#বাম_পাঁজরের_হাড়
#পর্ব-২
#Farhana_Yesmin
“আপনি কি আমায় নিয়ে কোন ভয়ে আছেন?”
তুষারের কথায় মুখ তুলতেই চোখাচোখি হলো। এই বয়সে এসে আমার লজ্জা পাওয়ার কথা না কিন্তু তন্বী তরুণীর মতোই লজ্জিত হলাম। গালের তাপমাত্রা বেশি হচ্ছে টের পেলাম। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। একটা কথাও মুখ ফুটে বেরুলো না।
“আপনার কিছু জানার থাকলে আমার প্রশ্ন করতে পারেন।”
আমি তবুও নিশ্চুপ। তুষারের হাল টের পেলাম না। তবে কিছুক্ষণ পর ওর গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো-
“দেখুন আমি জানি বিয়ের পাত্র দেখার ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা ভালো না। সেজন্য ফরমালি কোন প্রস্তাব পাঠাইনি। সাদমানের কাছে আপনার কথা শুনে আগ্রহী হয়েছিলাম। না জানিয়ে আপনাকে দেখবো এই উদ্দেশ্যে আমার ভাগ্নিকে নিয়ে গেছিলাম আপনার কলেজে ভর্তি করাতে তখন আপনি অনেক হেল্প করেছিলেন। এই তো মাস দুয়েক আগের কথা। আপনার মনে আছে কিনা জানিনা।”
আমার মনে পড়লো ঘটনাটা। এইজন্যই তুষারকে চেনা চেনা লাগছিলো। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজে প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তার সাক্ষর আর সিল লাগে যা ওদের কাগজে ছিলোনা। বাসা অনেক দূরে বলে আমায় রিকোয়েস্ট করলে আমি নিজে সাক্ষর আর সিল মেরে দেই। ঘটনাটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি এবার তুষারকে দেখলাম পূর্ণ দৃষ্টি মেলে। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের তুষারের চোখ দুটো একেবারে স্বচ্ছ টলটলে পানির দীঘি যেন। যথেষ্ট লম্বা কারন চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছে। পরনের পাঞ্জাবি ভেদ করে বলিষ্ঠ গাথুনীর শরীর উঁকি দিচ্ছে। তুষার আমার ধারালো দৃষ্টি দেখে মাথা নামায়। আমি বলি-
“আপনি ব্যাংকে জব করেন বলেছিলেন।”
তুষার উজ্জ্বল চোখে তাকালো-
“আরে আপনার মনে আছে দেখছি? জ্বি ঠিকই বলেছিলাম। আমি সিদ্ধেশ্বরী ব্রান্চের ম্যানেজার। আমার বয়স উনচল্লিশ। মায়ের কাছে তো সব শুনেছেনই তাই আর নতুন করে কিছু বলছিনা। চাইলে কম বয়সী কাউকে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছে করেনি। আমার নিজের বয়স তো কম হয়নি। এখন কম বয়সী মেয়ের চাইতে মানসিক পরিপক্বতার মেয়ে আমার জন্য ঠিক মানানসই হবে মনেহয়। এতো দেরিতে বিয়ে করছি মেন্টাল এ্যাডজাস্টমেন্ট বেশি জরুরি। তাছাড়া একা থাকতে থাকতে আমিও কিছুটা আনসোশাল হয়ে গেছি হয়তো। আপনাকে দেখে কেন যেন আমার মতোই মনে হয়েছে তাই আর দেরী না করে মাকে আপনার কথা জানালাম। এখন আপনি বলুন আপনার মতামত। আপনার মনে কোন সন্দেহ থাকলে আমরা সময় নেব।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। বাবা মা আমাকে না জানিয়ে যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে হয়তো তুষার এর মাঝে তারা এমন কিছু গুন দেখেছে। তারা হুট করে কিছু করার মানুষ না।
“দেখুন, নিজে যেহেতু এতোদিনেও ভালো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি তাই বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করতে চাই। তবে একটা কথা জানাতে চাই। আমি পড়ালেখার বাইরে সংসার নিয়ে খুব বেশি কিছু জানিনা তাই ভয় লাগে সবকিছু ঠিক ঠাক ম্যানেজ করতে পারবো কিনা।”
আমার কথা শোনা মাত্রই তুষারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো-
“এসব নিয়ে মোটেও ভাববেন না। বাড়িতে মোটের উপর আমি আর মা আমরা কেউই ভয় পাওয়ার মতো না। আর বোনেরা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে তাদের নিয়ে এতো ভাবনার কিছু নেই। আর বাদবাকিটা যাতে ঠিক থাকে সেজন্য আমরা দু’জনেই মন থেকে চেষ্টা করলেই হবে। আপনি… ”
কথা শেষ হওয়ার আগেই বীথি আর সাদমান রুমে ঢুকলো। সাদমান তুষারের সামনে দাঁড়ালো-
“বলেছিলাম না আপুর মধ্যে জাদু আছে। এখন সত্যি প্রমান হলো তো? ভাইয়া তোমার তো কথাই ফুরচ্ছে না? আজই সব কথা বলে শেষ করবে নাকি?”
তুষার মুচকি হেসে মাথা নামায়। বীথি এসে পর থেকে আমার হাতে পায়ে সমানে চিমটি কাটছে। শয়তান মেয়ে একটা। আমিও ভেবে রাখলাম সাদমানের সাথে বিয়ের সময় ওকে আচ্ছা মতন জ্বালাবো। কি কি ভাবে জ্বালানো যায় তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হুট করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলাম। সাথে সাথে বাকি তিনজোড়া চোখ আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন চিরিয়াখানার বানর দেখছে। আসলে ভুলে গেছিলাম যে আমি কোন অবস্থায় আছি। আমি লাজেনত হয়ে জীভ কামড়ে ধরতেই তিনজন হো হো করে হেসে দিলো।
ঠিক হলো ঈদের পরে ঘটা করে সাদমান আর বীথির বিয়ে হবে তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে। বিয়ের পর দশ পনের দিন পরে ওরা চলে যাবে ইস্তাম্বুল। আমি ভেবেছি বীথি না থাকলে আমিও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় যাবো না। মেহমান চলে যাওয়ার পর বাবা আমার কাছে এলেন-
“তোর মতামত না নিয়ে বিয়ের কথা আগালাম বলে আমাদের উপর রাগ করেছিস নাকি রে মা? আসলে প্রতিবার ছেলের এটাসেটা দেখতে দেখতে বিয়ের কথা আগায় না তাই এবার আর তোকে জানাইনি। তবে তুষার একেবারে খাটি হীরা একথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তুই সুখে থাকবিরে মা।”
“তোমার উপর আমার আস্থা আছে বাবা। আমি রাগ করিনি তোমার উপর।”
আমার কথায় বাবার চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠলো। মাথায় আলতো করে স্নেহের পরশ দিয়ে বাবা উঠলেন। বীথি যে এই বিয়ের বিষয়ে কলকাঠি নেড়েছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। মেয়েটা আমাকে এতো কেন ভালোবাসে? আমার থেকে দশ বছরের ছোট বোন কবে এতো বড় হয়ে গেলো? ছোটবেলায় চকলেটের জন্য আমার পেছনে ঘুরে বেড়ানো বোনটা আমার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে আনে। ও বরাবরই বলেছে আমার আগে বিয়ে করবে না। বীথি ওর কথা রেখেছে। রুমে বীথিকে ঢুকতে দেখে আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ভেজা কন্ঠে বললাম-
“থ্যাংক ইউ বীথি। তুই তোর কথা রেখেছিস।”
বীথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমায় দেখলো তারপর হাত ধরে বিছানায় বসালো আমায়-
“ছিহ বড়পা, থ্যাংক ইউ কেন বলছো? তুমি সারাজীবন আমার জন্য কতো কি করেছো এখন কি সেসবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ বলবো? আর তাছাড়া বিয়ের জন্য আমি বা আমরা কিছু করিনি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তা না হলে সাদমানের এই খালার সাথে ওদের যোগাযোগ ছিলোনা অনেকদিন। হঠাৎ নাকি একদিন হাজির, তুষার ভাইকে বিয়ে করাবে মেয়ে দেখে দিতে বলছে। সাদমান তখন তোমার কথা বলেছে তুষার ভাইকে। আমি নিজেও অবাক হয়ে ভাবছি এমনটাও সম্ভব কিনা? উপরওয়ালার ইশারা ব্যাতীত এমন কান্ড সম্ভব?”
আমি তন্ময় হয়ে শুনছি। এজন্যই হয়তো বলে জন্ম মৃত্যু বিয়ে সৃষ্টিকর্তার হাতে। এ ব্যাপারে অন্য কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই।
পরদিন সেহেরির আগে রাত দুটোয় ঘুম ভাঙলো আননোন ফোন কলে।
“হ্যালো।”
“আমি তুষার। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি? ভাবলাম একটু পরে তো উঠতেই হবে আগেই না হয় ঘুম ভাঙাই।”
আমি অবাক হয়ে ভাবছি তুষার আমার নাম্বার পেলো কোথায়? আমার কাছে তো চায়নি।
“সাদমানকে বলেছিলাম, ও সম্ভবত বীথির কাছ থেকে আপনার নাম্বার নিয়েছে।”
তুষারের কথায় আরেকপ্রস্ত চমকিত হলাম। এই লোক কি অর্ন্তজামি? আমার মনের কথা বুঝছে কি করে?
“কি হলো কথা বলছেন না যে?”
তুষারের কথায় থতমত খেয়ে বলি-
“কি বলবো? যা জানতে চাইবো তা আপনি আগেই বলে দিচ্ছেন। ভাবছি মনের কথা বুঝছেন কি করে?”
তুষার রাশভারি কন্ঠে হাসলো কিছুক্ষণ তারপর মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিলো-
“বলেছিলামনা আপনি কিছুটা আমার মতো। তাই আপনার ভাবনা খানিকটা বুঝতে পারছি। এবার আপনি কিছু বলুন তো আমায় নিয়ে।”
“কি বলবো?”
আমি বোকার মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই তুষার বলে-
“যা খুশি মন চায়।”
আমি কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ থাকি। তুষার বললো-
“কি কথা খুঁজে পাচ্ছেনা নাতো? আচ্ছা এক কাজ করি। আমরা পাঁচটা করে বেসিক প্রশ্ন দিয়ে আলাপ শুরু করি। একই প্রশ্ন আপনি আমাকে আমি আপনাকে করবো। তারপর বাকী কথা আপনাতেই আসবে।”
“ঠিক আছে?”
“প্রশ্নগুলো আপনি ঠিক করুন।”
“আমি?”
“হ্যা আপনি? আপনি টিচার না? প্রশ্ন করার দায়িত্ব তো সবসময় টিচারেরই। টিচারের দক্ষতা কিন্তু নির্ভর করে প্রশ্নের ধরনের উপর। টিচার হিসেবে আপনি কতোটা ইন্টেলিজেন্ট সেটা আপনার প্রশ্ন দেখলেই বোঝা যাবে।”
তুষারের মুচকি হাসি যেন স্বচক্ষে দেখলাম। আমার মেজাজ খারাপ হলো একটু। ভাবছি সারাজীবন ছাত্র ছাত্রীর পরীক্ষা নিলাম। এখন কি নিজের পরীক্ষা দিতে হবে?
“আমি ইন্টেলিজেন্ট না হলে কি বিসিএস পাশ করতে পারতাম?”
আমার কথা শুনে তুষার চুপ করে রইলো তিরিশ সেকেন্ড তারপর বললো-
“আপনি প্লিজ অন্যভাবে নেবেন না। আমি কিন্তু আপনাকে ছোট করতে কিছু বলিনি।”
“আমি কি তাই বলেছি?”
বলেই মুচকি হাসলাম-
“আচ্ছা দাঁড়ান প্রশ্নগুলো রেডি করি। উমমম, পাঁচটা প্রশ্ন। খুব শর্টে করি। পচ্ছন্দগুলো বলবেন শুধু।”
তুষার কন্ঠে খুশির আভা-
“প্লিজ কন্টিনিউ।”
“সাদা না কালো, রংচা না দুধচা, পাহাড় নাকি সমুদ্র, সকাল নাকি সন্ধ্যা, ট্র্যাডিশনাল নাকি ক্যাজুয়াল।”
“ও বাবা, এ কেমন প্রশ্ন?”
তুষার বোকা বনে গেলো। এতোক্ষণ ও বকবক করছিলো এখন যেন কথা বন্ধ। আমি ফোনের এপাশে মুচকি হাসছি। ভাবলাম মানুষটাকে আরেকটু ভরকে দেই-
“এইসব প্রশ্নের উত্তর থেকে একটা মানুষ সম্পর্কে অনেকটা আন্দাজ করা যায় জানেন তো? এবার ঝটপট উত্তরগুলো দিন তো দেখি আপনি মানুষ হিসেবে কেমন?”
তুষার ঝটপট জবাব দিলো-
“আগে আপনি বলুন। লেডিস ফাস্ট বলে একটা কথা আছে না সেটা ফলো করুন।”
“বেশ তো। বলবো কিন্তু আজ তো সেহরির সময় হয়ে গেছে কাজেই উত্তর কাল পাবেন। আর নিজের উত্তরগুলো তৈরী রাখুন। কাল কিন্তু দিতেই হবে। ভালো থাকবেন।”