বালুকাবেলা (০১)

0
2210

#বালুকাবেলা (০১)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বোনের পড়ালেখার পেছনে এতো টাকা খরচ করতে মানা করেছিলাম! আপনার বোন এখন আমাদের মুখে চুনকালি মাখালো তো! দুই দুইটা সাব্জেক্টে ফেল করেছে। আরো দুই বছর আগেই যদি গ্রামের সেই কাতার ফেরত ছেলেটার কাছে ওর বিয়ে দিয়ে দিতাম তাহলে আজকের এইদিনটা দেখতে হতোনা।

ভেতরের রুমে চোখের পানিতে ওড়না আধভেজা করে ফেলা মেয়েটা শুনলো তার ভাই বলছে,
‘ একটা বছরই তো। সামনের বছর দেখো তূর্ণা খুব ভালো করবে।

হুংকার ছেড়ে তার ভাইকে খবরদারি করা স্ত্রীর জবাব,
‘ আর এই এক বছর তাকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো তাইনা? খুব তো বলছিলেন আমার বোন এ প্লাস ছাড়া জীবনে কিছু পাবেই না। আর আপনাকেও তার দায়িত্ব আর দু বছর নিলেই যথেষ্ট, তারপর সে ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বে আর তখন নিজের দায়িত্ব সে নিজেই নিতে পারবে! কি পারবে এখন? ফেইল করা ছাত্রীকে দুনিয়ার কে দু পয়সার দাম দিবে? শুধু আমরা দায়বদ্ধ বলে এখনো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের দিতে পারছিনা!
ছি ছি অন্তত পাশ তো করতে পারতো!
তার ভাই শখ করে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে নিজের জেলায় এতো কলেজ রেখে ঢাকায় ভালো কলেজে ভর্তি করিয়েছিলো! কি জানি কোনো ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করেই পরিক্ষায় ফেল করে বসেছে কিনা! আমার কথা শুনে পাখনা গজানোর আগেই বিয়েটা দিলে আজকে কতো সুন্দর সংসার করতো, এতো জ্বালাতনও সহ্য করা লাগতোনা। দুইটা বছরে কতগুলো টাকা জলে গেলো আমাদের।

ভেতর থেকে এসব শুনতে শুনতে তূর্ণা হেঁচকি তুলে কাঁদছে আর ভাবছে, এইজন্যই বোধহয় ছোটবেলা থেকে সে নিউজে দেখে আসছে পরিক্ষার পর পর অকৃতকার্য ছাত্র ছাত্রীরা বিভিন্নভাবে আত্মহত্যা করে বসে! তারা আসলে নিজেদের ব্যর্থতায় দুনিয়া ছাড়েনা, দুনিয়া ছেড়ে দেয় এমন এক দুইটা মানুষের বিশ্রী কথা থেকে মুক্তি পেতে!

হুট করেই ওপাশে সবকিছু থমথমে। কেউ কোনো কথা বলছেনা। চোখ বন্ধ করে মেয়েটা আল্লাহকে ডাকছে আর বলছে, তার ভাবি আর যেন কিছু না বলে!
কিন্তু মিনিট পাঁচেক যেতেই তার ভাবি কি যেন বিরবির করে বলতে লাগলো।
সেগুলোর কিছু না শোনা গেলেও তার ভাই যখন না সূচক একটা জবাব দিলো।
তখনি তার ভাবি আবার চিৎকার করে বলে উঠলো,

‘ আপনার মা-বাবা থাকলে আরো আগেই বিয়ে দিয়ে দিতো। কিন্তু মরার আগে অবলা ছেলেকে কোন আন্দাজে বলে গেছে, মেয়ে যতটুকু পড়তে চায় পড়াস! কে জানে?
আর তাদের বাধ্য ছেলে তাদের কথা রাখতে এমন উঠে পড়ে লেগেছে কোন জ্ঞানে আমার মাথায় আসেনা! এতকিছু করে সুতা পরিমাণও দাম পাবেন পরে? দুদিন পরে আপনি কে আমি কে চিনিবেই তো না!
তাই ভালোই ভালোই বলছি এই পাত্র যদি ফেরত যায়, আপনার খবর আছে! আপনার বোনের তো এখানে স্থান নেই-ই আপনারও কোনো জায়গা নেই। এই ফ্ল্যাট আমার বাবার, মানে এটা আমার!

তূর্ণার ভাই তার স্ত্রীর সাথে সাথে জোর গলায় বললো,
‘ হ্যাঁ চলে যাবো, ছাতামাথার ফ্ল্যাটে না থাকলে মানুষ মরে যাবেনা। কিন্তু আমি আমার মৃত বাবার কথা ফেলতে পারবোনা। আমার বোন যতদিন পড়তে চায়, আমি রক্ত বিক্রি করে হলেও পড়াবো। এমনকি অর্ণাকেও আমার কাছে এনে রাখবো। আমার খারাপ লাগে নিজের আরেকটা বোনকে খালার কাছে রাখতে!

তারপর পরই কিছু ভাঙার আওয়াজ এলো, তূর্ণার ভাবি চিৎকার করে বললো,
‘ ওহ আপনি বোনকে পড়াতে রক্ত বিক্রি করে ফেলবেন তাইনা? আবার ওইটাকেও কাছে এনে রাখার শখ জেগেছে? রক্ত তো বিক্রি করবেন না, বলুন এখন টাকার গরম আছে! আমার বাবা আপনাকে দিতে দিতে হাতটা এত্তো বড় করে ফেলেছে কি ছুঁয়ে ফেলছেন টেরই পাচ্ছেন না৷ একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা ফকিরকে বিয়ে করার এই পরিণতি হবে জানলে আজীবন কুমারী থাকতাম তবুও বাবার রাজমহল ছেড়ে আসতাম না।

ধীর পায়ে তখনি সেখানে তূর্ণার আগমন। তার উপস্থিতি বুঝেই তার দিকে তার ভাবি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো।

তূর্ণা তার ভেঙে যাওয়া গলায় সর্বোচ্চ আওয়াজ করে বলার চেষ্টা করলো,
‘ আমি বিয়ে করবো। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত! আমার জন্য আপনারা পাত্র দেখতে পারেন। আর ভাই আমি আর পড়তে চাইনা।

মূহুর্তেই সবকিছু কেমন ঠান্ডা হয়ে গেলো। তার ভাবি ইতোমধ্যেই আলতো হেসে বলে উঠলো,
‘ দেখলেন দেখলেন? মেয়েদেরকে এভাবে সরাসরি বিয়ের কথা বলা লাগে। বুঝেছেন এবার? বিয়ের বয়স তো কবেই হয়ে গেছে!মেয়েরা বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলেও পরিবারের কারো কাছে মুখ ফুটে বলতে পারেনা! ফেইল করেছে কি সাধে?

তূর্ণার ভাই দাঁত কটমট করে তার স্ত্রীকে বললো,
‘ এবার আপনি চুপ করবেন? যা চেয়েছিলেন পেয়েছেন তো! আপনার এলাকার কে না কোন ভাই, তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারবেন এবার। এখন আমাকে একটু শান্তি দেন দয়া করে। আমি আপনার কাছে একটু শান্তি ভিক্ষা চাই।

তূর্ণার ভাবি শেষ আবার বিরবির করে বললো,
‘ তামজিদ তূর্ণাকে বিয়ে করার কথা স্বয়ং আমাকে বলছিলো, এমনকি আপনার সবার ছোট বোন অর্ণার দায়িত্ব নিতেও রাজী। এরপর দেখবেন অর্ণাকেও খালার হেল্প হ্যান্ড হয়ে ওই বাসায় থাকতে হবে না, তূর্ণার সাথেই ভালো থাকবে। চাইলে পড়ালেখাও করতে পারবে! তামজিদের অনেক টাকাপয়সা। বদ স্বভাব যা আছে তা তূর্ণাকে বিয়ে করলে থাকবে বলে মনে হয় না।

তূর্ণার ভাই ঘটঘট আওয়াজ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। সবকিছু আল্লাহর উপর সোপর্দ করে তূর্ণা বিছানায় গা হেলালো। নিজেকে প্রাণে মেরে ফেলা যেহেতু মহাপাপ, তাহলে নিজেকে প্রাণে না মেরে জীবন্তই মেরে ফেলা উচিত। তবে সেই জীবন্ত অবস্থায় যেন কথার আঘাতে প্রতিনিয়ত কেউ রক্তাক্ত করতে না পারে! বিয়েটা তাকে তাই করতেই হবে।


পরেরদিন ভোর বেলা নামাজ পড়ে তূর্ণা নাস্তার আয়োজন করতে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। রুটির জন্য আটা মাখানোর সময়ই তার ভাই তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। শুকনো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘ কিছু বলবেন ভাই?

তার ভাই মাথা ঝাকিয়ে বললো,
‘ আমি বড্ড অসহায়, তোদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমার হাত পা এতো কঠিন সুতোয় বাঁধা যে, এর থেকে পরিত্রাণ চাইলেও ধ্বংস হয়ে যাবো, আর সম্মতি দিলে তোদেরকে কূলহীন সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হবে , আর আমি জানিনা তোরা সেই সমুদ্রের কূল মিলাতে পারবি নাকি হাবুডুবু খেতে খেতে কেবল ভাসতেই থাকবি এক জীবন!

তূর্ণা ঝাপসা চোখেই আওয়াজ করে হাসতে হাসতে বললো,
‘ কি যে বলেন ভাই। আমরা আজীবন কূলেই থাকবো। আর ভালো থাকবো। শুধু আপনি দোয়া করবেন আমাদের জন্য!

তূর্ণার ভাই কোনো জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেলো।

সকালের নাস্তায় বসার পর তূর্ণার ভাবি হেসে তূর্ণাকে বললো,
‘ আমাদের সামনের ক্যাফেটাতে দুপুর একটায় চলে যেও। তোমার সাথে একজন দেখা করতে আসবে, একসাথেই ওখানে লাঞ্চ করবে।


তাদের কথামতো তূর্ণা দুপুর ঠিক একটা বাজেই সেই ক্যাফেতে গেলো। তার ভাবির দেওয়া নাম্বারে কল করে নিশ্চিত হলো এই মানুষ ঠিক কোথায় আছে। গিয়ে দেখলো তার আগেই সেই লোক বসে আছে। সে আস্তে আস্তে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হাতব্যাগটাকে রাখলো। তাকে উদ্দেশ্য করে লোকটা বললো,
‘ তূর্ণা বসো।

তূর্ণার হাত পা অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। সে স্বাভাবিক হতে পারছেনা। সে ব্যাগটা রেখেই কোনো রকম বললো,
‘ আমি ওয়াশরুম থেকে থেকে আসছি প্লিজ।

বলেই তূর্ণা ওয়াশরুমে প্রবেশ করে মাস্কটা সরিয়ে আয়নায় দেখলো তার চোখের কাজল চোখের পানিতে ভিজে সেগুলো গালে কালচে দাগ করে বসে আছে। সে দ্রুত মুখ ধুয়ে নিজেকে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ করে বের হতে পা বাড়ালো।
কিন্তু ওয়াশরুম থেকে অল্প বের হয়ে সে তাদের টেবিলে দৃষ্টি রাখতেই চমকে উঠলো। পাত্র তার ব্যাগের মধ্যে চোরের মতো কিছু খুঁজছে। আবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেও। তাকে ঠিক দেখতে পায়নি ততক্ষণে সে আবার ভেতরে চলে আসছে৷ নিজেকে যতটা সংযত করতে পেরেছিলো তাও এখন হারিয়ে গেলো, সে এখন সামনে এগুতেই পারছেনা। এদিকে তার কপালে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অঝোরে ঘাম জমে উঠছে!

বেশ খানিকটা সময় সে চুপচাপ ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর আবারও বহু কষ্টে নিজেকে বুঝালো। আর আস্তে আস্তে বের হলো। কিছু বুঝতে না দিয়ে তূর্ণা গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। ততক্ষণে তার সামনের মানুষটা ব্যাগ থেকে নিজের হাত নিখুঁতভাবে সরিয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়েছিলো।
তূর্ণা বসতেই হেসে বললো,
‘ কেমন আছো তূর্ণা?

ধীর কণ্ঠে তূর্ণা জবাব দিলো,
‘ আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?

অদ্ভুত আওয়াজ করে তামজিদ নামক সেই ব্যক্তি হাসতে হাসতে বললো,
‘ আমি বেশ ভালো আছি। কিন্তু তুমি যে ঠিক নেই তাও বুঝতে পারছি। আমার সামনে স্বাভাবিক থাকতে পারো। হাহাহাহা!

হাসির তীব্রতায় তূর্ণা একটু চোখ তুলে তাকালো। বিধ্বস্ত একটা চেহেরা, চেহেরার এই হাল যে তার বদ চরিত্রের প্রতীকী তা বুঝাই যাচ্ছে। আর তার সাথে হাসিটা কোনোভাবেই মুখের সাথে যাচ্ছেনা,খুব বিদঘুটে লাগছে। বিদঘুটে লাগার সবচেয়ে বড় কারণটা মনে হয় একটু আগে তার দ্বারা হওয়া সবচেয়ে জঘন্য কাজটা! কি করে পারলো একটা মেয়ের ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে? ব্যাগে ঠিক কি খোঁজার চেষ্টা করছিলো? এখনি এমন নিম্ন মানসিকতার পরিচয় দিলে তার সাথে ভবিষ্যৎ কেমন হবে? এখন আবার হাসছে,বিশ্রী দৃশ্য!
অফিসের বসদের সামনে নিজের জায়গা ধরে রাখতে কর্মকর্তারা যেকোনো অবস্থায় যে একটা হাসি ধরে রাখে, লোকটাও ঠিক এমন কোনো একটা জায়গা পাওয়ার লোভে জোরপূর্বক দাঁত বের করে কেবল হাসছে।

তূর্ণার মনে হচ্ছে এই হাসি দেখার চাইতে পৃথিবীর যেকোনো ভয়ংকর মৃত্যুও বোধহয় সহজ! তার ভাই সকালে বলছিলো কূলহীন সমুদ্রে ছেড়ে দিচ্ছে, কিন্তু সমুদ্রের পানিও তো স্বচ্ছ হয়। হাবুডুবু খেতে থাকলেও অন্তত ভেতর গুলিয়ে আসবেনা! সেখানে এই লোকের তুলনা তো হওয়া উচিত পঁচা ডোবা!

তূর্ণার চুপচাপ থাকার ভেতরে তামজিদ বলে উঠলো,
‘ আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি জানি, তবে সবকিছু ঠিক থাকলে বিয়েটা হয়তো আমাকেই করতে হবে। এখন খাবার পছন্দ করো, কি খাবে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here