বালুকাবেলা (০২)

0
1317

#বালুকাবেলা (০২)

পাত্রী দেখতে এসে যে পুরুষ তার হবু স্ত্রীর ব্যাগে সন্দেহের তাড়নায় চুরের মতো ঘাঁটাঘাঁটি করে অন্তত তার সামনে বসে আমি তূর্ণার গলা দিয়ে খাবার নামবেনা। ইতোমধ্যে এটা আমি ভালোই আঁচ করতে পেরেছি।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম,
‘ আমি কিছু খাবোনা। আপনি খেতে পারেন!

লোকটা চোখ পিটপিট করে আমাকে দেখছিলো, আমার কথা শেষ হতেই বললো,
‘ তাহলে আমি যা খাবো তুমিই তাই খাবে। ওকে। ওয়েটার এদিকে প্লিজ!

ওয়েটার দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়াতেই তিনি খাবার দেখালেন। দ্রুত পায়ে ওয়েটার আবার এই জায়গা প্রস্থান করলো।

তারপর তামজিদ তার দুই হাত টেবিলে সোজা করে রেখে আমাকে বললো,
‘ কখনো প্রেম করেছো?

আমি এমন প্রশ্নে বিব্রত হলাম। তবুও বিব্রতি প্রকাশ না করে ছোট করে উত্তর দিলাম,
‘ না।

অদ্ভুতভাবে হেসে বললো,
‘ করলেও কি বলবে? হাহাহাহা! এসবে আমার কোনো সমস্যা নেই। এমনি প্রশ্ন করলাম, পাত্রী দেখতে এলে এই প্রশ্নটা নাকি জাতীয় প্রশ্ন বলে গণ্য! তবে তোমার রেজাল্টটা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিলো। তোমার ভাবি বলছিলো আমার কপাল ভালো বলে নাকি তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, যদি তোমার কপাল ভালো হতো আর তুমি যদি পাশ করে যেতে তবে তো আমি তোমার জন্য প্রস্তাব দেওয়ারই সাহস পেতাম না। তোমার ভাই তো তোমাকে অনেক পড়াতে চায়!

আমি চুপ করে বসে আছি। কিছু সময় নিরবই চলে গেলো। তবে লোকটা যে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তা আমি আমার দৃষ্টি নিচু রেখেও বুঝতে পারছি।
কিছু সময়ের ভেতরে ওয়েটার এলো দুই গ্লাস জুস নিয়ে। উনারটা উনাকে দিয়ে আমারটা আমার দিকে দিতেই টেবিলের ফুলদানিতে ধাক্কা লেগে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গ্লাসটা আমার গায়ে পড়ে গেলো, আমার জামাকাপড় মূহুর্তেই নষ্ট গেলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম,
‘ এটা কি হলো! এই জামাটা তো ভাবির, একদম নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাসায় গেলে আমাকে অনেক বকবে!

তার সাথে সাথেই তামজিদ একটা হুংকার দিয়ে ওয়েটারের কলার চেপে ধরলো। মূহুর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন তিনি। বেসুরে বলতে লাগলেন,
‘ চোখ কোথায় থাকে হ্যাঁ?

আমি ভয়ে পুরো চুপসে গেলাম। আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। কথাটা আমি মনের ভয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। কারণ আসলেই ভাবি আমাকে বকবে, অবশ্য ভাবি নিজেই পরতে দিয়েছিলো আর বলেছিলো সাবধানে রাখতে। যেহেতু এই পাত্র উনার প্রিয়, সেহেতু আমাকে পছন্দ করতে হবে বিষয়টাও উনার মাথায় আছে।
এদিকে ওয়েটার বিনয়ের সাথে থমথমে গলায় বললো,
‘ সরি স্যার, ক্ষমা করুন আমাকে।

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ভয়ে আমার দাঁতে দাঁত ধাক্কা লাগছে। এইটুকু ব্যাপারে আমি কাউকেই কোনোদিন এমন আচরণ করতে দেখিনি। এখানকার ম্যানেজার দৌঁড়ে এসে তামজিদকে ছাড়ালো আর হাত জোর করে বললো,
‘ আপনি প্লিজ শান্ত হউন, প্রয়োজনে আপনাকে বিল পরিশোধ করতে হবে না।

এবার উনি আরো রেগে গেলো। ব্যাগ থেকে হাজার টাকার ৫ টা নোট টেবিলে রেখে বললেন,
‘ আমাকে কি ফকিন্নি মনে হয়? বিলের জন্য আমি চিৎকার করছি? সে আমার হবু স্ত্রীর কাপড়টা এভাবে নষ্ট করলো কেন? এতো অদক্ষ হয়ে এতো বড় রেস্টুরেন্টে কীভাবে চাকরি করে? আমাদের অর্ডারকৃত খাবার আপনারাই খেয়ে নিবেন, বিল কতো জানিনা বেশিটা বকশিস নয় সদকা দিলাম।

বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বড়সড় একটা ঢোক নিয়ে রুক্ষ কণ্ঠস্বর বদলে কোমলতার শীর্ষ প্রান্তে পৌঁছে বললেন,
‘ চলো তূর্ণা।

আমি হকচকিয়ে তাকালাম৷ এটা কি কোনো সাইকো? কি না কি করছে। কতো খারাপ তার ব্যবহার,ছি! আবার আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলছে।
এদিকে আমাকে তখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু কদম এগিয়েও আবার পিছিয়ে এসে আচমকা আমার হাত ধরে টেনে বললেন,
‘ আসো তুমি তাড়াতাড়ি!

তারপর দ্রুত আমাকে নিয়ে এখান থেকে বের হলেন। আসার সময় আমি পেছনে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখছিলাম আশেপাশের সবাই তামজিদের এমন আচরণকে নিয়ে কানাঘুষা করছে। কিন্তু সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারেনি।

তারপর সামনের কালো রঙের যে গাড়ীটাকে রেস্টুরেন্টের ভেতরে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তামজিদ আমাকে নিয়ে সেটাতে উঠালো। আমি বুঝতে পারলাম উনি এখানে গাড়ী নিয়েই এসেছিলেন।
কিছুদূর গিয়ে উনি গাড়ী থামালেন বড় একটা শপিংমলের সামনে৷
আমাকে নামতে বলে ভেতরে যেতে থাকলেন৷ আমিও জুসে আধভেজা পোশাকটাকে কোনো রকম ওড়নার ভালো অংশ দিয়ে লুকিয়ে ভেতরে গেলাম। গিয়ে প্রথমেই তিনি একটা ড্রেস হাতে নিয়ে আমাকে বললেন,
‘ ভেতরে গিয়ে পরিবর্তন করে আসো, তারপর সব দেখছি।

আমি কোনো কথা বলার উপায় দেখছিলাম না, কেননা এই পোশাক পরে থাকা আমার কাছে অসম্ভব লাগছে, সাদামাটা রঙে জুসের দাগটা ভীষণ বিশ্রী দেখাচ্ছে। তাই আমিও কথামতো পোশাক বদলে আসলাম। ড্রেসটা অনেক দামী, আমার জীবনে প্রথমবার হয়তো এতো সুন্দর জামা পরিধান করেছি। আমাকে দেখেই তামজিদ বলে উঠলো,
‘ আরেহ তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছেনা, মাশাল্লাহ! চলো এখন আরো ড্রেস দেখি।

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘ না আমার আসলে কিছু লাগবেনা। এটারও তো কোনো দরকার ছিলোনা, কিন্তু..

তামজিদ মূহুর্তে তার ভ্রু কুঁচকে ফেললো, এটা দেখতেই আমি ভয়ে পেয়ে থেমে গেলাম। উনি ১০ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম ধমক দিয়ে কথা বলার গতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যা ভাবলাম তাই হলো, তিনি নরম স্বরে বললেন,
‘ তূর্ণা তুমি আমার বউ হচ্ছো, তামজিদ দস্তগীরের বউ! তার বউকে সে সবসময় রাণীর মতো কল্পনা করে।

আমি কিছু বলতে চেয়েও বললাম না। উনি একে একে ড্রেস বের করেন আর সামনে ধরে বলেন,
‘ এটার রঙ ভালো, এটার ডিজাইন ভালো, এটাতে তোমাকে মায়াবী লাগবে, এটাতে তোমাকে বউ বউ লাগবে, এটাতে তো পুরো এঞ্জেল লাগবে! এভাবে বলতে বলতে তার পছন্দেই অনেকগুলো পোশাক নিয়ে নিলেন।

আর ভাবির পোশাক নষ্ট হয়েছে বলে ভাবির জন্য দুইটা জামা কিনে সেগুলো আলাদা করে দিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে সব ড্রেসের সাথে জুতা ব্যাগ প্রয়োজনীয় সব ধরনের কসমেটিকস নিলেন, যেগুলো আমি কখনোই পরিনা। কিন্তু উনি একবারও আমাকে কোনো জিনিসের জন্য জিজ্ঞাসা করলেন না। আমার পছন্দ হয়েছে কিনা সেটাও জানতে চাইলেন না।

সব নিয়ে গাড়ীতে রাখলেন। তারপর আমাকে নিয়ে অন্য একটা রেস্তোরাঁয় বসে খাবার আনালেন। আমি সবকিছু বোবার মতো শুধু দেখছিলাম। সত্যি বলতে আমার ভয় লাগছে। যদিও উনি আমার সাথে চোখ লাল করে কিংবা উচ্চস্বরে কিছু বলেননি, কিন্তু যা দেখেছি এবং শুনেছি তাতেই আমি ভেজা বিড়াল! তবে তা বুঝতে পারছিলাম বিয়ে ফেরানোর রাস্তা যেহেতু নেই, ছটফট না করে চুপ থাকাটাই উত্তম হবে।

তামজিদ আমার সামনে বসে খেলো, আমি কিছুক্ষণ চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও খেতে পারলাম না। শুধু এক বোতল পানি খেয়েছি। এতেও তার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমাকে খেতে তেমন জোরও করেনি। তারপর আমাকে নিয়ে আমাদের বাসার সামনে নামিয়ে দারোয়ানকে ডেকে হাতের মুঠোয় কিছু টাকা ধরিয়ে বললো,
‘ গাড়ীর ব্যাগগুলো ভেতরে দিয়ে আসুন।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
‘ খুব শীগ্রই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি, সে পর্যন্ত ভালো থেকো।

বলেই গাড়ী স্টার্ট দিলো, আর চোখের পলকে সেখান থেকে চলে গেলো। এখনো আমি নির্বাকই হয়ে আছি। কি বলবো, কি করবো বুঝেই উঠতে পারছিনা। দিনটা যদি স্বপ্ন হয়ে যেতো তাহলে হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালো হতো।

দারোয়ান ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে, আমিও কিছুক্ষণ থেকে আস্তে আস্তে গেলাম। গিয়ে দেখলাম দারোয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ভাবি এখনো দরজা খুলেনি। আমি গিয়ে আবার বেল বাজালাম। মিনিট পাঁচেক পরে দরজা খুলে দেখলো আমি দারোয়ান আর সাথে অনেকগুলো ব্যাগ,যার সবই শপিং!
ভাবি চোখ বড় বড় করে বললো,
‘ এগুলো তামজিদ কিনে দিয়েছে? আর তুমি না আমার পোশাক পরে গিয়েছিলে, ড্রেস বদলালে কেন? কি করেছিলে গিয়ে?

রাগে ভেতরটা ফেটে গেলেও আস্তে করে জবাব দিলাম,
‘ জুস পরে নষ্ট হয়ে গেছে, তাই উনি এগুলো আমার জন্য কিনে দিয়েছেন। আপনাকেও দিয়েছে, একটার বদলে দুইটা।

ভাবি আর কিছু না বলেই সবগুলো ব্যাগকে নিজের হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আমি কিছুই বললাম না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দেখলাম আসরের ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। ওজু করতে গেলাম। বের হয়ে ভাবির দরজার সামনে দিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম ভাবি বলছে,
‘ সবগুলো পোশাক এতো সুন্দর, আমার একটাও তূর্ণাকে দিতে ইচ্ছে করছেনা। আর তামজিদের বাবার অনেক টাকাপয়সা থাকলেও সে এখনো ভালো কিছু করে বলে তো জানতাম না। যদি তূর্ণার এখানে বিয়ে হয় তাহলে আমরাই দেখছি ওর কাছে কোনো দাম পাবোনা, শুনো না ওকে নাহয় আরেক বছর পরিক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ দেই? তুমি বলেছিলে না সে ভালো করবে?

আমার ভাই জবাব দিলো,
‘ পায়ে পড়ি আপনার, যা ইচ্ছে করেন। আল্লাহর ওয়াস্তে আমার মাথাটা আর খাবেন না।

আমি ওড়না দিয়ে মুখের ওজু ভেজা পানি মুছতে মুছতে রুমে চলে গেলাম। একটা মানুষ কতটা অসহ্যকর হতে পারে তাই কেবল ভাবছি। তবে এই কথাগুলো শুনে খুশিই হলাম, বিয়েটা না হোক তাই তো আমি চাই। যদি সত্যি তাই হয় আমার চেয়ে খুশি কে হবে?

চলবে……

লেখাঃ তাজরীন খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here