেও হাসতো কেননা সেও জানে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক্ষণ আগেই ! আমাকে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুমকি এখন শুধুই হাস্যরসাত্মক কথোপকথন!
এদিকে শাড়ী পরানোর সময়ই আমি ফোনের ভয়েজ রেকর্ডটা তনয়ের কাছে সেন্ট করে একসাথে অনেকগুলো হাসির ইমোজি দিলাম।
তনয়ও সেখানে হাহা দিয়ে রিপ্লে দিলো,
‘ আচ্ছা আচ্ছা আমিও চাচ্ছি সে সামনে আসুক, আর বিয়ে ভেঙে দেখাক!
কিছুক্ষণ পেরুতেই আস্তে আস্তে মেহমানদের আগমন দেখতে পেলাম। বর ছাড়াই বরযাত্রী একে একে আসছে। আর বর তো আগে থেকেই এখানে।
আমার ভাবিও আজকে অনেক সেজেছে।
সবাইকেই এখন অনেকবেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।
ভাবি ভাইয়াকে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে আমাকে এসে বললো,
‘ নিবিতা এবার আসো বাইরে সবকিছু একদম ঠিকঠাক। ক্যামেরা নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জুতো পায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর ভাবির হাত ধরে আস্তে আস্তে দরজা খুললাম। দরজা খুলে প্রথমেই দেখলাম লিয়নের বউকে! দেখেই মেজাজটা চরম বিষাদ হলো।
কোনো কারণ ছাড়াই সবকিছুর জন্য বারবার ওকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ওর সাথে কয়েকটা ছেলেপেলেকে সারাক্ষণ ঘুরাঘুরি করতে দেখি। কাল অসমাপ্ত অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসার সময় ওকে দেখেই আমি থমকে গিয়েছিলাম। কারণ তার সাথে কয়েকটা মেয়েও আছে, আবার ছেলেও।
কিন্তু কোনো রকম গানের আওয়াজ না পাওয়াতে আমার সন্দেহ ভেস্তে গিয়েছে,তবুও ওকে দেখলে সন্দেহের মোড় ঘুরাতে পারিনা।
কিন্তু ভেবে পাইনা যদি সে হয় তাহলে কেনই বা সে বিয়েতে বাঁধা হবে? তার সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক নেই, তার উপর সে বিবাহিতা!
তার নিজের সংসার আছে, সে এখন কিসের জন্য অন্যের সংসার ভাঙতে চাইবে?
আবার যদি সে না হয় তাহলে কে যে এটা করছে কিংবা করার চেষ্টা চালাচ্ছে?
দেখি আজকে কিছু করতে এলেই বুঝতে পারবো।
সেখান থেকে ভিডিওম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী বের হলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম তনয় বরবেশে উপস্থিত! তার সাথে আরেকটা বিরক্তিকর মুখ! আচ্ছা সে কি কিছু করছে? লিয়ন!
কিন্তু মেয়ে কণ্ঠস্বর আবার অচেনা ছেলের কণ্ঠস্বর এসব কোথা থেকে? আর লিয়ন আমার চোখকে পছন্দ করেনা সেটা শুধু আমাকে নয় তনয়কেও বলেছে। কিন্তু সেদিন রেস্টুরেন্টে আবেগময়ী চিঠিটা কেন লিখেছিলো?
সে সেখানে স্পষ্ট বুঝাতে চেয়ে সে সুখে নেই, আর আমাকেই সে এখন তার যোগ্য মনে করে। কিন্তু তবুও পরবর্তীতে তনয়কে বলেছে বাদামি চোখের জন্য সে তার প্রাক্তনকে বিয়ে করেনি। তাহলে তার কথার কোনো ঠিক নেই? আর এখন কি লিয়ন এখানে কিছু করতে পারে? কিন্তু কেন করবে সেটাই তো আমার মাথায় আসছেনা!
এদিকে আবার শুরু হয়েছে অতিরিক্ত আলোর মধ্যে সবার কথা শুনে শুনে নিজেদের অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করা! সবাই আসছে আমাদের সাথে ভিডিও এবং ছবিতে যুক্ত হচ্ছে।
কাল রাতে লিয়ন না আসলেও আজকে সে নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে। স্টেজে উঠে সে এসে আমার পাশে দাঁড়াতেই তনয় ওকে একটানে ওর দিকে নিয়ে বললো,
‘ আরে ওপাশে যাচ্ছো কেন ভাই? আমার পাশে থাকো। আমার বউয়ের বাদামি চোখে তুমি তাকাবে না একদম। কেননা সেটা তোমার অপছন্দ! আর আমিও চাইনা আমার বউয়ের দিকে কেউ অপছন্দের নজরে তাকাক!
লিয়ন তনয়ের এমন কথার জবাবে মুখ ত্যাড়া করে বললো,
‘ এখনো বিয়ে হয়নি আর এতো বউ বউ করছিস!
তনয় এবার লিয়নকে সামনে লক্ষ্য করার ইশারা করে আওয়াজ করে হেসে উঠলো।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
#বাদামি_চোখ [০৯]
তনয়ের অট্টহাসিতে লিয়ন তার চেহেরাটা ভাঁজ করে পুরো হুতুম পেঁচা বানিয়ে ফেললো। আওয়াজ করে কথা বলার ধাঁচ আসলেও লিয়ন নিজেকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে আস্তে আস্তে বললো,
‘ তনয় এখানে হাসির কি আছে হ্যাঁ ? তোদের বিয়ে কিছুক্ষণ পরে হয়ে যাবে আর এখন কেন আমি বউ ডাকাকে তাচ্ছিল্য করেছি, সেইজন্যই হাসছিস তো? আরে কবুল বলার আগ সময়েও মানুষের বিয়ে ভেঙে যায়! তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না বউ হচ্ছে ততক্ষণ বউ বলা থেকে বিরত থাক!
তনয় এবার লিয়নের কথায় হাসির তীব্রতা আরো বাড়িয়ে ফেললো, সে হাসতে হাসতে নুয়ে যাচ্ছে প্রায়।
তখনি সামনে থেকে আওয়াজ আসলো,
‘ রাগারাগি, হাসাহাসির ফটো এবং ভিডিও তো তুললাম, এবার আপনারা একটু সোজা হয়ে তাকাবেন প্লিজ?
এটা শুনতেই লিয়ন তনয়ের হাসির উপর চরম বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালো আর একটু স্বাভাবিক হয়ে হাসার চেষ্টা করলো। তবে লিয়নের বুঝতে হয়তো অসুবিধা হয়নি যে তনয় তার সাথে অন্য সময়ের মতো আচরণ করছেনা।
এদিকে এখনো লিয়ন তনয়ের হাসির কারণটা বুঝতে পারেনি! কারণ এখনো তার কানে এই খবর পৌঁছায়নি যে আমাদের অনেক্ষণ আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।
এদিকে কুঁচকানো চেহেরাটাকে কোনোভাবেই ঠিক জায়গায় নিতে পারলোনা লিয়ন। তনয়ের উপর বেশ রেগে আছে সে! আর কোনো রকম কয়েকটা ছবি তুলে সেখান থেকে নেমে পড়লো।
লিয়ন চলে যাওয়ার পরেই আমি আস্তে আস্তে তনয়ের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘ কিছু বুঝলেন উনার কথায়?
তনয় সম্মুখের ধরণ ঠিক রেখেই জবাব দিলো,
‘ আরো কিছু সময় যেতে দাও, এটার দ্বারাও কিছু বুঝা সম্ভব না। হতে পারে উনি আমার হাসিতে বিরক্ত হয়ে এটা বলেছেন! একটু অপেক্ষা করে দেখি বিয়েটা কে আর কীভাবে ভাঙতে আসে!
আমি মুচকি হেসে তনয়ের কথাতেই সায় দিলাম। লিয়ন সেখান থেকে নেমে একটা চেয়ারে বসে নিজের ফোনটা বের করে সেটার দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালালো। এদিকে তার বউয়ের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তার বউও নিজের মতো করে যার সাথে ইচ্ছে কথা বলছে, ফূর্তি করছে। ওরা দুজন যে সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী হয় এই অনুষ্ঠানে একবারের জন্যও কারো মনে হয়নি বোধহয়। কেননা তারা একে অপরের কাছাকাছি একদমই যায়না।
এদিকে কেউ খাচ্ছে,হাঁটছে,বসছে, ছবি তুলছে,আসছে,যাচ্ছে।
কিন্তু আড়াল থেকে আমাদেরকে আলাদা করে দিতে চাওয়া আগন্তুকের দেখা এখনো মিলছেনা।
এমনকি আমি আমার ফোনটাকে পাশেই রেখেছি যাতে কিছু বুঝতে পারি।
তখন বেলা প্রায় দুইটা!
তনয়দের বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে সে হন্তদন্ত হয়ে আমার বরাবর এসেই আমাকে ইশারা করলো। তার হাতে কিছু একটা রয়েছে।
আমি মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
‘ কিছু বলতে চাও?
তখন সে আরেকটু এগিয়ে বললো,
‘ একটা হ্যান্ডসাম ভাইয়া এটা আপনার হাতে দিতে বলছে।
বলেই সে আরেকটু উঠে আমার হাতে দিয়ে বললো,
‘ অনন্য গিফট সামগ্রীর সাথে রাখতে মানা করেছে আর বলছে এখনি দেখতে।
বলেই সে সেখান থেকে চলে গেলো।
আমি তনয়ের হাতে এটা দিয়ে খোলার ইশারা করলাম।
তনয় এটাকে খুলে দেখলো ভেতরে একটা ম্যাগাজিন শুধু! এটা দেখে আমি একটু অবাক হয়ে ভাবলাম গুরুতর কিছু না আবার এটা আমাদের কাছে আলাদা করে দিতে বলার কারণ কি?
তবুও আমি টেনে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টালাম। আর ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠাতেই আমার চোখ আটকে গেলো, আমার বহু আগেরকার একটা লেখা এখানে চাপানো। তখন আমি বেশ কয়েকটা কবিতা লিখেছিলাম, যেখানে ছিল প্রচন্ডরকম আবেগ, অনূভুতি আর ভালোবাসার ছড়াছড়ি! এখানে যে কবিতাটা সেটা লিয়নের সাথে বিচ্ছেদের কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম, তখনও আমি জানতাম না আমাদের দূরত্ব শীগ্রই হতে যাচ্ছে।
এদিকে ম্যাগাজিনে আমার নাম দেখে তনয় খুব আগ্রহ নিয়ে লেখাটা পড়তে আরম্ভ করেছে। বিশাল বড় একটা আবৃত্তিযোগ্য কবিতা। লিয়নের জন্মদিনে ওকে আবৃত্তি করে শুনাবো বলেই লেখা ছিলো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।
তনয় পড়ছে কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছি আসলে কি লিখেছিলাম? মনে হতেই আমার প্রচন্ডরকম লজ্জা অনূভুত হতে লাগলো।
লেখাটা ছিল আমার ভাবনার ২০ বছর পরের একটা ধারণাচিত্র! সেই ভাবনা যে সম্পূর্ণই মিথ্যে আর বানোয়াট তা প্রমাণ হতে হাতে গোনা অল্পকিছু সময় নিয়েছিলো মাত্র।
লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘ভালোবাসার বয়স’
আর লেখাটা ঠিক এমন ছিল,
”
আমার বয়সটা তখন ঠিক চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
হুট করে আপনি এক ছুটির দিনে আশেপাশে তাকিয়ে আমার পিছু নিবেন।
আপনার অনুসরণ টের পেয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ততার সাথে তাড়া করে বলবো,
” কি? কিছু লাগবে আপনার?
আপনি ভ্রু কুঁচকে বলবেন,
“গোসল করেও কি চুল খোঁপা করে রাখতে হয়? কতদিন খোলা চুলে চারপাশে হেঁটে বেড়াওনা বলোতো?
আমি তখন বয়সের রেশ দেখিয়ে মৃদু হাসবো।
আপনি আবারও বিরক্ত নিয়ে বলবেন,
” আচ্ছা তুমি না আগে রোজ চুলে শ্যাম্পু করতে, এখন কি ওই গায়ে মাখার সাবানেই চলে যায়?
আচ্ছা ঠিক আছে সবকিছু নিজের মেয়ের সাথে ভাগাভাগি করতে ইতস্ত হলে আমি আলাদা সব এনে দিবো!
আপনার কথা শুনে আমি কপালের ঘামগুলো আঁচলে মুছে খুব চাপা একটা হাসি মেখে জবাব দিবো,
হুহহ বয়স হয়েছে তো, এসবের এখন আর কি দরকার?
তবুও আপনি নাছোড়বান্দা হয়ে চারপাশ ঘুরঘুর করবেন আর বলবেন,
একটু সাজলে কি হয়? আমার যে এখনো বড্ড প্রেমিক হতে ইচ্ছে করে, ওই যেমন ২০ বছর আগে ছিলাম!
তোমার কাঁজল আঁকা বাদামি চোখে তাকিয়ে দিন পার করে দেওয়ার সাহস করতাম ! কান আড়াল করে দেওয়া অবাধ্য চুলগুলোকে পেছনে ফিরিয়ে বড় বড় ঝুমকোজোড়ায় আঙুল ছুঁয়ে টুনটুন আওয়াজ শুনতে ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। হাতভর্তি চুড়ি পরা হাত ধরে অনবরত ছবি তোলার আবদার করতাম!
অথচ তখন আমাদের দেখা হওয়ায় কতো আতঙ্ক জড়িয়ে ছিল বলো? তুমি ভয়ে ভয়ে খানিক পরেই বলতে শুরু করতে, কেউ দেখলে বিপদ হবে, এখনি বাসায় ফিরতে হবে, নইলে আম্মু বকবে।
জানো?
তখন থেকে শুধু প্রহর গুনতাম, কবে এই ভয়ের পালা শেষ করে তোমাকে শুধুই আমার অধিকারে পরিণত করবো!
বহু প্রতিক্ষা শেষে একদিন সেই সময় আসলো!
কিন্তু আমি যে তখন প্রেমিকা হারিয়ে তোমায় পেলাম গৃহবধূ রূপে! যার বিস্তার দেখা দিলো শেখরের ন্যায়।
তখন থেকে শুধু একজনের ভয় নয়, একটা পরিবারের নানান কথার ভয় থামিয়ে দিলো সব, আর বাড়িয়ে দিলো তোমার নিত্যব্যস্ততা।
এদিকে আমার মধ্যে জেগে উঠলো ভবিষ্যৎ চিন্তা, মস্তিষ্ক ধাবিত হলো একের পর এক উপার্জনের রাস্তায়। হারাতে থাকলো সময়। আমাদের সময়!
তবে আজকাল ভীষণভাবে মনে হয় ভালোবাসার জন্য বোধহয় আমাদের স্বল্প বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয়।
দেখলে তো ২০ বছর কতো অল্প সময়? আমরা আমাদের ব্যস্ততায় কতগুলো বছর ভালো করে দিনের একটুখানি সময় একাকিত্বে বসে এক কাপ কফি খাওয়ার সময়ও পেলাম না। অথচ আমাদের বয়স ঠিকি কতো বেড়ে গেছে! আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি এখন!
‘
অনেকদিন পর আপনার মুখে এসব কথা শুনে আমি বেশখানিক্ষণ নিরব থেকে ভাব্বো,তাইতো!
আপনি যে আর সেই টগবগে তরুণটা নেই। দাঁড়িতে পাক ধরেছে, চোখে ভাঁজ পড়েছে, গালের মাংসের সতেজতা হ্রাস পেয়েছে! আসলেই কি আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি?
কি করে কেটে গেলো এতগুলো বছর ?
সেদিন হয়তো আপনার কথার জবাব দেওয়া হবে না, তবে বুঝে যাবো হ্যাঁ সময় চলে যাচ্ছে। আমিও আর সেই আবেগপূর্ণ কিশোরী প্রেমিকাটা নেই, বউ হয়েছি, সংসারী হয়েছি, মা হয়েছি আর এখন সেসবকিছুর দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার অন্যতম মানুষ হয়েছি।
দু এক বছরে আমারও কালো চুলের ফাঁকফোকরে দেখা মিলতে থাকবে সাদাচুলেদের।
হঠাৎ একদিন আমাদের মেয়েও আমার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে বলে উঠবে, আরে আম্মু তুমি তো বুড়ি হয়ে গেছো! দেখো দেখো তোমার চুল পেকে যাচ্ছে সব।
তারপর সে যখন কয়েকটা পাকা চুল ছিঁড়ে আমার চোখের সামনে তুলে ধরবে, তখন আমি মুচকি হাসলেও গভীরতার সাথে অনূভব করবো, হ্যাঁ বুড়ি হয়ে যাচ্ছি! আয়ু কমে যাচ্ছে ঝড়েরবেগে!
ব্যস্ততার ফাঁকে আপনিও আমাকে খেয়াল করে অল্প রসিকতা করে নিজের সাথে আমাকে বুড়ি আখ্যা দিবেন। পরক্ষনে স্বরণ করতে থাকবেন আমাদেরও অতীত ছিল, ছিল চোখ ধাঁধানো তারুণ্য!
ভাবতে থাকবেন, কি দ্রুত চলে গেলো জীবনের সুবর্ণ সেসব সময়গুলো!
এখন বাকি যে জীবন আছে তাও যে ভিন্ন ভিন্ন দায়ভারের বোজা বইতে বইতে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিবে।
আপনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকবেন, জীবনের প্রতিটা সময় আরো দীর্ঘ হয়না কেন? এতো স্বল্প কেন একটা জীবন? কেন জীবন এতো তারাতাড়ি স্থিরতা হারায়? যেখানে ভালোবাসার বয়সটাকেই স্থিরহীন ভাবা দুষ্কর! (শেষ)
“”
কতো কিছু পূর্ব ভেবে রেখেছিলাম, কি ভীষণ ভুল ধারণা মনে আসলে মানুষ আগামী ২০ বছর পরের কথা ভেবে কবিতা লিখতে পারে? যেখানে এই ভাবনার ২০ দিন পরেই মানুষটা হারিয়ে গেলো!
এটা তো আমি লিয়নকেও দেইনি, এমনকি আমার ফেইসবুক ওয়ালেও পোস্ট করিনি। তার আগেই আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে এটা কে পেলো? যদি এটা পেয়ে থাকে তাহলে লিয়নের সাথে আমার অসংখ্য ছবিও পেয়েছে সে। তাহলে কি এই সেই আগন্তুক যে শক্ত প্রমাণ নিয়ে আমাদের বিয়ে ভাঙার হুমকি দিচ্ছে?
এটা তাহলে লিয়ন নয়?
কিভাবে সম্ভব?
তনয় লেখাটা পড়েই আমার দিকে তাকিয়ে একদম সোজাসাপটা বললো,
‘ এটা আবৃত্তি করলে বেশ হবে! আমায় শুনাবে কেমন?
এখন এই কথাগুলো কি করে ওকে বলবে বুঝতে পারছি না। আর সে জিজ্ঞেসও করছেনা এটা কখন এবং কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলাম! হয়তো বুঝেছে পূর্বের লেখা।
আমি তার দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললাম,
‘ আপনি বুঝতে পারছেন এটা ওই ব্যক্তির কাজ, যে আমাদেরকে কাল থেকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে!
এই লেখা বহু আগের, যেটা আমার সেই ফোন হারানোর সাথে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার পুরনো স্মৃতিরা দলবেঁধে জমে ছিলো!
তনয় এবার বিষয়টার গভীরতা কিছুটা ধারণা করতে পেরে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ওর ফোন বেজে ওঠলো।
তনয় দেখলো তার খালুর নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। তারাও অনুষ্ঠানে আসার জন্যই রওয়ানা দিয়েছে, কিন্তু এখনো এসে পৌঁছায়নি।
তনয় কলটা কানে ঠেকিয়েই মুখ চেপে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
‘ আপনারা এখন কোথায়? আর নিশি আপা? উনি ঠিক আছেন তো? আমরা এক্ষুনি আসছি!
ব্যস্ত হয়ে তনয় কল কেটে বললো,
‘ মা! মা কোথায় তুমি? মা নিশি আপাদের গাড়ী আসার পথে এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতাল চলো!
কিছুক্ষণের মধ্যে ভীষণ শোরগোল পড়ে গেলো।
তনয়ের আত্মীয় স্বজনরা ব্যকুল হয়ে ছুটাছুটি করছে।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী আমার আব্বু আম্মুকে এদিকটা সামলাতে বলে গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেলো।
এদিকে তনয়ও ব্যস্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। আর যাবার আগে আমাকে বলে গেলো,
‘ আপার অবস্থা খুব খারাপ। বিয়ে তো হয়েই গেছে তাইনা,তুমি একদম এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আর আমরা যথাসময়ে চলে আসবো! এসব আমি পরে দেখবো।
এরপর তনয় তার এক বন্ধুর বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
আমার ভেতরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, বুকের কম্পন বেড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে এই দূর্ঘটনার সংবাদ এসবের সাথে জড়িত নয়তো?
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার