বাম_পাঁজরের_হাড়
#পর্ব-৪
Farhana_Yesmin
দু’জন পাশাপাশি বসে আছি, একে একে সবাই দু’জনকে হলুদ ছুঁইয়ে যাচ্ছে। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি তুষার আমায় দেখছে। ওর মুগ্ধ দৃষ্টি টের পেয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে থুতনি বুকে ঠেকে গেলো। সবাই একটু সরে যেতেই টের পেলাম ওর ডান হাত আলতো করে ছুয়ে গেলো আমার বাম বাহু। অচেনা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম, শরীরজুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো। চমকে তাকাতেই দেখলাম বা বাহুতে অনেকখানি হলুদের ছোঁয়া। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। চোখে মুগ্ধতা নিয়ে ক্ষীন কন্ঠে বলে উঠে-
“ইচ্ছে হচ্ছে আপনার পুরো গায়ে নিজ হাতে হলুদ ছোঁয়াতে কিন্তু তা পারলাম না বলে এইটুকু সই। এই ইচ্ছেটা তোলা থাকলো বিয়ের পর কোন এক সময় পূরণ করবো।”
তুষারের কন্ঠে নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা জড়তা। ওর কথা শুনতে শুনতে আমার কান গরম হয়। লাজে আধমরা হয়ে চোখ নামিয়ে নেই। মানুষটা একটু বেশি বেসামাল কথা বলছে আজ। সত্যি বলতে আমার আসলে খারাপ লাগছে না। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার শরীর মন অদ্ভুত মাদকতায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মন চাইছে তুষার আরো কিছু বলুক, মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক কিছু সময়।
“শুনুন।”
তুষার খুব আস্তে ডাকলো আমায়। আমি চোখ মেলে তাকাতেই আমার চোখে চোখ রাখলো-
“একটা অনুরোধ রাখবেন?”
আমি উপর নিচ মাথা নাড়ি। আমার চোখে অবাক দৃষ্টি দেখে সে আস্বস্ত করার হাসি দিলো-
“আরে, ভয় পাচ্ছেন নাকি? ভয় পাওয়ার মতো কিছু বলবো না বাবা। বলছিলাম কি, কাল প্লিজ কোন মেকআপ করবেন না মুখে। হলুদ ছোঁয়ার পরে নাকি মেয়েদের চেহারায় আপনাতেই গ্লো চলে আসে। আর শ্যামা মেয়েদের হলুদের পর নাকি একদমই অন্যরকম লাগে। আমি আপনার এই অন্যরকম লুকটা দেখতে চাই। প্লিজ, অনুরোধ রইলো।”
আমি এবার ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। গাল দুটো আরক্ত তা বেশ টের পাচ্ছি। আমায় বাঁচাতেই বুঝি বীথি এসে আমার পাশে বসলো। তুষারকে বলে-
“ভাইয়া, সেই কখন থেকে দেখছি আপুর সাথে বকবক করছেন। এতো কি কথা বলেন তো? আজ সব বলে ফেললে কাল কি বলবেন?”
“কাল কিছু বলবো না কাজ করবো?”
হঠাৎ তুষারের মুখে এমন কথা শুনে আমি যেন মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি। লোকটা এতো দুষ্ট আগে বোঝা যায়নি। আমি চোখ মটকে তাকালাম কিন্তু সে ভয় পেলো বলে মনেহয় না। বেহায়ার মতো হাসতে হাসতে বলে কিনা-
“তোমার আপার মুখে হলুদ লাগাবো নিজ হাতে ব্যবস্থা করে দাও।”
বীথি আর আমি দু’জনেই চোখ গোল করে তাকে দেখছি। সে আমার চোখ চোখ রেখে বলে-
“ওভাবে দেখছেন কি? আপনি তো ভারী বেহায়া? বিয়ের কনে এভাবে বরকে দেখে?”
বলেই আমাকে বোকা বানিয়ে একমুঠো হলুদ আমার দু’গালে মাখিয়ে দিলো। আমি শরমে কিছু বলতে পারলাম না। বীথি খিলখিল করে হাসছে। আমি মেজাজ দেখালাম-
“এর শোধ কাল নেবো।”
“ইউ আর ওয়েলকাম।”
বলে সে দুষ্ট হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিলো।
রাতে গোসল সেরে চুল মেলে শুয়ে আছি সেই সময় তুষারের ম্যাসেজ। ওপেন করতেই দেখলাম-
“আপনার একটা ছবি পাঠান তো। দেখি কেমন লাগছে আপনাকে।”
আমি মুচকি হেসে উত্তর লিখি-
“উহু, কাল একেবারে দেখবেন। আজ অনেক জ্বালায়েছেন আর সু্যোগ দেবোনা।”
“কাল যে আরো জ্বালাবো। তখন কি করবেন শুনি?”
“আমি লজ্জা পেয়ে প্রসংগ পাল্টাই-
“এই শুনুন, শাড়িটা কখন কিনলেন বলুন তো?”
“আপনি যখন হাত বুলিয়ে আরেকদিকে তাকালেন তখন। আপনার চেহারা দেখে বুঝেছিলাম এই রং আপনার পচ্ছন্দের। কিন্তু তখন কিছু বললেন না কেন বলুনতো?”
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলি-
“আমায় নাকি এমন রং মানায় না। আরো বেশি কালো লাগে তাই কখনো সাহস করে পরা হয়নি।”
“ধ্যাত, একদম বাজে কথা। কালকে যে আপনাকে কি দারুণ লাগছিলো তা তো আমায় দেখে বুঝেছনই। আপনার দিক থেকে নজর ফেরাতে পারছিলাম না।”
“উফফ, শুধু শুধু বাড়িয়ে বলছেন। মোটেও অতোটা সুন্দর লাগছিলো না।”
আমি শরম পাই। লোকটা যে কি না, যা মুখে আসে তাই বলে দেয়।
“লজ্জা পাচ্ছেন? জানেন, লজ্জা পেলে আপনাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। কাল জেনেছি ব্যাপারটা তাই তো আপনাকে বেশি বেশি লজ্জা দিচ্ছিলাম।”
“আপনি একটা পঁচা লোক। আর কথা বলবো না আপনার সাথে।”
ম্যাসেজ সেন্ট হতেই হাসির ইমো এলো ফিরতি ম্যাসেজে।
“এখনও কিন্তু কথা বলছেন না ম্যাসেজ দিচ্ছেন। কাজেই কথা না বললেও চলবে।”
আমি রাগের ইমোজি পাঠিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম।
ননদেরা অনেকবার আমাকে সাজিয়ে দিতে চেয়েছে আমি সোজা না করেছি। এই দিনে সব মেয়ে সাজতে চায় আমি চাইছি না বলে ওরা বিস্মিত। তবে ওদের বলিনি এমনটা ওদের ভাইয়ের ইচ্ছে। কি দরকার নিজেকে লজ্জায় ফেলার। বিয়েতে লাল টুকটুকে শাড়ি পরার শখ ছিলো। যদিও সে শখের কথা কাউকে বলিনি। শাড়ির বাক্স খুলতেই সিঁদুর লাল শাড়ি দেখে বেশ অবাকই হলাম। তুষারের বাড়ির কেউ শাড়ির রং জানতে চায়নি। ওরা নিজেরা পচ্ছন্দ করে কিনেছে। ওদের পচ্ছন্দের সাথে আমার পচ্ছন্দ মিলে গেলো বলে মনটা স্নিগ্ধ হয়ে গেলো। আমি খুশি মনে সিদুর লাল শাড়ি পরে মুখে নরমাল ক্রীম মেখে চোখে গাঁড় করে কাজল দিলাম, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক আর লম্বা চুলগুলো বিনুনি করেছি। গায়ে গয়না চড়ানোর পরে যখন আয়নায় নিজেকে দেখলাম তখন নিজেই অবাক হলাম। সাজগোছ ছাড়াই এই আমাকে দেখতে বেশ লাগছে। তুষার নিশ্চয়ই খুশি হবে এই সাধারণ আমাকে দেখে। পরিপূর্ণ কনের সাজে সবাই আমার প্রসংশাই করলো। দূর থেকে বাবা মা কণের সাজে আমাকে দেখে আপ্লূত হলেন। বীথিটাও দেখছি কাছে আসছে না। মাকে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখলেও সে আমার কাছে আসছে না। আমি টের পাচ্ছি মা কান্না লুকোনোর চেষ্টা করছে। যে মেয়ের বিয়ের জন্য এতোদিন ধরে প্রতিক্ষায় ছিলো তার অনুপস্থিতির কথা ভেবে মায়ের কান্না পাচ্ছে। মাকে আড়ালে চোখ মুছতে দেখছি। আমি কয়েকবার কাছে ডাকতে যেয়ে পারলাম না। টের পেলাম আমারও গলা ধরে আসছে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। সবাই এমন করছে কেন? বিয়ের আগেই পর করে দিচ্ছে? আমার হঠাৎ কি যে হলো আমি ভেউ ভেউ কেঁদে দিলাম। আমার কান্না দেখে মা বাবা বীথি ভাইয়ারা সকলে দৌড়ে এলো। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছু না বলে কেবল কেঁদেই যাচ্ছি।
রাত এগারোটায় তুষারের সাথে আমার বিয়ে হলো। সব আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করে নতুন গৃহে প্রবেশ করতে করতে আমাদের রাত একটা বাজলো। নতুন চাঁদ দেখার সাথে তুষারের সঙ্গে আমার নতুন জীবন শুরু হলো।